২.০২ ইরোকোয়া গণ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ইরোকোয়া গণ

ক্রমশ তার অভিজ্ঞতার জোরে মানবজাতি দু ধরনের সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে, অবশ্য পরিকল্পনা শব্দটাকে তার বিজ্ঞানসম্মত অর্থে নিতে হবে। দুটোই সমাজের সুনির্দিষ্ট সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে। প্রথমটি এবং আদিম সংগঠনটি ছিল গণ, গোষ্ঠী ও ভ্রাতৃত্ব ভিত্তিতে। দ্বিতীয় সংগঠন হল রাজনৈতিক সংগঠন, যার ভিত্তি অঞ্চল ও সম্পত্তি। প্রথমটা ছিল গণ সংগঠন–যার মাঝে সরকার, গোষ্ঠী ও গুণ সম্পর্কের মাঝ দিয়ে ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করত। এখানে সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবেই ছিল ব্যক্তিগত। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিতে একটা রাজনৈতিক সমাজের দেখা পাই, যেখানে ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক ঘটে অঞ্চলের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, যেমন–শহর, জেলা ও রাষ্ট্র। এইসব সম্পর্ক সম্পূর্ণই অঞ্চলভিত্তিক। দুটি ব্যাপার মূলতই পৃথক সত্তার। প্রথমটি হল আদিম সমাজের সরকার, দ্বিতীয়টি আধুনিক সমাজের সরকার।

গণ সংগঠন সর্বপ্রাচীন ও প্রাচীনকালের প্রায় সর্বত্র প্রচলিত প্রতিষ্ঠান। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সব জায়গাতেই এই ধরনের সরকার ছিল সর্বজনীন। আদিম পর্যায়ে তার সূচনা, বর্বর যুগের তিনটি পর্যায় জুড়ে তার অবস্থান এবং শেষ হয় রাজনৈতিক সমাজ স্থাপনের মধ্যে। মানবজাতি সভ্যতায় প্রবেশ করার পর রাজনৈতিক সমাজ সৃষ্টি হয়। গ্রিক গণ, গোষ্ঠী ও ভ্রাতৃত্ব, রোমান গণ, কুরিয়া এবং গোষ্ঠীর সমান্তরাল সংগঠন। গণ, ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠীর দেখা পাই আমেরিকান অধিবাসীদের মধ্যেও। ঠিক এমনি আমরা দেখি আইরিশ সেপ্ট, স্কট ক্ল্যান, আলবেনিয়ানদের ফারারা এবং সংস্কৃত-এ গণস, সবই আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের সমতুল্য। যাকে অবশ্য সাধারণত ক্ল্যান বলে অভিহিত করা হয়। আমাদের জ্ঞানের আওতায় যা পড়েছে তা থেকে এই সিদ্ধান্তই টানা যায় যে আদিমকালে সমস্ত মহাদেশে এই সংগঠন চলে এসেছে। ঐতিহাসিক যুগে সভ্যতায় প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত তা চলে। শুধু তাই নয়–যেখানেই গণ সংগঠন দেখা গেছে, তার কাঠামো সর্বত্র এক এবং তাদের কর্ম পদ্ধতির সূত্রও এক। মানুষের অগ্রগতির সাথে সাথে এই সংগঠনের অগ্রগতি ঘটেছে। এইসব পরিবর্তন মৌলিক ধ্যান-ধারণাসমূহের উন্নয়নের ইতিহাসকেই ব্যক্ত করে।

ল্যাটিন, গ্রিক ও সংস্কৃত-এ যথাক্রমে জেন্স, জেনোস ও গণস-এর মূল অর্থ জ্ঞাতি। পূর্বোক্ত ভাষাসমূহে ঠিক এমনি দেখা যায় জিগননা, জিগননামাই ও গণমাই, যার অর্থ আদিপিতা। এতেই বোঝা যাচ্ছে এরা মূল এক গণ থেকে সৃষ্ট। গণ অর্থ, এক জ্ঞাতি জনসমষ্টি। এভাবে গণের অর্থ দাঁড়াচ্ছে এক পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্ট জ্ঞাতি জনসমষ্টি, যারা এক ‘গণ’ নাম দ্বারা বিশিষ্টতা অর্জন করে এবং পরস্পর রক্ত সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। একই পূর্বপুরুষ-উদ্ভূত অন্য অর্ধাংশকেও অন্তর্ভুক্ত করে। স্ত্রী ধারায় উত্তরাধিকার নির্ণয় করা। হয়, যা প্রাচীনকালে আদিম সমাজে ছিল সর্বজনীন। আদিকালে গণ সংগঠন গঠিত হয় কোনো মহিলা পূর্বপুরুষকে কল্পনা করে। তার ছেলেমেয়ে নিয়ে, বিশেষ করে মেয়েদের ধরে এই সংগঠন গঠিত হয়। আর যেখানে পুরুষ-ধারা ধরে চলে বুঝতে হবে এটা পূর্বের সংগঠনের পরিবর্তনের ফল এবং সমাজে কিছু সম্পত্তি জমেছে। এক্ষেত্রে একজন পুরুষ পূর্বপুরুষ কল্পনা করা হয় এবং তার ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে ছেলেদের দিয়ে এই সংগঠন চলতে থাকে। আমাদের মধ্যে যে পারিবারিক নাম দেখা যায় তা সেই গণ সংগঠনের সূত্র অনুযায়ী চলছে, অবশ্য পুরুষ-ধারা ধরে। আধুনিক পরিবার তার নামে যতটুকু প্রকাশ পায় তা অসংগঠিত গণের প্রতিফলন। বর্তমানে পারিবারিক নাম যেভাবে পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে জ্ঞাতি সম্পর্ক সব ভেঙে যাচ্ছে এবং এর সদস্যরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

যে সমস্ত জাতির নাম করা হয়েছে, তাদের গণ সংগঠন সামাজিক সংগঠন হিসেবে স্মরণীয় ব্যাপার। তা এত আদিমকাল থেকে চলে আসছে যে এর উৎস কালের সুদূর দূরত্বে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এই পদ্ধতি শুধু সামাজিক নয়–প্রাথমিক সরকারি সংগঠন হিসেবেও কাজ করেছে। এই সংগঠন শুধু ল্যাটিন, গ্রিক ও সংস্কৃত ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, আর্য পরিবারের অন্যান্য শাখা যেমন, সেমিটিক, উরালীয়, তুরালীয়, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীসমূহ এবং আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যেও দেখা গেছে।

গণ সংগঠনের প্রাথমিক সংবিধান প্রকাশ করার সাথে এর কাজ ও ক্ষমতা সম্বন্ধে আমাদের প্রথম নজর দেওয়া উচিত। পরে বিভিন্ন মানবজাতির মাঝে তুলনামূলক আলোচনা করে প্রমাণ করতে সক্ষম হব এর মূল ঐক্য। এভাবে মানবসমাজের অন্যতম প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে পূর্ণভাবে তুলে ধরা যাবে।

মানবজাতির প্রগতির সাথে সাথে গণও বিভিন্ন পর্যায়ে এগিয়ে গেছে। এই পরিবর্তনের দুটো মূল ধারা লক্ষ করা যায়, প্রথমত, স্ত্রী-ধারায় যে উত্তরাধিকারের ব্যবস্থা ছিল তার পরিবর্তন, দ্বিতীয়ত, আগে গণের কোনো সদস্যের মৃত্যুর পর সম্পত্তি গণের অধিকারেই আসত, কিন্তু তার বদলে সম্পত্তি একেবারে ছেলেমেয়েদের হাতে আসে। এই পরিবর্তন থেকে আমরা একটা বিরাট ব্যাপার লক্ষ করি, বোঝা যাচ্ছে অবস্থার প্রচুর পরিবর্তন ঘটেছে, প্রগতিমূলক উন্নয়নের মাত্রাও বেড়েছে প্রচুর পরিমাণে।

গ্রিক ও রোমানদের মধ্যে গণ সমাজের পেছনেই এসে দাঁড়ায় রাজনৈতিক সমাজ, কিন্তু তারা সভ্যতায় প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত তা ঘটে নি। নগর সৃষ্টির সাথে, নির্দিষ্ট সম্পত্তি স্থির হবার পর, এখানের অধিবাসীরা যখন রাজনৈতিক সংগঠনের আওতায় আসে তখন নূতন এক পদ্ধতিতে প্রবেশ করে। যে সরকার আগের সরকার থেকে পুরোপুরি আলাদা। রাজনৈতিক সমাজ স্থাপিত হয়ে যাবার পর ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠী সব কিছুই ক্রমশ এর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই খণ্ডেই আমি দেখাব কেমন করে এই সংগঠন আদিম অবস্থায় সৃষ্টি হয়ে সভ্যতার মাঝে উৎক্ষিপ্ত হয়ে যায়। কারণ, দেখা গেছে গণ সংগঠন বর্বর যুগে আদিম গোষ্ঠীদের কুক্ষীগত করে এবং বর্বরদেরই কোনো কোনো উন্নত অংশ বর্বরতাকে জয় করে সভ্যতার জন্ম দিয়েছে।

এখনো কিছু বর্তমান আদিগোষ্ঠী ও জাতির মধ্যে এই সংগঠনকে বেশ সফলতার সাথে আমরা পাঠ করতে পারি। এই অনুসন্ধান চালিয়ে আমরা একেবারে এর আদিম অবস্থাও পাই। আবার এই বিভিন্ন উন্নত অংশে এর উন্নত আকারও দেখতে পাই। আমরা এই পরিবর্তনের কারণ দেখার চেষ্টা করব। এ জন্যেই আমি আমেরিকান আদিবাসীদের নিয়ে আলোচনা করব, যারা আছে এই সংগঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে। যাদের মধ্যে এই সংগঠনের ন্যায়সঙ্গত পাঠ সহজ। গ্রিক ও রোমান ঐতিহাসিক গণসমূহের চেয়ে ঐ প্রাথমিক পর্যায়ের গণকে পাঠ করাই ফলপ্রসূ। মোট কথা প্রবর্তী যুগের গণ সম্বন্ধে জানতে গেলে এইসব আমেরিকান ইণ্ডিয়ান গণের কর্মপদ্ধতি, ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা ভোগ এবং যেসব বাধা নিষেধ আছে তা পাঠ করলে অন্যদের সম্বন্ধে অনুমান করা সহজ হবে।

আমেরিকান জাতিতত্ত্ব পাঠে গোষ্ঠী ও ক্ল্যান বহু জায়গাতেই গণের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমার আগের কিছু কাজে সেভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে।[১] আমেরিকান ক্ল্যানের সাথে গ্রিক বা রোমান গণের তুলনা করলে তাদের কাঠামো ও কর্মের অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখতে পাই। আমেরিকান পদ্ধতিতে ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠীও ছিল। এইভাবে বিভিন্ন সংগঠনের নমুনা দেখিয়ে নিঃসন্দেহে দেখানো যায় যে আমরা গ্রিক ও ল্যাটিন নাম গ্রহণ করলেই পারি, কারণ এদের অর্থ যথেষ্ট সুসংবদ্ধ। আগামীতে আমরা দেখাব কেমন সমান্তরালভাবে এইসব সংগঠন দু জায়গাতেই দেখা যায়।

আমেরিকান আদিবাসীদের সরকার সৃষ্টি হয় গণ সংগঠনে এবং শেষ হয় মিত্রসঞ্জের মধ্যে। মিত্রসংঘই তাদের সর্বোচ্চ ধরনের সরকার। এই মিত্রসঙে যাবার পথে প্রথমে পড়ে গণ : সগোত্র ও জ্ঞাতি-জন এবং তাদের এক গণ নাম, দ্বিতীয়ত ভ্রাতৃত্ব, কয়েকটা আত্মীয় সম্পর্কিত গণের সমষ্টি, তারা কোনো যৌথ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে একত্রিত হয়। তৃতীয়ত গোষ্ঠী, যা কয়েকটি ভ্রাতৃত্বের সংগঠন। যারা একই ভাষায় কথা বলে। চতুর্থত গোষ্ঠীদের মিত্রসংঘ, যার সদস্যরা একই বৃহৎ ভাষার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। এই সমাজ সৃষ্টি হয়েছে গণসংগঠনেরই বৃহত্তর রূপ হিসেবে (Societas), রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে যা আলাদা (civitas)। আমেরিকান আদিবাসীরা যখন আবিষ্কৃত হয় তাদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক-সমাজ বা নাগরিকতা বা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বা সভ্যতা কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না।

ঠিক একইভাবে আমরা গ্রিক সরকারের দিকে লক্ষ করলে দেখব সভ্যতা-পূর্ব সরকার একের পর এক ওপরে উঠেছে। প্রথম, গণজ্ঞাতির সমষ্টি, যাদের সাধারণ একটা গণ নাম আছে। দ্বিতীয়, ভ্রাতৃত্ব-সামাজিক এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যে গণের সমাবেশ। তৃতীয়, গোষ্ঠী, ভ্রাতৃত্বের সমাবেশ। সবশেষে বিশেষ এক এলাকা জুড়ে গোষ্ঠীদের একত্রিত হয়ে জাতি সংগঠন। যেমন, এটিকায় চারটি এথেনীয় গোষ্ঠীর সমাবেশ এবং স্পার্টায় তিনটি ডোরিয়ান গোষ্ঠীর সমাবেশ ঘটে। এখানে যে একাঙ্গীভবন ঘটে তা মিসঙের চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের। মিত্রসঙ্রে ক্ষেত্রে গোষ্ঠীরা নিজ নিজ স্বাধীন এলাকা নিয়ে থাকে।

রোমান সরকারের পরিকল্পনাও সেই একইভাবে এগিয়েছে : প্রথমে, জ্ঞাতি জনসমষ্টি ‘গণ’। দ্বিতীয়, গণের সমাবেশ, যাকে রোমানরা কিউরিয়া বলত। তৃতীয়, কিউরিয়ার সমাবেশে গোষ্ঠী গঠন, যেখানে গণসমাজের একাঙ্গীভবন ঘটে গেছে। সবশেষে জাতি, যেখানে গোষ্ঠীরা একাঙ্গীভূত হয়েছে। প্রথম দিকের রোমানরা সমস্ত সম্পদ নিয়ে নিজেদের বলত, পোপুলাস রোমানাস।

রাজনৈতিক সমাজ স্থাপনের পূর্বে যেখানেই গণ পদ্ধতিমূলক সরকার ছিল তারা ছিল ঐ একই ধরনে, এর অন্য কোনো ধরন আমাদের চোখে পড়ে নি। তাদের সরকারের প্রকৃতি ছিল গণতান্ত্রিক। গণ, ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠী সবই গণতান্ত্রিক নীতির ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। এদের গণতান্ত্রিক নীতির বিরুদ্ধে অনেকে বলে, কিন্তু গণতন্ত্র এই কথাটা। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই কথার সত্যতার প্রমাণ পাব যখন আমেরিকান আদিবাসী, গ্রিক ও রোমের গণ, ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠী-সংগঠন সম্বন্ধে আলোচনা করব। যেহেতু গণ সগঠন ছিল গণতান্ত্রিক, আর ভ্রাতৃত্ব সেই গণের সমাবেশ এবং গোষ্ঠী ভ্রাতৃত্বের সমাবেশ এবং মিত্রসংঘ গোষ্ঠীর সমাবেশ, যেখানে গণসমাজের একাঙ্গীভবন ঘটেছে, তাই গণতান্ত্রিক হতে বাধ্য।

‘গণ’ যদিও সর্বপ্রাচীন সামাজিক সংগঠন, আর জ্ঞাতিভিত্তিক, কিন্তু সাধারণ পূর্বপুরুষের সমস্ত অধস্তন পুরুষকে অন্তর্ভুক্ত করে না। কারণ হল গণ যখন সৃষ্টি হয় তখন এক জোড়া স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে বিয়ে ছিল অজ্ঞাত এবং পুরুষ লাইন ধরে উত্তরাধিকার নির্ণয়ের নির্দিষ্ট ধারাও ছিল না। ছেলেমেয়েরা মাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। প্রাচীন গণে উত্তরাধিকার মহিলা-ধারায় নির্দিষ্ট হত। যে সমস্ত লোকেরা মনে করত তারা এক মহিলা-পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে গণ শুধু তাদেরই গ্রহণ করত, এর সাক্ষী হল সবার এক গণ নাম। এই ব্যবস্থায় এই মহিলা পূর্বপুরুষ তার ছেলেমেয়ে, তার মেয়ের ছেলেমেয়ে এবং তার সব মহিলা উত্তরপুরুষদের ছেলেমেয়ে তাদের দলে পড়ে এবং এমনি ধারা চলত। এদিকে তার ছেলেরা এবং সমস্ত পুরুষ উত্তরপুরুষদের ছেলেমেয়ে, পুরুষ ধারা অনুযায়ী অন্য গণের লোক হবে। কিন্তু নাম বলবে মায়ের। এটা গণের অতি প্রাচীন রূপ, যখন গণের মধ্যে ছেলেমেয়ের পিতৃত্ব নির্দিষ্ট করা যেত না, যখন কেবল মায়ের ধারা ধরেই গণ নির্দিষ্ট করা যেত।

এই স্তরের উত্তরপুরুষ নির্ণয় ব্যবস্থা অস্ট্রেলীয়দের মধ্য বর্বর পর্যায়েও দেখা গেছে। আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে নিম্ন বর্বর পর্যায়ে ও উচ্চ আদিম পর্যায়েও তা দেখা গেছে। দু-এক জায়গায় অবশ্য ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। মধ্য বর্বর পর্যায়ে ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীরা স্ত্রী ধারা ছেড়ে পুরুষ ধারায় পরিবর্তিত হতে থাকে–যেমন এই সময় জোড়-বিয়ে পদ্ধতি এক স্ত্রী পুরুষের বিয়ের বীজ বোনে। উচ্চ বর্বর পর্যায়ে গ্রিক গোষ্ঠীসমূহ পুরুষ ধারায় পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অবশ্য লাইসীয় গোষ্ঠী এবং ইটালির এটুস্কান গোষ্ঠী বাদে। সম্পত্তির প্রভাব এবং পুরুষ ধারার উত্তরাধিকার নির্ণয়ের স্বীকৃতি সম্বন্ধে আমি আগামীতে আলোচনা করব।

পুরুষ ধারায় জ্ঞাতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ধরা হত যে সমস্ত লোকজন এক পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায় এক যৌথ গণ নামে। এতে আছে সেই পূর্বপুরুষ, তার ছেলেমেয়ে তার ছেলের ছেলেমেয়ে এবং সমস্ত উত্তরপুরুষের ছেলেমেয়ে, এইভাবে পুরুষ ধারা স্থায়ী হয়। এদিকে তার মেয়ের ছেলেমেয়েরা অন্য গণের উত্তরপুরুষ হবে, কারণ তারা তাদের বাপের গণের লোক বলে গণ্য হবে। এক জায়গায় যাদের গ্রহণ করা হচ্ছে অন্যত্র তাদের খারিজ করা হয়। এইভাবে গণ তার পূর্ণরূপ লাভ করে এবং একবিয়ে প্রথার মাধ্যমে। পরিচয় নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়। এভাবে এক প্রকারের গণ থেকে অন্য প্রকারের গণে পরিবর্তন খুব সহজভাবেই দেখা দেয়, যদিও গণ সংগঠনকে বাদ দিতে হচ্ছে না। এখানে শুধু একটা জিনিসই বিশেষভাবে দরকার যথেষ্ট উদ্দেশ্যমূলক মনোভাব। সেই একই গণ উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মহিলা ধারা থেকে পুরুষ ধারা গ্রহণ করেও সামাজিক পদ্ধতির একক হিসেবে কাজ করছে। তা প্রথম অবস্থায় না থাকলে দ্বিতীয় অবস্থায়ও আসতে পারত না।

যেহেতু গণের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল, তাই জ্ঞাতি-বিয়ের দুষ্কর্ম থেকে মুক্তি দিয়ে দলের মধ্যে শক্তি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করে। গণ সংগঠন তিনটি প্রধান সূত্রের ওপর নির্ভর করে সৃষ্টি হয় : জ্ঞাতি সম্পর্ক, মহিলা ধারায় উত্তরাধিকার নির্ণয় এবং গণের মধ্যে বিয়ে না হওয়া। যখনই গণের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে দেখা যাচ্ছে এক জোড়া-গণ সৃষ্টি করছে, কারণ পুরুষদের ছেলেমেয়েদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। এই কারণে দুই শ্রেণীরই প্রয়োজন দেখা যাচ্ছে। দুই গণ একই সাথে চালু হওয়ায় সব সমস্যার সমাধান ঘটে, যাতে এক গণের পুরুষরা অপর গণের মেয়েদের এবং অপর গণের পুরুষরা এ গণের মেয়েদের বিয়ে করতে পারে। আর তাদের ছেলেমেয়েরাও মায়ের সূত্রে দুই গণে ভাগাভাগি হয়ে যায়। জ্ঞাতিসূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় প্রতিটি লোককে গণ সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দান করে যা অন্য কোনো সংস্থা দিতে পারত না।

গণের প্রতিটি লোকের সুবিধা এবং দায়-দায়িত্ব ও বাধা-নিষেধ সম্বন্ধে নীতিমালা তৈরির পর গণ, ভ্রাতৃত্ব, গোষ্ঠী ও মিত্রসংঘ তৈরি হচ্ছে। একটা বাস্তব উদাহরণ হিসেবে ইরোকোয়া গণকে নেওয়া হবে। তারা গণ থেকে শুরু করে মিত্রসংঘ পর্যন্ত গঠন করে, কিন্তু তার অভ্যন্তরে গণপদ্ধতি আদিম অবস্থা নিয়েই বিরাজ করে। ইরোকোয়ারা যখন আবিষ্কৃত হয় তারা ছিল নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগে। তারা শিল্পকলায় বেশ উন্নত ছিল। তারা জাল বুনতে পারত, টুন সুতো এবং গাছের আঁশ দিয়ে দড়ি পাকাতে পারত। কোমরের বন্ধনী এবং তার বহনের ফিতে তৈরি করেছিল। মাটির কলসি এবং হুঁকো তৈরি করত। পুড়িয়ে মাটি শক্ত করার পদ্ধতিও তাদের অজানা ছিল না। মৃৎপাত্রে আবার কিছু কিছু নকশা কাটা হত। তারা ভুট্টা, জনার, শিম এবং তামাকের চাষ করত, ভুট্টা গুঁড়িয়ে মাটির হাঁড়িতে সিদ্ধ করে নিত।[২] চামড়া পাকা করতে পারত এবং জুতো ও নিম্নাঙ্গের পোশাকও করত। যুদ্ধে তারা তীর ধনুককেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। চকমকি পাথর ও পাথরের অস্ত্রের ব্যবহারও করত। চামড়ার পোশাক পরত ও মাছ ধরায় ছিল দক্ষ। তারা বিরাট বিরাট চালা আকারে ঘর করত, যার মধ্যে পাঁচ-দশ পরিবার একসাথে বসবাস করত এবং এ রকম প্রতিটি বাড়িতেই ছিল সামাবাদী জীবন ব্যবস্থা। গৃহ নির্মাণে তারা পাথর বা কাঁচা ইটের ব্যবহার জানত না। তারা বিভিন্ন ধাতু সম্বন্ধেও ছিল অজ্ঞ। উন্নয়ন ক্ষেত্রে তারা ছিল নিউ মেক্সিকোর উত্তরের ইণ্ডিয়ানদের প্রতিভূ। জেনারে এম, এ, ওয়াকার তাদের সামরিক ক্ষেত্রের বর্ণনায় বলেছেন : ইরোকোয়াদের চরিত্র ছিল ভয়ঙ্কর। মহাদেশের অন্যান্য আদিবাসীদের উপর তারা ছিল যেন ভগবানের অভিশাপ।

সময়ে ইরোকোয়াদের গণের সংখ্যা কিছু রদবদল ঘটে এবং তাদের নামেরও সামান্য পরিবর্তন ঘটে। তাদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গণ হল আট। তাদের গণের তালিকা নিম্নরূপ :

সেনেকা–১। নেকড়ে ২। ভালুক ৩। কচ্ছপ ৪। বিভার ৫। হরিণ ৬। কাদাখোঁচা ৭। সারস ৮। শ্যেন।

ক্যায়ুগা– ১। নেকড়ে ২। ভালুক ৩। কচ্ছপ ৪। বিভার ৫। হরিণ ৬। কাদাখোঁচা ৭। বানমাছ ৮। শ্যেন। ওনোনডাগা–১। নেকড়ে ২। ভালুক ৩। কচ্ছপ ৪। বিভার ৫। হরিণ ৬। কাদাখোঁচা ৭। বানমাছ ৮। শুটি।

ওনাইডা– ১। নেকড়ে ২। হরিণ ৩। কচ্ছপ।

মোহক্‌– ১। নেকড়ে ২। হরিণ ৩। কচ্ছপ।

টুসকারোরা–১। ধূসর নেকড়ে ২। হরিণ ৩। বড় কচ্ছপ।

এই পরিবর্তন দেখে বোঝা যায় কোনো কোনো গোষ্ঠীতে কিছু গণ কালে নষ্ট হয়ে গেছে এবং নূতন কিছু গণ সৃষ্টি হয়েছে।

গণের মধ্যে ব্যক্তি-অধিকার, দায়-দায়িত্ব, সুবিধাভোগ, ইত্যাদি জ্ঞান লাভ করে আমরা এর পরবর্তী অধ্যায় ভ্রাতৃত্ব, গোষ্ঠী ও মিত্রসংঘ সম্বন্ধে ভালোভাবে ধারণা করতে পারব।

গণের প্রতিটি লোককে নিম্নলিখিত কর্তব্য পালন করতে হয় :

১। সাকেম ও প্রধানদের নির্বাচনের অধিকার।

২। সাকেম ও প্রধানদের পদচ্যুত করার অধিকার।

৩। গণের মধ্যে বিয়ে না করা।

৪। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে বণ্টন।

৫। পারস্পরিক সাহায্য ও বিপদে রক্ষা করার দায়িত্ব। ক্ষত সারানোর ব্যবস্থা করা।

৬। ব্যক্তির নাম দেবার ক্ষমতা গণের।

৭। গণে কোনো অপরিচিতকে গ্রহণ করার অধিকার।

৮। সর্বজনীন ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান করা।

৯। এক যৌথ সমাধিস্থান নির্দিষ্ট করা।

১০। গণ পরিষদ গঠন।

এই সমস্ত দায়িত্ব যেমন সংগঠনকে শক্তিশালী করে তেমনি ব্যক্তিকেও নিরাপত্তা দান করে এবং এর ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষিত হয়।

। সাকেম ও প্রধানদের নির্বাচনের অধিকার

প্রায় সমস্ত আমেরিকান ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীরই দু ধরনের প্রধান আছে, যাদের বলা যায় সাকেম ও সাধারণ প্রধানসমূহ। এই দুটিই প্রাথমিক সংগঠন, বাকিগুলো এরই শাখা প্রশাখা। গণের সদস্যদের মধ্য থেকে এদের নির্বাচন হয়। যেখানে মাতৃধারা পালিত হয় সেখানে বাপের জায়গায় তার ছেলেকে নির্বাচিত করা যাবে না। কারণ এই ছেলে অন্য গণের লোক। গণের বাইরের লোককে সাকেম নির্বাচন করা যায় না। গণের মধ্যে সাকেম পদ্ধতি অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্ণ হয়, অর্থাৎ একটা পদ শূন্য হলেই তা পূর্ণ করা হয়। কিন্তু সাধারণ প্রধানদের উত্তরাধিকার সূত্র খাটে না, কারণ এই পদ পেতে হয় ব্যক্তিগত যোগ্যতা দিয়ে। তার মৃত্যুর সাথেই এটা শেষ হয়ে যায়। অধিকন্তু সাকেমের কাজ শান্তি বজায় রাখা। একজন সাকেম হিসেবে সে যুদ্ধে যেতে পারে না। অন্যদিকে ব্যক্তিগত বীরত্ব, প্রজ্ঞা, পরিষদে বাগ্মিতার দরুন যে প্রধান হয় সাধারণত মনে করা হয় সে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি, যদিও গণের ওপর তার কর্তৃত্ব নেই। সাকেমের সম্পর্ক প্রধানত গণের অভ্যন্তরে–সে-ই গণপ্রধান। এদিকে অন্য প্রধানরা হল গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত, গোষ্ঠী-পরিষদে সাধারণ প্রধান ও সাকেম দুজনই সদস্য।

গণের মধ্যে সাকেমের পদের একটা স্বাভাবিক ভিত্তি হল জ্ঞাতিসংগঠনের একজন প্রধানের প্রয়োজন হিসেবে। পদ হিসেবে এটা গণ সংগঠনেরও পুরোনো। পুনালুয়া দলের মধ্যে এ রকম প্রধানের স্থান ছিল, এমনকি যাযাবর জাতীয় আরো প্রাচীন দলের মধ্যেও এর উপস্থিতি ছিল। গণের মধ্যে সাকেমের কর্তব্য ছিল নির্দিষ্ট এবং তাকে গণপিতার দায়িত্ব পালন করতে হত। গণের পুরুষদের মধ্য থেকে তা নির্বাচিত হত। যখন আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের জ্ঞাতি সম্বন্ধে বিবেচনা করা হয় দেখা যায় কোনো গণের পুরুষরা হয় পরস্পর ভাই (নিজের বা চাচাতো ভাই), পরস্পর চাচা-ভাইপো (নিজের চাচা বা বাপের চাচাতো ভাই) বা দাদা-পৌত্র, ইত্যাদি।[৪] এই সাকেম পদ ভায়ের কাছ থেকে ভায়ের হাতে যায় বা চাচার কাছ থেকে যায় ভাইপোর হাতে। খুব কম সময়েই দাদার কাছ থেকে তা পৌত্রের হাতে বর্তায়। কোনো সাকেম মারা গেলে তার কোনো ভাই বা তার কোনো ভাগনাকে দলের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মেয়েরা নির্বাচিত করে। নিজের ভাই বা নিজের ভাগনাকেই বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হত। সব ধরনের ভাই বা ভাগনের দল কাউকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হত না। যেহেতু সব পুরুষই এই পদের জন্যে সমানভাবে দাবি রাখে তাই নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠে।

উদাহরণত সেনেকা-ইরোকোয়াদের মধ্যে এক গণের সাকেম মারা গেলে গণের[৫] পরিষদ ডাকা হয় যাতে তারা পরবর্তী সাকেম ঠিক করে। এরা দুজনকে ঠিক করে। এই দুজনের একজন নির্বাচিত হবে। এরা একই গণের সদস্য। দুজনকে ঠিক করার জন্যে বাকি সাতটি গণের মতামত দরকার। যদি গণ আপত্তি তোলে তা হলে আরেক জনকে ঠিক করতে হবে। নিজ গণ কর্তৃক নির্বাচিত ও অন্যান্য গণ মেনে নিলে সাকেম নির্বাচন সমাপ্ত হয়। সাকেমকে তাদের মিত্রসঙ্রে পরিষদের সাথে মিলিত হয়ে বিভিন্ন কর্তব্য সম্বন্ধে জ্ঞাত হতে হয়। বিশেষ করে সামরিক দায়-দায়িত্বের ব্যাপার জেনে নিতে হয়। এইভাবে বিভিন্ন গণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার আলোচনা চলে এবং তা রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় অন্য সব প্রধান সম্বন্ধে। সাকেমের নিচের স্তরের প্রধানদের ক্ষেত্রে কোনো সাধারণ পরিষদ ডাকা হয় না। সাকেমের পদ পাওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হয়।

গণের মধ্যে গণতান্ত্রিক নীতির জন্ম। তারা গণপ্রধান নির্বাচন করে। আর এক্ষেত্রে তারা অন্যান্য গণপ্রধানদের ডাকে, যাতে জোর করে কেউ নির্বাচিত হতে না পারে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে এই ব্যবস্থা।

প্রতিটি গণে কত জন করে প্রধান থাকবে তা নির্ভর করছে তার লোকসংখ্যার ওপর। সেনেকা-ইরোকোয়াদের মধ্যে প্রতি পঞ্চাশ জনের জন্যে ছিল এক জন করে প্রধান। নিউ ইয়র্কে তাদের বর্তমান সংখ্যা প্রায় তিন হাজার, আর তাদের সাকেম হল আট জন এবং প্রধান হল ষাট জন। সম্ভবত পূর্বের চেয়ে তাদের আনুপাতিক সংখ্যা এখন বেশি। কারণ একটা গোষ্ঠীতে লোকসংখ্যা বেশি হলে গণও বেশি হয়। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে এই সংখ্যার কমবেশি দেখা যায়, গণের সংখ্যা তিন থেকে শুরু করে কুড়ি পর্যন্ত হয়, যেমন ডেলাওয়ার এবং মুনসে গণের সংখ্যা তিন; ওজিবত্তা এবং গ্রিকদের গণের সংখ্যা কুড়ি। সাধারণত গণের সংখ্যা হয় ছয়, আট এবং দশ।

। সাকেম ও প্রধানদের পদচ্যুত করার অধিকার

নির্বাচনের মতো এই অধিকারও গুরুত্বপূর্ণ এবং গণের লোকেরা এই অধিকার নিজেদের হাতে রেখেছে। যদিও পদটা প্রায় সারা জীবনের জন্যে তবু সদাচরণের ওপর সবকিছু নির্ভর করে। সাকেমকে অভিষিক্ত করার সময় একটা প্রতীক তৈরি করা হয়, মাথায় ‘শিং বসানো হয় আর তাকে পদচ্যুত করা হলে ‘শিং সরিয়ে নেওয়া হয়। অনেক গোষ্ঠীর মধ্যেই দেখা গেছে শিং হল কর্মকর্তাদের প্রতীক। এর ব্যাখ্যায় টাইলর দেখিয়েছেন রোমন্থক প্রাণীদের মধ্যে শিং ওঠার সাথে সাথে তারা কর্তৃত্ব ফলাও করতে থাকে। অসদাচরণের জন্যে সাকেমের প্রতি আস্থা কমলে পদত্যাগের জন্যে সভা বসে। যখন সাকেম বা কোনো প্রধানকে গণের পরিষদ পদচ্যুত করে তখন তার আর কোনো প্রকার ক্ষমতা থাকে না এবং সে একজন সাধারণ লোকে পরিণত হয়। গণের পরিষদের এমন ক্ষমতা যে জনসাধারণের ইচ্ছা বা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তারা একই সাথে সাকেম ও প্রধানদের পদচ্যুত করতে পারে। এই ক্ষমতা বলে গণের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা সাকেম ও প্রধানদের ক্ষমতায় রাখতেও পারে। পরিষদ অবশ্য গণতান্ত্রিক মতকে পরিস্ফুট করার চেষ্টা করে থাকে।

। নিজ গণে বিয়ের বাধা

যদিও প্রতিপাদ্যটা নেতিবাচক, এটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠনের এটা একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল একই উত্তরাধিকার থেকে আসা লোকদের অধিকাংশের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক না রাখা, কারণ তারা রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয়। গণসংগঠন সৃষ্টির সময় ভাই-বোন বিয়ে হত। কিন্তু পরে তা নিষিদ্ধ হয়। কারণ মানুষ সামান্য কয়েকজনের দল নিয়ে পৃথিবী বক্ষে ঘুরে বেড়াত, বিভিন্ন দলের সাথে বিয়ের ফলে তারা উন্নত ধরনের ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেয়েছে। এই ব্যাপারটা গণের মধ্যে যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তাই ইরোকোয়ারা এখনো তাদের নিজ গণের মধ্যে বিয়ে একেবারে নিষিদ্ধ করে রেখেছে।

। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির পারস্পরিক অধিকার

আদিম যুগে ও নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগে সম্পত্তি ছিল খুবই সামান্য। প্রথমোক্ত অবস্থায় সম্পত্তি অনেকটা ছিল ব্যক্তির, পরে তাতে যৌথ অধিকার বর্তায়, যেমন, ঘর-বাড়ি-বাগান, ইত্যাদি। ব্যক্তিগত মূল্যবান জিনিস সব ব্যক্তির মৃতদেহের সাথে কবর দিয়ে দেওয়া হত। যাই হোক সম্পত্তি অধিকারের প্রশ্ন উঠবেই। ক্রমশ যত সম্পত্তি বাড়তে থাকে এর একটা নির্দিষ্ট নিয়ম সৃষ্টি হতে থাকে। আমরা দেখতে পাই বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে এমনকি আদিম যুগেও সম্পত্তি গণের অধিকারে রাখার নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সমস্ত সম্পত্তি গণের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়। গ্রিক এবং ল্যাটিন গণে উচ্চ পর্যায়ের বর্বর যুগেও এই প্রথা চালু ছিল। সভ্যতার আওতায় এসে তা লিখিত পর্যায়ে ওঠে, কিন্তু সোলোনের পর এথেন্সবাসীর মধ্যে এর পরিবর্তন দেখা যায়। একমাত্র যারা উইল করে মারা যায় তাদের সম্পত্তিই গণের সম্পত্তি হবে।

কে সম্পত্তি পাবে এ সম্বন্ধে তিনটে প্রধান নিয়ম দেখা দেয়। প্রথম, সম্পত্তি গণের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হবে। এই নিয়ম ছিল নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগে, এমনকি আদিম যুগেও। দ্বিতীয়, সম্পত্তি মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনদের ছেলেমেয়ের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে, গণের অন্যান্য লোকরা এ থেকে বঞ্চিত হবে। এই নিয়মের বীজ বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়েই দেখা যায় এবং সম্ভবত পুরোপুরি স্থাপিত হয় বর্বর যুগের মধ্য পর্যায়ে। তৃতীয় নিয়ম হল শুধু মৃত ব্যক্তির ছেলেমেয়েরা সম্পত্তি পাচ্ছে। বর্বর যুগের উচ্চ পর্যায়ে এই নিয়ম স্থাপিত হয়।

ইরোকোয়ারা ছিল প্রথম নিয়মের আওতায়। কিন্তু মূলত দেখা যেত একজন মারা গেলে তার নিকট- জ্ঞাতিরা সব দখল করত। কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে তার ভাই-বোন ও মামা দখল করত। এর মধ্যেই ছিল জ্ঞাতি-তাই-বোন যেসম্পত্তি পাবে তার বীজ। কোনো মেয়ের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি পাবে তার ছেলেমেয়ে এবং তার বোনেরা, এক্ষেত্রে তার ভায়েরা বাদ। সব ক্ষেত্রেই অবশ্য সম্পত্তি গণের মধ্যে থাকছে। মৃত পুরুষের ছেলেমেয়েরা। কিছুই পাবে না, কারণ তারা ভিন্ন গণের। ঠিক এই একই কারণে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তি পায় না বা স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি পায় না। এই পারস্পরিক উত্তরাধিকারের অধিকার গণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।

। পারস্পরিক সাহায্য, বিপদে রক্ষা ও ক্ষতের ক্রমা করা

সভ্য সমাজ ধরে নেয় রাষ্ট্র ব্যক্তি এবং সম্পত্তির নিরাপত্তা দেবে। এই ব্যক্তিগত অধিকারের সাথে আরেকটা জিনিস সমান্তরালভাবে চলছে, তা হল আত্মীয়তার বন্ধন। কিন্তু গণ সমাজে ব্যক্তি নির্ভর করত তার গণের ওপর। পরে রাষ্ট্র এই ক্ষমতা গ্রহণ করে। গণে তার লোকদের আত্মীয়-বন্ধন পারস্পরিক সাহায্যের জন্যে একটা বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করত। একজনের ওপর অন্যায় করা মানে সমস্ত গণের ওপর অন্যায় করা। আর একজনের পেছনে দাঁড়ানো মানে সমস্ত গণ শক্তি নিয়ে দাঁড়ানো।

কোনো বিপদ-আপদে গণের সমস্ত লোক একসাথে সে বিপদ কাটাবার চেষ্টা করে। আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের থেকে তিনটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ইয়ুকাটানের মায়াদের সম্বন্ধে হেরেরা বলেছেন, “কারো কোনো ক্ষতি করার জন্যে কাউকে যদি ক্ষতিপূরণ করতে হয় এবং এই ক্ষতিপূরণ করতে গিয়ে একজন যদি একেবারে গরিব হয়ে পড়ে তা হলে তার আত্মীয়রা তাকে সাহায্য করে।”[৬] এখানে আত্মীয় বলতে ধরতে হবে গণকে। এদিকে ফ্লোরিডার ইণ্ডিয়ানরা কী করে : “যখন ভাই বা ছেলে মারা যায় বাড়ির সবাই প্রায় কিছুই না খেয়ে তিন মাস উপোস করে। তখন আত্মীয়স্বজনরা তাদের খাবার পাঠাতে থাকে।”[৭] যখন কোনো লোক তার পূর্বের গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বাস স্থাপন করে তখন সে তার জমির মালিকানা বাইরের কোনো লোককে দিয়ে যেতে পারবে না, বরং তার গণের কোনো আত্মীয়ের হাতে তা ছেড়ে যেতে হবে। হেরেরা নিকারাগুয়া গোষ্ঠী সম্বন্ধে বলেছেন : “কেউ যদি কোনো শহর থেকে অন্যত্র যায় তার সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে না, বরং তার কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাছে দিয়ে যেতে হবে।”[৮] সম্পত্তি গণের সাথে এমনিভাবে জড়িত ছিল যে অন্য কোনো গণের লোকের তাতে ভাগ বসাবার উপায় ছিল না। তাই দেখা যাচ্ছে সম্পত্তি শুধু একজনের অধিকারে থাকে, শেষে তা আবার গণের হাতেই ফিরে যায়। গার্সিলাসো ডি লা ভেগা পেরুভিয়ান এ্যাসে গোষ্ঠী সম্বন্ধে বলেছেন : “কোনো গরিব লোক বিয়ে করলে তার সম্প্রদায় নবদম্পতির জন্য ঘর-বাড়ি তৈরি করে দেবে।”[৯] এখানে সম্প্রদায় যে ‘গণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। হেরেরা এই একই গোষ্ঠী সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন, “এই ভাষার পার্থক্য ঘটে জাতি যখন গোষ্ঠী বা ক্ল্যানে বিভক্ত হয়।”[১০] নবদম্পতিকে জ্ঞাতিরা বাড়ি তৈরি করে দিত।

আদিম যুগের প্রতিশোধস্পৃহা যা প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় এর বীজ লুকিয়ে ছিল গণ। সংগঠনের মধ্যে। এক গণের লোক খুন হলে তার গণ যারা খুন করেছে তাদের আরেকজনকে না মারা পর্যন্ত শান্ত হবে না। গণ সমাজে চোর, খুনি ও আইন অমান্যকারীদের জন্যে বিচারের ব্যবস্থা বেশ পরে দেখা দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাজ গঠিত হবার আগেই তার সৃষ্টি। অন্যদিকে খুনের মতো অপরাধ মানবজাতি সৃষ্টির সাথেই জন্মলাভ করে এবং তার জ্ঞাতি কর্তৃক শাস্তির ব্যবস্থাও ছিল। ইরোকোয়া ও অন্যান্য ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীদের মধ্যে জ্ঞাতির খুনের বদলা নেওয়া সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত ছিল।[১১]

অবশ্য যাদের ক্ষতি হয়েছে এবং যারা ক্ষতি করেছে এই দুই পক্ষের গণই চূড়ান্ত কিছু করার আগে মিটমাটের চেষ্টা করত। দুই গণেরই আলাদা আলাদা পরিষদ গঠন করা হয় এবং যাদের লোক খুন হয়েছে তাদের কাছে অনুশোচনা প্রকাশ করে ও বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করা হয়। যদি সেই ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট বলে মনে হয় গণ তা মেনে নেয়। কিন্তু যদি তাদের লোকের ক্ষতিটা অন্য কোনোভাবে পূরণ হবে না বলে মনে করে তা হলে তারা খুনিকে খুঁজে বের করবে এবং যেখানেই পাক তাকে খুন করে তবে ছাড়বে। এই রকম ঘটলে যাদের গণের লোক মরল তারা কোনো অভিযোগ আনতে পারবে না। জানের বা জান, এটাই হল বিচারের রায়।

ঠিক এই একই রকম ভ্রাতৃত্ববোধ দেখা যায় গণের কোনো লোক জখম বা অসুস্থ হলে।

। নাম নির্ধারণের অধিকার

আদিম এবং বর্বর সমাজে পরিবারের কোনো নাম নেই। একই পরিবারের ব্যক্তিগত নামগুলো তাদের মধ্যে কোনো পারিবারিক সম্পর্ক প্রকাশ করে না। পারিবারিক নাম সভ্যতার[১২] চেয়ে খুব বেশি পুরোনো নয়। আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের ব্যক্তিগত নাম বলতে একই গোষ্ঠীর মাঝে তার নিজস্ব গণকে নির্দেশ করে। প্রতিটি গণের নাম ব্যবহারের অধিকার তার নিজস্ব। একই গোষ্ঠীর মাঝে অন্য কোনো গণ আর এক গণের নাম ব্যবহার করতে পারবে না। গণের নাম প্রকাশ করে গণের অধিকার। এই নামগুলো প্রকাশ করে তারা কোন গণের লোক বা প্রকাশ করে তাদের যৌথ সুনাম।[১৩]

৪৭

কোনো শিশু জন্মলাভ করলে তার মা তার যে নাম রাখে তা ঠিক গণের দেওয়া নাম নয়। পরে তার আবার নাম রাখা হয়, তার মায়ের দেওয়া নাম, গণের নাম এবং বাপের নাম মিলিয়ে। তারপর এই নাম গণের পরিষদের কাছে দেওয়া হবে। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার বড় ছেলের অনুমতি ছাড়া সেই নাম আর ব্যবহার করা যেত না। [১৪]

দু ধারার নাম ব্যবহার করা হত, এক–বাল্যকালে, দুই প্রাপ্তবয়স্ক হলে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হত। ষোল বছর বয়সে প্রথম নামটা গণের সর্দার বা প্রধান তুলে নিয়ে নৃতন নামানুকরণ করত। এর পরের পরিষদের বৈঠকে লৌকিকভাবে নামটা ঘোষণা করা হত এবং ব্যাটা-ছেলে হলে তাকে প্রাপ্তবয়স্কদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হত। এই একই ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীর মধ্যে সামরিক কলাকৌশলে ব্যক্তিগত কোনো বীরত্ব দর্শনের জন্যে তার দ্বিতীয় নাম দেওয়া হত। এ ছাড়া খুব শক্ত অসুখ করলে কুসংস্কারজনিত নাম বদলের ব্যাপারও দেখা যায়। এটা একেবারে বৃদ্ধ বয়সেও করা হয়। যখন কোনো লোক সাকেম বা গণ প্রধান নিযুক্ত হয় অভিষেকের সময় তার আসল নাম তুলে নিয়ে নূতন নামানুকরণ হয়। ব্যক্তির নাম বদলের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। এটা থাকে মহিলা আত্মীয়স্বজন ও গণ প্রধানের হাতে। কিন্তু কোনো প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য যদি তার নাম বদলের ব্যাপারটা পরিষদকে বোঝাতে পারে সেক্ষেত্রে নাম বদলাতে পারে। একটা বিশেষ নামের ওপর কোনো ব্যক্তির অধিকার থাকলে, যেমন, বাপের নাম, বড় ছেলে সেই নাম গণের অন্য কোনো বন্ধুকে দান করতে পারে, কিন্তু সেই লোকটার মৃত্যু হলে নামটা আবার আগের গণে ফিরে যায়।

শনি ও ডেলওয়ার গণে এখন দেখা যাচ্ছে মা তার ছেলেমেয়ের ইচ্ছামতো যে কোনো গণের নাম রাখছে। আর এই নামের ফলে ছেলেটার গণ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা আদিম প্রথা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে এবং বর্তমানে তা অনেকটা পড়ে ব্যতিক্রমের পর্যায়ে। এই পদ্ধতি গণ ধারাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। বর্তমানে ইরোকোয়া এবং অন্যান্য গণের মধ্যে সেই আদিম ধারাই চলে আসছে।

নাম ব্যবহারের এই সাবধানতা থেকেই বোঝা যায় গণ অধিকার আরোপের ব্যাপারে কতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

যদিও ব্যক্তিগত নামানুকরণের আরো অনেক শাখা-প্রশাখা আছে আমি সাধারণ রীতিটাই তুলে ধরতে চেয়েছি। গণের সাথে তার সদস্যদের সম্পর্কটা যতটা ফোটে তা দেখানোর জন্যে এইসব তুলে ধরা হল। সাধারণ ঘরোয়া এবং আনুষ্ঠানিক সম্বোধনে আমেরিকান ইণ্ডিয়ানরা আত্মীয় সম্পর্ক নিয়ে সম্বোধন করে। তারা সালাম বিনিময় করে আত্মীয় সম্বোধনে। আর আত্মীয় না হলে “বন্ধু” সম্বোধনে সম্বোধন করে। কোনো আমেরিকান ইণ্ডিয়ানকে নাম ধরে ডাকা, সরাসরি তার নাম জানতে চাওয়া খুবই রূঢ় আচরণ।

নৰ্মান বিজয়ের সময় পর্যন্ত আমাদের স্যাক্সন পূর্বপুরুষদের কেবল একটা ব্যক্তিগত নাম ছিল, কেউ পারিবারিক পরিচয় বহন করত না। এতে মনে হয় একবিয়ে পরিবার তাদের মধ্যে বেশ পরে আসে। আর এতেই বোঝা যায় একসময় তাদের মধ্যে স্যাক্সন গণের অস্তিত্ব ছিল।

। আগন্তুককে গণে স্থান দেবার অধিকার

গণের আর একটা বিশেষ অধিকার হল নূতন লোককে জায়গা দেওয়া। যুদ্ধবন্দীদের হয় মেরে ফেলা হত, নয় কোনো গণ তাদের পালত। মেয়েছেলে এবং শিশুদের সাধারণত এইভাবে পালন করা হত। এই পালন শুধু গণ অধিকারই দিত না, গোষ্ঠীর জাতীয়তাও দিত। যে পালত সে রাখত ভাই-বোনের মতো। আর যদি কোনো মা রাখে রাখত ছেলেমেয়ের মতো। তাদের সাথে এমন ব্যবহার করা হত যেন তারা এই গণেই জন্মেছে। উচ্চ পর্যায়ের বর্বর যুগে যুদ্ধবন্দীদের ভাগ্যে ছিল দাসত্ব। এই জিনিসটা বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে এবং আদিম যুগে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। যুদ্ধবন্দীদের এমন পরিবারে রাখা হত যাদের কোনো ভাই বা কোনো পুরুষ মারা গেছে। যারা মারা গেছে তাদের স্থান যেন দেওয়া হত তাকে। কোনো গণের লোকসংখ্যা বিশেষ কমে গেলে তারা অনেক সময় দত্তক নেয়, কিন্তু এ রকম অবস্থা খুব একটা দেখা যায় না। একবার বাজ-গণের লোকসংখ্যা ভীষণ কমে গিয়েছিল, তাদের গণ প্রায় শেষ হয়ে যায় আর কি। এই অবস্থায় নেকড়ে-গণ থেকে কথাবার্তা বলে বেশ কিছুসংখ্যক লোক নেওয়া হয়। দত্তক নেবার ব্যাপারটা নির্ভর করছে। গণের ওপর।

ইরোকোয়াদের মধ্যে দত্তক গ্রহণের ব্যাপারটা গোষ্ঠীর সাধারণ পরিষদের সামনে করা হয়, পরে যা রীতিমতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিগণিত হয়েছিল।[১৫]

। গণে ধর্মীয় রীতি-থা। অনুসন্ধান

গ্রিক এবং ল্যাটিন গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এ ধরনের ধর্মীয় উৎসব ছিল প্রচুর। বহু ঈশ্বরবাদী ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেশি দেখা যায় গণ সমাজেই। তাদের মধ্যে কিছু কিছু অনুষ্ঠান চরম ভক্তি দেখানোর ফলে জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। কোনো কোনো শহরে পুরোহিতের স্থান উত্তরাধিকার সূত্র প্রাপ্ত হয়েছিল এবং যা হত বিশেষ কোনো গণ থেকে।[১৬] গণই হল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আঁতুড় ঘর।

কিন্তু আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের ধর্মীয় আচরণ বহু-ঈশ্বরবাদী হলেও ধর্মীয় প্রভাবে গ্রিক ও রোমানরা যেমন গড়ে উঠেছিল তেমন প্রভাব ওদের মধ্যে ছিল না। আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের ধর্মীয় পুজো-পার্বণ ছিল কমবেশি গণকে কেন্দ্র করে। ধর্মীয় প্রথাগুলো পরে গণের মধ্যে প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই গণ থেকে তা গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ে। এইভাবে আমরা দেখি ইরোকোয়াদের মধ্যে বছরে ছ’টা ধর্মীয় উৎসব হয়। যে ছ’টা গণ মিলে গোষ্ঠী গঠন করে সেই ছ’টি গণের মধ্যেই তা পালিত হত। ছ’টি উৎসব হল : ম্যাপল, গাছ লাগানো, বেট্টী, সবুজ শস্য, নবান্ন এবং নববর্ষ।[১৭]

প্রতি গণে কিছু “ধর্মরক্ষক”[১৮] নির্বাচিত হত। মেয়ে-পুরুষ উভয়ই এই উৎসবের ব্যবস্থা করত। এই নির্বাচিত লোকদের ওপর গণের ধর্মীয় কাজ ছেড়ে দেওয়া মানে তাদের ওপর গোটা গণের নির্ভর করা। এ ধর্মরক্ষকরা উৎসবের দিন ঠিক করত, আর ঠিক করত কী কী সরঞ্জাম লাগবে। গণপ্রধান বা সাকেম ও ধর্মরক্ষকদের সবাই সমান। মহিলা ‘ধর্মরক্ষক’গণ বিশেষ করে ভোজ তৈরির কাজে নিযুক্ত থাকত–কারণ উৎসবের সবাইকে খাওয়ানো হত। আমি আমার আগের এক নিবন্ধে দেখিয়েছি উৎসবে তারা ছোট-বড় সব ভৌতিক ক্ষমতাদের কাছ থেকে নব জীবনের আশীর্বাদ গ্রহণ করে। গণ থেকে ধর্ম যায় গোষ্ঠীতে। ইরোকোয়াদের মোট উৎসব ছিল ছয়টি।[১৯] যা প্রতিটি গণে ছিল সাধারণ।

প্রতিটি গণ কিছু লোক নিয়োগ করত (স্ত্রী-পুরুষ) যাদের বলত ‘ধর্মরক্ষক’। এরা উৎসবের ভার নিত। এরা ঠিক করত কখন এইসব উৎসব পালন করা হবে। আমি আগের একটি কাজে এর বিষদ বর্ণনা করেছি, এখানে শুধু মন্তব্য করে গেলাম। এই উৎসব ছিল ভৌতিক সব ক্ষমতাদের অনেকটা ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মতো।

নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের বর্বর অবস্থায় গণই ছিল ধর্মীয় প্রভাবের কেন্দ্র ও ধর্মীয় উন্নয়ন কেন্দ্র। আমরা কেবল আজটেকদের সাধারণ ধর্মীয় পদ্ধতি নিয়ে দেখেছি, কিন্তু এ ছাড়াও কিছু কিছু জাতীয় দেবতা ও অন্যান্য ছোট ছোট দেবতারও দেখা পাওয়া যায় অন্যান্য ক্ষুদ্র সংগঠনে, যেমন, ভ্রাতৃত্ব সংগঠনে। আজটেকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখলে দেখা যায় গণ সংগঠনের সাথে তা বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যা ইরোকোয়াদের মধ্যে অতটা দেখা যায় না। ইরোকোয়াদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান তাদের সামাজিক সংগঠনের মতোই সুদূর ধূসরতায় ঢাকা পড়ে গেছে।

। এক নির্দিষ্ট সকারের জায়গা।

আদিম কালে সৎকারের নিয়ম ছিল উঁচু মাচা বেঁধে শবদেহটাকে রেখে দেওয়া– যতদিন না দেহ থেকে সব মাংস খসে পড়ে। তারপর একটা ঘরের মধ্যে হাড়গুলো একটা ছালের তৈরি নলের মধ্যে ভরে রেখে দেওয়া হত। এই ঘরটা এ জন্যেই তৈরি। একই গণের লোকদের হাড় এক এক ঘরে রাখা হত। ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে ডাঃ রেভারেণ্ড সাইরাস বায়িংটন চোকটাদের মধ্যে এই পদ্ধতি লক্ষ করেন। আর এ্যাডেইর চেরোকিদের মধ্যে একই জিনিস দেখেন। “আমি এক শহরে এমনি তিনটে ঘর দেখি, ঘরগুলো ছিল কাছাকাছি, একটি গোষ্ঠীর হাড়ের মধ্যে এক এক পরিবারের (গণ) অস্থি আলাদা করে রাখা হত। তারা একজনের হাড় অন্যের হাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলাকে পাপ বলে মনে করত।”[২০] আদিম যুগে ইরোকোয়ারা মাচা করে শবদেহ রেখে দিত, পরে যে ঘরে তারা থাকত সে ঘরেই হাড় এনে রাখত। তারা মাটিতেও কবর দিত। কোনো গণের যদি যৌথ কবরস্থান না থাকে তারা অন্য কারো কবরস্থানে কবর দিত না। আমেরিকান মিশনারি রেভারেণ্ড আশুর রাইট সেনেকাদের সম্বন্ধে লিখেছেন, “গোরস্থানে আমি কোনো ক্ল্যানের চিহ্ন দেখতে পেলাম না। আমার বিশ্বাস তারা বিভিন্ন লোকদের একই জায়গায় কবর দিয়েছে। যাই হোক, পরে তারা জানাল যে আগে বিভিন্ন ক্ল্যানের সদস্যরা প্রায়ই একসাথে থাকত বরং এখন যেভাবে আছে সেভাবে নয়। একটা পরিবার হিসেবে তাদের পরিবারের প্রতি টান ছিল বেশি, ব্যক্তির প্রতি তেমন অনুভূতি ছিল না। তাই এভাবে হতে পারে যে একটা গোরস্থানে মৃতদের একটা বড় অংশ হল এক ক্ল্যানের লোক।” রাইট ঠিকই দেখেছেন, গ্রামের সব গণ মিলে একটা যৌথ গোরস্থান ঠিক করে। একই গণের লোকদের এক সাথে পাশাপাশি রাখা স্বাভাবিক। এর একটা উদাহরণ এখন দেখা গেছে লুইসটনের নিকটে টুসকারোরাদের মধ্যে, যেখানে গোষ্ঠীর যৌথ কবরস্থানে একই গণের লোকদের এক লাইন করে কবর দেয়। স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা সারিতে কবর দেওয়া হয়, কারণ তারা ভিন্ন গণের লোক। বাপ ও তার ছেলেমেয়েদের এক সারিতে, মা এবং তার ছেলেমেয়ে এবং ভাই-বোনদের একই সারিতে কবর দেওয়া হয়। এতে দেখা যাচ্ছে গণ সংগঠনের প্রভাব। তারই সাথে পূর্বের কিছু রীতি বদলে গেছে, নিকট জ্ঞাতিরাও স্থান করেছে। টুসকারোরা গোষ্ঠী এখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করছে, কিন্তু তাদের প্রথা বদলায় নি। একজন ওনোনডাগা ইণ্ডিয়ান লেখককে জানিয়েছে, ঠিক এই ধরনের গোর পদ্ধতি চলে ওনোনডাগা ও ওনেই কবরস্থানে। এই পদ্ধতিকে আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে সর্বজনীন সৎকার ব্যবস্থা বলা যাবে না। অবশ্য আদিম যুগে প্রধান ঝোঁকটা ছিল এই দিকে।

অগ্রগতির যারা একই পর্যায়ে ছিল ইরোকোয়াদের মধ্যে যা দেখা যেত অন্যান্য আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে প্রায় তাই দেখা গেছে। কোনো লোক মারা গেলে গণের সমস্ত লোক শোক প্রকাশ করত। সৎকারের মন্ত্র পড়া, কবর খোঁড়া এবং অন্যান্য কাজ করত ভিন্ন গণের লোক।

মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানরা দাহ করা, মাচায় রেখে বিনষ্ট করা ও কবর দেওয়া এই তিন পদ্ধতিই ব্যবহার করত। পোড়ানো হত শুধু প্রধান ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের।

০। গণ পরিষদ

এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার আদিম সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল গণ। পরিষদ। এটা এক দিকে সরকার নামক প্রতিষ্ঠান, অন্য দিকে গণ, গোষ্ঠী ও মিত্রসংঘের ওপর সর্বনিয়ামক সংস্থা। ছোটখাটো ব্যাপারগুলো প্রধানরাই দেখে দিত। কিন্তু যেখানে সবার স্বার্থ জড়িত সেসব ক্ষেত্রে পরিষদের কাছে তা পেশ করা হত। যেহেতু পরিষদ গণ সংগঠনের মাঝেই সৃষ্টি হয়েছে তাই যতদিন না রাজনৈতিক সমাজের সৃষ্টি হয় এই দুটি সংস্থা একসাথে বহু শতাব্দী ধরে চলে এসেছে। পরে পরিষদের রূপান্তর ঘটে সেনেটে।

পরিষদের সবচেয়ে সহজ-সরল রূপ হল গণ নিজে। কারণ গণের এমন একটা গণতান্ত্রিক রূপ ছিল যেখানে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারত। গণের সবাই মিলে সাকেম ও গণপ্রধান এবং ধর্মরক্ষক নির্বাচিত করত। খুনের শোধ প্রতিশোধ গ্রহণ সবই ছিল গণের যৌথ দায়িত্ব। এরই মধ্যে গোষ্ঠী পরিষদ ও সবশেষে মিত্র পরিষদের প্রধান নির্বাচনের বীজ সুপ্ত ছিল।

উপরে ইরোকোয়া গণের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করা হল। আমরা গ্রিক ও ল্যাটিন গোষ্ঠীর মাঝেও এইসব দায়িত্ব একইভাবে দেখতে পাই। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি ইরোকোয়া গণের লোক সমভাবে স্বাধীন এবং সেই সাথে অপরের স্বাধীনতা রক্ষা করাও তার সমান দায়িত্ব। এমনকি সাকেম ও গণপ্রধানও অতিরিক্ত কিছু চাইতে পারে না, বরং তারা ছিল এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আত্মীয়তাসূত্রে গ্রথিত। সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব যদিও কোনো লিখিত আইনরূপে ছিল না, কিন্তু এটাই ছিল তাদের মূলমন্ত্র।

আমেরিকান ইণ্ডিয়ানরা যখন আবিষ্কৃত হয় তারা সবাই ছিল গণ সংগঠনের ভিত্তিতে এবং উত্তরাধিকার নির্ণয় করত স্ত্রীধারায়। কিছু কিছু গোষ্ঠীতে অবশ্য গণ সংগঠন শেষ হয়ে গিয়েছিল, যেমন ডাকোটা গোষ্ঠীতে। ওজিবওয়া, ওমাহা ও ইয়ুকাটান মায়াদের মধ্যে স্ত্রী। ধারার বদলে উত্তরাধিকার পুরুষ ধারায় পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত আদিবাসীরাই তাদের গণ নাম গ্রহণ করত কোনো গাছপালা বা প্রাণীর নামানুসারে। এইসব নাম কোনো ব্যক্তির নামানুসারে কখনোই হত না। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ছিল গণের মধ্যে বিলুপ্ত। গ্রিক ও ল্যাটিন গোষ্ঠীরাও আদিম যুগে তাই ছিল, কিন্তু তারা যখন প্রথম ঐতিহাসিক যুগে আবির্ভূত হয় তাদের গণ নাম ঘটেছে ব্যক্তির নামানুসারে। নিউ মেক্সিকোর কিছু গোষ্ঠী, যেমন, মোকি গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানদের ধারণা কোনো ভৌতিক শক্তির জোরে তাদের প্রাণীগণ নাম ব্যক্তিগণ নামে রূপান্তরিত হয়েছে। ওজিবওয়ার সারস গণের লোকদের মধ্যেও এ ধরনের একটা উপকথা প্রচলিত আছে। কোনো কোনো গোষ্ঠীতে বিশেষ কোনো এক প্রাণীর মাংস গোষ্ঠীবাসীরা আহার করে না, কারণ এক সময় তারা ঐ জন্তুর নাম ব্যবহার করত।

একটা গণে কত লোক হবে তা নির্ভর করছে তার গণ অংশগুলোর ওপর। নির্ভর করে গোষ্ঠীর উন্নতি বা অবক্ষয়ের ওপর। সেনেকা গোষ্ঠীতে মোট গণ ছিল আটটি, যাদের গড় লোকসংখ্যা ছিল তিন শ পঁচাত্তর, মোট লোকসংখ্যা ছিল তিন হাজার। ওজিবওয়া গোষ্ঠীতে মোট গণসংখ্যা তেইশ, প্রতি গণে লোকসংখ্যা গড়ে ছ’ শ পঞ্চাশ এবং মোট লোকসংখ্যা। পনের হাজার।

মানুষের প্রগতির পথে গণ সংগঠনের প্রভাব সবচাইতে বেশি। বিভিন্ন মহাদেশে নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের বর্বর যুগে গণ সংগঠনই গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়। এমনকি গ্রিক ও ল্যাটিন গোষ্ঠীর মধ্যেও। একমাত্র পলিনেশীয় জনগোষ্ঠী বাদে আর সমস্ত মানব পরিবারই এই গণ ও গোষ্ঠী সংগঠনের মাঝখান দিয়ে এসেছে। প্রথমে এই গণ সংগঠনে সগোত্র বিবাহ ছিল একমাত্র ভিত্তি। পরে ভিন্ন পরিবেশে এই বিবাহ পদ্ধতি তার আদিম রূপ বদল করে।

যে সংগঠন ছিল মানবসমাজের একমাত্র কাঠামো সেই গণ ও গোষ্ঠী সম্বন্ধে আমরা আপাতত কিছুটা ধারণা পেলাম।


১। স্কেন্যানডোয়াহ-এর ইরোকোয়াদের ওপর লিখিত চিঠি যা ১৮৪৭ সালে “এ্যামেরিকান রিভিউ”-এ ছাপা হয়, ‘ইরোকেয়া সঘ’ ১৮৫১ সালে প্রকাশিত এবং “জ্ঞাতি পদ্ধতি ও মানব পরিবারের বৈবাহিক সূত্রে কুটুম্বিতা” যা ১৮৭১ সালে ছাপা হয়–এইসব লেখায় আমি ‘গণে’র জায়গায় ‘গোষ্ঠী’ শব্দ ব্যবহার করেছি, কিন্তু এই দলের একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে দিয়েছি।

২। এই রুটি বা পিঠেগুলো ছিল ছ’ ইঞ্চি ব্যাসযুক্ত এবং এক ইঞ্চি পুরু।

৩। নর্থ আমেরিকান রিভিউ”, এপ্রিল সংখ্যা, ১৮৭৩, পৃঃ ৩৬০।

৪। কয়েকজন বোনের ছেলেরা পরস্পর ভাই, মাসতুতো ভাই নয়। বাকিরা জ্ঞাতি ভাই। তাই একজন লোকের ভায়ের ছেলেরা তার ছেলে, ভাইপো নয়। এদিকে তার নিজবোন ও জ্ঞাতিবোনদের ছেলেরা তার ভাগনা।

৫। জেনটাইলস-এর ল্যাটিন উচ্চারণ হল “জেন-টি-লেস”।

৬। “আমেরিকার ইতিহাস” ১৭২৫, স্টিভেন্স-এর অনুবাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৭১।

৭। ঐ, ৪র্থ খণ্ড, ৩৪।

৮। ঐ, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২৯৮।

৯। “রাজকীয় ভাষ্য”, ১৬৮৮, রায়কাউট-এর অনুবাদ, পৃঃ ১০৭।

১০। হেরেরা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২৩১।

১১। দিনরাত তাদের বুক জ্বলতে থাকে যতক্ষণ না রক্তের বদলা নিতে পারে। কোনো আত্মীয় বা গোষ্ঠীবাসী মারা গেলে বাপের কাছ থেকে ছেলে ঐ হত্যার কথা শুনে মনে রাখে।” এ্যাডেয়ার-এর ‘আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের ইতিহাস”, ১৭৭৫, পৃঃ ১৫০।

১২। মমসেন-এর “রোমের ইতিহাস, ডিকিনসনের অনুবাদ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪৯।

১৩। ওমাহাদের বারোটা গণের মধ্যে একটার নাম হল লা-টা-ডা বা পায়রা-শীকরা”, তাদের মধ্যে এবং অন্যদের মধ্যে এইসব নাম দেখা যায়:

ছেলেদের নাম

গ্লা-ডান-নোহ-চে, “বাতাসে ভেসে বেড়ান শ্যেন।”

আহ্‌-হিসে-না-ডা, “লম্বা ডানা”।

নেস-টাসে-কা, “সাদা চোখে পাখি”।

মেয়েদের নাম

মে-টা-না, “ভোরের পাখির গান”।

লা-টা-ডা-উইন, “অন্যতম পাখি”।

ওয়া-টা-না, “পাখির ডিম”।

১৪। যখন কোনো প্রকার প্রধার কথা বলা হয় অন্য কিছু না বললে ধরে নিতে হবে বলা হচ্ছে ইরোকোয়াদের সম্বন্ধে।

১৫। পরিষদ ভবনে লোকেরা উপস্থিত হলে একজন প্রধান লোকটির নানা রকম তথ্য দিতে থাকে, কেন তাকে গ্রহণ করা হল, তার গণের নাম কী এবং তাকে কী নাম দেওয়া হল। দু জন প্রধান লোকটির দু হাত ধরে সারা ঘর ঘুরে আসে এবং আবাহনী গান গাইতে থাকে। প্রতিটি কবিতার শেষে জনতাও গলা মেলায়। গান চলতে থাকে, যতক্ষণ না তিন বার পাক দেওয়া হয়। এভাবে অনুষ্ঠান শেষ হয়। অনেক সময় আমেরিকানদের গ্রহণ করা হয়। এইভাবে কয়েক বছর আগে আমার ভাগ্যেও এই গ্রহণের পালা পড়েছিল। আমাকে যখন সেনেকাদের শোন গ্রহণ করা হয়।

১৬। গ্রোটে-র “গ্রিসের ইতিহাস”, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৯৪।

১৭। “ইবোকোয়া স”, পৃঃ ১৮২।

 ১৮। “ধর্ম রক্ষাকারীরা” প্রায় সংখ্যায় ছিল প্রধানদের মতোই এবং প্রতি গণের থেকে জ্ঞানী লোক ও প্রৌঢ়ারা এদের মনোনীত করত। তাদের নির্বাচন হয়ে গেলে গোষ্ঠীর পরিষদ এক উৎসব করে এদের গ্রহণ করে। তাদের নাম নিয়ে নেওয়া হত এবং এই শ্রেণীর নতুন নাম দেওয়া হত। স্ত্রী এবং পুরুষ স সংখ্যায় নেওয়া হত। এরা জনতার প্রতিনিধি এবং পরিষদে কেউ খারাপ কাজ করলে লোককে জানিয়ে দিত। কাউকে নির্বাচিত করলে তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য। তবে কিছু কাজ করার পর একজনকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে এবং “ধর্ম রক্ষাকারীর” নাম থেকে তার নাম কাটা যায় এবং আগের নাম ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

১৯। “ইরোকেয়া সখ”, পৃঃ ১৮২

২০। “আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের ইতিহাস”, পৃঃ ১৮৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *