১১০. সংসার-ক্লেশনাশের উপায়

১১০তম অধ্যায়

সংসার-ক্লেশনাশের উপায়

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! প্রাণীগণ বিবিধ সাংসারিক ভারে নিতান্ত ক্লিষ্ট হইলে যে উপায় অবলম্বনপূৰ্ব্বক দুর্গম বিষয় অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্রাহ্মণেরা বিধানানুসারে আশ্রমে বাস করিয়া থাকেন, যাঁহারা অহঙ্কার পরিহার, লোভাদি নিকৃষ্ট প্রবৃত্তির সংযম ও কটুবাক্য সহ্য করিয়া থাকেন, কেহ হিংসা করিলেও তাহার প্রতিহিংসা করেন না, অর্থপ্রার্থনায় বিমুখ হইয়া দান ও প্রতিনিয়ত অতিথিসঙ্কার করেন, অসূয়াশূন্য, স্বাধ্যায় সম্পন্ন ও ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া পরমাত্নসহকারে পিতামাতার শুশ্রুষায় নিরত থাকেন এবং দিবাভাগে কদাচ নিদ্রিত হয়েন না, তাঁহারাই দুস্তর বিষয় অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়েন। যে ভূপালগণ কায়মনোবাক্যে কদাচ পাপানুষ্ঠান করেন না, যাঁহারা সকলের প্রতিই অপরাধানুসারে দণ্ডবিধান করেন, যাঁহারা রজোগুণ ও লোভপ্রভাবে অর্থসংগ্রহ করেন না, যাঁহারা অগ্নিহোত্ৰপরায়ণ ও সতত সাবধান হইয়া স্ব স্ব বিষয়ক্ষায় নিযুক্ত থাকেন, যাঁহারা পরদারাভিমর্ষণে [পরনারীধর্ষণে বিরত] নিরত হইয়া ঋতুকালে আপন আপন ধৰ্ম্মপত্নীতে গমন ও মৃত্যুভয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক রণস্থলে ধৰ্ম্মানুসারে জয়লাভের অভিলাষ করেন, যাঁহারা প্রাণসংশয় উপস্থিত হইলেও কদাচ সত্যবাক্য পরিত্যাগ করেন না, যাঁহারা মনুষ্যদিগের আদর্শস্বরূপ, যাঁহাদিগের কোন কাৰ্য্যই অবিশ্বাসের যোগ্য নহে, যাঁহাদিগের অর্থ সৎকার্য্যেই ব্যয়িত হয়, তাঁহারাই দুস্তর বিষয় অতিক্রম করিতে সমর্থ হইয়া থাকেন। যেসকল ব্রাহ্মণ অনধ্যায়কালে অধ্যয়ন করেন না, যাঁহারা বাল্যকালাবধি ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক তপানুষ্ঠান, বেদাধ্যয়ন ও অন্যান্য বিদ্যাভ্যাস সমাধানান্তে স্নান করিয়া থাকেন, যাঁহারা রজঃ ও তমোগুণের বশীভূত না হইয়া একমাত্র সত্ত্বগুণেরই আশ্রয় গ্রহণ করেন, যাঁহাদিগের হইতে কাহারই অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হয় না, যাঁহারা কোন ব্যক্তি হইতেই ভীত হয়েন না ও সকলকেই আপনার ন্যায় নিরীক্ষণ করিয়া থাকেন, যাঁহারা পরশ্রীদর্শনে সন্তপ্ত বা কুৎসিত আচারে প্রবৃত্ত হয়েন না, যাঁহারা সকল দেবতাকে নমস্কার ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া সকল ধৰ্ম্ম শ্রবণ করেন, যাঁহারা আপনাদিগের মানসম্ভ্রমের প্রতি দৃষ্টিপাতও করেন না, যাঁহারা মান্য ব্যক্তিকে নমস্কার ও যথোচিত সম্মান করিয়া থাকেন, যাঁহারা সন্তানার্থী হইয়া বিশুদ্ধমনে প্রত্যেক তিথিতে শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পাদন, আপনার ক্রোধসংবরণ, অন্যের ক্রোধাপনয়ন ও জন্মাবধি মদ্যমাংসের প্রতি সবিশেষ অনাদর প্রদর্শন করেন এবং যাঁহারা প্রাণধারণের নিমিত্তই ভোজন, অপত্যোৎপাদনের [সন্তান উৎপাদনের] নিমিত্তই স্ত্রীসহবাস ও সত্যকথা কহিবার নিমিত্তই বাক্যপ্রয়োগ করিয়া থাকেন, তাঁহারাই দুস্তর বিষয় অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়েন।

“হে যুধিষ্ঠির! আর এই যে মহাত্মা মধুসূদন এ স্থানে অবস্থান করিতেছেন, উনি আমাদিগের পরম সুহৃদ, ভ্রাতা, মিত্র ও সম্বন্ধী। উনি স্বেচ্ছাক্রমে চৰ্ম্মের ন্যায় এই সমস্ত লোককে পরিবেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন। উনি লোকের প্রিয় ও হিতানুষ্ঠানার্থ নিরন্তর যত্ন করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি ভক্তিসহকারে এই সৰ্ব্বভূতের ঈশ্বর, সকল জগতের সৃষ্টিকর্ত্তা, অক্ষয় পুরুষোত্তমকে আশ্রয় করে, সে নিঃসন্দেহেই অনায়াসে দুষ্কর বিষয় অতিক্রম করিতে পারে। যাঁহারা এই দুর্গতিতরণ পাঠ ব্রাহ্মণের নিকট কীৰ্ত্তন করেন এবং অন্যান্য ব্যক্তিকে শ্রবণ করান, তাঁহারাও দুস্তর বস্তু অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়েন। হে ধৰ্ম্মরাজ! মনুষ্যেরা ইহলোকে ও পরলোকে যে প্রকারে দুস্তর বিষয় সমুত্তীর্ণ হইতে পারে, আমি তাহা তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিলাম।”