১০৭. ভেদবুদ্ধির ভীষণতা

১০৭তম অধ্যায়

ভেদবুদ্ধির ভীষণতা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রগণের ধর্ম্মাচরণ, জীবিকানির্ব্বাহ ও ঐশ্বৰ্য্যলাভ এবং ভূপালগণের কোযরক্ষা, কোষোৎপাদন, জয়লাভ, অমাত্যগুণ পরীক্ষা, প্রজাবৃদ্ধি, ষাড় গুণ্য আশ্রয়, সেনাগণের সহিত ব্যবহার, সাধু, অসাধু, প্রধান, নিকৃষ্ট ও সমকক্ষ ব্যক্তিদিগের লক্ষণ অবধারণ, মধ্যবিত্ত লোকের সন্তোষসম্পাদন, ক্ষীণদিগকে আশ্রয়দান ও জয়লাভবিষয়ক কৌশলের কথা কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। এক্ষণে আত্মপক্ষীয় শূরগণের সহিত কিরূপ ব্যবহার করা উচিত, আর উহারা কিরূপে বর্দ্ধিত, ভেদবুদ্ধিশূন্য এবং শত্ৰুবিজয় ও সুহৃদলাভে সমর্থ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। আমার মতে ভেদই শূরগণের বিনাশের মূল এবং অনেকের সহিত মন্ত্রণা করিলে উহা গোপন থাকা নিতান্ত কঠিন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! লোভ ও ক্রোধ হইতেই নরপতি ও তাঁহার অধিকৃত বীরদিগের বৈরানল সন্দীপিত হয়। রাজা লোভাকৃষ্ট ও ধীরগণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়াই পরস্পর পরস্পরের বিনাশের হেতু হইয়া উঠেন। ভূপতি ও তাঁহার পক্ষীয় বীরগণ ক্ষয়, ব্যয় ও ভয়নিবন্ধন চর, মন্ত্রণা, বল এবং সাম, দান ও ভেদ প্রভৃতি উপায় প্রয়োগদ্বারা পরস্পর পরস্পরকে নিপীড়িত করিবার চেষ্টা করেন। একমতাবলম্বী শূরগণের নিকট হইতে অপরিমিত কর গ্রহণ করিলে তাহাদের মধ্যে ভেদ উৎপন্ন হয় এবং তাহারা তন্নিবন্ধন ভীত ও বিমনায়মান হইয়া অরাতিপক্ষ অবলম্বন করে। যাহাদের মধ্যে ভেদ উৎপন্ন হয়, তাহাদিগকে নিশ্চয়ই অরাতির বশীভূত ও বিনষ্ট হইতে হয়। অতএব পরস্পর ঐকমত্য অবলম্বন করাই শূরগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। বলপৌরুষসম্পন্ন বীরগণ একমতাবলম্বী হইলে প্রভূত অর্থ উপার্জ্জন, অন্যান্য অনেক ব্যক্তির সহিত মিত্রতালাভ ও সৰ্ব্বপ্রকার সুখভোগ করিতে পারেন। জ্ঞানবৃদ্ধ মহাত্মারা সতত উহাদিগের প্রশংসা করিয়া থাকেন। নানাগুণসম্পন্ন একমতাবলম্বী শূরগণ সমাজমধ্যে ধর্ম্মব্যবহার-সংস্থাপন, সকলের প্রতি সমভাবে দৃষ্টিপাত, পুত্র ও ভ্রাতৃগণকে শাসন, বিনয়ীদিগের প্রতি অনুগ্রহপ্রদর্শন, চরপ্রয়োগ, মন্ত্রণা ও কোষপূরণবিষয়ে বিশেষ যত্ন এবং কাৰ্য্যানুষ্ঠানসময়ে পুরুষকার ও উৎসাহসম্পন্ন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদিগের মত গ্রহণ করিলে অচিরাৎ পরিবর্দ্ধিত হইতে পারেন। সৌভাগ্যশালী শাস্ত্রজ্ঞ বীরপুরুষদিগের প্রভাবেই মূঢ়গণ ঘোর বিপদ হইতে সমুত্তীর্ণ হয়। ঐ সকল বীরপুরুষকে নিগ্রহ, বধ ও ভয়প্রদর্শন, উহাদের মধ্যে ভেদোৎপাদন এবং উহাদের প্রতি ক্রোধপ্রকাশ ও দণ্ডবিধান করিলে উহারা অচিরাৎ বিপক্ষপক্ষের বশীভূত হয়; অতএব তাহাদিগের সম্মান করা কর্ত্তব্য। উহাদের প্রভাবে সমুদয় লোকের দেহযাত্ৰা [সংসারযাত্রা] নির্ব্বাহ হইয়া থাকে এবং তাহাদিগেরই গৃঢ়মন্ত্রণাদ্বারা চরগণ শত্ৰুদিগকে আকর্ষণ করিতে পারে।

“সমুদয় বীরের সহিত মন্ত্রণা করা কর্ত্তব্য নহে। বীরগণের মধ্যে যাঁহারা প্রধান, তাঁহাদের সহিত মন্ত্রণা করিয়া অন্যান্য ব্যক্তির হিতসাধন করা উচিত। নচেৎ মন্ত্রণাপ্রকাশ ও ভেদনিবন্ধন অর্থনাশ ও অনর্থ উৎপত্তির বিলক্ষণ সম্ভাবনা। শূরগণের মধ্যে যাহাদিগের ভেদবুদ্ধি জন্মিবে এবং যাহারা স্ব স্ব ভিন্ন ভিন্ন মতানুসারে কাৰ্য্য করিবে, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা অচিরাৎ তাহাদের শাসন করিবেন। যদি কুলবৃদ্ধ[বংশের প্রাচীন]গণ কুলসম্ভূত[বংশঘটিত] কলহে উপেক্ষা করেন, তাহা হইলে গণভেদ নিবন্ধন গোত্রের ক্ষয় হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। আত্মীয়ভেদ[আত্মীয়বিচ্ছেদ]সম্ভূত ভয় শত্রুভয় অপেক্ষা গুরুতর। অতএব যাহাতে আত্মীয়ভেদ না হয়, তদ্বিষয়ে সতত সতর্ক থাকা উচিত। আত্মীয়ভেদ অচিরাৎ মনুষ্যকে সমূলে নির্মূল করিয়া ফেলে। যখন সমান জাতি ও সমান কুলসম্পন্ন ব্যক্তিগণ অকস্মাৎ ক্রোধ, মোহ ও স্বভাবতঃ লোভের বশীভূত হইয়া পরস্পর বাক্যালাপে বিরত হয়েন, তখনই পরাভবের লক্ষণ লক্ষিত হয়। শত্রুগণ উদ্যোগ বা বুদ্ধিবলে শূরগণকে বিনষ্ট করিতে পারে না, কেবল উহাদের মধ্যে ভেদ উৎপাদন করিতে পারিলেই কৃতকার্য্য হয়। অতএব ঐকমত্য অবলম্বন শূরগণের রক্ষার প্রধান উপায়।”