১১৩. ভীমকর্ণযুদ্ধ–কর্ণপরাজয়

১৩৩তম অধ্যায়

ভীমকর্ণযুদ্ধ–কর্ণপরাজয়

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! ভীম লঘুবিক্রম কর্ণের সহিত যখন সংগ্রাম করিতে সমর্থ হইল, তখন তাহার বলবীৰ্য্য নিতান্ত অদ্ভুত বলিয়া বোধ হইতেছে। যে কর্ণ সর্ব্বশস্ত্রধারী, সমরে উদ্যত যক্ষ, অসুর ও মনুষ্যগণের সহিত অমরগণকে নিবারণ করিতে পারে, সে ভীমকে কেন পরাজয় করিতে সমর্থ হইল না? যাহা হউক, ঐ বীরদ্বয়ের প্রাণসংশয়কর যুদ্ধ কিরূপ হইল, তুমি তাহা কীৰ্ত্তন কর। আমার বোধ হয়, জয় বা পরাজয় তাহাদের উভয়েরই আয়ত্ত। হে সঞ্জয়! আমার পুত্র দুৰ্য্যোধন কর্ণের সাহায্য লাভ করিয়া সমরে সাত্যকি ও বাসুদেবের সহিত পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিবার নিমিত্ত উৎসাহিত হইয়া থাকে; কিন্তু আমি কর্ণকে ভীমশরে বারংবার পরাজিত শ্রবণ করিয়া মোহে নিতান্ত অভিভূত হইতেছি। এক্ষণে আমার পুত্রের দুর্নীতি প্রভাবেই কৌরবগণ কালকবলে নিপতিত হইতেছেন। কর্ণ পাণ্ডবগণকে কখনই পরাজিত করিতে সমর্থ হইবেন না। তিনি তাহাদিগের সহিত যতবার যুদ্ধ করিয়াছেন, ততবারই পরাজিত হইয়াছেন।

অমরগণসমবেত সুররাজ ইন্দ্রও যে পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিতে সমর্থ নহেন, মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধন তাহা বুঝিতে পারে না। মধুলাভার্থী যেমন বৃক্ষে আরোহণকালে আপনার অধঃপতন অনুধাবন করে না, তদ্রূপ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ধনেশ্বর তুল্য ধর্ম্মরাজের ধন গ্রহণ করিয়া আত্মবিনাশ অবধারণ করিতে সমর্থ হইতেছে না। ঐ কৈতবপরতন্ত্র দুরাত্মা শঠতাপূর্ব্বক মহাত্মা পাণ্ডবগণের রাজ্যাপহরণ করিয়া তাহাদিগকে পরাজিত বোধ করিয়া সতত তাহাদের অবমাননা করিয়া থাকে; আমিও পুত্রবাৎসল্যে একান্ত অভিভূত হইয়া ধর্ম্মপরায়ণ পাণ্ডবগণকে বঞ্চিত করিয়াছি। দূরদর্শী যুধিষ্ঠির অনেকবার সন্ধিস্থাপনের বাসনা করিয়াছিল, কিন্তু আমার আত্মজগণ তাহাকে যুদ্ধে অশক্ত বোধ করিয়া তাহার বাক্যে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছে। হে সঞ্জয়। তুমি কহিলে, মহাবীর ভীমসেন পূর্ব্বের সেই সমস্ত দুঃখ ও অপকার স্মরণ করিয়া কর্ণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছে। এক্ষণে কর্ণ ও ভীম পরস্পরের বধসাধনে সমুদ্যত হইয়া যেরূপ যুদ্ধ করিয়াছিল, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অরণ্যমধ্যে কুঞ্জরযুগলের ন্যায় পরস্পরবধাথী মহাবীর ভীম ও কর্ণের যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, শ্রবণ করুন। মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া বিক্ৰম প্ৰকাশপূর্ব্বক রোষপরবশ ভীমসেনকে মহাবেগসম্পন্ন, প্রসন্নমুখ, ত্রিংশৎশরে বিদ্ধ করিলেন। ভীমসেন নিশিত তিনশরে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ভল্লাস্ত্রে তাঁহার সারথির প্রাণ সংহারপূর্ব্বক রথ হইতে তাঁহাকে ভূতলে নিপাতিত করিলেন। তখন কর্ণ তাঁহাকে সংহার করিবার নিমিত্ত কনকবৈদূৰ্য্যসমলঙ্কৃত দণ্ডসম্পন্ন, কালশক্তির ন্যায় প্রাণান্তকর এক মহাশক্তি গ্রহণ, উৎক্ষেপণ ও সন্ধানপূর্ব্বক বজ্রের ন্যায় ভীমের প্রতি পরিত্যাগ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। দুৰ্য্যোধনপ্রমুখ আপনার আত্মজগণ সেই সিংহনাদ শ্রবণ করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। তখন মহাবীর ভীম অনল ও সূৰ্য্যপ্রভ নির্মোকনির্মুক্ত ভীষণ ভুজগসদৃশ সেই কর্ণভুজনির্মুক্ত সুদারুণ শক্তি সাতশরে নভোমণ্ডলেই ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং কর্ণের জীবনানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াই যেন ক্রোধভরে তাঁহার উপর স্বর্ণপুঙ্খ শিলাশিত যমদণ্ডেপম শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন কর্ণও অন্য শরাসন গ্রহণ ও আকর্ষণপূর্ব্বক শরজাল বিস্তার করিতে আরম্ভ করিলেন। ভীমসেন নতপর্ব্ব নয়বাণে সেই কর্ণাবমুক্ত শরসমুদয় ছেদন করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে তাঁহারা কখন গাভীলাভার্থী মত্ত বৃষভদ্বয়ের ন্যায় চীৎকার, কখন আমিষলোলুপ শার্দুলযুগলের ন্যায় তর্জ্জনগর্জ্জন, কখন পরস্পরের প্রতি প্রহারে উদ্যত, কখন পরস্পরের রন্ধ্রান্বেষণ এবং কখন বা গোষ্ঠস্থিত মহাবৃষভদ্বয়ের ন্যায় সক্রোধনয়নে পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মাতঙ্গদ্বয় যেমন সমাগত হইয়া পরস্পরের উপর দশনপ্রহার করিয়া থাকে, তদ্রূপ তাঁহারা রোষকষায়িতলোচনে পরস্পরের প্রতি শর বর্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন এবং কখন হাস্য, কখন ভৎর্সনা ও কখন বা শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহাদের ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। তখন মহাবীর ভীম কর্ণের কার্মুকমুষ্টিদেশ ছেদন ও ধবলকায় অশ্বসকলকে যমালয়ে প্রেরণ করিয়া সারথিকে রথোপস্থ হইতে ভূতলে নিপাতিত করিলেন। এইরূপে মহাবীর কর্ণ ভীমশরে হতাশ্ব, হতসারথি ও বিমোহিতপ্রায় হইয়া চিন্তাসাগরে নিমগ্ন হইলেন এবং তৎকালে কি করিবেন, কিছুই অবধারণ করিতে পারিলেন না।

“হে মহারাজ! ঐ সময় কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন কর্ণকে একান্ত বিপদাপন্ন অবলোকন করিয়া কম্পিতকলেবরে ক্রোধভরে দুর্জ্জয়কে কহিলেন, “হে দুর্জ্জয়! ঐ দেখ, অগ্রে ভীম কর্ণকে শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত করিতেছে; অতএব তুমি কর্ণের সাহায্যার্থ অবিলম্বে গমনপূর্ব্বক শ্মশ্রুশূন্য ভীমকে বিনাশ কর।’ তখন আপনার আত্মজ দুর্জ্জয় জ্যেষ্ঠভ্রাতার আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিয়া শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং ভীমকে নয়, ভীমের অশ্বগণকে আট ও সারথিকে ছয়বাণে নিপীড়িত করিয়া তিনশরে তাহার কেতু বিদ্ধ করিয়া পুনরায় তাহার প্রতি সাত শর প্রয়োগ করিলেন। তখন ভীম ক্রোধে একান্ত অধীর হইয়া শরনিকরদ্বারা দুর্জ্জয়ের মর্ম্ম বিদ্ধ করিয়া তাঁহাকে অশ্বগণ ও সারথির সহিত যমসদনে প্রেরণ করিলেন। মহাবীর কর্ণ দুঃখিতমনে অবিরল বাষ্পকুললোচনে সেই দিব্যাভরণভূষিত, ক্ষিতিতলে নিপতিত, ভুজঙ্গের ন্যায় বিলুণ্ঠমান দুর্জ্জয়কে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন। তখন ভীমসেন সেই প্রবল বৈরী কর্ণকে রথশূন্য করিয়া হাস্যমুখে শতঘ্নীতে যেমন শঙ্কু বিদ্ধ করে, তদ্রূপ কর্ণের গাত্রে শনিকর বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে মহারথ কর্ণ ভীমের সায়কসমূহে ক্ষতবিক্ষতকলেবর হইয়াও তৎকালে রোষপরবশ বৃকোদরকে পরিত্যাগ করিলেন না।”