১১১. সাত্যকি কর্ত্তৃক অর্জ্জুনের গূঢ় অভিপ্রায় প্রকাশ

১১১তম অধ্যায়

সাত্যকি কর্ত্তৃক অর্জ্জুনের গূঢ় অভিপ্রায় প্রকাশ

হে মহারাজ! শিনিপুঙ্গব সাত্যকি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রীতিযুক্ত, তৎকালোচিত, ন্যায়ানুগত বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আপনি মহাবীর অর্জ্জুনের নিমিত্ত যে সকল নীতিগর্ভ যশস্কর বাক্য বলিলেন, তৎসমুদায়ই শ্রবণ করিলাম। এইরূপ সময়ে পার্থের ন্যায় আমাকে অনুরোধ করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। আমি ধনঞ্জয়ের রক্ষার্থ জীবন পরিত্যাগ করিতেও স্বীকৃত আছি; বিশেষত আপনি যখন অনুরোধ করিতেছেন, তখন রণস্থলে যে কোন কাৰ্য্য হউক না কেন, সকলই অনুষ্ঠান করা আমার কর্ত্তব্য। আমি আপনার অনুমতিক্রমে দেবতা, অসুর ও মনুষ্য পরিপূর্ণ এই ত্রিলোকের সহিত সংগ্রাম করিতে পারি; অতএব আজি এই দুর্ব্বল দুৰ্য্যোধন বলের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব; তাহার আর বিচিত্র কি? আমি নিশ্চিয়ই রণস্থলে ইহাদিগকে পরাজয় করিব। হে মহারাজ! আমি নির্বিঘ্নে নিরাপদ ধনঞ্জয়ের নিকট গমন করিব এবং দুরাত্মা জয়দ্রথ নিহত হইলে পুনরায় আপনার সন্নিধানে সমুপস্থিত হইব। কিন্তু হে মহারাজ! বাসুদেব ও ধীমান অর্জ্জুন যে কথা কহিয়াছেন, তাহা আপনাকে জ্ঞাপিত করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। মহাবীর ধনঞ্জয় সমুদায় সৈন্য ও বাসুদেব সমক্ষে বারংবার আমাকে কহিয়াছেন, ‘হে শৈনেয়! আমি যতক্ষণ জয়দ্রথকে বিনাশ না করিতেছি, তদবধি তুমি অপ্রমত্ত চিত্তে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা কর। আমি তোমার বা মহারথ প্রদ্যুম্নের হস্তে ধর্ম্মরাজকে সমর্পণ পূর্ব্বক নিশ্চিন্ত হইয়া জয়দ্রথের প্রতি গমন করিতে পারি। তুমি কৌরব পক্ষের শ্রেষ্ঠ দ্রোণাচাৰ্য্যকে সম্যক বিদিত ও তাঁহার প্রতিজ্ঞা শ্রুত হইয়াছ। তিনি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত অতিশয় যত্ন করিতেছেন তদ্বিষয় সম্পাদনেও অসমর্থ নহেন, অতএব এক্ষণে আমি নরোত্তম ধর্ম্মরাজকে তোমার হস্তে নিক্ষেপ করিয়া জয়দ্রথ বধার্থ প্রস্থান করিতেছি; তাঁহাকে সংহার করিয়া অবিলম্বেই প্রত্যাগত হইব। দেখিও দ্রোণাচার্য্য যেন ধর্ম্মরাজকে গ্রহণ করিতে সমর্থ না হন। ধর্ম্মরাজ গৃহীত হইলে আমি সিন্ধুরাজ বধে অকৃতকাৰ্য্য ও অতিশয় অসন্তুষ্ট হইব। সত্যবাদী যুধিষ্ঠির সমরে গৃহীত হইলে নিশ্চয়ই আমাদিগকে পুনরায় অরণ্যে প্রস্থান করিতে হইবে, সুতরাং আমাদিগের এই জয়লাভও কোন ফলোপধায়ক হইবে না। অতএব হে শৈনেয়! আজি তুমি আমার প্রিয়ানুষ্ঠান, জয়লাভ ও যশোলাভার্থ ধর্ম্মরাজকে রক্ষা কর।’

হে ধর্ম্মরাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় দ্রোণাচার্য্যের আশঙ্কায় আপনাকে আমার হস্তে নিক্ষেপ করিয়া গিয়াছেন। এক্ষণে মহাবীর প্রদ্যুম্ন ব্যতিরেকে সেই দ্রোণাচার্য্যের প্রতিযোদ্ধা আর কাহাকেও নিরীক্ষণ করি না। কেহ কেহ আমাকেও তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী বোধ করিয়া থাকেন। অতএব আমি এই আত্মোৎকর্ষ ও আচার্য্য অর্জ্জুনের আদেশ বিফল করিতে কিছুতেই সমর্থ হইতেছি না। আর আপনাকেই বা কিরূপে পরিত্যাগ করিব। দুর্ভেদ্য কবচধারী মহাবীর দ্রোণ ক্ষিপ্র হস্ততা প্রযুক্ত রণস্থলে আপনাকে প্রাপ্ত হইয়া শিশু যেমন পক্ষী লইয়া ক্রীড়া করে, তদ্রূপ আপনার সহিত ক্রীড়া করিবেন। যদি কৃষ্ণতনয় প্রদ্যুম্ন এই স্থানে থাকিতেন, তাহা হইলে আপনাকে তাঁহার হস্তে সমৰ্পণ করিতাম, তিনি মহা বীর অর্জ্জুনের ন্যায় আপনাকে রক্ষা করিতেন। আমি অর্জ্জুনের নিকট গমন করিলে মহাবীর দ্রোণের অভিমুখীন হইতে পারে আপনার এমন রক্ষক আর কে আছে? অতএব আপনার আত্মরক্ষা করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। হে মহারাজ! মহাবীর্য্য অর্জ্জুন ভার গ্রহণ করিয়া কদাচ অবসন্ন হন না; অতএব আজি আপনি তাঁহার নিমিত্ত কোন শঙ্কা করিবেন না। সৌবীরক, সৈন্ধব, পৌরব, উদীচ্য ও দাক্ষিণাত্য যোদ্ধৃগণ এবং কর্ণ প্রমুখ মহারথগণ মহাবীর অর্জ্জুনের ষোড়শাংশেরও উপযুক্ত নহেন। সুর, অসুর, মানব, রাক্ষস, কিন্নর ও মহোরগ প্রভৃতি স্থাবর জঙ্গমাত্মক ভূত সমুদায় রণস্থলে পার্থের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ নহেন। অতএব আপনি তাঁহার নিমিত্ত আশঙ্কা পরিত্যাগ করুন। যথায় মহাবল পরাক্রান্ত অর্জ্জুন ও কৃষ্ণ অবস্থান করিতেছেন, তথায় কার্য্যের বিঘ্ন-সম্ভাবনা কোথায়? আপনি আচার্য্য অর্জ্জুনের দৈববল, কৃতাস্ত্ৰতা, অভ্যাস, অমর্ষ, কৃতজ্ঞতা ও দয়ার বিষয় চিন্তা করুন এবং আমি অর্জ্জুন সন্নিধানে গমন করিলে দ্রোণাচাৰ্য্য যেরূপ অস্ত্রবল প্রদর্শন করিবেন, তাহাও অনুধাবন করিয়া দেখুন। মহাবীর দ্ৰোণ স্বীয় প্রতিজ্ঞা সফল করিবার নিমিত্ত আপনাকে গ্রহণ করিবার উদ্দেশে সাতিশয় যত্ন করিতেছেন। অতএব আপনার আত্মরক্ষা করা নিতান্ত আবশ্যক। হে মহারাজ! এক্ষণে আমি যাহাকে বিশ্বাস করিয়া অর্জ্জুনের নিকট গমন করিতে পারি, আপনার এমন রক্ষক আর কে আছে? আমি সত্যই কহিতেছি, আপনাকে কাহারও হস্তে সমর্পণ না করিয়া কদাচ অর্জ্জুনের নিকট গমন করিব না। অতএব ইহা বারংবার বিচার করিয়া যাহা শ্রেয়স্কর বোধ হয়, তাহা অবধারণ পূর্ব্বক আমাকে আজ্ঞা করুন।

অর্জ্জুন-সাহায্যে যুধিষ্ঠিরের একান্ত আগ্রহ

ধর্ম্মরাজ সাত্যকির বাক্য শ্রবণানন্তর তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে শৈনেয়! তুমি যাহা কহিলে তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু অর্জ্জুনের অনিষ্টাশঙ্কা সতত আমার মনে সমুদিত হইতেছে। অতএব আমি স্বয়ং আত্মরক্ষায় যত্ন করিব। তুমি আমার আদেশানুসারে অর্জ্জুন সমীপে প্রস্থান কর। আমি আত্মরক্ষণ ও অর্জ্জুনের রক্ষার্থে তোমাকে প্রেরণ এই দুইটি বিষয়ের তারতম্য বিচার করিয়া তোমাকে অর্জ্জুন সমীপে প্রেরণ করাই কৰ্ত্তব্য বলিয়া প্রতিপাদন করিতেছি। অতএব তুমি অবিলম্বে ধনঞ্জয়ের নিকট গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হও। মহাবল পরাক্রান্ত ভীম, দ্রুপদ, তাঁহার সহোদর, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, কেকয় দেশীয় পাঁচ ভ্রাতা, রাক্ষস ঘটোৎকচ, বিরাট, দ্রুপদ, মহারথ শিখণ্ডী, ধৃষ্টকেতু, কুন্তিভোজ, নকুল, সহদেব এবং পাঞ্চাল, সৃঞ্জয় ও অন্যান্য ভূপালগণ সাবধান হইয়া আমাকে রক্ষা করিবেন; সন্দেহ নাই। তাহা হইলে মহাবীর দ্রোণ ও কৃতবর্ম্মা আমাকে আক্রমণ ও নিগ্রহ করিতে সমর্থ হইবেন না। বেলাভূমি যেরূপ মহাসাগরকে নিবারণ করে, তদ্রূপ ধৃষ্টদ্যুম্ন বিক্ৰম প্রকাশ পূর্ব্বক রোষাবিষ্ট দ্রোণকে নিবারণ করিবেন। যথায় তিনি অবস্থান করিবেন, তথায় দ্রোণাচাৰ্য্য মহাবল বল সমুদায়কে কদাচ আক্রমণ করিতে পারিবেন না। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণ বিনাশার্থই হুতাশন হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন। হে শৈনেয়! এক্ষণে তুমি কবচ, শর, শরাসন ও খড়্গ ধারণ পূর্ব্বক বিশ্বস্ত মনে গমন কর। আমার নিমিত্ত তোমার কিছুমাত্র চিন্তা নাই। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নই রোষপরবশ দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিবারণ করিতে সমর্থ হইবেন।