১১০. দ্রোণ-সাত্যকি-সমরে যুধিষ্ঠির সাহায্য

১১০তম অধ্যায়

দ্রোণ-সাত্যকি-সমরে যুধিষ্ঠির সাহায্য

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর সাত্যকি দ্রোণাচাৰ্য্যকে যুদ্ধে কি রূপে নিবারণ করিলেন, তুমি তাহা আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন কর; উহা শ্রবণ করিতে আমার সাতিশয় কৌতুহল হইয়াছে।

সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! সাত্যকি প্রভৃতি পাণ্ডব পক্ষীয় বীরগণের সহিত দ্রোণাচার্য্যের যে রূপ লোমহর্ষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইয়াছিল, তাহা শ্রবণ করুন। মহাবীর দ্রোণ সত্যবিক্রম সাত্যকিকে সৈন্য সংহারে প্রবৃত্ত দেখিয়া স্বয়ং তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। সাত্যকি তাঁহাকে সহসা আগমন করিতে নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার উপর পঞ্চবিংশতি ক্ষুরপ্রাস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন। মহাবল পরাক্রান্ত দ্রোণও হেমপুঙ্খ নিশিত পাঁচ শরে তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ বিদ্ধ করিলেন। সেই সমস্ত অরাতি বিনাশন শর সাত্যকির সুদৃঢ় বৰ্ম্মভেদ করিয়া নিশ্বসন্ত পন্নগের ন্যায় ধরণীতলে নিপতিত হইল। তখন সাত্যকি অঙ্কুশাহত মাতঙ্গের ন্যায় নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া অনল সংকাশ পঞ্চাশত নারাচাস্ত্রে দ্রোণকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য সাত্যকির শরাঘাতে নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া প্রথমত তাঁহাকে অসংখ্য শরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় শরজালে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাবল পরাক্রান্ত সাত্যকি দ্রোণাচাৰ্য্যকে তাঁহার উপর নিশিত শরনিকর বর্ষণ করিতে নিরীক্ষণ করিয়া ইতিকর্ত্তব্যবিমূঢ় ও অতিশয় বিসর্গ হইলেন। তখন আপনার আত্মজ ও সৈন্যগণ সাত্যকিকে তদবস্থ অবলোকন করিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে বারংবার সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই ভয়ঙ্কর সিংহনাদ শ্রবণ ও সাত্যকিকে একান্ত নিপীড়িত নিরীক্ষণ করিয়া সৈন্যদিগকে আহ্বান পূর্ব্বক কহিলেন, হে বীরগণ! যেরূপ রাহু সূৰ্য্যকে পীড়ন করে তদ্রূপ দ্রোণাচাৰ্য্য বৃষ্ণিপ্রবর মহাবীর সাত্যকিকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতেছেন; অতএব যে স্থানে তিনি দ্রোণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তোমরা সত্বরে তথায় ধাবমান হও। ধর্ম্মনন্দন সৈন্যগণকে এই কথা বলিয়া পাঞ্চালরাজ তনয় ধৃষ্টদ্যুম্নকে কহিলেন, “হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! তুমি কেন এখনও নিশ্চিন্ত হইয়া অবস্থান করিতেছ, অবিলম্বে দ্রোণাচার্য্যের প্রতি ধাবমান হও। দ্রোণাচাৰ্য্য হইতে আমাদের ঘোরতর বিপদ উপস্থিত হইয়াছে, তাহা কি তোমার বোধগম্য হয় নাই? যেমন বালক সূত্র সংযত পক্ষী লইয়া ক্রীড়া করে, তদ্রূপ মহাবীর দ্রোণ সাত্যকির সহিত ক্রীড়া করিতেছেন। অতএব তুমি সত্বরে ভীমসেন প্রভৃতি বীরগণ সমভিব্যাহারে সাত্যকির রথাভিমুখে ধাবমান হও। আমি সৈন্যগণের সহিত তোমার অনুগমন করিব। হে পাঞ্চাল! আজি তুমি যমদংষ্ট্ৰান্তৰ্গত সাত্যকিকে পরিত্রাণ কর।”

দ্রোণ কর্ত্তৃক বহু পাঞ্চাল-কৈকয় বীর বধ

রাজা যুধিষ্ঠির এই বলিয়া সাত্যকিকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত বীরগণ সমভিব্যাহারে দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। এই রূপে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ একমাত্র দ্রোণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইলে সমরক্ষেত্রে মহান্ কোলাহল সমুপস্থিত হইল। বীরগণ একত্র সমবেত হইয়া দ্রোণের প্রতি কঙ্কপত্র ও ময়ূরপুচ্ছ সুশোভিত সুতীক্ষ্ণ শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। লোকে অভ্যাগত অতিথিদিগকে সলিল ও আসন প্রদান পূর্ব্বক যেমন প্রতিগ্ৰহ করিয়া থাকে, তদ্রূপ দ্রোণাচাৰ্য্য সহাস্যমুখে সেই বীরগণকে প্রতিগ্ৰহ করিয়া তাঁহাদের উপর অসংখ্য শর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা তৎকালে সেই মধ্যাকালীন দিনকর সদৃশ দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইলেন না। যে রূপ দিবাকর প্রখর করজালে সকলকে সন্তাপিত করেন, তদ্রূপ ধনুর্দ্ধর প্রধান দ্রোণ শরনিকরে সেই বীরগণকে সন্তপ্ত করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ পঙ্ক নিমগ্ন মাতঙ্গের ন্যায় কাহারই আশ্রয় লাভে সমর্থ হইলেন না। সূর্যের করজাল সদৃশ দ্রোণাচার্য্যের শরজাল পাণ্ডব সৈন্যগণকে সন্তাপিত করিয়া ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইল। ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রিয় পাঞ্চাল দেশীয় সুবিখ্যাত পঞ্চবিংশতি মহারথ দ্রোণশরে কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। মহাবীর দ্রোণাচার্য্য পাণ্ডব ও পাঞ্চাল সৈন্যগণ মধ্যে প্রধান প্রধান বীর বিনষ্ট করিয়া ফেলিলেন। তিনি এক শত কৈকেয়কে বিনষ্ট ও অন্যান্য সকলকে ইতস্তত বিদ্রাবিত করিয়া ব্যাদিতানন কৃতান্তের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। পাঞ্চাল, সঞ্জয়, মৎস্য ও কৈকয় দেশীয় অসংখ্য বীরগণ তাঁহার শরে ক্ষত বিক্ষতাঙ্গ ও পরাজিত হইয়া অরণ্য মধ্যে হুতাশন পরিবেষ্টিত বনবাসিগণের ন্যায় আর্ত্তস্বর পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিল। তখন সমর দর্শনার্থ সমাগত দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব ও পিতৃগণ কহিতে লাগিলেন, ঐ দেখ সমস্ত পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ সৈন্য মণ্ডলী সমভিব্যাহারে পলায়ন করিতেছেন।

অর্জ্জুনসাহায্যার্থ যুধিষ্ঠিরের সাত্যকি আমন্ত্রণ

হে মহারাজ! মহাবীর দ্রোণাচার্য্য যখন শত্রু সংহারে প্রবৃত্ত হইলেন, তৎকালে কেহই তাহার সম্মুখীন হইতে বা তাঁহাকে শর বিদ্ধ করিতে সমর্থ হন নাই। দ্রোণের সহিত পাণ্ডবগণের এই রূপ বীরক্ষয়কর ভয়ঙ্কর সংগ্রাম হইতেছে, এমন সময় পাঞ্চজন্য শঙ্খের শব্দ সহসা যুধিষ্ঠিরের শ্রবণগোচর হইল। ঐ শঙ্খ বাসুদেবের মুখমারুতে পুরিত হইয়া ঘোরতর শব্দ করিতে লাগিল। ঐ সময় জয়দ্রথ রক্ষক বীর সকল সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এবং ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ অর্জ্জুনের রথাভিমুখে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতেছিলেন; সুতরাং তাঁহার গাণ্ডীব নির্ঘোষ এককালে তিরোহিত হইয়া গেল। তখন ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির বাসুদেবের শঙ্খনিস্বন ও কৌরবগণের সিংহনাদ শ্রবণে বিষন্ন হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, যখন পাঞ্চজন্য নির্ঘোষ শ্রুতিগোচর হইতেছে এবং কৌরবগণ হৃষ্টান্তঃকরণে বারংবার সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতেছে, তখন নিশ্চয়ই অর্জ্জুনের কোন অমঙ্গল ঘটিয়াছে। ধর্ম্মরাজ আকুলিত চিত্তে এই রূপ চিন্তা করিয়া মুহুর্মুহু মোহে অভিভূত হইয়াও তৎকাল কর্ত্তব্য কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান নিমিত্ত বাষ্পগদ্‌গদ বচনে সাত্যকিকে কহিলেন, হে শৈনেয়! পূর্ব্বে সাধু ব্যক্তিরা যুদ্ধ সময়ে সুহৃৎগণের কর্ত্তব্য বিষয়ে যাহা নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন, এক্ষণে সেই কাৰ্য্য অনুষ্ঠানের সময় উপস্থিত হইয়াছে। হে মহাত্মন্! আমি সম্যক্ অনুসন্ধান করিয়া সমুদায় যোদ্ধাদিগের মধ্যে তোমার তুল্য প্রিয়সুহৃৎ আর কাহারেও দেখিতে পাই না। হে শিনিপুঙ্গব! যে ব্যক্তি নিরন্তর প্রসন্ন চিত্ত ও অনুগত থাকে, আমার বিবেচনায় তাঁহকেই যুদ্ধে নিয়োগ করা কর্ত্তব্য। তুমি কৃষ্ণের ন্যায় বলবীর্য্য সম্পন্ন এবং তাঁহারই ন্যায় নিরন্তর আমাদিগকে আশ্রয় প্রদান করিয়া থাক। অতএব আমি তোমার প্রতি যে ভারার্পণ করিতেছি, তুমি তাহা বহন কর; আমার অভিলাষ নিষ্ফল করিও না। মহাবীর অর্জ্জুন তোমার ভ্রাতা, বয়স্য ও গুরু; অতএব তুমি বিপকালে তাঁহার সাহায্য কর! তুমি সত্যব্রত, মহাবল পরাক্রান্ত ও মিত্রগণের প্রিয়দর্শন এবং স্বীয় কার্য্য প্রভাবে লোক মধ্যে সত্যবাদী বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছ। হে শিনিবংশাবতংস! যে ব্যক্তি মিত্ৰাৰ্থ যুদ্ধ করিয়া কলেবর পরিত্যাগ করেন, আর যিনি ব্রাহ্মণগণকে সমুদায় পৃথিবী দান করেন, তাঁহাদের উভয়েরই সমান ফল লাভ হয়। আমরা শ্রবণ করিয়াছি, অনেকানেক মহীপাল যজ্ঞানুষ্ঠান পূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে সমুদায় পৃথিবী দান করিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন; এক্ষণে তুমি সংগ্রামে সুহৃদের সাহায্য করিয়া পৃথিবী দান তুল্য অথবা তদপেক্ষা অধিক ফল লাভ কর। আমি কৃতাঞ্জলিপুটে তোমার নিকট এই প্রার্থনা করিতেছি। হে সাত্যকে! কেবল মহাবাহু বাসুদেব ও তুমি তোমরা দুই জনে মিত্রগণের অভয়প্রদ হইয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া থাক। আর দেখ, বীরপুরুষই মহাবল পরাক্রান্ত সংগ্রামে যশোলাভার্থী বীরপুরুষের সহায় হইয়া থাকেন, প্রাকৃত ব্যক্তি কদাচ তদ্বিষয়ে সমর্থ হয় না। অতএব এই বিপদ সময়ে তোমা ভিন্ন অন্য কাহাকেও অর্জ্জুনের রক্ষক দেখিতেছি না।

হে বীর! ধনঞ্জয় আমার হর্ষবর্দ্ধন পূর্ব্বক বারংবার তোমার কার্য্যের শ্লাঘা করিয়া থাকেন। একদা তিনি দ্বৈতবনে সজ্জনসমাজে তোমার পরোক্ষে তোমার প্রকৃত গুণকীর্ত্তন করিয়া আমাকে কহিয়াছিলেন। মহারাজ! সাত্যকি লঘুহস্ত, অসাধারণ পরাক্রমশালী, চিত্রযোধী, প্রাজ্ঞ, সৰ্বাস্ত্রবেত্তা ও মহাবীর; তিনি যুদ্ধে কদাচ বিমোহিত হন না। ঐ বিশালবক্ষ বৃষস্কন্ধ মহাবল পরাক্রান্ত মহারথ আমার শিষ্য ও সখা। আমি তাঁহার প্রিয়পাত্র এবং তিনিও আমার নিতান্ত প্রিয়তম। তিনি আমার সহায় হইয়া কৌরবগণকে প্রমথিত করিবেন। যদি মহাবীর কৃষ্ণ, রাম, অনিরুদ্ধ, প্রদ্যুম্ন, গদ, সারণ ও সাম্ব এবং সমুদায় বৃষ্ণিবংশীয়গণ রণস্থলে আমার সাহায্য করেন, তথাপি আমি নরশ্রেষ্ঠ সত্যবিক্রম সাত্যকিকে সাহায্যার্থ নিয়োগ করিব। তাঁহার সমান যোদ্ধা আর কেহই নাই। হে সাত্যকি! ধনঞ্জয় এইরূপ তোমার গুণকীর্ত্তন করিয়া থাকেন; অতএব তুমি সেই অর্জ্জুনের, ভীমের ও আমার এই মনোরথ নিস্ফল করিও না। আমি তীর্থ পর্য্যটন প্রসঙ্গে দ্বারকায় সমুপস্থিত হইয়া অর্জ্জুনের প্রতি তোমার দৃঢ়ভক্তি নিরীক্ষণ করিয়াছি। বিশেষত এক্ষণে আমাদের এই বিপদকালে তুমি যেরূপ সখ্যভাব প্রদর্শন করিতেছ, আমি অন্য কাহাতেও সেরূপ অবলোকন করি না। তুমি সদ্বংশম্ভূত, একান্ত ভক্ত, সত্যবাদী ও মহাবল পরাক্রান্ত; অতএব এক্ষণে স্বীয় সখা বিশেষত আচাৰ্য্য ধনঞ্জয়ের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত আপনার অনুরূপ কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। দুৰ্য্যোধন দ্রোণ প্রদত্ত কবচ ধারণ করিয়া সহসা অর্জ্জুনের সমীপে গমন করিয়াছে এবং কৌরব পক্ষীয় অন্যান্য মহারথ সকল পূর্ব্বেই তথায় সমুপস্থিত হইয়াছেন। ঐ দেখ, অর্জ্জুনের রথাভিমুখে মহান্ কোলাহল সমুত্থিত হইয়াছে; অতএব সত্বরে তথায় গমন করা তোমার কর্ত্তব্য। যদি মহাবীর দ্রোণ তোমাকে আক্রমণ করেন, তাহা হইলে আমরা ভীমসেন ও সেনাগণ সমভিব্যাহারে তাঁহাকে নিবারণ করিব।

হে শৈনেয়! ঐ দেখ, কৌরবসৈন্যগণ সমর পরিহারপূর্ব্বক মহাকোলাহল করিয়া পলায়ন করিতেছে। উহারা পূর্ব্বকালীন বায়ুবেগ বিক্ষুব্ধ মহাসাগরের ন্যায় মহাবীর ধনঞ্জয় কর্ত্তৃক ছিন্ন ভিন্ন হইয়াছে। ঐ দেখ, অসংখ্য মনুষ্য, অশ্ব ও রথ ধাবমান হওয়াতে ধূলি পটল উড্ডীন হইয়া চারিদিক্‌ সমাচ্ছন্ন করিতেছে। মহাবীর অর্জ্জুন তোমর ও প্রাসধারী মহাবল পরাক্রান্ত সিন্ধু সৌবীরবৃন্দে পরিবৃত হইয়াছেন। উহাদিগকে নিবারণ না করিয়া জয়দ্রথকে পরাজয় করা অসাধ্য হইবে; উহারা জয়দ্রথকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিবে। ঐ দেখ, শর, শক্তি, ধ্বজ সম্পন্ন, অশ্ব নাগ সমাকুল নিতান্ত দুরভিগম্য কৌরবসৈন্য রণস্থলে অবস্থান করিতেছে। দুন্দুভিনির্ঘোষ, গভীর শঙ্খধ্বনি, সিংহনাদ, রথ চক্রের ঘর্ঘর শব্দ, করিবৃংহিত ও শতসহস্র পদাতিগণের পদ শব্দ শ্রবণগোচর হইতেছে। ঐ দেখ, হস্তিপকেরা ধরাতল বিকম্পিত করিয়া ধামান হইয়াছে। ঐ অগ্রে সৈন্ধবসৈন্য, পশ্চাদ্ভাগে দ্রোণ সৈন্য অবস্থান করিতেছে। উহাদের সংখ্যা এত অধিক যে, উহারা দেবরাজ ইন্দ্রকেও নিপীড়িত করিতে অসমর্থ নহে। মহাবীর অর্জ্জুন এই অসীম সৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, সুতরাং তাঁহার প্রাণ বিয়োগের বিলক্ষ্মণ সম্ভাবনা। অর্জ্জুন বিনষ্ট হইলে আমি কি রূপে প্রাণ ধারণ করিব। হে শৈনেয়! এক্ষণে তুমি জীবিত থাকিতেও আমাকে এই কষ্ট সহ্য করিতে হইল। প্রিয় দর্শন অর্জ্জুন সূর্য্যোদয়কালে কৌরবসৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছেন; এক্ষণে দিবাও প্রায় অতিবাহিত হইল। মহাবীর অর্জ্জুন এখন জীবিত আছেন কি না, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। কৌরব বল সাগর তুল্য, উহা দেবগণেরও দুরধিগম্য। অর্জ্জুন একাকী তাঁহার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন। তাঁহার বিপদ আশঙ্কা করিয়া এক্ষণে এই যুদ্ধবিষয়ে কিছুতেই আমার বুদ্ধি ঘূর্ত্তি হইতেছে না। ঐ দেখ মহাবীর দ্রোণাচার্য্য সংগ্রামে নিতান্ত সমুৎসুক হইয়া তোমার সমক্ষে আমার সৈন্য পীড়ন করিতেছেন। হে শৈনেয়! তুমি দুর্বোধকাৰ্য্য সমুদায় অবধারণ করিতে বিলক্ষ্মণ সমর্থ; এক্ষণে যাহা শ্রেয়স্কর হয়, তাহার অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। কিন্তু আমার সকল কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া অগ্রে অর্জ্জুনকে পরিত্রাণ করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। আমি লোকপালক জগৎপতি বাসুদেবের নিমিত্ত কিছুমাত্র শোক করি না। আমি নিশ্চয় কহিতেছি তিনি এই দুর্ব্বল ধাৰ্তরাষ্ট্র বলের কথা দূরে থাকুক, ত্রিজগৎ একত্র সমবেত হইলেও তাহা পরাজয় করিতে পারেন। মহাবীর অর্জ্জুন সমরাঙ্গনে বহুসংখ্য যোদ্ধাদিগের শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া পাছে প্রাণ পরিত্যাগ করেন, এই চিন্তা করিয়া আমি মোহে একান্ত অভিভূত হইতেছি। অতএব তুমি আমার বাক্যানুসারে অর্জ্জুনের অনুসরণ কর। তোমার সদৃশ মহাবীরগণেরই অর্জ্জুনের রক্ষাৰ্থ গমন করা কর্ত্তব্য। হে মহাত্মন্! বৃষ্ণিবংশীয় দিগের মধ্যে মহাবাহু প্রদ্যুম্ন ও তুমি তোমরা উভয়েই অতিরথ বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছ। তুমি অস্ত্রবলে নারায়ণ তুল্য, বাহুবলে বলদেব সদৃশ ও পরাক্রম প্রকাশে অর্জ্জুনের সমান। সাধুলোকেরা, সাত্যকির অসাধ্য কিছুই নাই, তিনি সর্ব্বযুদ্ধ বিশারদ, ভীষ্ম ও দ্রোণ অপেক্ষাও প্রভাবসম্পন্ন; এই বলিয়া তোমার প্রশংসা করেন অতএব আমি যাহা বলিতেছি, তুমি তাহারই অনুষ্ঠান কর। জনগণের অর্জ্জুনের ও আমার অভিলাষ নিষ্ফল করা তোমার কর্ত্তব্য হইতেছে না। এক্ষণে প্রিয়তর প্রাণ রক্ষণে নিরপেক্ষ হইয়া বীরের ন্যায় রণস্থলে বিচরণ কর। হে শৈনেয়! যাদবগণ কদাচ সমরে প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত যত্ন করেন না। রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া যুদ্ধ না করা, অন্তরালে থাকিয়া যুদ্ধ করা ও সমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করা যাদবগণের অভ্যস্ত নহে। ঐ সমুদায় ভীরু স্বভাব অসৎ লোকেরই কার্য্য। ধর্ম্মাত্মা ধনঞ্জয় তোমার গুরু এবং বাসুদেব তোমার ও অর্জ্জুনের গুরু; আমি এই নিমিত্তই তোমাকে অর্জ্জুনের নিকট গমন করিতে অনুরোধ করিতেছি। আমি তোমার গুরুর গুরু; অতএব আমার বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শন করা তোমার কর্ত্তব্য নয়। হে শৈনেয়! আমি তোমাকে যাহা কহিলাম, ইহা বাসুদেব ও অর্জ্জুনের অনুমোদিত; অতএব এ বিষয়ে আর অণুমাত্র সংশয় করিও না। এক্ষণে তুমি দুৰ্ম্মতি দুৰ্য্যোধনের সৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক ন্যায়ানুসারে মহারথগণের সহিত সমাগত হইয়া যথোচিত কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও’।”