১০. শিলং-এ আসিয়াই আলাপ

শিলং-এ আসিয়াই আলাপ হইল মিঃ রায়ের সহিত। রূপবান্ যুবক। সঙ্গীতে তাহাব অসমান্য অনুরাগ; আই-এ-এস্ পাশ করিয়া আসিয়াছেন, শীঘ্রই কার্যে যোগদান করিবেন।

মিঃ চ্যাটার্জী সাদরে তাহাকে ডাকিয়া আনিয়া কন্যার সহিত আলাপ করাইয়া দিলেন। তপতী মাকে বলিয়াছে,—যদি সে একান্তই না আসে —আমাকে বিবাহিতা বলে পরিচয় দেবার কি দরকার এখানে—মা-বাবা কোনো উত্তর দেন নাই। তপতী মিস চ্যাটার্জী নামেই সম্বােধিতা হইতেছে। মিঃ রায়ও তাহাই জানিয়া রহিলেন।

কয়েদিনের মধ্যেই মিঃ রায়-এর অসামান্য বাকপটুতা, অনুপম সঙ্গীত কুশলতা এবং বিলাতী ধরণধারণের গুণে তপতীর জুবাক্রান্ত মনটা শীতলতার দিকে নামিতে লাগিল। রোজই তাহারা দল বাঁধিয়ে বেড়াইতে যায়—পাহাড়ের গাম্ভীর্য, ঝরণার চাপল্য, পাইন বনের শ্যামল সুষমা চোখ জুড়াইয়া দেয়, মন ভরাইয়া তুলে।

পূজার সময় শিলং-প্রবাসী বাঙালীগণ একটি অভিনয়ের ব্যবস্থা করিয়াছেন; তপতী দুদিনেই তাহার নেত্রী হইয়া পড়িল। এসব কাজে সে চিরদিন দক্ষ। তাহার পটুতা মিঃ রায় দুই চোখ ভরিয়া দেখেন আর বলেন-দি এঞ্জেল অব পাইন-বন-দি ডিভাইন নাইটিংগেল …

তপতী রুমাল দিয়া তার গায়ে হাল্কা আঘাত করিয়া বলে নটি বয়!…

অভিনয়ের আয়োজন সমারোহে চলিতেছে; বিজয়ার দিন অভিনয়। কল্যাণী দেবী কহিল, মিস চ্যাটার্জীর সঙ্গে মিঃ রায়ের বিয়ের দৃশ্যটা বড্ড হাসির।

–কেন?–প্রশ্ন করিল তপতী।

—মিঃ রায় বিলেতে কিছু করে এসেছেন কিনা, কে জানে।

–অভিনয়ে তার কি ক্ষতি হবে?–তপতী রুস্বরে প্রশ্ন করিল।

–অভিনয়টা মাঝে মাঝে সত্য হয়ে ওঠে কিনা?—কথাটা বলিয়া কল্যাণী হাসিল।

—আপনার কথাটাকে সত্যের মর্যাদা যদি উনি দেন, কল্যাণী দেবী, তাহলে আমি আপনাকে নিজের খরচে বিলেত পাঠাব এনকোয়ারী করতে বলিলেন মিঃ রায়।

মিঃ রায়ের এই কথায় সবাই হাসিল।

কল্যাণী কহিল,—আপনি তো বেশ চালাক। আমার কথাটাকে ঘুরিয়ে ওর কাছে প্রপোজ করে বসলেন? বুদ্ধি আপনার সত্যি হাকিমের মতো।

অতসী কহিল,হাকিমের আর দরকার হবে না, হুকুম তামিল করবেন এবার থেকে।

তপতী একক্ষণ চুপ করিয়াই ছিল; হঠাৎ একটু তীক্ষ্মস্বরেই কহিল,–ঠাকুরদা বলতো—যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়াপড়শীর ঘুম নেই? আপনাদের দেখছি সেই অবস্থা! কিন্তু আমার একটা কথা আছে।

সমস্বরে প্রশ্ন হইল—কি?

—বিয়ের দৃশ্যটা বাদ না দিলে নাটকের মর্যাদা থাকবে না। বিয়ের বন্ধনে ঐ নায়কনায়িকাকে বাঁধা যায় না। নাট্যকার বিয়ের কথাটা মোটে লেখেননি।

–নাটকটা ভালো বলেই আমরা নিয়েছি। কিন্তু পুজোর দিন একটা করুণ নাটক!

তপতী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল,–এই জগতে বহু মানুষের মনে ওর থেকে ঢের বেশী করুণ নাটকের অভিনয় হচ্ছে

প্রস্তাব পাস হইয়া গেল। অর্থাৎ তপতীর কথার প্রতিবাদ করিতে কেউ উৎসাহ দেখাইল না। তপতীর এরকম কথার উদ্দেশ্য কিন্তু মিঃ রায় বুঝিলেন না। মিলনের দৃশ্যটা তিনিই লিখিয়াছেন। তাহার লিখিত অংশটুকুকেই তপতী পরিত্যাগ করিল কেন?

তপতীকে বাড়ী পৌঁছাইবার পথে একখণ্ড শিলাসনে বসিয়া তিনি প্রশ্ন কবিলেন, বিয়ের দৃশ্যটা কেন বাদ দিলেন, মিস চ্যাটার্জী?

তপতী আর্টের দোহাই দিয়া কহিল,–ও বই কেন ধরলেন? আর কি বই ছিল না? জ্যোতি গোস্বামীর বই অভিনয় করা অত্যন্ত কঠিন।

বহুদিনের বিরহের পর প্রিয় মিলনের দৃশ্যটা ভালই জমতো।

না, জমতো না। যাদের এতটুকু কলারস জ্ঞান আছে, তারা বলবে নাটকটাকে খুন করা হয়েছে।

কিছুক্ষণ মিঃ রায় চুপ করিয়া রহিলেন। বহুদিন তিনি বিলাতে থাকায় বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানেন না; প্রশ্ন করিলেন, জ্যোতি গোস্বামী পুরুষ না মেয়ে? খুব ভালো লেখে বুঝি?

জানি না। কিন্তু লেখে অদ্ভুত। বই এর নামও অদ্ভুত মুক্তির বন্ধন।

মিঃ রায় আশ্বস্ত হইলেন। আর্ট না ক্ষুন্ন করার জন্যই বোধ হয়, তপতী তাহার লিখিত অংশটি হাঁটিয়া দিল, তপতীর হাতের মালা তিনি সেদিন পাইবেন না। বাট ইফ গ্রেশাস গড্‌ উইলস..

বাড়ি ফিরিয়া আপন কক্ষে একাকী বসিয়া তপতী ভাবিতে লাগিল, মিঃ রায় বেশ সুন্দর ছেলে। উহাকে বিবাহ করা যাইতে পারে, অবশ্য তার পূর্বে তপনের সহিত বিবাহ-বিচ্ছেদটা আইন-সিদ্ধ করা দরকার। যে আশা সে এতকাল পোষণ করিয়াছে, তপনকে তাড়াইয়া তাহাই ফলবতী হইয়া উঠিল! এ ভালোই হইল। তপনের মতো একজন নিতান্ত গোঁড়া অদ্ভুত-প্রকৃতির লোক লইয়া সে করিবে কি? তাহার বর্তমানের শিক্ষা-দীক্ষা মোটেই তপনের উপযুক্ত নয়। মিঃ রায়ই তাহার ভালো।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি করিবার কি আছে? কলিকাতা গিয়া আগে বিবাহ বিচ্ছেদটি পাকা করিয়া লওয়া যাক—তারপর মিঃ রায়কে আরো একটু ভালো করিয়া বোঝা যাক, এম, এ পড়াটাও শেষ হইয়া যাক—পরে দেখা যাইবে।

মিঃ রায় কিন্তু বড়ই ব্যস্ত হইয়াছেন। আজই তো তিনি প্রায় বলিয়া ফেলিয়াছেন। ইহার মূলে শুধুই কী তপতীর রূপগুণ? না, আরো কিছু আছে, তাহার বাবার টাকা, যে, টাকা জন্য তপনকে তাড়াইয়া দিয়াছে তপতী! কিন্তু এ ভাবনাও ভাবিয়া লাভ নাই। যে তাহাকে বিবাহ করিবে, সেই তাহার বাবার টাকা পাইবে। মিঃ রায় কৃতবিদ্য ব্যক্তি, তিনি তো অশিক্ষিত তপন নন! টাকার তোয়াক্কা তিনি নিশ্চয়ই রাখেন না! মুখে পাউডারের পাফটা আর-একবার বুলাইয়া লইয়া ৩গতী মার কাছে আসিল।

মা কন্যার পরিবর্তন লক্ষ্য করিতেছে, কহিলেন,–ততার গলায় ইংরাজী গানগুলো বেশ মিষ্টি লাগে, খুকী! কটা শিখলি?

—শিখেছি তিন চারটা। মিঃ রায়ের শেখাবার পদ্ধতিটা বেশ মা, চটপট শেখা যায়।

মা খুশী হইয়া কহিলেন, বেশ ছেলেটি। কথাবার্তা চালচলন চমৎকার। তপতী বিদ্রূপ করিয়া কহিল, তোমার তপনের চেয়ে নাকি! মা ব্যথিত হইয়া কহিলেন, তার কথা কেন, খুকী। সে তো সব ছেড়ে চলে গেছে।

তপতী বলিল—এখনও বিচ্ছেদটা কোর্ট থেকে পাকা হয়নি। তুমি তো বোকা মেয়ে, বোঝে কচু। দুলাখ টাকায় ওর পেট ভরেনি, আরো অত্যন্ত লাখ-খানেক চায়—তাই মুক্তিপত্রটা এখনও হাতে রেখে দিয়েছে।

মা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন,—যাকগে খুকী—যেতে দে।

টাকাটাই ওর লক্ষ্য ছিল, মা। আমি যে ওকে নেবো না, সেকথা ওকে প্রথম দিনই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম ঘর থেকে বার করে দিয়ে। লোকটা এতবেশী চালাক যে, সাত মাস ধরে অভিনয় করে তোমাদের ঠকিয়ে গেল। মাসোহারার টাকাটা তোমার কাছে জমা রেখে ও বোঝালে, কারও দান ও নেয় না,আর বোকা তোমরা দুলাখ টাকা দিয়ে দিলে—একটা হিসাব পর্যন্ত চাইলে না।

—কিন্তু অফিসের কেরানীটাকে রক্ত দেওয়া?

তপতীর একটা খটকা লাগিল। পরমুহূর্তেই তাহার তীক্ষ্মবুদ্ধি তাহাকে সাহায্য করিল, কহিল,—ও একটা মস্ত চাল! অফিসের টাকায় তাকে হাসপাতালে রেখেছে—শিখিয়ে দিয়েছে ঐ কথা বলতে, কিংবা দিয়েছে একটু রক্ত, তাতেই কি! শরীরটায় তো রক্তের তার অভাব নেই–যা খাওয়া তুমি খাওয়াতে ওকে!—তপতী আপনার কথায় আপনি হাসিয়া উঠিল।

মারও মনে হইতেছে, হয়তো ইহাই সত্য হইবে। তথাপি তিনি বললেন–না চলে গেলেও পারতো?

–না, ধরা ও পড়াতেই; তাই জেলে যাবার ভয়ে পালিয়েছে দেশ ছেড়ে বিস্তর বাংলা বই ও পড়েছে, বুঝলে মা? বাংলা কথা কইলে ওকে কিছুতেই ধরা যায় না।

মা সত্যই আজ বিভ্রান্ত হইয়া উঠিলেন। তপন কি তাঁহাদের এমনি ভাবে সত্যই ঠকাইয়াছে।

তপতী আহার সাবিয়া শয়নকক্ষে গেল। শয়নের বেশ পরিধান করিতে গিয়া সে আপনাকে বারবার নিরীক্ষণ করিল দর্পণে। নিটোল কপোল আবার রক্তাভ হইয়া উঠিতেছে। কটাক্ষের বিদ্যুত আবার ফিরিয়া আসিয়াছে পূর্বের মতো! মসৃণ বাহুতে তরঙ্গারিত হইতেছে দেহের দ্যুতি। রক্তরাঙা ঠোটা উল্টাইয়া তপতী আপন মনে বলিল-এই ওষ্ঠে যে প্রথম প্রেমচুম্বন আঁকিবে সে তপন নয় ..

ওঃ কি দারুণ ভুল সে করিতে বসিয়াছিল! শরীরটা তাহার ভাঙিয়া গিয়াছিল আর কি! প্রথম জীবনের প্রণয়োচ্ছাস! বোকামী আর কাহাকে বলে? সেই ভণ্ডটার জন্য জন্য প্রাণ দিতে বসিয়াছিল তপতী। গান গাহিতে গাহিতে তপতী শুইয়া পড়িল-হোয়েন দাই বিলাভেড় কামস…

অভিনয়ের দিন আর-একবার মিঃ রায় অনুরোধ করিলেন শেষ দৃশ্যটা জুড়িয়া দেবার জন্য। কিন্তু তপতী দৃঢ়স্বরে কহিল,না। তাহলে আমি অভিনয় করবো না—বিয়ের বন্ধন আমি সইতে পারিনে।

সকলেই আশ্চৰ্য্যন্বিত হইয়া কহিলেন,—অর্থাৎ! বিয়ে আপনি করবেন না নাকি?

কলহাস্যে সকলকে চমকাইয়া দিয়া তপতী কহিল,—বিয়ের চেয়ে বড় কিছু আমি করতে চাই।

মিঃ রায় কহিলেন,—আইডিয়াটা চমৎকার, কিন্তু কী সেটা?

—যিনি আমার বিয়ে করবেন, তিনিই সেটা আমায় বলবেন… মিঃ রায় ব্যাকুল হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, তা কি হইতে পারে? বিবাহের চেয়ে বড় তো প্রেম! কহিলেন,—প্রেম!

—আমি পাদরী নই যে যিশুকে প্রেম নিবেদন করব।

সকলেই হাসিয়া উঠিল। মিঃ রায় আরো খানিক ভাবিয়া বলিলেন,–বুঝেছি। আপনার ইচ্ছে কম্প্যানিয়েট ম্যারেজ।

হো হো করিয়া হাসিয়া তপতী কহিল,—আপনার বুদ্ধিতে কুলোবে না, মিঃ রায়, চুপ করুন।

চারদিক অন্ধকার দেখিয়া মিঃ রায় থামিয়া গেলেন।

তপতী কহিল, আমিই বলে দিচ্ছি, শুনুন। বিবাহের চেয়ে বড় হচ্ছে অবিবাহিত ছেলেদের মাথাগুলো চিবিয়ে খাওয়া!

হাসিয়া কল্যাণী কহিল,–ওটা বুঝি এখন আস্বাদন করছিস?

-চুপ কর, লক্ষ্মীছাড়ি! ওর মাথায় গোবরের গন্ধ!

সকলেই হাসিয়া উঠিল। মিঃ রায়ও হাসিলেন। কিন্তু তপতীকে তাহার অত্যন্ত দুর্বোধ বোধ হইতেছে। উহার মনের ইচ্ছাটা কী?

অভিনয় হইয়া গেলে তিনি খানিকটা পথ তপতীর সহিত আসিতে আসিতে কহিলেন,—বিয়ে কি আপনি সত্য করবেন না মিস্ চ্যাটার্জী?

—আমার বাবার ঠিক করা আছে একটি ছেলে। তাকে যদি বিয়ে না করি তোল, আপনার কথাটা তখন ভেবে দেখব।

মিঃ রায় কথা শুনিয়া দমিয়া গেলেন। আরো কিছুটা আসিয়া তিনি বিদায় লইলেন।

তপতী হাসিয়া উঠিল আপন মনে। এক ঢিলে দুই পাখী সে মারিয়াছে। কৌশলে সে মিঃ রায়কে জানাইয়া দিলো, বিবাহিতা না হইলেও, স্বামী তাহার ঠিক করা আছে—তপনে কথাটা প্রকাশ পাইলেও আর বেশী ভয়ের কারণ থাকিবেনা; দ্বিতীয়ত, মিঃ রায়ের অন্তরে তপতী আরো গভীর ভাবে আসন গড়িবে কিংবা মিঃ রায় তাহাকে ভুলিতে চাহিবেন।তপতী পরীক্ষা করিয়া লইতে চায়। আর সে ঠকিবেনা। অবশ্য মিঃ রায়কে বিবাহ করিতে তপতীর কিছুমাত্র আপত্তি হইতে পারে না; তথাপি মিঃ রায়ের দিকটাও সে ভালো করিয়া জানিয়া লইতে চায়! কারণ এ বিবাহ অন্তরের নয় বাহিরের।

পরদিন সকালে আসিল একখানি চিঠি—মার নামে–

বিজয়ার সংখ্যাতীত প্রণামান্তে, নিবেদন, মা, আপনাদের অপরিশোধ্য স্নেহঋণের বিনিময়ে কিছুই আমি দিতে পারিনি। অভাগা ছেলেকে মার্জনা করিবেন।

ইতি–প্রণতঃ তপন

 

মা চিঠিখানার দিকে চাহিয়াই রহিলেন। কলকাতার একটা ঠিকানা রহিয়াছে! ঐখানে হয়তো আছে সে। উঠিয়া তিনি স্বামীকে গিয়া কহিলেন—আসতে টেলিগ্রাম করে দাও, খুকীর সঙ্গে একটা শেষ বোঝাপড়া হয়ে যাক। আর, মুক্তিনামাও তো লিখিয়ে নেওয়া চাই একটা?

মিঃ চ্যাটার্জী খানিক ভাবিয়া বলিলেন—খুকীকে জিজ্ঞাসা করেছো? কী বলে সে?

–না, ওকে জিজ্ঞাসা করবার দরকার নেই। টেলি করে দাও এক্ষুনি প্রি-পেড।

তৎক্ষণাৎ টেলিগ্রাম করা হইল। উত্তরে তপন জানাইল যে সে ত্রয়োদশীর দিন শিলং আসিবে, কিন্তু উঠিবে হোটেলে।

মা তপতীকে খবরটা জানাইলেন না। আগে আসুক তপন, মা তাহার সহিত কথা বলিবেন, তার পর যাহা হয় করা যাইবে। সত্য বলিতে কি, এখনও তপনের দিকে মন তাঁহার স্নেহাতুর হইয়া রহিয়াছে।

প্রতিদিন সকালে মিঃ রায় আসেন তপতীর সহিত বেড়াইবার জন্য। সেদিনও তপতী সাজিয়া-গুজিয়া মিঃ রায়ের সহিত বেড়াইতে গেল।

পথের ধারে একটা গাছে অজস্র ফুল ফুটিয়াছে, মিঃ রায় একটা ডাল নোয়াইয়া ধরিলেন—তপতী ফুল তুলিয়া খোঁপায় খুঁজিতে লাগিল আর দুই-চারিটা ফুল ছুড়িয়া মিঃ রায়কে মারিতে লাগিল। মিঃ রায় হাসিয়া বলিলেন,–বড্ড বেশী সুইট…

তপতী আর একগোছা ফুল ছুড়িয়া দিয়া কহিল,দেখছি কতখানি আমার ইডিয়টের উইট?

কে একজন মুটের মাথায় বাক্স-বিছানা দিয়া আসিয়া পড়িয়াছে খুব কাছে! তপতী যেন ভূত দেখিয়া চমকিয়া উঠিল—তপন। নীরবে তপন পাশ কাটাইয়া চলিয়া গেল, কিন্তু তাহার মুখের বিদ্রূপ-হাসিটা বিদ্যুতের মতোই তপতীর চোখে লাগিল। তপতী চাহিয়াই রহিল তপনের দিকে। মিঃ রায় কহিলেন,—চেনেন নাকি।

—হাঁ–বলিয়া তপতী একটা উঁচু পাথরের উপর উঠিয়া দেখিতে লাগিল তপন কোন দিকে যায়। কিন্তু পথের বাঁকে তপন অদৃশ্য হইয়াছে। নিশ্চয় তাহাদের বাড়ি যাইতেছে। তপতী ভাবিতে ভাবিতে আরো খানিক বেড়াইল। ও কেন এখানে আসিল? আর আসিয়াই দেখিল, তপতী মিঃ রায়ের সহিত কেমন স্বচ্ছন্দে খেলা করিতেছে। যদি দেখিয়াছে তো ভালো করিয়াই দেখুক। যে বিদ্রুপের হাসি সে হাসিয়া গেল, তপতী তাহাকে গ্রাহ্যমাত্ৰ করে না। হয়তো সে ভাবিয়াছিল, তাহার বিরহে তপতী বুক ফাটিয়া মরিবে! হায়রে কপাল!

তপতী মিঃ রায়কে লইয়াই গৃহে ফিরিল। ইচ্ছাটা, তপনকে ভালো করিয়াই দেখাইয়া দিবে, তপতী তাহার অপেক্ষায় বসিয়া নাই;-তাহার জীবনে সাথীর স্থান অনায়াসে পরণ করিয়া লইতে পারে।

—কৈ মা, তোমার সেই ভণ্ড ছেলেটিকে লুকালে কোথায়? বার করো!

মা বিস্মিত হইয়া বলিলেন,–তপন এল নাকি?

–হ্যাঁ। কিন্তু কৈ সে? এখানে আসেনি?

–না, হোটেলে উঠবে বলেছে। এখানে কাল আসবে বিজয়ার প্রণাম করতে।

তপতী অত্যন্ত বিস্মিত হইল। হোটেলে উঠবে কেন? এখানে আসতে তো কেহ বারণ করে নাই। মাকে শুধাইল, তুমি জানতে ও আসবে?

–হ্যাঁ, আমিই তো টেলিগ্রাম করেছিলাম আসতে। তোর সঙ্গে একটা পাকাপাকি কথা হয়ে যাক—আর মুক্তিনামাটাও করিয়েনি।

—বেশ। কিন্তু বলে রাখছি, কথা যা কইবার আমি বলবো।

মা কিছু বলিলেন না। বিকালে তপতী সুসজ্জিত হইয়া মিঃ রায় সমভিব্যাহারে চলিল তপনের সহিত দেখা করিতে হোটেলে। তাহার আর সবুর সহিতেছিল না। মিঃ রায়কে লইয়া গিয়া তপতী এখনি দেখাইয়া দিবে যে কত সহজে তাহার যোগ্য স্বামী সে লাভ করিতে পারে।

তপন একটা জানালার ধারে দাঁড়াইয়া পাইন-বনের দিকে চাহিয়া ছিল।

নমস্কার, তপনবাবু! প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, আমাদের ওখানে না-ওঠার জন্য। অনর্থক একটা ডিস্টারবেন্স ক্রিয়েট না করে ভালোই করেছেন।

তপন ফিরিয়া চাহিয়া প্রতিনমস্কার করিয়া বলিল,আসুন! মীরার কাছে শুনেছিলাম আপনি অসুস্থা। আশা করি ভালো আছেন এখন?

হ্যাঁ ভালো। আসুন মিঃ রায়, আলাপ করিয়ে দিই। এর সঙ্গে আমার হিন্দুমতে বিয়ে হয়েছিল একদিন। আর তপনবাবু, ইনি মিঃ বি. সি. রায়, আই-সি-এস বাঙলায় অনুবাদ হচ্ছে বোকা চন্দ্র রায়—তপতী হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, ওঁর সঙ্গে আমার ভাবী সম্বন্ধটা আশা করি আপনি অনুমান করতে পারছেন?

মৃদুহাসির সহিত নমস্কার করিয়া তপন বলিল, বড় সুখী হলুম, মিঃ রায়। প্রার্থনা কবি আপনাদের জীবনে যেন নেমে আসে পাইন বনের শীতল শান্তি, আর এই নিঝরিণীর নন্দিত কল্লোল। বসুন, চা খান একটু।

তপন বয়কে চা আনিতে বলিল।

আশ্চর্য!বাংলা ভাষাটা উহার কণ্ঠে কী বিদ্যুতের মতোই খেলিতে থাকে। কী কবিত্বময় ভাষা!

তপন মিঃ রায়কে বলিল, কোথায় কর্মস্থান হলো আপনার? বাঙলার বাহিরের নয় তো?

না, নদীয়ায়। বড় ম্যালেরিয়ার দেশ। তাই ভাবছি—

ম্যালেরিয়া বুভুক্ষু ব্যাধি। আপনাদের তো কিছু ভয়ের কারণ নেই?

অনুপ্রাস না দিয়ে কি আপনি কথা বলেন না, তপনবাবু? তপতী প্রশ্ন করিল।

অনুপ্রাসটা চ্যবনপ্রাসের মতো উপাদেয় আর উপকারী। তপন মৃদু হাসিল।

কথা বলার আটটি আপনি চমৎকার আয়ত্ত করেছেন। তপতীও মৃদু হাসিল।

চা আসিলে তপন স্বহস্তে তিন পাত্র প্রস্তুত করিয়া মিঃ রায়কে ও তপতীকে দুই পাত্র দিয়া নিজে এক পাত্র লইয়া। কি কথা বলিবেন মিঃ রায় বুঝিতে পারিতেছেন না। তপতীও কিছুটা উন্মনা হইয়া রহিয়াছে।

তপন কহিল,—মীরা আপনার কাছে বড় অন্যায় করেছে, আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি। আপনি শিক্ষিতা, ওর মতো একটা পন্নী-মেয়ের দোষ নেবেন না।

তপতীর বিস্ময় ক্রমাগত বাড়িয়া যাইতেছে। তপনের ইহাও কি ভণ্ডামী? সংযতকণ্ঠে কহিল, না, কিছু মনে করিনি। আপনি আমাদের ওখানে যাবেন না?

আজ একটু খাসিয়া-পল্লীতে যাবার কথা আছে, এখনি বেরুবো।

সেখানে কী দরকার? চলুন তাহলে আমরাও যাবো ঐদিকে।

তপন বিস্মিত হইল তপতীর এই আহ্বানে। কিছু না বলিয়া সে বাহির হইল উহাদের সঙ্গে। তিনজনেই নির্বাক চলিতেছে; প্রত্যেকের মন যেন একটা গভীর চিন্তায় ভারাক্রান্ত।

পথের ধারে একটা উঁচু ডালে গুচ্ছ-গুচ্ছ ফুল ফুটিয়া আছে। তপতী মিঃ রায়কে বলিল,—দিন না ফুলটা পেড়ে?—মিঃ রায় দুএকবার লাফ দিয়াও ডালটা ধরিতে পারিলেন না। আপনার চাদরের খুঁটে একটা ছোট পাথর বাঁধিয়া তপন ডালের উপর হুঁড়িল। সরু ডালটা নুইয়া পড়িতেই মিঃ রায়কে ডাকিয়া বলিল—তুলে নিন ফুলটা—মিঃ রায় ঘাড় উঁচু করিয়া ফুলটি তুলিতে যাইতেই তাহার চোখে পড়িল ডালের ঝরা একটা কুটা। মিঃ রায় ফুল না তুলিয়াই চোখে রুমাল চাপিয়া মাথা নীচু করিলেন। তপনই নিজেই শাখাসমেত ফুলটি ছিঁড়িয়া আলগোছা তপতীর হাতে ফেলিয়া দিল, তারপর পরম যত্নে রায়ের চোখের উপরের পাতাটি নীচের পাতার মধ্যে ঢুকাইয়া চোখ মর্দন করিয়া দিতেই কুটাটা বাহির হইয়া আসিল।

এখনও তপন তাহাদের উপর এতটা সহানুভূতি কেন দেখায়—তপতী ভাবিয়া পাইতেছে না। মিঃ রায়কে সে লইয়া আসিল তপনকে আঘাত করিতে, আর তপন কিনা পরম যত্নে তাহারই সেবা করিতেছে। এতটুকু বিচলিত হইল না, লোকটা আশ্চর্য!

—পাইনকন আপনার কি রকম লাগছে?—তপতী প্রশ্ন করিল নীরবতাটা অসহ্য বোধ করিয়া।

সহাস্যে তপন উত্তর দিল,–মায়ের মুখের প্রশান্ত-স্নিগ্ধতার মতো স্নেহমাখা।

দূরের একটা আবছা পাহাড়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া তপতী কহিল-ঐ পাহাড়টা?

তপন নিম্নকণ্ঠে উত্তর দিল,দুঃখের দিনে সুখের স্মৃতির মতো বিষাদময়।

কয়েকটা পুষ্পিত বৃক্ষের দিকে তাকাইয়া তপতী বলিল,–ঐ ফুলবীথিকা?

রূপসী মেয়ের সিঁথির মতোই সুন্দর সুকুমার, ওদের সীমান্তের শোভা অক্ষয় হোক!

তপতী হার মানিয়া গেল।

একটা নিঝরিণীর দিকে আঙ্গুল তুলিয়া তপতী মিঃ রায়কে কহিল—এবার আপনি বলুন ঐ ঝরণাটা কেমন লাগছে।

মিঃ রায় কহিলেন—আপনার দোদুল্যমান বেণীর মতন।

হাসিয়া তপতী কহিল,–ইউনিভার্সাল হলো না। আপনি বলুন তো তপনবাবু।

—মৌন গিরিরাজের মুখর বাণী, বিষন্না বনানীর আনন্দ-কলগান, স্থিরা ধরিত্রীর অস্থির আঁখিজল…

একটা খাসিয়া মেয়ে দূরে বসিয়া আছে, তপতী কহিল,বলুন মিঃ রায় ঐ মেয়েকে কেমন লাগছে?

মিঃ রায় বলিলেন,—ওঁর সঙ্গে এ বিষয়ে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। তবু বলছি—নির্জন পাহাড়ের পটভূমিকায় যেন একখানি জীবন্ত ছবি।

তপতী খুসী হইয়া কহিল,খুব নতুন না হলেও সুন্দর। এবং আপনারটা বলুন!তপতী অনুরোধ করিল তপনকে।

তপন কহিল,—কিন্তু আপনারও একটা বলবার আছে আশাকরি, বলুন সেটা।

তপতী কহিল—অলকার অলিন্দে বিরহিনী বধু—এবার আপনারটা বলুন।

তপন প্রশংসমান দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া কহিল চমত্তার। আমারটা আর থাক।

–না–বলুন—বলতেই হবে—তপতী খুকীর মতো আবদার ধরিল।

আমি যদি অদ্ভুত কিছু বলি?—তপন মৃদুমধুর হাসিল।

তাই বলুন-যা আপনার ইচ্ছে বলুন! তপতীর আগ্রহ অদমনীয় হইয়া উঠিতেছে।

তপন বলিল,–মরণের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস, জীবনেব যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী

সরু রাস্তাটি চলিয়া গিয়াছে খাসিয়া-পত্নীর দিকে। তপন হাসিমুখে নমস্কার জানাইয়া চলিয়া গেল। তপতী পরমাশ্চর্য্যের সহিত কবিতাটির টীকা করিতে আরম্ভ করিল মনে মনে। কী বলিয়া গেল তপন ঐ কবিতার মধ্যে? তপতী চিন্তা করিতেছে দেখিয়া মিঃ রায় কহিলেন,—ওর কবিত্ব আপনাকে মুগ্ধ করলো নাকি, মিস চ্যাটার্জী?

—-জেলাস হবেন না, মিঃ রায়। ওর কবিতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। আর ও জেলাস হয় না।

–না, না, জেলাসি কিসের? ও তো আপনাকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়েছে, ও কি যোগ্য আপনার?

তপতী তড়িতাহত হইয়া উঠিল। স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়াছে। না তপতী মুক্তি চাহিয়াছিল। চাহিবার পূর্বে সহস্র অপমান সহ্য করিয়াও তপন তাহাকে মুক্তির কথা বলে নাই। মুক্তি দিবার সময় ও বারংবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, এবং মুক্তি দিয়া অজস্র উদ্বেলিত ক্রন্দনে পরিপ্লাবিত করিয়া দিয়াছিল তাহার পূজার বেদীমূল!

তপনের অযোগ্যতা কোথায়! ঐ সুন্দর আনন্দশ্রী, ঐ অদৃষ্টপূর্ব সংযম, ঐ হীরকদীপ্ত বাক্যালাপ-তপতীর অন্তর যেন জুড়াইয়া যাইতেছে। একমাত্র অপরাধ তপনের, সে দুই লক্ষ টাকার হিসাব দেয় নাই। নাই দিল—টাকা তো সে চুরি করিয়া লয় নাই, চাহিয়া লইয়াছে।

তপতী বাড়ি ফিরিতে চাহিল। মিঃ রায় আশঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া উঠিতেছেন। তপনকে তাঁহার অত্যন্ত ভয় করিতেছে। লোকটা অদ্ভুত প্রকৃতির হিমাচলের মতো অবিচল, আবার সাগরের মতো সঙ্গীতময়। কহিলেন তিনি,আর একটু বেড়ানো যাক-না—আসুন ঐদিকে-তপতীর ভালো লাগিতেছেনা। নিতান্ত নিশ্চিন্ততায় সে যে তার শ্রেষ্ঠ সম্পদকে এমন করিয়া নিঃশেষে মুছিয়া দিতে পারে, সে কে! মানুষ না পাথর–না দেবতা?

-আর বেড়ানো মা, মিঃ রায়চলুন! বাড়ি যেতে হবে আমায়-বলিয়াই তপতী ফেরার পথ ধরিল। অগত্যা মিঃ রায়ও ফিরিলেন। সারা পথ নীরবে তপতী হাঁটিয়া আসিল; মিঃ রায়ও কোনো কথা বলিতে পারিলেন না।

রাত্রি গভীর।

আপন কক্ষে বসিয়া তপতী চিন্তা করিতে লাগিল তপনের প্রত্যেকটি ব্যবহার, প্রত্যেকটি কথা—যতদূর মনে পড়ে। মনে পড়ল, তাহাকে জন্মদিনে দেওয়া অশোকগুচ্ছের সহিত ঋষিজনোচিত আশীর্বাদ; মনে পড়িতেছে অদ্যকার কবিত্বময় আশীর্বাণী; মনে পড়িয়া গেল—জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী কি বলিয়া গেল তপন ঐ কথাটার মধ্যে? তপতীর বিরহে তপন এতটুকু বাথা পাইয়াছে, তাহা তো তপতীর কোনদিন মনে হয় নাই। কিন্তু আজিকার ঐ কথাটা হা, উহাই তপনের অন্তরবেদনার আত্ম প্রকাশ-মধুরতম, করুণতম কিন্তু বিষাক্ত জ্বালাময়।

তপতীর অন্তর তৃপ্তিলাভ করিতেছে। তপনের মর্মমাঝে তবেআজও আছেতাহার আসন।

ঠাকুরদা যদি একবার আসিয়া তপতীকে বলিয়া যান–প্রেমের নবীনতম বাণী তাহাকে শুনাইবে ঐ তপন, তবে তাহার আদরের তপতী আজ, বাঁচিয়াই যাইবে!–তপতী আচ্ছন্নের মতো শয্যায় পড়িয়া রহিল। চিন্তাশক্তি তাহার বিলুপ্ত হইয়াছে যেন!

সকালে নিয়মিত সময়ে মিঃ রায় আসিবামাত্র তপতী জানাইল, বেড়াইতে যাইবে না। মিঃ রায় অত্যন্ত ক্ষুন্ন হইয়া কহিলেন,–বেড়াইবার জন্যই তোএখানে আসা মিস চ্যাটার্জি।

—সেটা আপনাদের পক্ষে। আমার আসা অপমানের প্রতিশোধ নিতে।

—কে করেছে অপমান আপনাকে? মিঃ রায় অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন।

–ঐ তপন! ও আমার নারীকে নির্মমভাবে পদদলিত করেছে; আমার প্রেমধারাকে পাষাণের মতো প্রতিহত করছে, আমার বন্ধনকে বিদায়ের নমস্কারে বঞ্চিত করেছে বলে গেছে-আমার বিদায় অশ্রু রাখিলাম, লহো নমস্কার।

তপতী হু হু করে কাঁদিয়া ফেলিল। বিস্ময়-সমুদ্রে নিমজ্জিত মিঃ রায় নির্বাক হইয়া গেলেন। তপতী আত্মসম্বরণ করিয়া কহিল,—বিকালে আসবেন, মিঃ রায়! ও আসবে সেই সময়। আর শুনে রাখুন, ওকে আমি আজও ভালবাসি, আমার শিরার শোণিতের মতো-বুকের স্পন্দনের মতে,—জীবনের যাতনার মতো।

তপতী চলিয়া গেল অন্যত্র। মিঃ রায় মিনিটখানেক দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন। বুঝিলেন, তপতী তাঁহার আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।

বিকালে সুসজ্জিতা তপতী বেণী দোলাইয়া বসিয়া রহিল তপনের অপেক্ষায়। কয়েকটি নারী এবং পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে মিঃ রায়ও শেষ চেষ্টা দেখিতে আসিয়াছেন। তপতী বললে,–ওকে যে ঠকাতে পারবে, তাকে পুরস্কার দেবো।

সলিলা বলিল,–ভারি তো! একটা পুরুষকে ভেড়া বানাতে কতক্ষণ লাগে?

মাধুরী বলিল,–অত্যন্ত সহজে জব্দ করে দিচ্ছি-দাঁড়া।

মিনতি বলিল,–পদ্মবনে পথভ্রান্ত পথিক করে ছাড়বো ওকে। কাটার ঘায়ে মূর্চ্ছা যাবে।

তপতী বলিল,–ও কিন্তু তপন, পদ্মরাই ওর পানে চেয়ে থাকে।

মিঃ রায় দ্রুকুটি করিলেন তপতীর শ্রদ্ধাভরা কথা শুনিয়া। বলিলেন,–গোলাপবাগে গুবরে পোকার মতো করতে পারলে তবে জানি।

তপতী মিঃ রায়ের অন্তরের ঈর্ষা ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, গোলাপবাগের ও গোপন মধুকর, গুবরে পোকার মতো ও ভ্যাভ্যানায় না! ও থাকে গোপন অন্তঃপুরে!

এমনভাবে কথা বলিতে পারিয়া তপতী যেন অত্যন্ত তৃপ্ত হইয়া গিয়াছে, এমনই দেখাইতেছে তাহার চোখ দুটি। আপনার অজ্ঞাতসারেই তাঁহার কণ্ঠে যেন আজ তপনের ভাষার মাধুরি ঝরিতেছে। ইহাই কি বৈষ্ণব সাহিত্যের অনুখন মাধব সোঙরিতে সুন্দরী ভেলি মাধাই।

মিঃ রায় বিপদ বুঝিয়া কথা বন্ধ করিয়া দিলেন।

তপন আসিয়া প্রথমেই বাড়ি ঢুকিয়া মিঃ চ্যাটার্জী ও মিসেস চ্যাটার্জীর পাবনা করিল। অতঃপর সকলকে বিনীত নমস্কার জানাইয়া আসনে বসিল।

প্রথমালাপের পর সলিলা বলিল, আপনার কথা অনেক শুনেছি, চোখে দেখে মনে হচ্ছে আপনি যাদুকর।

—আমার ভাগ্যটাকে অন্যের ঈর্ষার বস্তু করে তুলবেন না, মিস গুপ্তা, জগতে যাদুকরের আদর এখনও রয়েছে।

কিন্তু আপনিই-বা অনাদৃত কিসে?

-না–তবে, আদরটা আমার সহ্য হয় না-তুষারের পরে যথা রৌদের আদর উত্তপ্ত বালুতে যথা আদর অশ্রুর।

কথাটার কোথায় যেন বেদনার ইঙ্গিত রহিয়াছে। একটা হাসির কিছু আলোচনা হইলেই ভালো হয়। মাধুরী বলিল, ওসব কথা থাক, চায়ের মজলিসে হাসির গল্পই জমে ভালো।

মিঃ রায়ের পটুতা এ-বিষয়ে সর্বজনবিদিত; কহিলেন, রাইট, হাসি সব সময়ে কাম্য।

অন্যপ্রান্ত হইতে তপতী কহিল, সবারই মন সমান নয়। মানুষকে মানুষ করতে কান্নাই সক্ষম। আপনার মতটা কি বলুন তো? তপতী সাগ্রহে চাহিল তপনের পানে।

বিস্মিত তপন ভাবিয়া পাইলনা, তপতী তাহাকে লইয়া আজ কী খেলা খেলিবে। তপতী আজ অত্যন্ত দুর্বোধ্য। মৃদুহাস্য সহকারে সেকহিল ওঁর মতটাকেই তো প্রাধান্য দেওয়া উচিত আপনার।

সুমিষ্ট একটা ধমক দিয়া তপতী কহিল, চুপ। আমার মত কারও মতের অপেক্ষা রাখে। আমার মত আমার স্বাতন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত, মুক্ত স্বাধীন,বলুন এবার আপনারটা

আরো বিস্মিত হইয়া তপন ধীরে ধীরে কহিল, আমার মতে, হাসির মধ্যে কান্না আর কান্নার মধ্যে হাসিকে দেখতে শেখাই কাম্য। পৃথিবীর তিনভাগ অশ্রু-সাগর মাত্র এক ভাগ হাসির দ্বীপপুঞ্জ। আপাতদৃষ্টিতে মনোরম কিন্তু কুমীরের মাঝে মাঝে জল থেকে উঠে আসার মতো আনন্দদায়ক হলেও অস্বাভাবিক। হাসির প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু কান্নার প্রয়োজন ততোধিক, আনন্দ থেকেই হাসির উদ্ভব, কিন্তু গভীরতম আনন্দ কান্নাতেই প্রকাশ পায়। তাই মনে হয়, হাসি-কান্নাতে মূলত কোন তফাত নেই।

মিনতী বলিয়া উঠিল, বড্ড দার্শনিক প্রবন্ধের মতো শোনাচ্ছে। সহজ হাসি চাইছি আমরা।

তপন বলিল,–সহজ কথাটা পাত্রভেদে বদলায়। যেমন কাঠবিড়ালের গাছে ওঠা আর উদবিড়ালের জলে নামা।

মিনতী পুনরায় কহিল—অর্থাৎ আপনি বলতে চান, আমাদের চেয়ে আপনি উৎকৃষ্ট পাত্র?

তপন কহিল, উৎকৃষ্টতার প্রশ্ন অবান্তর। পৃথিবীর কাঞ্চনের প্রয়োজন থেকে কাচের প্রয়োজন কম নয়। এমন কি, ক্ষুদ্র কেঁচোরও প্রয়োজন আছে।

মুখ-টেপা হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল তপতী। কাচ-ভ্রমে সে তপনকে অগ্রাহ্য করিয়াছে। সে কহিল, আছে, কাগজি লেবু থেকে আরম্ভ করে কাঁচকলার অবধি প্রয়োজন আছে।

সকলেই মৃদুস্বরে হাসিতেছে। তপনের ভাষাটাকে এভাবে অনুকরণ করিয়া তপনকে সমর্থন করার জন্য মিঃ রায় ক্ষুন্ন হইতে গিয়া কথার হুল ফুটাইয়া ফেলিলেন। কহিলেন, কাচপোকারাওকেমন?

তপতীর দুই চক্ষু দীপ্ত হইয়া উঠিল। আপনার অজ্ঞাতসারেই সে আজ তপনকে অনুসরণ করিতেছে—কিন্তু মিঃ রায় যে ইহা সহিতে পারিতেছেন না, তাহা বুঝিতে তপতীর মুহূর্ত বিলম্ব হইল না! কহিল, হ্যাঁ,কাচপোকাও ভালো যেমন ভালো কাচের কুঁজোর জলের থেকে কৃষ্ণসাগরের কালো জল।

তপতীর এই উচ্ছ্বাসময় বাণী বিহ্বল করিয়া গিয়াছে সকলকেই। তপন সমই বুঝিল। তাহার দৃষ্টি নিবিড় বেদনায় নির্নিমেঘ হইয়া উঠিয়াছে। মৃদুস্বরে কহিল,ককারে কথা কলঙ্কিত হয়ে উঠেছে তপতী দেবী।

মৃদু হাসিয়া তপতী উত্তর দিল, কাপুরুষের গায়ে কাদাই ছিটানো উচিত। তাহাকেই কাপুরুষ বলা হইতেছে ভাবিয়া মিঃ রায় ক্রোধ সম্বরণ করিয়া কহিলেন,কাপুরুষের উল্টো লোকটি কে এখানে, মিস চ্যাচার্জী?

তপতী কহিল, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যারা সম্মুখযুদ্ধে পিছোয় না, যেমন আপনি।

আমি! তাহলে কাপুরুষটি কে আবার?

তপনের দিকে আঙুল তুলিয়া কহিল,–ঐ ইডিযট, ঐ ভণ্ড, ঐ জোচ্চর।

সকলেই বিস্মিত হইয়া উঠিতেছে। মিঃ রায় আনন্দিত হইতে গিয়াও যেন ধোঁকায় পড়িয়া কহিলেন,—ছিঃ ছিঃ, মিস চ্যাটার্জী, কি সব বলছেন আপনি?

আপনাকে বারণ করেছি না আমায় মিস চ্যাটার্জী বলতে? বলবেন না আর।

কিন্তু আপনি ওকে অত্যন্ত অপমান করছেন, মিস চ্যাটার্জী…

মিঃ রায় বাধা পাইলেন। তপতী সজোরে ধমক দিল, শাট আপ! ফের মিস চ্যাটার্জী?

তপতীর উচ্চকণ্ঠ শুনিয়া মা তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিলেন, খুকী হয়তো তপনের সহিত কিছু একটাকাণ্ড বাধাইযাছে।তাহাকে দেখিয়া তপনকুণ্ঠিত স্বরেকহিল—ওঁরাঅতিথি,ওঁদের অসম্মান করতে নেই। মা, ওঁকে বারণ করুন!—তপন মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিল মার পানে।

অকস্মাৎ তপতী চেয়ার ছাড়িয়া আসিয়া তাহার সুদীর্ঘ বেণীটাকে চাবুকের মতো ব্যবহার করিল তপনের বাম বাহুতে—সপাৎ সপাৎ! চীৎকার করিয়া বলিল,—ওরা তোমার অতিথি, তুমি ওদের সম্মান করবে…আর তোমার বিবাহিতা পত্নীকে ওরা বার বার অসম্মান করবে মিস, বলে নিশ্চিন্ত বসে দেখবে তুমি…কেন? কিসের জন্য বলোতপতী আবো একটা আঘাত করিল সজোরে।

এই অকস্মিকতার আঘাতে নিথর হইয়া গেছে রঙ্গভূমি। তপনের সুগের বাহুতে প্রত্যেকটি আঘাত রক্তলেখায় ফুটিয়া উঠিতেছে। মা কষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া কহিলেন—কি তুই করলি, খুকী।

ক্রোধ-কম্পিত তপতী চাহিয়া দেখিল তপনের শোণিতাক্ত বাহু! উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে তাহার সীমান্ত লুটাইয়া পড়িল সেই রক্তের উপর—তপতী যেন আজ ঐ রক্ত দিয়াই তাহার শুভ্র সীমান্ত রঞ্জিত করিয়া লইবে! অরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল,–বড় জ্বালা করছে না?

তপতীর আকুল কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট নিরুপায় তপন নির্লিপ্তর মতোই যেন বলিল,–এমন কিছু না। কাদবার কি হয়েছে? সেরে যাবে—তারপর তপতীর মাথাটি সস্নেহে তুলিয়া ধরিয়া মাকে বলিল,–মা, ধরুন ওকে,—পড়ে যাবে এখুনি

মা গিয়া তপতীকে ধরিলেন। তপতী থর-থর করিয়া কাপিতেছে! একটা নীরব নমস্কার জানাইয়া তপন ধীরে ধীরে চলিয়া যাইবে—তপতী ছুটিয়া গিয়া তাহার পথরোধ করিল,—যাচ্ছ যে?

—আমি তোমায় মুক্তি দিয়েছি, তোমায় গ্রহণ করবার সাধ্য আর আমার নেই। বিস্ময়ে তপতীর চক্ষু বিস্ফারিত হইল—মুক্তি দিয়েছো?

—হ্যাঁ। আমার সত্য বজ্রের চেয়ে কঠোর, মৃত্যুর চেয়ে নিষ্ঠুর। সত্যভঙ্গ করে তোমায় আমার সহধর্মিণীর আসনে আর বসাতে পারবো না—

তপন চলিয়া যাইতেছে। কিন্তু বিমূঢ়া তপতী পড়িয়া যাইবে, তপন ক্ষিপ্রহস্তে তাহাকে ধরিয়া স্নেহের শীতলতম মাধুর্যে কহিল,—এতদিন পরে এমন করে কেন তুমি আজ এলে তপতী? তুমি মুক্ত বিহঙ্গের মতো নীল আকাশের বিপুল বিস্তারে পাখা মেলো—আমার ধরার ধুলিতে পড়বে এসে তার ছায়া—একটি মুহূর্তের তরে যেখানে তুমি গ্রহণ করলে তোমার আসন! মুক্তির সেই অবাধ অধিকারে রইল আমাদের চিরমিলনের আকুতি…

তপন চলিয়া গেল।

অকস্মাৎ তপতীর আর্ত চীৎকারে দিগপ্রান্তধ্বনিত হইয়া উঠিল,–ঠাকুরদা-ঠাকুরদা… দিন, মাস, বর্ষ চলিয়া যাইতেছে…

বিশাল তপতী নিবাসে, তপনের পরিত্যক্ত কক্ষটিতে বসিয়া থাকে তপতী—একা, আত্ম-সমাহিত কুষ্ঠিত পিতা আসিয়া বলেন—তোর আবার বিয়ে দেবো, খুকী, তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে…

নিয়তির মতো নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যে তপতী উচ্চারণ করে-তাই বুঝি ঠাকুরদার সৃষ্ট দেবমূৰ্ত্তিকে দানবী করে তুলেছিলে? কিন্তু ওর নিষ্ঠুর ছেীর আঘাতে আবার তাকে দেবী করে দিয়ে গেছে বাবা!—এ-মন্দিরে আর কারও প্রবেশ নেই।—যাও।

স্নেহ-দুর্বল পিতা পুনরায় বলেন আমার কাছে দুলাখ টাকা নিয়ে আমারই বাবার নামে শ্যামসুন্দর ভিক্ষুকাশ্রম করেছে, এতেবড়ো হৃদয়বান সে! খুকী, চল্ ওকে ডেকে আনি।

হাস্যদৃঢ় কণ্ঠে তপতী উত্তর করে,—ওর সহধর্মিণী আমি হয়েছি, বাবা, সত্যভঙ্গ করিয়া বিলাস সঙ্গিনী হতে আর চাইনে!

মা আসিয়া স্নেহ-সজল স্বরে কহেন,—এমন করে কতদিন তুই থাকবি খুকী?

তপতী স্নিগ্ধ ঔদার্য্যে আত্মপ্রকাশ করে,—এমনি করে আমরণ রাখবো আমার বিরহের চিতা বহ্নিমান!

গভীর নিস্তব্ধ নিশীথে তপনের শূন্যশয্যা-প্রান্তে নতজানু তপতীর করুণ মধুর কণ্ঠঝঙ্কার শোনা যায় :

—তোমায়-আমায় মিলেছি, প্রিয়, শুধু চোখের জলের ব্যবধানটুকু রইল।

Leave a Reply to Abir Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *