০৫৫. পুনঃ মৃত্যুবিষয়ক প্রশ্ন – সৃঞ্জয় উপাখ্যান

৫৫তম অধ্যায়

পুনঃ মৃত্যুবিষয়ক প্রশ্ন – সৃঞ্জয় উপাখ্যান

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মৃত্যুর উৎপত্তি ও অদ্ভুত কাৰ্য্য সমুদায় শ্রবণ পূর্ব্বক ব্যাসকে প্রসন্ন করিয়া পুনরায় কহিলেন, ভগবন্! পূর্ব্বতন রাজর্ষিগণ ইন্দ্র তুল্য পরাক্রমশালী, পুণ্যকর্ম্মা, সত্যবাদী ও পাপশূন্য ছিলেন; আপনি তাঁহাদের কাৰ্য্য ও শোকাপনোদনবাক্যে আমাকে আশ্বাসিত করুন এবং কোন্ রাজর্ষি কি পরিমাণে দক্ষিণা দান করিয়াছিলেন, তাহাও কীর্ত্তন করুন।

ব্যাস কহিলেন, হে যুধিষ্ঠির! মহারাজ শ্বিত্যের সৃঞ্জয় নামে এক আত্মজ ছিলেন। মহর্ষি পর্ব্বত ও নারদের সহিত তাঁহার সখ্যভাব ছিল। একদা তাঁহারা সৃঞ্জয়ের সহিত সাক্ষাত করিবার নিমিত্ত তাঁহার আবাসে প্রবেশ করিলেন। সৃঞ্জয় তাঁহাদিগকে যথোচিত উপচারে অর্চনা করিলে তাহারা সাতিশয় প্রীত হইয়া পরম সুখে তথায় কিয়দ্দিবস অবস্থান করিতে লাগিলেন। একদা রাজা সৃঞ্জয় তাঁহাদিগের সহিত সুখ সচ্ছন্দে উপবেশন করিয়া আছেন, এই অবসরে তাঁহার একটি অবিবাহিতা দুহিতা তথায় সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন। সৃঞ্জয় পার্শ্বস্থ কন্যাকে অভিলাষানুরূপ আশীৰ্বাদ দ্বারা অভিনন্দন করিলেন। মহর্ষি পর্ব্বত ঐ কন্যাকে নিরীক্ষণ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, মহারাজ! এই সৰ্ব্ব লক্ষ্মণ সম্পন্ন কন্যা কাহার? ইনি সূর্যের প্রভা বা অনলের শিখা; অথবা শশধরের কান্তি কিম্বা শ্ৰী, লজ্জা, কীর্ত্তি, ধৃতি, পুষ্টি ও সিদ্ধির অন্যতম হইবেন। নৃপতি সৃঞ্জয় দেবর্ষি পর্ব্বতের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, সখে! এইটি আমার কন্যা, ‘এক্ষণে আমার নিকট বর প্রার্থনা করিতেছে।’ তখন নারদ কহিলেন, মহারাজ! তুমি যদি মঙ্গল লাভের অভিলাষী হও তাহা হইলে এই কন্যাটি ভাৰ্যার্থে আমাকে প্রদান কর। রাজা সৃঞ্জয় পরম প্রীতি সহকারে তৎক্ষণাৎ তাঁহার বাক্যে অঙ্গীকার করিলেন।

তখন মহর্ষি পর্ব্বত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া নারদকে কহিলেন, আমি পূর্ব্বেই ইহাকে মনে মনে বরণ করিয়াছি, পশ্চাৎ তুমি ইহাকে বরণ করিলে; অতএব তুমি স্বেচ্ছাক্রমে স্বর্গ গমনে সমর্থ হইবে না। নারদ কহিলেন, ইনি আমারই ভাৰ্য্যা এইরূপ জ্ঞান, এইরূপ বাক্য ও এইরূপ অধ্যবসায় এবং উদক প্রক্ষেপপূর্ব্বক দান আর পাণিগ্রহণ মন্ত্র এই কয়েকটি পরিণয়ের লক্ষ্মণ বলিয়া প্রখ্যাত আছে। এই সমস্ত বিষয় সম্পাদিত হইলেই যে ভাৰ্য্যাত্ব সম্পাদিত হয়, এমত নহে; সপ্তপদীগমনই ভাৰ্য্যাত্ব সম্পাদক বলিয়া উল্লিখিত হইয়া থাকে; এই কন্যা তোমার ভাৰ্য্যা না হইতেই তুমি যখন আমাকে অভিশম্পাত করিলে তখন তুমিও আমা ব্যতিরেকে স্বর্গগমনে সমর্থ হইবে না। এইরূপে সেই দেবর্ষিদ্বয় পরস্পর পরস্পরকে অভিশাপ প্রদান করিয়া তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন।

সৃঞ্জয়ের সুবর্ণবর্ষী পুত্রলাভ

এ দিকে রাজা সৃঞ্জয় পুত্র প্রার্থনায় বিশুদ্ধ মনে পরম যত্ন সহকারে অন্ন পান ও বস্ত্র প্রদান পূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণের আরাধনায় প্রবৃত্ত হইলেন। একদা বেদ বেদাঙ্গ পারগ স্বাধ্যায় নিরত ব্রাহ্মণগণ সৃঞ্জয়ের প্রতি প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে পুত্র প্ৰদান করিবার অভিলাষে মহর্ষি নারদের সমীপে গমন পূর্ব্বক কহিলেন, ভগবন্! আপনি মহারাজকে একটি অভিলষিত পুত্র প্রদান করুন। নারদ ব্রাহ্মণগণের বাক্যে স্বীকার করিয়া সৃঞ্জয়কে কহিলেন, মহারাজ! ব্রাহ্মণগণ প্রসন্ন হইয়া তোমার একটি পুত্র প্রার্থনা করিতেছেন। এক্ষণে তোমার যেরূপ পুত্র লাভের ইচ্ছা থাকে, প্রার্থনা কর; তোমার মঙ্গল হইবে। তখন রাজা সৃঞ্জয় কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, হে মহাত্মন! আপনার বর প্রভাবে আমার যেন সর্ব্বগুণ সম্পন্ন কীর্ত্তিমান, যশস্বী ও অসাধারণ তেজঃ সম্পন্ন এক পুত্র জন্মে এবং তাহার মূত্র, পুরীষ, ক্লেদ ও স্বেদ যেন কাঞ্চনময় হয়। নারদ সৃঞ্জয়ের বাক্যে স্বীকার করিয়া তাঁহাকে অভিলষিত বর প্রদান করিলে অতি অল্প কালের মধ্যে তাঁহার প্রার্থনানুরূপ এক পুত্র জন্মিল। ঐ পুত্র ক্ষিতিলে সুবর্ণষ্ঠীবী নামে প্রখ্যাত হইয়াছিলেন। ঐ পুত্র মহর্ষির বর প্রভাবে ক্ৰমে অপরিমিত ধন পরিবর্দ্ধিত করিলে রাজা সৃঞ্জয় সমস্ত অভীষ্ট বস্তু সুবর্ণময় করিয়া লইলেন। তখন তাঁহার গৃহ, প্রাকার, দুর্গম, ব্রাহ্মণালয়, শয্যা, আসন, স্থান ও স্থালী সমস্ত কাঞ্চনময় হইয়া কালসহকারে পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল।

সুবর্ণলোভী দৈত্যগণহস্তে সৃঞ্জয়পুত্র বধ

কিয়দদ্দিন পরে দস্যুগণ নৃপতনয়ের এই বৃত্তান্ত শ্রবণ ও তাঁহাকে নিরীক্ষণ পূর্ব্বক দলবদ্ধ হইয়া ভূপতির অনিষ্ট চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইল। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ কহিল আমরা স্বয়ং গিয়া রাজার পুত্রকে গ্রহণ করিব। ঐ পুত্ৰই সুবর্ণের আকর; অতএব উহাকে হস্তগত করিতে যত্ন করা আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্য।

অনন্তর লুব্ধস্বভাব দস্যুগণ ঐ রূপ পরামর্শ করিয়া নৃপসদনে প্রবেশ-পুরঃসর বলপূর্ব্বক রাজকুমার সুবর্ণষ্ঠীবীকে লইয়া অরণ্যে পলায়ন করিল। তথায় কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া তাঁহাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ছেদন করিল কিন্তু কিছুই অর্থলাভ করিতে সমর্থ হইল না। রাজকুমারের প্রাণনাশ হইলে সেই বরসঞ্জাত ধন বিনষ্ট হইয়া গেল। তখন মূর্খ দস্যুগণ জ্ঞান শূন্য হইয়া পরস্পর পরস্পরকে বিনাশ করিতে লাগিল। এইরূপে তাহারা সেই অভূতপূর্ব্ব রাজকুমারকে সংহার পূর্ব্বক পরস্পর বিনষ্ট হইয়া ঘোর নরকে গমন করিল।

এ দিকে রাজা সৃঞ্জয় সেই বর প্রদত্ত পুত্রকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া দুঃখিত মনে করুণ বচনে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। দেবর্ষি নারদ রাজাকে পুত্র শোকে নিতান্ত কাতর জানিয়া তাঁহার সন্নিধানে আগমন পূর্ব্বক কহিলেন, হে সৃঞ্জয়! আমরা ব্ৰহ্মবাদী মহর্ষি; আমরা সততই তোমার গৃহে অবস্থান করিতেছি; কিন্তু তোমাকেও বিষয় বাসনায় অপরিতৃপ্ত হইয়া কালগ্রাসে নিপতিত হইতে হইবে।

মরুত্তের মরণসংবাদে সৃঞ্জয়ের শোকশান্তি

আমরা শ্রবণ করিয়াছি, অবিক্ষিতের পুত্র মরুত্ত ও মৃত্যুগ্রস্ত হইয়াছিলেন। ঐ মহাত্মা সুরগুরু বৃহস্পতির প্রতি স্পর্ধা প্ৰকাশ করিয়া সম্বৰ্ত্ত-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। ভগবান্ শূলপাণী উহাকে বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান করিতে দেখিয়া হিমাচলের সুবর্ণময় এক প্রত্যন্ত পর্ব্বত প্রদান করিয়াছিলেন, বৃহস্পতি ও ইন্দ্র প্রভৃতি অমরগণ যজ্ঞান্তে উহার নিকট উপনীত হইতেন। উহার যজ্ঞ ভূমির পরিচ্ছদ সকল সুবর্ণময় ছিল। অন্নার্থী ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বর্ণত্রয় উহার যজ্ঞকালে অভিলাষানুরূপ পবিত্র অন্ন ভোজন করিয়া পরিতৃপ্ত হইতেন এবং বেদপারগ প্রহৃষ্ট ব্রাহ্মণগণ দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু, প্রভৃতি উৎকৃষ্ট ভোজ্য ও বস্ত্র অলঙ্কার প্রভৃতি সমস্ত অভিলাষানুরূপ দ্রব্য প্রাপ্ত হইতেন। দেবগণ রাজা মরুত্তের গৃহে দ্রব্য সামগ্রী পরিবেশন করিতেন। বিশ্বদেবগণ তাঁহার সভাসদ ছিলেন। অমরগণ হবি দ্বারা পরিতৃপ্ত হইয়া প্রচুর পরিমাণে বারি বর্ষণপূর্ব্বক সেই মহাবল পরাক্রান্ত রাজার শস্য সকল পরিবর্দ্ধিত করিতেন। তিনি ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠান, বেদাধ্যয়ন ও শ্রাদ্ধাদি দ্বারা নিরন্তর ঋষি, দেবতা ও পিতৃ লোকের তৃপ্তি সাধন করিতেন। তিনি স্বেচ্ছাক্রমে শয়ন, আসন, যান ও দুস্ত্যজ সুবর্ণরাশি অধিক পরিমাণে ব্রাহ্মণগণকে দান করিয়াছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র নিরন্তর তাঁহার শুভ চিন্তা করিতেন। তিনি প্রজাগণকে নির্বিঘ্নে রাখিয়া পরম শ্রদ্ধা সহকারে জিত অক্ষয় লোক সকল প্রাপ্ত হইয়াছেন। তিনি যৌবনাবস্থায় পুত্র, কলত্র, বন্ধু, বান্ধব, অমাত্য ও প্রজাবর্গ সমভিব্যাহারে সহস্র বৎসর রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন। হে সৃঞ্জয়! তোমা অপেক্ষা তপ, সত্য, দয়া ও দান সম্পন্ন এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা পুণ্যবান্ সেই মরুত্তরাজও কালগ্রাসে নিপতিত হইয়াছেন। অতএব তুমি সেই অযাজ্ঞিক ও অনুধ্যায়ী পুত্রের নিমিত্ত আর শোক করিও না।