০৫৪. প্রাণিসংহারার্থ নারীমূর্ত্তির প্রতি ব্রহ্মার আদেশ

৫৪তম অধ্যায়

প্রাণিসংহারার্থ নারীমূর্ত্তির প্রতি ব্রহ্মার আদেশ

কিয়ৎক্ষণ পরে মৃত্যু দুঃখ অপনীত করিয়া সন্নমিত লতার ন্যায় কৃতাঞ্জলিপুটে ব্ৰহ্মাকে কহিলেন, ভগবন্! আপনি কেন এই পাপীয়সীকে সৃষ্টি করিলেন। এক্ষণে আমি এই অহিত ক্রুরকর্ম্ম নিতান্ত অধৰ্ম্ মূলক জানিয়াও কি রূপে ইহার অনুষ্ঠান করিব। আমি অধৰ্ম্মানুষ্ঠানে অতিশয় ভীত হইতেছি; আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। আমি যাহাদের একান্ত প্রিয়তর পুত্র, মিত্র, ভ্রাতা, পিতা ও ভর্তাদিগকে বিনাশ করিব, তাহারা অবশ্যই আমার অনিষ্ট চিন্তা করিবে; এই নিমিত্ত আমার অত্যন্ত শঙ্কা হইতেছে। আমি প্রিয়বিয়োগে দীনভাবে রোরুদ্যমান প্রজাগণের অনর্গল নিপতিত নেত্ৰজল হইতে সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া আপনার শরণাপন্ন হইলাম। এক্ষণে কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিতেছি; আপনি প্রসন্ন হউন। আমি কদাচ যমালয়ে গমন করিতে পারিব না। আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার এই অভিলাষ সফল করুন। ধেনুকাশ্রমে গমন পূর্ব্বক কঠোর তপস্যা দ্বারা আপনার আরাধনা করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে; আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক আমাকে তদ্বিষয়ে আদেশ করুন; আমি এই মাত্র বর প্রার্থনা করি। আমি কদাচ বিলপমান প্রাণিগণের প্রিয়তম প্রাণ বিনাশ করিতে সমর্থ হইব না। হে পিতামহ! আপনি আমাকে অধর্ম্ম হইতে রক্ষা করুন।

ব্ৰহ্মা কহিলেন, হে মৃত্যু! তুমি প্রজা সংহারার্থ সমুৎপন্ন হইয়াছ; অতএব আমার নিয়োগানুসারে কোন বিচার না করিয়া লোক বিনাশে প্রবৃত্ত হও। লোকক্ষয় অবশ্যই হইবে; ইহা কদাচ অন্যথা হইবার নহে। অতএব তুমি আমার আজ্ঞা প্রতিপালন কর; এই বিষয়ে কেহই তোমাকে নিন্দা করিবে না। মৃত্যু ব্রহ্মার বাক্য শ্রবণে নিতান্ত ভীত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ব্রহ্মার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলেন। লোকের হিত সাধনোদ্দেশে লোক বিনাশে কোন মতেই তাঁহার অভিলাষ হইল না। পিতামহ ব্রহ্মা তৎকালে মৌনভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন এবং অবিলম্বেই হাস্য মুখে লোক রক্ষার্থে প্রসন্ন হইলেন।

কন্যারূপিনী মৃত্যুর তীব্র তপস্যা

এই রূপে সৰ্ব্বলোক পিতামহ কমলযোনি ক্রোধ পরিত্যাগ করিলে সমুদায় লোক অপমৃত্যুগ্রস্ত না হইয়া পূৰ্ব্ববৎ অবস্থান করিতে লাগিল। তখন সেই কন্যা প্রজা সংহার বিষয়ে অঙ্গীকার না করিয়া ব্রহ্মার নিকট বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক তথা হইতে অপসৃত হইলেন এবং অবিলম্বে ধেনুকাশ্রমে উপস্থিত হইয়া অতি কঠোর ব্রত অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। তিনি সমুদায় ইন্দ্রিয়সেব্য প্রিয়বস্তু হইতে ইন্দ্রিয়গণকে নিবৃত্ত করিয়া প্রজাগণের হিতার্থ এক বিংশতি পদ্ম বৎসর একপদে দণ্ডায়মান রহিলেন। পরে পুনরায় এক বিংশতি পদ্ম বৎসর একপদে অবস্থান করিলেন। অনন্তর অযুত পদ্ম বৎসর মৃগগণের সহিত সঞ্চরণ করিতে লাগিলেন। পরে পুনরায় সুশীতল নিৰ্ম্মল জল সম্পন্ন পবিত্র নন্দাতীর্থে গমন করিয়া – নিয়মপূর্ব্বক অষ্টোত্তর সহস্র বৎসর সলিলে কালাতিপাত করিলেন। এইরূপে নানাতীর্থে বিগতপাপ হইয়া প্রথমতঃ অতি পবিত্র কৌশিকী তীর্থে উপস্থিত হইলেন। তথায় বায়ু ভক্ষণ ও জল পান করিয়া পুনরায় নিয়মানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। পরে পঞ্চগঙ্গ ও বেতস-তীর্থে তপোবিশেষ দ্বারা দেহ পরিশুদ্ধ করিলেন। অনন্তর গঙ্গা ও প্রধান মহামেরু-তীর্থে গমন পূর্ব্বক প্রাণায়াম পরায়ণ হইয়া প্রস্তরের ন্যায় নিশ্চেষ্ট ভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তৎকালে হিমালয়ের শিখরদেশে গমনপূর্ব্বক অঙ্গুলির উপর নির্ভর কবিয়া নিখৰ্ব্ব বৎসর অবস্থান করিলেন। পূর্ব্বকালে দেবগণ ঐ স্থানে যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। অনন্তর ঐ কন্যা পুষ্কর, গোকর্ণ, নৈমিষ ও মলয় তীর্থে অভিলষিত নিয়মানুষ্ঠান পূর্ব্বক দেহ পরিশুদ্ধ করিতে লাগিলেন। এই রূপে তিনি অনন্যমনে একমাত্র ব্রহ্মাকে প্রতি নিয়ত ভক্তি প্রদর্শন পূর্ব্বক প্রসন্ন করিলেন।

মৃত্যুর প্রতি ব্রহ্মার বরদান-ব্যবস্থা

তখন অব্যয় ভূতভাব ভগবান ব্রহ্মা শান্ত ও প্রীত মনে তাঁহাকে কহিলেন, হে মৃত্যু! তুমি কি নিমিত্ত এইরূপ অতি কঠোর তপোনুষ্ঠান করিতেছ? তখন মৃত্যু পুনরায় ব্রহ্মাকে কহিলেন। হে ভগবন্! প্রজারা সুস্থ হইয়া কালযাপন করিতেছে; তাহারা বাক্যেও অন্যের অপকার করে না; আমি তাহাদিগকে কখনই বিনষ্ট করিতে পারিব না। এক্ষণে আপনার নিকট এই বরই প্রার্থনা করি। আমি অধর্ম্মভয়ে ভীত হইয়া তপোনুষ্ঠান করিয়াছি। অতএব আপনি আমাকে অভয় প্রদান করুন। আমি একান্ত কাতর ও নিরপরাধি; প্রার্থনা করি, আপনি অনুগ্ৰহ করিয়া আমার আশ্রয় হউন। অনন্তর ত্রিকালজ্ঞ পিতামহ ব্রহ্মা কহিলেন, হে কন্যে! এই সমস্ত প্রজা সংহার করিলে তোমার কিছু মাত্র অধর্ম্ম হইবে না, আমার বাক্য কদাচ অন্যথা হইবার নয়। অতএব তুমি অশঙ্কিত চিত্তে চতুর্ব্বিধ প্রজা সংহার কর; তোমার সনাতন ধর্ম্ম লাভ হইবে। লোকপাল যম, ব্যাধি সকল ও দেবগণ তোমার সহায় হইবেন এবং আমিও তোমার সহায়তা সম্পাদন করিব। আর তুমি পাপ হইতে বিমুক্ত ও রজোগুণ রহিত হইয়া যে রূপে খ্যাতি লাভে সমর্থ হইবে, পুনরায় এমন একটি বরও তোমাকে প্ৰদান করিব।

অনন্তর মৃত্যু প্রণত হইয়া ব্রহ্মাকে প্রসন্ন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, ভগবন্! যদি আমা ব্যতিরেকে এই কাৰ্য্য অনুষ্ঠিত না হয়, তবে অগত্যা আপনার এই আজ্ঞা আমাকে শিরোধার্য্য করিতে হইল; কিন্তু আমি যাহা নিবেদন করিতেছি, আপনি তাহা শ্রবণ করুন। লোভ, ক্রোধ, অসূয়া, ঈর্ষা, দ্রোহ, মোহ ও নির্লজ্জতা এই সকল পরুষ ইন্দ্রিয়বৃত্তি প্রাণিগণের দেহভেদ করিবে। তখন ব্রহ্মা কহিলেন, হে মৃত্যু! তুমি যাহা কহিলে তাহাই হইবে, এক্ষণে তুমি লোক বিনাশে প্রবৃত্ত হও। তোমার অধর্ম্ম হইবে না এবং আমিও তোমার অনিষ্ট চেষ্টা করিব না। আমার করতলে তোমার যে সমুদায় অশ্রু বিন্দু নিপতিত রহিয়াছে, উহা প্রাণিগণের আত্মসম্ভূত ব্যাধি রূপে প্রাদুভূত হইয়া প্রাণ সংহার করিবে; তাহা হইলে তোমার অধর্ম্ম হইবে না। তুমি এক্ষণে ভয় পরিত্যাগ কর। তুমি প্রাণিগণের-ধর্ম্ম, ধর্মের অধীশ্বর, ধর্ম্ম পরায়ণ ও ধর্মের কারণ; এক্ষণে ধৈৰ্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক প্রাণিগণের প্রাণ বিনাশে প্রবৃত্ত হও। তুমি কাম ও রোষ বিসৰ্জন করিয়া জীবগণের জীবন সংহার কর; তাহা হইলে তোমার অক্ষয় ধৰ্মলাভ হইবে। অধর্ম্ম দুরাচারদিগকে নিমূল করিবে; তুমি আমার বাক্যানুসারে কাৰ্য্য করিয়া আপনাকে পবিত্র কর; তুমি অসাধু জীবগণকে পাপে নিমগ্ন করিবে।

মৃত্যুর লোকগ্রাসে অঙ্গীকার

নারদ কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর সেই কন্যা আপনার, মৃত্যু, এই নাম হইল দেখিয়া নিতান্ত ভীত ও অভিশাপ ভয়ে একান্ত শঙ্কিত হইয়া তৎক্ষণাৎ ব্রহ্মার বাক্য স্বীকার করিলেন। সেই মৃত্যু কাম ক্রোধ পরিত্যাগ করিয়া অসংসক্ত রূপে অন্তকালে প্রাণিগণের প্রাণ নাশ করিয়া থাকেন। প্রাণিদিগেরই মৃত্যু হয়; রোগ নামধারী ব্যাধি প্রাণিগণ হইতেই সম্ভূত হইয়া থাকে, তদ্বারা তাহারা সাতিশয় নিপীড়িত হয়। অতএব আপনি জীবনান্তে জীবগণের নিমিত্ত বৃথা শোক করিবেন না। ইন্দ্রিয় সকল জীবনান্তে জীবগণের সহিত পরলোকেগমন ও স্বস্ব কাৰ্য্য সংসাধন পূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইয়া থাকে, এই রূপ দেবগণও মনুষ্যের ন্যায় পরলোকে গমন ও স্ব স্ব কার্য্য সংসাধন করিয়া থাকেন। ভীমরূপ, ভীমনাদ, সর্ব্বগামী, উগ্র, অনন্ততেজা প্রাণ বায়ু কেবল দেহই ভেদ করিয়া থাকে; উহার যাতায়াত নাই। সকল দেবতারাও মর্ত্যসংজ্ঞাধারী; হে মহারাজ! এক্ষণে আপনি স্বীয় পুত্রের নিমিত্ত শোক করিবেন না। তিনি স্বর্গে সুরম্য বীরলোক প্রাপ্ত হইয়া দুঃখ পরিত্যাগ ও সাধুসমাগম লাভ পূর্ব্বক প্রতিনিয়ত আনন্দিত হইতেছেন। প্রজাদিগের মৃত্যু দেবনির্দ্দিষ্ট; মৃত্যু, কাল উপস্থিত হইলে প্রজাদিগের প্রাণনাশ করিয়া থাকে। প্রাণিগণ স্বয়ংই বিনষ্ট হয়; মৃত্যু দণ্ড ধারণ পূর্ব্বক তাহাদিগকে হিংসা করেন না; এই ব্ৰহ্মসৃষ্ট সত্যটি পণ্ডিতেরা সম্যক অবগত হইয়া মৃতব্যক্তিদিগের নিমিত্ত কদাচ শোক করেন না। হে মহারাজ! আপনি দৈববিহিত এইরূপ সৃষ্টি অবগত হইয়া পুত্রের বিনাশ নিবন্ধন শোক অবিলম্বে পরিত্যাগ করুন।

মহারাজ অকম্পন প্ৰিয় সখা নারদের নিকট এইরূপ অর্থবহুল বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ভগবন্! আমি এই ইতিহাস শ্রবণ করিয়া বিগত শোক, প্রীত ও কৃতার্থ হইলাম, এক্ষণে আপনাকে অভিবাদন করি। এইরূপে ভূপতি অকম্পন বিগত শোক হইলে দেবর্ষি নারদ অবিলম্বে নন্দন কাননে প্রস্থান করিলেন। হে ধর্ম্মরাজ! এই ইতিহাস শ্রবণ ও অন্যের নিকট কীৰ্ত্তন করা উভয়ই ধন্য, পুণ্যজনক, যশস্কর, আয়ুস্কর স্বর্গলাভের হেতুভূত; হে ধর্ম্মরাজ! তুমি এই অর্থ-ভূয়িষ্ঠ বাক্য শ্রবণ পূর্ব্বক ক্ষত্ৰধর্ম্ম ও বীরগণের উৎকৃষ্ট গতি অবগত হইয়া ধৈর্য্যালম্বন কর। চন্দ্রাংশসদ্ভূত মহারথ অভিমন্যু অসংখ্য ধনুর্ধারীদিগের সমক্ষে শত্রুগণকে বিনাশ পূর্ব্বক সংগ্রাম করিয়া অসি, গদা, শক্তি ও কার্মুক দ্বারা বিনষ্ট ও রজোগুণবিরহিত হইয়া পুনরায় চন্দ্রে বিলীন হইয়াছেন। অতএব তুমি ধৈৰ্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক অপ্রমত্ত ও ক্রুদ্ধ হইয়া ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে সত্বরে যুদ্ধার্থ নির্গত হও।