০৫১. অভিমন্যুবধে যুধিষ্ঠিরের বিলাপ

৫১তম অধ্যায়

অভিমন্যুবধে যুধিষ্ঠিরের বিলাপ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে রথযুথপতি মহাবীর অভিমন্যু সমরে নিপতিত হইলে পাণ্ডব পক্ষ বীর সমুদায় রথ, কবচ ও শরাসন পরিত্যাগ পূর্ব্বক দুঃখিতচিত্তে অভিমন্যুকে চিন্তা করিয়া যুধিষ্ঠিরের চতুর্দ্দিকে উপবেশন করিলেন।

মহারাজ ধর্ম্মনন্দন ভ্রাতৃপুত্র নিধনে একান্ত কাতর হইয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন; হায়! মহাবীর অভিমন্যু আমার প্রিয়চিকীর্ষায় ব্যূহ ভেদপূর্ব্বক সিংহ যেমন গোগণ মধ্যে প্রবিষ্ট হয়, তদ্রূপ দুর্ভেদ্য দ্রোণ সৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। যাহার প্রভাবে মহাধনুর্দ্ধর, সমর দুর্ম্মদ, অস্ত্র শস্ত্র বিশারদ, বিপক্ষ পক্ষ বীরগণ রণে ভগ্ন হইয়া পলায়ন করিয়াছে, যে মহাবীর আমাদের প্রধান শত্রু দুঃশাসনকে সংগ্রামে অতি অল্প ক্ষণের মধ্যেই বিসংজ্ঞ ও বিমুখ করিয়াছে এবং অনায়াসে দ্রোণসৈন্যরূপ মহাসাগর পার হইয়াছে, সেই সমর বিশারদ অভিমন্যু দুঃশাসনতনয়ের সহিত সংগ্রাম করিয়া শমন সদনে গমন করিল! আজি আমি কি রূপে পুত্রবৎসল ধনঞ্জয় ও পুত্রের অদর্শনে একান্ত কাতরা সুভদ্রাকে অবলোকন করিব! কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন এ স্থানে আগমন করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহাদিগকে কি প্রত্যুত্তর প্রদান করিব! আমিই কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের জয়লাভ ও প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার মানসে এই অপ্রিয় কাৰ্য্য করিয়াছি! লুব্ধ ব্যক্তি কদাপি দোষ জানিতে পারে না; লোভ মোহ হইতে উৎপন্ন হয়। আমি রাজ্যলোলুপ হইয়া এই মহৎ অনিষ্টপাত অবলোকন করিতে সমর্থ হই নাই। যে সুকুমার কুমারকে ভোজ্য, যান, শয্যা ও ভূষণ প্রদান করা উচিত, আমরা তাহার উপরেই সংগ্রামের প্রধান ভার সমর্পণ করিয়াছিলাম। সৎ স্বভাব সম্পন্ন অশ্ব যেমন বিষম সঙ্কটে পতিত হইলে তাহার মঙ্গল হয় না, তদ্রূপ সমরানভিজ্ঞ বালক অভিমন্যুর এই বিষম সঙ্কটে কি রূপে মঙ্গল হইবে?

যাহা হউক, অদ্য আমরা ক্রোধ প্রদীপ্ত অর্জ্জুনের দীন নয়নানলে দগ্ধ হইয়া অভিমন্যুর সহিত ভূতলে শয়ন করিব। যে অর্জ্জুন নিতান্ত অলুব্ধ, মতিমান, লজ্জাশীল, ক্ষমাশালী, রূপবান্, মানপ্রদ, সত্যপন্নয়ণ, ধীরপ্রকৃতি ও মহাবল পরাক্রান্ত; পণ্ডিতগণ যাঁহার উৎকৃষ্ট কার্যের প্রশংসা করেন; যে মহাবীর হিরণ্যপুরবাসী, ইন্দ্রশত্রু নিবাতকবচ ও কালকেয়গণকে নিহত করিয়াছেন; যিনি চক্ষুর নিমেষমাত্রে পুলোমনন্দনগণকে সগণে নিধন করিয়াছেন এবং যিনি শরণাগত শত্রুগণকেও অভয় প্রদান করেন, আজি আমরা সেই অর্জ্জুনের পুত্রকে নিদারুণ কৌরব সৈন্যের ভয় হইতে রক্ষা করিতে পারিলাম না! মহাবীর ধনঞ্জয় পুত্রবধে ক্রুদ্ধ হইয়া নিশ্চয়ই কৌরবগণকে সংহার করিবেন এবং ক্ষুদ্রসহায় ক্ষুদ্রাশয় স্বপক্ষ ক্ষয়কারী দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনও আত্মীয়গণের নিধন দর্শনে নিশ্চয়ই প্রাণ পরিত্যাগ করিবে। এই অসাধারণ পুরুষকারসম্পন্ন অর্জ্জুনতনয়কে সংগ্রামস্থলে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া আজি, আমাদের জয় লাভ, রাজ্য লাভ বা সুরলোক প্রাপ্তি কিছুই প্রীতিজনক বলিয়া বোধ হইতেছে না।