০৪৯. কালিকেয়প্রমুখ সৌবল বধ

৪৯তম অধ্যায়

কালিকেয়প্রমুখ সৌবল বধ

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সুভদ্রানন্দকর মহাবীর অভিমন্যু চক্র ধারণ করিয়া সমরে দ্বিতীয় বিষ্ণুর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন; তাঁহার কেশকলাপ বায়ুবেগে উদ্ধত হইতে লাগিল এবং আয়ুধপ্রধান চক্র উদ্যত হইয়া শোভা পাইতে লাগিল; তখন তিনি দুঃসমীক্ষ্য হইয়া উঠিলেন। ভূপতিগণ তাঁহার সেই অলৌকিক রূপ সন্দর্শন করিয়া সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া তাঁহার চক্র খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুনতনয় সত্বরে গদা গ্রহণ পূর্ব্বক অশ্বত্থামার অভিমুখে ধাবমান হইলে মহাবাহু দ্রোণনন্দন প্রজ্বলিত অশনির ন্যায় সেই অভিমন্যুর গদা অবলোকন করিয়া রথোপস্থ হইতে তিন লম্ফে পলায়ন করিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুনতনয় গদা দ্বারা তাঁহার অশ্ব সমুদায় এবং পার্ঞ্চি-সারথিদ্বয়কে সংহার করিয়া বীরগণের শরনিকরে বিদ্ধগাত্র হইয়া শল্লকীর ন্যায় নয়নগোচর হইতে লাগিলেন। পরে সুবলনন্দন কালিকেয়কে নিহত করিয়া তাঁহার অনুচর সপ্তসপ্ততি গান্ধারকে নিহত করিলেন। অনন্তর ব্রহ্মবসাতীয় দশ রথী এবং কৈকয়দিগের সাত রথী ও দশ মাতঙ্গ বিনষ্ট করিয়া গদা দ্বারা দুঃশাসনতনয়ের রথ ও অশ্বগণকে চূর্ণ করিয়া ফেলিলেন।

মহাবীর দুঃশাসনতনয় ক্রোধভরে ভীষণ গদা সমুদ্যত করিয়া ‘থাক্ থাক্’ বলিয়া অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন। পূর্ব্বকালে মহাদেব ও অন্ধক যেমন পরস্পরের উপর গদাঘাত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাবীর অভিমন্যু ও দুঃশাসনতনয় পরস্পরকে সংহার করিবার বাসনায় পরস্পরের প্রতি গদাঘাত করিতে লাগিলেন। সেই বীরদ্বয় গদাযুদ্ধ করত পরস্পর গদাঘাতে ভূতলে পতিত হইয়া নিপতিত ইন্দ্ৰধ্বজ দ্বয়ের ন্যায় শোভমান হইলেন। তখন কুরুকুল কীৰ্ত্তিবৰ্ধন মহাবীর দুঃশাসনতনয় সত্বরে অগ্রে সমুত্থিত হইয়া উত্তিষ্ঠমান মহাবাহু অর্জ্জুনতনয়ের মস্তকে গদাঘাত করিলেন। অরাতিকুলনিপাতন মহাবীর অভিমন্যু দুঃশাসননন্দনের দারুণ গদাঘাত ও সমরপরিশ্রমে মোহিত এবং অচেতন হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন।

হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুনতনয় একাকী অরাতিপক্ষ সমুদায় সৈন্যগণকে বিক্ষোভিত করিয়া পরিশেষে বহুসংখ্য শত্রু কর্ত্তৃক নিহত হইয়া পদ্মবনপ্রমাথী ব্যাধগণের হস্তে নিহত বনগজের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন আপনার পক্ষ মহাবল পরাক্রান্ত মহারথগণ সমরাঙ্গনে নিপতিত মহাবীর অর্জ্জুনতনয়কে চতুর্দ্দিকে পরিবেষ্টন করিলেন এবং দাবদহনানন্তর নিদাঘকালীন প্রশান্ত পাবকের ন্যায়, অস্তগত আদিত্যের ন্যায়, রাহুগ্রন্ত শশাঙ্কের ন্যায়, শুষ্কসাগরের ন্যায়, তরুশৃঙ্গ মর্দ্দনানন্তর নিবৃত্ত সমীরণের ন্যায়, পূর্ণচন্দ্রনিভানন, কাকপক্ষে আবৃতনেত্র সেই অভিমন্যুকে ভূতলে পতিত দেখিয়া পরমাহ্লাদসহকারে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন তাহাদের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। এ দিকে পাণ্ডবপক্ষ বীরগণের নেত্র হইতে অবিরল বারিধারা নিপতিত হইতে লাগিল। ঐ সময় গগনচর ভূতগণ অভিমন্যুকে আকাশচ্যুত চন্দ্রের ন্যায় নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া উচ্চস্বরে কহিতে লাগিল যে, মহাবীর দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্র পক্ষ ছয় জন মহারথ এই বালককে সংহার করিয়াছেন, ইহা আমাদের মতে নিতান্ত ধর্ম্ম বিরুদ্ধ কর্ম্ম হইয়াছে। মহাবীর অভিমন্যু নিহত হইয়া ধরাতলে নিপতিত এবং রুধিরসংপ্লুত রুক্মপুঙ্খ শরনিকর, বীরগণের কুণ্ডল শোভিত মস্তক, বিচিত্র উষ্ণীষ, পতাকা, চামর, চিত্র কম্বল, উত্তম আয়ুধ, রথ, অশ্ব ও গজগণের অলঙ্কার, নির্ম্মোক-নির্ম্মুক্ত ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ নিশিত খড়্গ, শরাসন, ছিন্ন শক্তি, ঋষ্টি, প্রাস, কম্পন ও অন্যান্য আয়ুধ সমুদায় ইতস্তত নিক্ষিপ্ত হওয়াতে ভূমণ্ডল পূর্ণচন্দ্র ও গ্রহ নক্ষত্র বিভূষিত নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। অর্জ্জুনতনয়ের শরে ভূতলে নিপতিত শোণিতদিগ্ধাঙ্গ আরোহী সমবেত নির্জীব ও শ্বাসাবশিষ্ট অশ্ব সমুদায়ে রণস্থল বন্ধুর হইয়া উঠিল। মহামাত্র, অঙ্কুশ, চৰ্ম্ম, আয়ুধ ও কেতু সমবেত শরনিহত পর্ব্বতাকার গজ সকল, অশ্ব, সারথি ও যোদ্ধা সমবেত প্রক্ষুভিত হ্রদ সদৃশ রথ সমুদায় এবং বিবিধায়ুধধারী পদাতি সমুদায়ে রণস্থল ভীরুজনভয়াবহ ঘোররূপ ধারণ করিল।

হে মহারাজ। এইরূপে অপ্রাপ্তবয়স্ক মহাবীর অর্জ্জুনতনয় সমরভূতলে নিপতিত হইলে কৌরব পক্ষ বীরগণের আনন্দ ও পাণ্ডব পক্ষদিগের বিষাদের পরিসীমা রহিল না। পাণ্ডব সৈন্যগণ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সমক্ষেই পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। মহারাজ যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনতনয়ের নিধন-নিবন্ধন বীরগণকে পলায়ন করিতে দেখিয়া কহিলেন, হে মহাবল-পরাক্রান্ত বীরগণ! সমর বিশারদ মহাবাহু অভিমন্যু সমরে পরাঙ্মুখ না হইয়া শত্রু হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ পূর্ব্বক স্বর্গে গমন করিয়াছে; তোমরা স্থির হও; ভীত হইয়া পলায়ন করিও না; আমরা অবিলম্বে শত্রুগণকে পরাজয় করিব। কৃষ্ণার্জ্জুনসমপ্রভাব মহাবীর অর্জ্জুনতনয় সমরে আশীবিষ সদৃশ রাজপুত্রগণ, দশ সহস্র সৈন্য, মহারথ কৌশল্য বৃহদ্বল এবং অসংখ্য রথ, অশ্ব, মাতঙ্গ ও নরগণকে সংহার করিয়াও পরিতৃপ্ত হয় নাই। ঐ মহাবীর অগ্রে ঐ সমুদায় শত্রু পক্ষদিগকে নিধন করিয়া পশ্চাৎ শত্রুহস্তে সমরে প্রাণ পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিশ্চয়ই ইন্দ্র ভবনে বা অন্য কোন পুণ্যনির্জিত পবিত্র সনাতন স্থানে গমন করিয়াছে। সেই পুণ্যাত্মার নিমিত্ত শোক করা কদাপি বিধেয় নয়। মহাতেজা মহারাজ ধর্ম্মরাজ এই বলিয়া সেই সমুদায় দুঃখিত সৈন্যগণের দুঃখ মোচন করিতে লাগিলেন।