০৩৬. অভিমন্যুর দ্রোণাভিমুখে গমন

৩৬তম অধ্যায়

অভিমন্যুর দ্রোণাভিমুখে গমন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! অভিমন্যু চালাও চালাও বলিয়া সারথিকে বারংবার আদেশ করিলে সারথি সম্বোধন পূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, হে আয়ুষ্মন্! পাণ্ডবগণ আপনার উপর গুরুতর ভার সমর্পণ করিয়াছেন; এক্ষণে ইহা আপনার উপযুক্ত কি না, সবিশেষ বিবেচনা করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হউন। দ্রোণাচাৰ্য্য কার্য্যকুশল ও দিব্যাস্ত্রে সুনিপুণ; আপনি নিরন্তর সুখসম্ভোগে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছেন। তখন অভিমন্যু হাস্য করিয়া কহিলেন, হে সারথি! ক্ষত্রিয়গণ ও দ্রোণের কথা দূরে থাকুক, অমরগণ পরিবৃত, ঐরাবত সমারূঢ়, ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্রের সহিতও যুদ্ধ করিব; আজি ক্ষত্রিয়গণের সহিত যুদ্ধ করিতে আমার কিছু মাত্র বিস্ময় নাই। এই সমস্ত শত্রুসৈন্য আমার ঘোড়শভাগের উপযুক্ত হইতেছে না; অধিক কি, বিশ্ব বিজয়ী মাতুল ও পিতার সহিত সমর করিতেও আমার অন্তঃকরণে ভয় সঞ্চার হয় না। অভিমন্যু এই রূপে সারথির বাক্যে অনাদর প্রদর্শন করিয়া কহিলেন, সূত! তুমি অবিলম্বে দ্রোণ সৈন্যাভিমুখে গমন কর ।

অনন্তর সারথি অতিশয় অসন্তুষ্ট মনে ত্রিবর্ষবয়স্ক সুবর্ণমণ্ডিত অশ্বগণকে দ্রোণ সৈন্যাভিমুখে চালন করিল। মহাবেগ পরাক্রমশালী অশ্বসকল সারথি কর্ত্তৃক পরিচালিত হইয়া দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইল। কৌরবগণ অভিমন্যুকে আগমন করিতে অবলোকন করিয়া দ্রোণাচাৰ্য্যকে পুরোবৰ্ত্তী করিয়া গমন করিতে লাগিলেন; এ দিকে পাণ্ডবেরাও অভিমন্যুর অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। যেমন সিংহশাবক হস্তিযূথ প্রাপ্ত হয়, তদ্রূপ কণিকারলাঞ্ছিত ধ্বজদণ্ডশালী, সুবর্ণ বৰ্ম্মসমলঙ্কৃত অভিমন্যু যুদ্ধার্থী হইয়া নির্ভীকের ন্যায় দ্ৰোণপ্রমুখ বীরগণকে প্রাপ্ত হইলেন।

অভিমন্যুর চক্রব্যূহপ্রবেশ – শত্রুসংহার

তখন কৌরবগণ নিতান্ত হৃষ্ট হইয়া অভিমন্যুকে প্রহার করিতে লাগিলেন। যেমন ভাগীরথীর আবর্ত্ত সাগর মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া মুহূর্ত্তকাল তুমুল হইয়া থাকে, তদ্রূপ পরস্পর প্রহরণশীল বীরগণের অতি ভীষণ যুদ্ধ তুমুল হইয়া উঠিল। ইত্যবসরে মহাবীর অভিমন্যু দ্রোণের সমক্ষে ব্যূহ ভেদ করিয়া তম্মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

অশ্ব, হস্তী, রথ ও পদাতি সকল মহাবল পরাক্রান্ত অভিমন্যুকে শত্রু মধ্যে প্রবিষ্ট ও বীর বিনাশে প্রবৃত্ত দেখিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিল। বীরগণ নানা প্রকার বাক্যধ্বনি, সিংহনাদ, বাহ্বাস্ফোটন, গভীর গর্জ্জন, হুঙ্কার, থাক থাক শব্দ, ঘোরতর হলাহল রব, ‘গমন করিও না, আমার নিকট অবস্থান কর, আমি এই স্থানে অবস্থান করিতেছি’, এই রূপ কোলাহল, করিবৃংহিত, ভূষণ-শিঞ্জিত, হাস্য ও অশ্বের খুরধ্বনি দ্বারা ভূমণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর অভিম তাঁহাদিগকে আগমন করিতে নিরীক্ষণ করিয়া মর্ম্মভেদী শরনিকরে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তাহারা বিবিধ লক্ষণ-লাঞ্ছিত শরজালে বিনষ্ট হইয়া শলভের হুতাশনপ্রবেশের ন্যায় রণস্থলে নিপতিত হইতে লাগিল। তখন রণস্থল তাঁহাদিগের অবয়বে কুশ সংস্তীর্ণ যজ্ঞবেদীরন্যায় সমাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। অভিমন্যু গোধাচৰ্ম্মবিনির্ম্মিত অঙ্গুলিত্ৰাণ, শর, শরাসন, অসি, চৰ্ম্ম, অঙ্কুশ, অভীষু, তোমর, পরশু, গদা, অয়োগুড়, প্রাস, ঋষ্টি, পট্টিশ, ভিন্দিপাল, পরিঘ, শক্তি, কম্পন, প্রতোদ, মহাশঙ্খ, কুন্ত, কচগ্রহ, মুগদর, ক্ষেপণীয়, পাশ, উপল, কেয়ুর ও অঙ্গদে সুশোভিত মনোহর গন্ধানুলিপ্ত সহস্র সহস্র করযুগল ছেদন করিলেন। বিহগরাজচ্ছিন্ন, পঞ্চশীর্ষ ভুজঙ্গের ন্যায় শোণিতলিপ্ত করনিকরে সমর ভূমি সুশোভিত হইতে লাগিল। যে সকল মস্তক মনোহর নাসা, আনন ও কেশ কলাপে সুশোভিত, সুচারু কুণ্ডল, মাল্য, মুকুট, উষ্ণীষ, মণি ও রত্নে বিরাজিত, বিনাল-নলিনের ন্যায় আকার ও চন্দ্র সূৰ্য্যের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন এবং ব্রণশুন্য যাহা রোষবশত ওষ্ঠপুট দংশন করিয়া রহিয়াছে; যাহা হইতে রুধির ধারা বিনিঃসৃত হইতেছে; জীবনকালে যাহা হিতকর ও প্রীতিকর বাক্য কহিত, অভিমন্যু অরাতিগণের সেই সুগন্ধময় মস্তকসমূহে ধরামণ্ডল আচ্ছন্ন করিলেন। গন্ধৰ্ব্ব নগরাকার যে সকল রথ ঈষামুখ, বিচিত্ৰবেণু ও দণ্ডে যথাবিধি সুসজ্জিত ছিল, অভিমন্যুর শরনিকরে তাহার রথী সকল বিনষ্ট, জঙ্ঘা, অঙ্ঘি, নাসা, দর্শন, চক্র, উপস্কর ও উপস্থ-সকল ছেদিত, উপকরণ সকল ভগ্ন, আস্তরণ সকল নিক্ষিপ্ত, পরিশেষে রথ সকলও খণ্ড খণ্ড হইল। অনন্তর তিনি পতাকা, অঙ্কুশ ও ধ্বজ সম্পন্ন, তৃণ বৰ্মধারী শত্রুপক্ষ গজারোহী, গজ ও পাদরক্ষকদিগকে গ্রীবা বন্ধন রঞ্জু, কম্বল, ঘণ্টা, শুণ্ড, দশনাগ্রভাগের সহিত নিশিত শরনিকরে ছেদন করিলেন। বনায়ুজ কাম্বোজ, বাহ্লীক ও পার্ব্বতীয়, স্থির পুচ্ছ, স্থির কর্ণ, স্থির নেত্র, বেগশালী যে সকল অশ্ব শক্তি, ঋষ্টি ও প্রাসযোধী সুশিক্ষিত যোদ্ধৃগণে সমারূঢ় ছিল, তাহাদিগের মুকুট ও চামর বিনষ্ট, জিহ্বা ও নয়ন ছিন্ন, অস্ত্র ও যকৃৎ নিষ্কাশিত, আরোহিগণ নিহত এবং চর্ম্ম ও বৰ্ম্ম নিকর্ত্তিত হইল। তাহারা মল, মূত্র ও রুধিরাধারায় পরিপ্লত ও গতজীবন হইয়া ক্ৰব্যাদগণের প্রমোদবর্দ্ধন করিতে লাগিল।

যেমন ভগবান্ শূলপাণি ঘোরতর অসুর বল সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ বিষ্ণুর সদৃশ অচিন্ত্যপ্রভাব একাকী অভিমন্যু ঈদৃশ অতি দুষ্কর কাৰ্য্য সমাধান করিয়া অঙ্গত্রয়সম্পন্ন আপনার সৈন্য সমুদায় বিমর্দ্দিত ও পদাতিগণকে ছিন্ন ভিন্ন করিতে লাগিলেন।

অনন্তর কার্ত্তিকেয় যেমন আসুরী সেনা নিহত করিয়া ছিলেন, তদ্রূপ একমাত্র অভিমন্যু কৌরব সৈন্যগণকে নিহত করিতেছেন নিরীক্ষণ করিয়া আপনার পক্ষীয় বীরগণ ও আপনার পুত্রগণ দশদিক্‌ অবলোকন করিতে লাগিলেন; তাঁহাদিগের মুখ শুষ্ক হইয়া গেল; নয়ন যুগল নিতান্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল; কলেবর কণ্টকিত ও ঘর্ম্মাক্ত হইতে লাগিল। তখন তাঁহার শত্রু পরাজয়ে একান্ত উৎসাহশূন্য ও পলায়নে সমুৎসুক হইয়া জীবিতাভিলাষে গোত্র ও নাম উচ্চারণ পূর্ব্বক পরস্পরকে আহ্বান, নিহত পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, বন্ধু ও সম্বন্ধীদিগকে পরিত্যাগ এবং করী ও তুরঙ্গে আরোহণ করিয়া সত্বরে প্রস্থান করিলেন।