০৭. তপতী বি. এ. পরীক্ষায় সে পাশ করিয়াছে

পরদিন সকালেই তপতী আয়োজন করিল বন্ধুদিগকে ভোজ দিবার। বি. এ. পরীক্ষায় সে পাশ করিয়াছে, সঙ্গীত-প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাইয়াছে, এবং সর্বোপরি যাহা সে লাভ করিয়াছে—তাহা তপনের সঠিক পরিচয়! এমন দিনে সে খাওয়াইবে না তো কবে খাওয়াইবে? তপতী টেলিফোনে সকলকে নিমন্ত্রণ করিল এবং মাকে বলিল,—ওকে বলে দিয়ো মা, সবার সঙ্গে বসে যেন আজ খায়—

মা হাসিয়া কহিলেন—নিজে বলতে পারিস্ নে খুকু? কি লাজুক মেয়ে তুই!

–না মা, ও ছুতো করে এড়িয়ে যায়—জানো তো, কি রকম দুষ্টু!

তপতী চলিয়া গেল। মার কাছে তপনের সম্বন্ধে দুষ্টুমির আরোপ তাহাকে লজ্জিতই করিয়াছে। তাহার নারী-হৃদয় ঐ কথাটুকু বলিয়াই যে এত তৃপ্তিলাভ করিতে পারে, তপতী তাহা কখনও ভাবে নাই। হউক লজ্জা, তথাপি তপতীর আনন্দ যেন মাত্রা ছাড়াইয়া গেলে!

নির্দিষ্ট সময়ে সকলেই আসিল—আসিল না শুধু তপন। তপতীর প্রশ্নের উত্তরে মা বলিলেন,–সাড়ে পাঁচটার আগে সে তো ফেরে না—ঠিক সময়েই ফিরবে।

নিরুপায় তপতী অন্যান্য সকলকে খাইতে দিল। সাড়ে পাঁচটায় তপন আসিতেই মা তাহাকে সকলের সঙ্গে বসাইয়া দিলেন। তপতী স্বহস্তে পরিবেশন করিল চপ-কাটলেট ইত্যাদি।

নিরুপায়ভাবে কিছুক্ষণ খাদ্যগুলির দিকে চাহিয়া থাকিয়া তপন কহিল মাংস খেতে আমি ভালবাসিনে—আমায় একটু রুটি-মাখন দিলে ভাল হয়।

মা বলিলেন,–একটু খাও বাবা, রুটি মাখন আজ নাই-বা খেলে? তুমি তো বৌদ্ধ নও যে অহিংস হচ্ছ।

তপন হাসিয়া বলিল,–মাংস না খেলেই অহিংস হয় না, মাংস তত খাদ্যই। ও খাওয়ায় হিংসাও হয় না। তবে আমার প্রয়োজনাভাব।

মিঃ ব্যানার্জি তপনকে আক্রমণের জন্যে যেন ওৎ পাতিয়া ছিলেন, কহিলেন,—-চপকাটলেট-ডিম খাওয়া কাঁটা-চামচেতে খাওয়া আধুনিক সভ্যতার অঙ্গ একটা–তপন চুপ করিয়া রহিল। উত্তর না পাইলে মিঃ ব্যানার্জি অপমান বোধ করিবেন ভাবিয়া মা বলিলেন,—ওর কথাটির জবাব দাও তত বাবা!

হাসিয়া তপন বলিল,–সভ্যতা কথাটা আপেক্ষিক, মা। বিলাতের লোক আমাদের অসভ্য বলে, আমরা আবার আমাদের থেকে অসভ্য বাছাই করে নিজের সভ্যতা প্রমাণ করতে চাই। দেশ আর পাত্র এবং রুচি ভেদে ওর পরিবর্তন হয়।

তপতী এতক্ষণ পরে হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, মানুষকে যুগোপযোগী হতে হবে—তপন নির্লিপ্তর মতো বলিল—এটাও অপেক্ষিক শব্দ। আমার সমাজে এই যুগেই আমি বেশ উপযোগী আছি, আবার সাঁওতালরা তাদের সমাজে এই বিংশশতাব্দীতেই বেশ উপযোগী রয়েছে।

কিন্তু আপনি তো এসে পড়েছেন আমাদের সমাজে? মিঃ অধিকারী বঙ্গের সুরে কহিলেন।

আপনাদের সঙ্গে আমার পবিচয় আজই প্রথম, এর মধ্যে আপনাদের সমাজে এসে পড়লুম কেমন করে, বুঝলুম না তো?—তপন প্রশ্নসূচক ভঙ্গীতে চাহিল।

তপতীকে বিয়ে করে।–রেবা উত্তর দিল হাসির মাধুৰ্য্য দিয়া।

তপন কয়েক সেকেও নীরব থাকিয়া কহিল,আমার ধারণা ছিল—বিয়ে করে মানুষ তার নিজের সমাজেই স্ত্রীকে নিয়ে যায়। আপনাদের বুঝি উল্টা হয় জানতুম না তো!

এই তীক্ষ ব্যঙ্গোক্তি তপতীকে স্পর্শ করিল গভীরভাবে। জেলিমাখা রুটিটা তপনের, দিকে আগাইয়া দিতে দিতে সে কহিল,—সব স্ত্রী যদি সে সমাজে না মিশতে পারে? না সইতে পারে সে সমাজকে?

তপন নিঃশব্দে কাপের চা-টুকু পান করিয়া উঠিতে উঠিতে বলিল,—সে তবে স্ত্রী নয়, সহধর্মিণী নয়-সে শুধু বিলাস সঙ্গিনী। সব স্বামীরও তাকে সইবার ক্ষমতা না থাকতে পারে।

—তপন চলিয়া গেল সকলকে নমস্কার জানাইয়া। চির অসহিষ্ণু তপতী শান্তস্নিগ্ধ ঔদার্য্যে চাহিয়া রহিল তপনের গমন পথের পানে-দৃষ্টিতে তাহার কোন সুদূর অতীত যুগের উজ্জ্বলতা ছড়ানো।

অতিথিদের সকলেই চলিয়া যাইবার পরেও রহিল রেবা, মিঃ ব্যানার্জি, মিঃ অধিকারী, মিঃ সান্যাল। তপতী উঠি উঠি করিতেছে, ভদ্রতার খাতিরে পারিতেছে না। মিঃ ব্যানার্জি এবং অন্যরা যাহারা এতদিন তপনকে পাড়াগেঁয়ে গণ্ড মূর্খ বর্বর ভাবিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিল, তাহারা আজ নিঃসংশয়ে বুঝিল, তপন মূর্খ তো নহেই, উপরন্তু উহার কথা বলার কায়দা অসাধারণ। উহারা বেশ বুঝিল—তপতী মুগ্ধ হইয়া গিয়াছে। কর্ণের শেষ অস্ত্র ত্যাগের মতো মিঃ ব্যানার্জি বলিয়া উঠিল,–পাঁচালি ছড়া পড়লেও অনেক কিছু শেখা যায়, দেখছি।

মিঃ অধিকারী তাহাকে সমর্থন করিয়া বলিল,–গোঁড়ামি দিয়েও আধুনিকদের বশ করা যায় দেখা যাচ্ছে!

রেবা এতক্ষণ চুপ করিয়াই ছিল—সুযোগ বুঝিয়া খিল খিল করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, বশ কাকে হতে দেখলেন আপনারা? কথাটার নূতনত্ব আমাদিগকে একটু চমকে দিয়েছে মাত্র। ভেবে দেখতে গেলে, তপনবাবু সেই প্রাচীন কুসংস্কারের জগদ্দল পাথরটাই তপতীর ঘাড়ে বসাতে চান, বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ উনি চান, তপতী তার সমাজ-সংস্কার, শিক্ষা-দীক্ষা সব বিসর্জন দিয়ে ওর সঙ্গে সেই ঘোমটা-টানা বৌ হয়ে থাক। যত অনাসৃষ্টি কাও লোকটার।

মিঃ সান্যাল কহিল,–নিশ্চয়ই তাই, নইলে ঐ সহধর্মিণী হওয়া কথাটা তুলবে কেন? সহধর্মিণীর যুগ আর নেই বাপু সখীত্বের যুগ চলছে

উহারা যাইবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইল। তপতী কোন কথাই বলিল না, যদিও রেবার কথাগুলি তাহার বুকে গভীর আলোড়ন তুলিয়াছে। সকলে চলিয়া যাওয়ার পরেও তপতী বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল–সমাজ-সংস্কার ছাড়িলে তো তাহার চলিবে না, তপনকে লইয়া কি সে বনে গিয়া বাস করিবে? তপন যদি আমাদের সমাজে না মিশতে পারে তবে তো তপতীর পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপদের কথা! তপতী প্ল্যান আঁটিয়া রাখিল আগামী পরশু তাহার সহপাঠিনী টুকুর বিবাহে তপনকে সঙ্গে লইয়া সে বরাহনগর যাইবে। তপনকে তাহাদের সমাজের যোগ্য করিয়া লইতেই হইবে, নতুবা তপতীর উপায় নাই।

নির্দিষ্ট দিনে দুপুর বেলা ৩পন খাইতে আসিতেই মা বলিলেন,–আজ খুকীর এক বন্ধুর বিয়ে বাবা, ওর সঙ্গে তোমায় যেতে হবে সন্ধ্যেবেলা বুঝলে?

তপন ভাতের গ্রাসটা গিলিয়া কহিল,আমি নাইবা গেলাম মা! আমার যে অন্যত্র কাজ রয়েছে। আগে বললে সময় করে রাখতাম আমি।

—সে কাজ পরে করো, বাবা! মা সস্নেহে আদেশ করিলেন–

–তা হয় না, মা আমি কথা দিয়েছি-আমার কথা আমি রাখবোই। একটা উপহার আমি এনে দেবো, আপনার খুকীর সেটা নিয়ে গেলেই হবে। আমার না যাওয়ায় ক্ষতি হবে না।

তপতী আড়ালেই ছিল।–তপন যাওয়াটা এড়াইয়া যাইতেছে দেখিয়া সম্মুখে আসিয়া বলিল,–যেতে—ভয় করে বললেই সত্যি বলা হয়। না-যাবার হেতু?

তপনের খাওয়া হইয়া গিয়াছিল, ৩পতীর কথাটার জবাবমাত্র না দিয়া সে আঁচাইবার জন্য বাহিরে চলিয়া গেল। রুদ্ধ অপমানে তপতীর সর্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া গেল। একে তো আজ যাচিয়া তপনের সহিত যাইতে চাহিয়াছে,—তার উপর মাকে দিয়া সে-ই অনুরোধ করাইয়াছে, আবার নিজে আসিয়া প্রস্তাব করিল, আর ঐ ইতর কিনা ভদ্রভাবে একটা জবাব পৰ্য্যন্ত দিল না! তপতীর প্রশ্নটাও যে ভদ্রজনোচিত হয় নাই, ইহা তাহার উষ্ণ মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল না। তপনের পিছনে গিয়া সে আদেশের সুরে কহিল,—যেতেই হবে বুঝেছেন?

মুখ ধুইয়া মশলা কয়টা মুখে ফেলিবার পূর্বে তপন অতি ধীর শান্তকণ্ঠে উত্তর দিল,–যেতে পারবো না—মাফ চাইছি–

উত্তর দিয়াই তপন চলিয়া গিয়াছে, তপতী যখন বুঝিল, তখন যুগপৎ ক্রোধ এবং অপমান তাহাকে দগ্ধ করিয়া দিতেছে।

সন্ধ্যার পূর্বেই তপন একটি ভেলভেটের কেসে একটি মূল্যবান ব্রোচ কিনিয়া মার হাতে দিয়া বলিল,–এইটা নিয়ে গেলেই আমার না যাওয়ার অসৌজন্য হবে না, মা। মুখ্য-সুখ্য মানুষ, আমার না যাওয়াই ভালো।

–হ্যাঁ, ভালোই—তপতীও তাহা সমর্থন করিল এবং তপনের বদলে তাহার প্রদত্ত উপরাহটা লইয়া বিবাহ বাড়ি চলিয়া গেল। সেখানে বহু লোকের উপহৃত দ্রব্যের মধ্যে তপনের দেওয়া ব্রোচটা তুলিয়া দেখা গেল লেখা আছে : আপনাদের জীবন বসন্তের বনফুলের মতো বিকশিত হোক, বর্ষার জলোচ্ছাসের মতো পরিপূর্ণ হোক—শরতের শস্যের মতো সুন্দর আর সার্থক হোক!…

তপনের আশীর্বাণী। যিনি পড়িলেন, তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি। কহিলেন—বেশ আশীর্বাদটি, বৎসবের শ্রেষ্ঠ তিনটি ঋতুর আশিস যেন ঐ কথা কটিতে ভরে দিয়েছে! চমৎকার লাগলো।

তপনের না-আসার জন্য অনেকেই ক্ষুন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাহার আশীর্বাদের প্রশংসা করিল সকলেই। দুচারজন কিন্তু বলিতে ছাড়িল না—জামাই মূর্খ, তাই তপতী সঙ্গে আনে না। ও আশিস কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে।

কথাটা তপতী শুনিল; লজ্জায় সে রাঙা হইয়া উঠিতেছে, কিন্তু বলিবার মতো কথা আজ তার জুটিতেছে না। যত শীঘ্র সম্ভব সে পলাইয়া আসিল।

সমস্ত রাত্রি তপতীর ভালো নিদ্রা হইল না। গত সন্ধ্যায় বিবাহ বাড়িতে সে রীতিমতো অপমানিত হইয়াছে। তপন কেন তাহার সঙ্গে গেল না? ভালো ইংরাজি জানে না সে, নাই বা জানিলতপতী সামলাইয়া লইত। মাছ-মাংস খায় না বলিলেই কাটা-চামচের হাঙ্গামা ঘটিত না। তপনের না যাইবার কী কারণ থাকিতে পারে? কোনদিনই সে কোথাও যায় নাই অবশ্য তপতীও ডাকে নাই। কিন্তু ডাকিলেও যাইবে না, এমন কি গুরুতর কাজ তাহার থাকিতে পারে? বিদ্যা তো আতি সামান্য। সারা দিন-রাত্রি কী এতে তাহার কাজ? না যাইবার অছিলায় সে ঐভাবে ঘুরিয়া বেড়ায় কাহারও সহিত দেখা করিতে চাহে না। তপতী আজ নিঃসংশয়ে বুঝিল—কতকগুলি পাকাপাকা কথা তপন বলিতে পারে, ভদ্রতা বা অভদ্রতা, অপমান বা সম্মান সম্বন্ধে তার কোন ধারণা নেই। তাহাকে এই বাড়িতে থাকিতে হইতেছে তাহার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যই। সে বুঝিয়াছে তপতীকে সে পাইবে না, এখন টাকাই তাহার লক্ষ্য। কিন্তু কাল তো তপতী তাহাকে আত্মদান করিতে প্রস্তুতই ছিল, তথাপি তপ কেন গেল না? তপতীর আন্তরিকতার অভাব সে কোথায় দেখিল?

ভোরে উঠিয়াই তপতী স্নান করিয়া এলোচুল ছড়াইয়া বসিল খাইবার ঘরে। তাহার অঙ্গের স্নিগ্ধ সুরভি ঘরের বাতাসকে মন্থর করিয়া তুলিয়াছে। পূজা করিয়া তপন চা খাইতে আসিল! মা দুজনকে খাবার দিয়া বসিয়া আছেন। তপতী যেন আপন মনেই বলিল,আজ বিকেলে আমি সিনেমায় যাবো, নিয়ে যেতে হবে আমায়।

মা হাসিয়া করিলেন,—শুনেছো বাবা, ওকে আজ যেন নিয়ে যেয়ো–

তপন মৃদুস্বরে কহিল, আজ থাক, মা, আমার ছোট বোনটিকে আজ একটু দেখতে যাব–যদি বলেন তো কাল সিনেমায় যেতে পারি।

রাগে তপতীর সর্বাঙ্গ কপিতে ছিল। তাহার অসংযত মন বিদ্রোহের সুরে ঝঙ্কার দিয়া উঠিল,—থাক, কাল আর যেতে হবে না! বোনকে নিয়ে থাকুন গে! বোনের বাড়ি থাকলেই পারতেন!

মা ধমক দিয়া উঠিলেন, কী সব বলছিস, খুকী? চুপ কর।

-থামো তুমি মা-কাজিন-এর উপর অত দরদের অর্থ তুমি বুঝবে না। তুমি থামো।

তপন চায়ের কাপটা চুমুক দিতে যাইতেছিলনামাইয়া রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মা, ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, উঠলে যে বাবা, বসো!

তপন বাহিরে যাইতে যাইতে শুধু বলিল,–আপনার খুকীকে বলে দেবেন মা, আমি আধুনিক যুগের তরুণ নই—আমার বোন বোনই!—তপন সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিবার পথ ধরিল। মা বিপন্না বোধ করিয়া কি করিবেন ভাবিয়া পাইতেছেন না।

তপতী রুখিয়া নীচে নামিতে নামিতে পিছন হইতে তপনকে বলিল,–যান চলে যান, আসবেন না আর।

তপন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–আমি চলে যাই এই কি চান আপনি?

-হ্যাঁ, চাই-চাই—চাই, আজই চলে যান, এক্ষুণি চলে যান।

তপনের দুই চোখে সীমাহারা বেদনা ঘনাইয়া উঠিল, নির্বাক স্তব্ধভাবে সে দাঁড়াইয়া আছে।

ব্যঙ্গ করিয়া তপতী বলিল,—দুলাখ তো নিয়েছেন, আবো কিছু যদি পারেন তো দেখেছেন–কেমন?

বিস্মিত তপনের কথা ফুটিল; কহিল,শ্যামসুন্দর চাটুজ্যের নাতনী সামান্য দুলাখ টাকার সন্ধানও রাখেন দেখছি?

ক্রোধে আত্মহারা তপতীর অভিজাত্যে আঘাত লাগিল। সক্রোধে সে জবাব দিল-শ্যামসুন্দরের নাতনীর বাবাকে কোনো জোচ্চোর ঠকিয়ে দুলাখ টাকা নিয়ে যাবে,

এ সে সইবে না মনে রাখবেন। যাবার আগে টাকার হিসেব দিয়ে যাবেন যেন।

উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া তপতী চলিয়া আসিল। মা ভাবিয়াছিলেন তপতী তপনকে ডাকিতে যাইতেছে, কিন্তু তাহাকে একা ফিরিতে দেখিয়া বা ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করিলেন,–তপন কই খুকী?

–জানিনে—চুলোয় গ্যাছে। বলিয়া তপতী আপন ঘরে চলিয়া গেল।

বিপন্না মাতা উহাদের কলহের কারণ খুঁজিয়া পাইতেছেন না। খুকীর ঘরে আসিয়া তিনি পুনরায় প্রশ্ন করিলেন,—কি বলে গেলো রে, না খেয়েই গেল যে!

তপতীর রাগ তখনও পড়ে নাই, তথাপি সংযত কণ্ঠেই উত্তর দিল;—আসব এক্ষুণি–ভাবছো কেন তুমি।

—কি সব বলিস বাবু তুই রাগের মাথায় ওরকম বিশ্রী কথা কেন তুই বলিস খুকী? তপতী এবার আর রাগ দমন করিতে না পারিয়া কহিল,–বেশ করেছি, বলেছি! কী এমন বললাম যে, না খেয়ে গেলেন—ভারী তো…!

মা ভাবিলেন দম্পতীর কলহ, চিরশান্ত তপন নিশ্চয়ই বাগ করিয়া যায় নাই। কিন্তু ভয় তাহার জাগিয়াই রহিল মনের মধ্যে।

বেলা প্রায় বারোটার সময় টেলিফোনের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিতেই উৎকণ্ঠিতা তপতী ছুটিয়া গিয়া ফোন ধরিল। মা-ও তখনি আসিয়া পাশে দাঁড়াইলেন! তপতী শুনিল পুরুষকণ্ঠে কে বলিতেছেন—তপনবাবু আজ বাড়ি ফিরবেন না, কাল সকালে ফিরবেন।

-কেন? কোথায় থাকবেন? তপতী প্রশ্ন করিল।

কিন্তু উত্তরদাতা ফোন ছাড়িয়া দিয়াছে।

মা ব্যাকুলকণ্ঠে কহিলেন,–কে ফোন করছে রে? তপন?

-হ্যাঁ, আজ আসবে না, বোনের বাড়ি থাকবে বলিয়া তপতী চলিয়া যাইতেছিল, পুনরায় ফিরিয়া কহিল,–রাগ করেনি মা, কাল ঠিক আসবে আমায় বললে; ভেবো না তুমি।

মা নিশ্চিন্ত হইলেন কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু তপতী ধরা পড়িবার ভয়ে পলায়ন করিয়া ভাবিতে লাগিল—কোথায় আর যাইবে, যাইবার জায়গা তো ঐ ফুটপাত, আর তপতীরই বাপের দুই লক্ষ টাকা—টাকার হিসাব দিতে হইলেই চক্ষু চড়কগাছ হইয়া যাইবে। ও ভাবিয়াছে, যাইবে বলিলেই তপতী ভয়ে কাঁদিয়া পড়িবে পায়ে! তপতীর অদৃষ্টে তাহা কখনও লেখে নাই, কিছুতেই না, তপতীর হাসি পাইল! তাহার পিতামহের গোড়ামী কম ছিল না, কিন্তু তাহার পিছনে ছিল যুক্তি—তিনি ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত। আর তপন কতকগুলি বাছা বাছা বুলি কপচাইয়া ভাবিয়াছে তপতীর অন্তর জিনিয়া লইল! অত সহজ নয়—তাহা হইলে আর ভাবনা ছিল না।

বিকালে বস্ত্রাদি পরিবর্তন করিয়া তপতী মিঃ ব্যানার্জি ও মিঃ সান্যালের সহিত বেড়াইতে বাহির হইল যথারীতি।

পরদিন সকালেই তপন ফিরিয়া আসিল ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখশ্রী লইয়া।

তপতীর সহিত তাহার কি কথা হইয়াছিল, মা কিছুই জানিতেন না; তিনি তপনকে স্বাগত সম্ভাষণে সস্নেহে বলিলেন,–শরীর ভলো তো বাবা! বড্ড শুকনো দেখাচ্ছে?

হ্যাঁ, মা, শরীর ভালোই আছে—খেতে দিন কিছু-বলিয়া তপন খাইতে বসিল।

তপতী আপন ঘরে বসিয়া দেখিল, তপন ফিরিয়াছে এবং নির্লজ্জের মতো খাইতেছে। অদ্ভুত এই লোকটা। এতবড় অপমান করার পরেও সে নির্বিকার? কোন্ মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে এইরূপ অপমান সহিতেছে, তপতীর আর তাহা অজানা নাই। ভালো, উহার ভণ্ডামীর শেষ কোথায় দেখা যাক।

 

দিন দুই তপনের আর কোন খোঁজ না-লইবার ভান করিল তপতী। সে দেখিতে চাহিতেছে, তপনের দিক হইতে কোন আবেদন আসে কিনা। কিন্তু তপন পূর্বের মতোই নির্বিকার, আসে, খায়, চলিয়া যায়! তৃতীয় দিনে তপতী ভীষণ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। এমন করিয়া সে আর পারে না! তপন আসে, খায়, মার সহিত পূর্বের ন্যায় দুই-একটা কথা যাহা কহিত তাহাও বন্ধ করিয়া দিয়াছে। দুইদিন তপতী সুযোগ খুঁজিয়া ফিরিয়াছে, সুবিধা হয় নাই। তপন যেন আপনাকে একেবারে অবলুপ্ত করিয়া দিয়াছে—অথচ নির্লজ্জের মতো খাওয়া আর থাকাটা তো তেমনই রহিল। এতই যদি উহার সম্মান-জ্ঞান, তবে চলিয়া গেল না কেন? তপতী নিশ্চয় জানে যে-কোন লোক নিতান্ত অপদার্থও, এই অপমানের পর চলিয়া যাইত। তপনের না-যাওয়ার কারণটা এতদিনে বেশ ধরা পড়িয়া গিয়াছে। তপতী সেদিন আগুনের খেলা খেলিয়া বসিল।

মিঃ ব্যানার্জিকে লইয়া সিঁড়ির পাশের ঘরে একটা সোফায় তপতী বসিয়া বেহালা বাজাইতেছে—তপন এখনি আসিবে, তাহাকে দেখানো দরকার যে, তপনের থাকা-না থাকায় বা রাগ-অভিমানে তপতীর কিছুই আসে যায় না।

ঠিক সাড়ে পাঁচটায় তপন প্রবেশ করিল। মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন, ভালো আছেন? টিকি-ই দেখা যায় না!

—টিকি নেই, ধন্যবাদ-বলিয়াই তপন পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতেছিল, তপতী বেহালার ছড়িটা দিয়া তপনকে খোঁচাইয়া কহিল,—ভদ্রভাবে জবাব দিতে পার না উল্লুক!

—আঃ করেন কি মিস চ্যাটার্জি! বলিয়া মিঃ ব্যানার্জি তাহার হাতটা ধরিলেন।

তপন চোখের কোণে দৃষ্টিপাতও করিল না, ধীরে ধীরে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতেছে—শুনিতে পাইল তপতী বলিতেছে,—ওকে লাথি মারলে যাবে না, জুতো মারলেও যাবে না–সত্যি কি না মেরে দেখুন।

তপনের হৃৎপিণ্ডে কে যেন একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ হুল ফুটাইয়া দিয়াছে। ধীরে ধীরে সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ নামিয়া আসিয়া তপন পূর্ণদৃষ্টিতে তপতীর মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল—আপনি কি আমার কাছে মুক্তিই চাইছেন?

তপতী নিজের মাথাটা মিঃ ব্যানার্জির কাঁধে রাখিয়া মৃদুহাস্যে বলিল,চাইছি দাও তো? দেখি তোমার কত ঔদার্য্য!

সত্যি চাইছেন?-তপন পুনরায় প্রশ্ন করিল।

মিঃ ব্যানার্জির একখানা হাত নিজের মসৃণ ললাটে ঘষিতে ঘষিতে তপতী ঝঙ্কার দিয়া কহিল,–হাঁ-হাঁ-হাঁ, চাইছি! দাও আমায় মুক্তি। পারবে দিতে?

—দিলাম। আজ থেকে আপনি মুক্ত, আপনি স্বতন্ত্র, আপনি স্বাধীন…

তপন সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া গেল।–তপতীর তৎক্ষণাৎ মনে পড়িল—ঐ অদ্ভুত লোক, যে দুই টাকার পাখি চার টাকার কিনিয়া আকাশে উড়াইয়া দেয়, তাহাকে বিবাহ বন্ধন হইতে মুক্তি দিয়া গেল! তপতীর সহিত তাহার আর কোনো সম্বন্ধ রহিল না। নানা-না, তাহা কি হইতে পারে? তপতীকে সে বিবাহ করিয়াছে। এত সহজে মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। ওটা একটা কথার কথা। ও তো এখনি আবার বাইরে যাইবে, তখন জিজ্ঞাসা করিবে তপতী দুই লক্ষের উপর আরো কত টাকা সে গুছাইয়াছে।

মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন,–লোকটার ধাপ্পা দেবার শক্তি অসাধারণ।

তপতী এতক্ষণে আবিষ্কার করিল, সে এখনও মিঃ ব্যানার্জির কোলে পড়িয়া আছে। এখনি কেহ দেখিয়া ফেলিবে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাজনাটা লইয়া বসিল।

অনেকক্ষণ অতীত হইল, তপন নামিতেছে না কেন? আজ আর বাহিরে যাইবে না কি? আগ্রহান্বিতা, তপতী একটি ছুতা করিয়া উপরে গিয়া দাঁড়াইল তপনের রুদ্ধদ্বার কক্ষের জানালা-পার্শ্বে দেখিল পরম বিস্ময়ের সহিত, তপন, ভণ্ড, অর্থ লোভী তপন উপুড় হইয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে তাহার পূজার বেদীমূলে। উহার হইল কি? ও কি এমনি ভাবেই কাদিয়াই তপতীকে হার মানাইবে? এখনি মা দেখিবেন, বাবা জানিতে পারিবেন, একটা কেলেঙ্কারী বাধিয়া যাইবে। তপতীর ভয় করিতে লাগিল। এত অপমানেও যাহার এতটুকু বিমর্ষতা তপতী দেখে নাই, আজ অতি সামান্য কারণেই সে কেন কাঁদিতেছে। ওঃ, তপতী মিঃ ব্যানার্জির কোলে শুইয়াছিল বলিয়া উহার জেলাসি জাগিয়াছে। নিশ্চয়ই। হাসিতে তপতীর দম আটকাইয়া যাইবার জো হইল। মিঃ ব্যানার্জি-যাহাকে তপতী জুতার ডগায় মাড়াইয়া চলে। নীচে না গিয়া আপন ঘরে আসিয়া তপতী খুব খানিক হাসিল-ঐ লোকটাও তবে জেলাস হইতে পারে! আশ্চৰ্য্য, উহারও এ বোধ আছে নাকি। থাকিবে না কেন? ও তো নির্বোধ নয়। আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য অপমান সহ্য করিতেছে। তপতীকে ও নাকি স্বেচ্ছায় মুক্তি দিবে! তাহা হইলে আর ভাবনা ছিল না। ভালোই হইয়াছে ঈর্ষায় উহার অন্তরটাকে তপতীক্ষত-বিক্ষত করিয়া দিবে। দেখিবে তপতী কত সহ্যশক্তি উহার আছে।

তপতী মার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। মা জিজ্ঞাসা করিলেন-তপন এখনও ফিরছে না কেনরে–জানিস কিছু?

মা জানেন না তপন ফিরিয়াছে। নিঃশব্দে আসিয়া তপনের দরজায় তপতী একটা জোর ধাক্কা দিল। তপন সম্বিত লাভ করিয়া যখন চোখ-মুখ মুছিয়া বাহিরে আসিল তখন তপতী সরিয়া গিয়াছে। মার সহিত কি কথা হয় শুনিতে হইবে, তপতী আড়ালে দাঁড়াইল। মা তপনের মুখ দেখিয়া বলিলেন কী হল বাবা! মুখ তোমার…

–বিশেষ কিছু না,, খেতে দিন।

খাবার দিতে দিতে মা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, সত্যি বলো, বাবা, কি তোমার হয়েছে-বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমায়।

—এক জায়গায় একটু আঘাত পেয়েছি, মা—তা প্রায় সামলে নিলাম।

–কী আঘাত বাবা, কোথায় আঘাত লাগলো?—মা ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন।

–শারীরিক না মা—মানসিক; শারীরিক আঘাত আমি সবই প্রায় সইতে পারি মা, মানসিক সব আঘাত এখনও সইতে পারি না, তবু সয়ে যাবো, মা! আমার অন্তর–নহে তা পাষাণ-মত, তাহলে ফাটিয়া যেতো।

বুকের গভীর দীর্ঘশ্বাসটা তপন কিছুতেই ছাপিতে পারিল না!

এত কি হইয়াছে! তপতী আশ্চর্য হইয়া গেল। মা প্রায় কান্নাকরা কোমল কণ্ঠে কহিলেন,—হ্যাঁ বাবা, খুকী কিছু বলেছে?

-থাক মা—সব কথা মাদের বলা যায় না—দিন চা আর-একটু।

মা নিশ্চিত বুঝিলেন, খুকী তাহার কিছু বলিয়াছে। নতুবা তপন তো কোন দিন এমন বিহ্বল হয় নাই। আশ্চৰ্য্য চরিত্র ঐ ছেলেটির। তপন চলিয়া গেলে মা তপতীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী তুই বলেছিস—বল খুকী আমার বড় ভাবনা হচ্ছে—

–ভাবনার কিছু নেই। তোমার অপদার্থ জোচ্চোর জামাইকে ঠেঙালেও তোমার বাড়ি ছেড়ে যাবে না—ভয় নেই তোমার–!

–খুকী!-মা ধমকাইয়া উঠিলেন!

একটা সামান্য ব্যাপারকে এতখানা বাড়াইয়া তোলার জন্য তপনের উপর তপতী তিক্তই হইয়াছিল। মার ধমক খাইয়া অত্যন্ত বিরক্তির সহিত উত্তর দিল,—ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি—শুনলে!

তপতী চলিয়া গেল। নিঃসহায় মাতা বি. এ. পাস মেয়ের কথা শুনিয়া বিস্ময়ে বাসিয়া রহিলেন।

 

শরাহত বিহঙ্গীর ন্যায় ব্যথিত-হৃদয়ে শিখা ও মীরা শুনিল তপনের মুখে তাহার ভাগ্যবিপর্যয়ের কাহিনী। মীরা উদাস দৃষ্টিতে দাদার মুখের পানে চাহিয়া আছে, আর শিখার দুই গণ্ড বহিয়া নামিয়াছে অশুর বন্যা! শিখাই কথা কহিল,

—তাহলে তোমার জীবনটা একেবারে পঙ্গু হয়ে গেল, দাদা?

—না ভাই এই-ই ভালো হয়েছে। আজ ঈশ্বরকে বলতে ইচ্ছে করছে :

এই করেছে ভালো…
এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো!
আমার এ ধূপ না পোড়ালে…

শিখা তপনের ব্যথা করুণ গান সহিতে পারিল না, মুখে হাত চাপা দিয়া বলিল,–থামো দাদা, তোমার পায়ে পড়ি, থামো! তোমার ঈশ্বর তোমার থাক—আমাদের তাঁকে দরকার নেই। যে নিষ্ঠুর বিধাতা পবিত্র জীবনকে এমন করে নষ্ট—শিখা আর বলিতে পারিল না, ফোপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

মীরা কহিল,–চুপ কর, শিখা—মানুষের কান্নায় ভগবান অবিচল! তার কাজ তিনি করবেনই।

বিনায়ক দূরে বসিয়া উহাদের কথোপকথন শুনিতেছিল; আগাইয়া আসিয়া বলিল–তাহলে কবে যাচ্ছিস? একুশেই যাবি তো?

-হ্যাঁ ভাই। আমি না-ফেরা পর্যন্ত তোদের কাজ যেন ঠিক চলতে থাকে। মীরা জিজ্ঞাসা করিল,–সেখানে তোমার কত দেরী হবে, দাদা! খুব বেশী!

-—তা জানিনে বোটি! এখন আমার কাজ সহজ হয়ে গেছে। আর তো কোন বন্ধন নেই। মুক্তি সে স্বেচ্ছায় চেয়ে নিল।—তোরা সুখে আছিস—আমি এবার সেখানে যতদিন থাকি না—খবর দেবো তোদর ভাবনা কেন?

মীরা চুপ করিয়া রহিল। শিখা পুনরায় প্রশ্ন করিল ক্রন্দন জড়িত কণ্ঠে—তুমি কি তবে দেশান্তরী হয়ে যাবে, দাদা?

–না, বোন্‌টি! আমার মাতৃভূমি বাংলা ছেড়ে যাবে কোথায়? আমি একনিষ্ঠা পত্নী চেয়েছিলাম–নিজে হয়তো একনিষ্ঠ হাতে পারিনি তাই বঞ্চিত হলাম। এবার যোগ্য হতে হবে।

–তুমি কি তাহলে তপতীকে এখনও ভালোবাসো দাদা?

—বাসি। আত্মবঞ্চনায় কোনো লাভ নেই। ভালবাসি বলেই তাকে অত সহজে মুক্তি দিতে পারলাম। তার বুকে বোঝা হয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না। আমার মনের আসনে ওর স্মৃতি আমি বহন করবো, শিখা, আমার চোখের জলে নিত্য ধুইয়ে দেবো সেই আসন।

–ও যদি আবার তোমায় ফিরে চায়, দাদা?—মীরা প্রশ্ন করিল তপনকে।

—সে আর হয় না, বোনটি। আমার সত্য চিরদিন অবিচল। কিছুর জন্য সে ভাঙে না। কিন্তু তোরা এমনি বসে থাকলে কি করে চলবে রে? চ সব, কাগজপত্রগুলো ঠিক করে ফেলি। বিনায়ক। তুই তোর কারখানা চালা ভাই, আমি আমার কাজের মধ্যে আত্মবিসর্জন করবো এবার।

বিনায়ক নতমুখেই দাঁড়াইয়া রহিল।

শিখা বলিল,–তোমার কাজটা কি দাদা?

মানুষ গড়ার কাজ, বোনটি–তোমাদেরও সাহায্য চাই। পৃথিবী থেকে মানবতার সাধারণ সূত্রটি লোপ পেতে বসেছে। আমি শুধু দেখিয়ে দিতে চাই, পশু থেকে মানুষ কোথায় ভিন্ন। পাশবত্ব আর মানবত্বের মাঝখানে সে সূক্ষ্ম ব্যবধান রেখা রয়েছে, তাকেই স্পষ্টতর করা হবে আমার কাজ।

—তোমর জ্যোতির্গময় বইখানা হিন্দুস্থানী ভাষায় অনুবাদিত হয়ে পুরস্কার পেল, আর বাংলাদেশে মোটে বুঝলেই না, এদেশের মানুষকে কি দিয়ে তুমি গড়বে, দাদা?

বিদেশ থেকে গড়া আরম্ভ করবো। যে কোন বিষয়কে অশ্রদ্ধার চোখে দেখা বাঙালীর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এ স্বভাব সহজে যাবার নয়। কিন্তু আয় তোরা—তপন সকলকে লইয়া অগ্রসর হইল।

বিনায়ক মৃদুস্বরে কহিল, আমিও সঙ্গে গেলে হোতনা তপু? একা যদি অতদূর?

–হ্যাঁ একাই যাবোসঙ্গী যার হবার কথা ছিল সে যখন সরে গেল…

শিখা আবার কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার নারীচিত্ত তপনের বেদনার গভীরতাকে মাপিতেছেনা। শান্ত শুদ্ধ তপন বারংবার বিচলিত হইয়া উঠিতেছে কোন্ অসহনীর যন্ত্রণায়, শিখা যেন তাহা নিজের বুকেই অনুভব করিতেছে।

অত্যন্ত করুণ কণ্ঠে সে কহিল,–লক্ষ্মী দাদা আমার, আজম্ম ব্রহ্মচারী তুমি-আমাদের ভগ্নী স্নেহ নিয়েই কি তুমি চালাতে পারবে না?

–ঠিক চলে যাবে, দিদি, কিছু না থাকলেও চলতো–নিরবধি কাল কোথাও আটকায়।

–কিন্তু তুমি বড় ব্যথা পেয়েছ, দাদা!

–নিজের জন্য নয়, বোনটি—ওর জন্য। ও কেমন করে এতবড় জীবনটা কাটাবে।

–ও আবার বিয়ে করবে।

—আহা, তাই করুক—ও বিয়ে করে সুখী হোক, শিখা, আমি কায়মনে আশীর্বাদ করছি।

–কিন্তু দাদা তুমি এবার আত্মপ্রকাশ করো-ও বুঝুক, কী ধন হারালো।

ছিঃ বোনটি। ওর উপর কি আমার প্রতিহিংসা নেবার কথা? ও-যে আমার—এ কথা আর কেউ না জানলেও আমি জানি।

–তাহলে তুমি মুক্তি দিলে কেন, দাদা? তোমাকেইবা ও চিনলো না কেন?

-ওর শিক্ষা ওকে বিকৃত করেছে, শিখা, মুক্তি না দিলে ও কোনদিন আমায় চিনবে না। অনেকদিন তো অপেক্ষা করে দেখলাম। ওকে ওর মা বাবা যেভাবে গড়েছেন, তেমনিই তো সে চলবে। তবে সে যদি আমার হয় তাহলে আমি তাকে পাবোই। একটা জন্ম কেন তার জন্য লক্ষ-জন্ম আমি অপেক্ষা করতে পারবো।

—তুমি তাহলে আত্মপ্রকাশ করবে না?

না। তাহলে তো এখুনি ও আমায় চাইবে। আর সে চাওয়া হবে—আমাকে নয় আমার মৰ্য্যদাকে। তেমন করে ওকে পেতে আমি চাইনে। আমি দরিদ্র তপন, মুখ তপন, ভণ্ড এবং অর্থলোভী তপন—এই তার ধারণা। এ ধারণাটা বদলাবার চেষ্টাও সে করলো না; কারণ, সে সর্বান্তকরণে আমাকে অমনি ভেবে ত্যাগ করতে চায়।

—বিয়ে যদি না করে? শ্যামসুন্দর চাটুজ্যের নাতনীর দ্বিতীয় বিবাহ সহজ হবে না।

—আমি তার কি করবো, শিখা! আর, কঠিনই বা কেন হবে? ওর বাবার একমাত্র মেয়ের সুখের জন্য নিশ্চয় করবে। তবে তপতী যদি নিজেই বিয়ে না করে তো অন্য কথা।

—তাহলে কি করবে তুমি?

—কিছু না, শিখা–আমার সঙ্গে তার এ-জন্মের সম্পর্ক চুকে গেছে। আমি কায়েমমনসাকথা বলি ছলনা করি মুক্তি দেবার ভণ্ডামী আমি করি না। প্রয়োজন হলেই রেজিষ্টারী করে দেব।

সকলে অফিস-ঘরে আসিল।

 

স্নেহাস্পদ জামাতাকে বাড়ি হইতে চলিয়া যাইতে বলায় মা যে অত্যন্ত ক্ষুন্ন হইয়াছে, তপতীর তাহা বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। কিন্তু তপন তো সত্যই চলিয়া যাইতেছে না? আশ্চর্য, এতবড় অপমানটা সে সহিয়া গেল! যাইলেই বরং তপতী বাঁচিয়া যাইত। বিদেশে থাকিলে লোকের কাছে তবু বলা যায়, বাড়িতে নেই। ঘরে থাকিয়াও পার্টিতে যোগ না দিলে লোকে যে কথা বলে! পার্টিতে যোগ দিবার যোগ্যতা যে উহার নাই, লোকে তো তাহা বোঝে না।

তপতী স্থির করিল, তপনকে অপমান সে আর করিবে না, যাহা খুশী করুক, তপতীর অদৃষ্টে স্বামীসুখ নাই—কি আর করা যাইবে! তপনকে লইয়া ঘর করা তাহার অসাধ্য।

তপতী তিন-চারদিন একবারও এদিকে আসে নাই। তপন নিয়মিত সময়ে আসে খায়—এবং চলিয়া যায়—ইহার সংবাদ পত্রী রাখিয়াছে। ঐ নির্লজ্জ লোকটা আবার মুক্তি দিবার ছলে তাহাকে শাসাইতে আসে,—বলে, তুমি মুক্ত স্বাধীন স্বতন্ত্র। লজ্জা বলিয়া

কোন বস্তু কি উহার অভিধানে একেবারে লেখে না! কিন্তু সেদিন অত কাদিল কেন? তপতী উহার কোনোই কিনারা করিতে পারিল না ভাবিয়া।

পঞ্চম দিন সকালে সে আসিয়া মাকে বলিল,–আমি তাহলে আজই ভর্তি হচ্ছি গিয়ে, মা, এম এ ক্লাসে।

তপন খাইতেছিল। মা তাহাকে প্রশ্ন করিলেন,–তুমি কি বললা বাবা, তপন?

তপন উত্তর দিল-আমার মতের কি মূল্য, মা। ওর যা ইচ্ছে করবে। তবে অর্থাভাবে আমি পড়তে পারি নি, অর্থ থাকতেও কেউ না পড়লে আমার দুঃখ হয়।

–না বাবা, পড়ুক-বলিয়া মা তপতীকেও খাইতে দিলেন।

তপতী ভাবিতে লাগিল, সে পড়িবে শুনিয়া তপন খুশীই তো হইল। পড়াশুনার দিকে উহার আগ্রহ বেশীই আছে। মাকে বলিল,আমার কখানা বই কিনতে হবে, না—দোকানে একা যেতে চাইনে।

–বেশ তো তপন সঙ্গে যাক। যাও তত বাবা, ওর সঙ্গে একটু। গাড়ী বার করো।

–আচ্ছা মা যাচ্ছিবলিয়া তপন উঠিল। গ্যারেজ হইতে গাড়ী আনিয়া দাঁড় করাইল। বেশ-বাস করিয়া তপতী আসিয়া উঠিল তপনের পাশেই। তপন নীরবে গাড়ী চালাইতেছে। মুখে তো কথা নাই-ই; এমন কি মুখখানা যথাসম্ভব নীচু করিয়া এবং ঘাড় ফিরাইয়া বহিয়াছে। তপতী নির্নিমেষ নেত্রে তাহার লতানোনা চুলগুলোর পানে চাহিয়া রহিল! না, তপন মুখ তুলিল না! গাড়ী গিয়া দাঁড়াইল পুস্তকের দোকানের সামনে। তপতী নামিয়া দোকানে ঢুকিল, তপন বসিয়া রহিল গাড়ীতেই। বই কিনিয়া তপতী ফিরিয়া আসিল। গাড়ীতে বসিয়াই বলিল,

–একটু মার্কেটে দরকার ছিল—কথাটা বাতাসকে বলা হইলেও তপন মার্কেটের সম্মুখে গাড়ী থামাইল। নামিয়া তপতী পিছন দিকে চাহিল, ইচ্ছা—তপন আসুক! কিন্তু ডাকিতে তাহার লজ্জা করিতেছে। এত কাণ্ডের পর তপনকে ডাকা সম্ভব হয় কেমন করিয়া। দোকানে ঢুকিয়া সে একটি কর্মচারীকে বলিল তপনকে ডাকিয়া আনিতে। তপন গাড়ী ছাড়িয়া আসিয়া দাঁড়াইল। তপতী সাহস করিয়া কহিল একটি কর্মচারীকে, কোন সেন্টটা নেবো ওঁকে দেখান তো?

তপন নিম্নকণ্ঠে উত্তর দিল,—ও সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

আচ্ছা লোককেই তপতী সেন্ট বাছাই করিতে বলিতেছে। তপতীরই বোকামী। একটা লিলি লইয়া সে ফুলের দোকানে আসিল, পিছনে তপন। বিক্রেতা তপতীকে চেনে, বলিল–আসুন, কী ফুল দেবো? একটা ভালো গোড়ে দিই যুঁই এর?

—দিন। ভালো ফুল তো? বাসি হবে না নিশ্চয়ই?

আপনাকে দেবো বাসি ফুল। সেদিনকার মালাটা কি বাসি ছিল?

তপতী লজ্জায় রাঙা হইয়া গেল। অতি অল্পদিন পূর্বেই যে সে এখানে মালা কিনিয়াছে, তপন তাহা বুঝিতে পারিল। বেশী কথা না বাড়াইয়া সে মালা চাহিল এবং আড়চোখে তপনের দিকেই চাহিল। তপন নির্বিকার নিশ্চল দাঁড়াইয়া… মুখের ভাব তেমনি, চোখে ঠুলি। মালাটা তপনের হাতে দিতে বলিয়া তপতী আগাইয়া গেল, গাড়ীর দিকে। কাগজ দিয়া মালাখানি জড়াইয়া দিলে তপন তাহা আনিয়া তপতী ও তাহার মধ্যকার স্থানে রাখিয়া গাড়ী চালাইল। তাহার মুখের ভাবের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হয় নাই কপালে এতটুকু কুঞ্চনরেখা পড়ে নাই। গতিশীল গাড়ীটাকে নিরাপদে লইয়া যাইবার জন্যই যেন তাহার সব মনটাই সংযুক্ত। তপতী আশ্চর্যান্বিত হইল। এতক্ষণ তপতী পাশে বসিয়া আছে, তপন একবার তাহিল না পৰ্য্যন্ত! এতটা ঔদাসিন্যের হেতু কি? কিম্বা উহার স্বভাবই এমনি! তপতীকে একবার দেখিলে ফিরিয়া দেখিতে ইচ্ছা করে, এ খবর তপতীর অজানা নাই। কিন্তু এই লোকটার কি তপতীকে দেখিতেও কিছুমাত্র আগ্রহ জাগে না। কিম্বা সেদিনকার ব্যাপারটায় এখনও সে রাগ করিয়া আছে।

গাড়ী আসিয়া পৌঁছিল! তপতী নামিয়া যাইতেই তপন দারোয়ানকে কহিল আমি একটা নাগাদ ফিরবো, মাকে বলল। সে আবার বাহিরে চলিয়া গেল পায়ে হাঁটিয়া; ট্রামে চড়িবে হয়ত। তপতীর হাতের মালাটা তাহাকে পীড়িত করিতেছিল। কি করিবে সে উহা লইয়া আর? তপনকে দিবার জন্য সে উহা কেনে নাই! কিন্তু গাড়ীতে আসিবার সময় ইচ্ছ হইয়াছিল মালাটা উহাকেই দিবে এবং ফেরৎ পাইবে; কিন্তু সাহসে কুলাইল না। মাল লইয়া আজ আর করিবে কি সে? এখনি কলেজে যাইতে হইবে।

ওবেলা দেখা যাইবে ভাবিয়া তপতী মালাটা রাখিয়া আহারাতেকলেজে চলিয় গেল। তপন তাহার দেওয়া মালার কদর কি বুঝিবে ভাবিয়া মনকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্ট করিল, কিন্তু বারম্বার মনে হইতেছেনা বুঝিবার কারণ নাই। তপন অশিক্ষিত নয়র অনেকের চেয়ে বেশী শিক্ষিত।

এই কয়েক মাসের ঘটনাগুলো আলোচনা করিতে গিয়া তপতীর ভয় করিতে লাগিল কী দুঃসহ অপমানই না তপতী করিয়াছে তপনকে! ও যদি একটু রাগিয়াই থাকে, তাহারে অন্যায় কিছুই হইবে না। কিন্তু রাগিয়াছে কিনা তাহারই বা প্রমাণ কই।

বৈকালবেলা তপতী মার কাছে আসিয়া খাবার তৈরী করিতে বসিল। বহুদিন আনে নাই-মা যেন কৃতার্থ হইয়া গেলেন। ভাবিলেন তপনকে খাওয়াইবার জন্য খুকী তাহা রান্নাঘরে আসিয়াছে। মা তাহাকে নিরামিষ চপকাটলেট তৈয়ারীর মশলা যোগাই দিলেন। তপনের জন্য রান্না করিতে তপতীর লজ্জা করিতেছিল, তাই বলিল,—মিঃ বোসকে আসিতে বলেছি, মা একটু আমিষও রাঁধবো।

মা বিষাদিত হইয়া উঠিলেন। খুকী আজও তপনের জন্য কিছু করে না। কিন্তু তাহা কিইবা বলিবার আছে? তপতী রান্না চড়াইয়া লুকাইয়া মিঃ বোসকে ফোন করিল চ খাইতে আসিবার জন্য।

মিঃ বোস আসিবার পূর্বেই আসিল তপন। মা বলিলেন,—বোস সাহেব তো এখনও এল না খুকী, তপনকে খেতে দে

এখনি এসে পড়বে, মা—একুট বসতে বলল, তপতী আবদার ধরিল। তপন কিছু বলিল না। নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। মিঃ বোস আসিতেই সুসজ্জিত সকালের মালাটা বাঁ হাতে জড়াইয়া বাহিরে আসিল নমস্কার করিতে। মিঃ বোস নমস্কার করিয়া বলিলে হাসিমুখে,–সুন্দর! আপনাকে এমন চমৎকার মানিয়েছে আজ!

বসুন বসুন! ওসব বাজে কথা কইতে হবে না বলিয়া তপতী একটা কৃত্রিম ধম দিয়া খাবারের প্লেট আগাইয়া দিল দুজনকেই। তপন নীরবে নতমুখে একটুকরা ভাঙ্গিয় যেন চুষিতে লাগিল। মা চলিয়া গিয়াছিলেন–তপতী নিজেই যখন খাওয়াইতেছে, তখ তাহার আর থাকার কী দরকার। তপতী লক্ষ্য করিল তপনের না-খাওয়া। মিঃ বোস না কথা বলিতেছেন—হঠাৎ যেন তার চমক ভাঙিল, এমন ভাবে বলিয়া উঠিলেন,—ও নমস্কার সেদিনকার ব্যবহারটার জন্য আমি লজ্জিত। মাফ করুন!

বিস্মিত তপন বলিল,–মাফ চাওয়ায় কী কারণ ঘটলো বুঝলাম না তো।

—সেদিন না জেনে আপনাকে একটা অন্যায় কথা বলে ফেলেছিলাম।

–ওঃ সেই ইডিয়েট! তাতে কি হয়েছে? আমি কিছু মনে করিনি! নমস্কার।

তপন উঠিয়া পড়িল। তপতী ভাবিতে লাগিল, তপনের জন্য খাবার করিতে আসি। সে তপনের অসম্মানকারীকেই তাহার পাশে খাইতে বসাইয়াছে, কথাটা তপতীর আদে মনে ছিল না। মিঃ বোসকে না ডাকিলেই হইত। তপন হয়তো সেজন্যই খাইল না।

মা আসিয়া দেখিলেন তপন চলিয়া গিয়াছে। বলিলেন–কিছুই সে খায়নি রে! ওসব ভালবাসে না তপন। রুটি-জেলি দিলিনে কেন?

তপতী উত্তর দিবার পূর্বেই মিঃ বোস বলিলেন,–খেতে শেখান, মাসিমা–মেয়েকে যে জলে ফেলে দিয়েছেন।

রাগে মার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া যাইতেছিল, নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে তিনি শুধু চুপ করিয়া বহিলেন।

তপতী কিন্তু কহিল,—থাক—আপনাদের তুলতে ডাকা হবে না।

নিজে তপতী ভাবিতেছে, তাহাকে জলেই ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু অন্যের মুখে সেকথা তপতী আর শুনিতে চাহে না।

মিঃ বোস শোধরাইয়া লইবার জন্য বলিলেন,—কথাটা আমি খারাপ ভেবে বলিনি—আহার-বিহার, আচার-আচরণ না শিখলে সমাজে মিশবেন কি করে। তার জন্যেই বলছিলাম।

মিঃ বোস অতিথি, তাই তপতী চুপ করিয়াই রহিল; কিন্তু আজ তাহার মনে হইতেছে, পরের মুখে তপনের নিন্দা শুনিতে তাহার আর ভালো লাগে না।

অসুস্থতার ছুতা করিয়া তপতী মিঃ বোসের সহিত সেদিন আর বেড়াইতে গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *