০৩৪. বিস্তৃতরূপে অভিমন্যু-বধ বৃত্তান্ত বর্ণন

৩৪তম অধ্যায়

বিস্তৃতরূপে অভিমন্যু-বধ বৃত্তান্ত বর্ণন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে নরনাথ! পঞ্চ পাণ্ডব ও কৃষ্ণ যুদ্ধে সাতিশয় ভীমকৰ্ম্মা ও দেবগণেরও দুরধিগম্য এবং তাঁহারা যে একান্ত শ্রমশীল, তাহাও তাঁহাদিগের কর্ম্ম দ্বারা ব্যক্ত হইয়াছে। রাজা যুধিষ্ঠির সত্ব, কর্ম্ম, অম্বয়, বুদ্ধি, কীর্ত্তি, যশ ও সৌন্দর্য্যে অদ্বিতীয়, সতত সত্যধর্ম্ম নিরত ও দান্ত। তিনি ব্রাহ্মণপূজা প্রভৃতি গুণসমুহে বিভূষিত হইয়া সৰ্ব্বদাই স্বর্গ-ভোগ করিতেছেন। যুগান্তকালীন অন্তক, জামদগ্ন্য ও রথস্থ ভীমসেন এই তিনজন সমকক্ষ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অর্জ্জুনের উপমা পৃথিবীতে নাই। গুরুভক্তি, মন্ত্র রক্ষণ, নিপুণতা, বিনয়, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, অনুকৃতি ও শূরতা এই ছয় গুণ নকুলে নিয়ত বিদ্যমান রহিয়াছে। সহদেব শ্রুত, গাম্ভীৰ্য্য, মাধুৰ্য্য, সত্ব, রূপ ও পরাক্রমে অশ্বিনীতনয়দ্বয়ের সদৃশ। কৃষ্ণে ও পঞ্চপাণ্ডবে যে সমস্ত গুণ আছে, সেই সকল গুণ একমাত্র অভিমন্যুতে লক্ষিত হইয়া থাকে। রাজা যুধিষ্ঠিরের ধৈৰ্য্য, কৃষ্ণের চরিত্র, ভীমসেনের কাৰ্য্য, অর্জ্জুনের রূপ, বিক্রম ও শাস্ত্র জ্ঞান এবং সহদেব ও নকুলের বিনয়ের উপমা নাই।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! নিতান্ত দুর্জ্জয় অভিমন্যু কিরূপে রণস্থলে বিনষ্ট হইল, আমি তাহা আনুপূর্বিক শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি।

চতুর্দ্দশ দিবসীয় যুদ্ধ – পাণ্ড কৌরব সময়

সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! আপনি দুঃসহ শোক সম্বরণ করিয়া সুস্থির হউন; আমি আপনার বন্ধু বিনাশ বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করি, শ্রবণ করুন। দ্রোণাচাৰ্য্য চক্রব্যূহ রচনা করিয়া তন্মধ্যে দেবরাজ তুল্য মহীপালগণকে সংস্থাপিত করিলেন। উহার দ্বারদেশে সূর্য্যসঙ্কাশ রাজকুমারগণ সন্নিবেশিত হইলেন। তৎকালে সমুদয় রাজতনয় একত্র হইয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই রক্ত পতাকা পরিশোভিত, হেমহার বিভূষিত, চন্দন ও অগুরুচৰ্চিত, রক্তবিভূষণ সম্পন্ন, সূক্ষরক্তাস্বরধারী, মাল্যদামমণ্ডিত, সুবর্ণ খচিত ধ্বজদণ্ডে শোভিত ও কৃতপ্রতিজ্ঞ। সেই দশ সহস্র রাজপুত্ৰ একত্র সমবেত হইয়া সমরাভিলাষে অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন। তাঁহারা পরস্পর সমদুঃখ-সুখ, সমসাহস ও হিতানুষ্ঠান নিরত হইয়া আপনার পৌত্র লক্ষণকে অগ্রসর করত পরস্পর স্পর্দ্ধাসহকারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। শ্বেতচ্ছত্রে ও চামরে উদয়মান দিবাকরের ন্যায়, পুরন্দর সদৃশ শ্রীমান্ রাজা দুর্য্যোধন মহারথ কর্ণ, কৃপ ও দুঃশাসন কর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়া দ্রোণাধিকৃত সেনামুখে অবস্থান করিতে লাগিলেন। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ সৈন্যমধ্যে সুমেরু পর্ব্বতের ন্যায় স্থির ভাবে অবস্থান করিলেন। অমর সদৃশ আপনার ত্রিংশৎ তনয় অশ্বত্থামাকে পুরোবর্ত্তী করিয়া সিন্ধুরাজের পার্শ্বে অবস্থান করিতে লাগিলেন। দ্যূতবেদী গান্ধাররাজ শকুনি, শল্য ও ভূরিশ্রবা সিন্ধুরাজের পার্শ্বে শোভমান হইলেন। অনন্তর উভয়পক্ষ বীরগণ মৃত্যু পর্য্যন্ত পণ করিয়া তুমুল লোমহর্ষণ সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন।”