০২৭. ভগদত্তের হস্তিপ্রভাব বর্ণন

২৭তম অধ্যায়

ভগদত্তের হস্তিপ্রভাব বর্ণন

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনি আমাকে অর্জ্জুনের সমরদক্ষতার বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, অতএব মহাবাহু ধনঞ্জয় যাহা যাহা করিয়াছেন, শ্রবণ করুন। মহাবীর ভগদত্ত সংগ্রাম স্থলে ভয়ঙ্কর কাৰ্য্য করিতে আরম্ভ করিলে মহাবীর ধনঞ্জয় সমুদ্ধূত ধুলিপটল দর্শন ও মানবগণের কোলাহল শ্ৰবণ করিয়া কৃষ্ণকে কহিলেন, হে মধুসূদন! মহারাজ ভগদত্ত গজ লইয়া সত্বরে নিষ্ক্রান্ত হওয়াতেই এই ঘোরতর নিনাদ উত্থিত হইতেছে। মহাবীর ভগদত্ত গজনবিশারদ ও পুরন্দর সদৃশ; উনি এই ভূমণ্ডলে গজবোধীদিগের প্রধান; উহাঁর গজের প্রতিগজ নাই। ঐ গজ কৃতকর্ম্মা, জিতক্লম এবং অস্ত্রাঘাত ও অগ্নিস্পর্শ সহিষ্ণু অস্ত্র দ্বারা উহাকে বধ করা দুঃসাধ্য। অদ্য ঐ হস্তী একাকীই সমুদায় পাণ্ডব সৈন্য সংহার করিবে। আমরা দুই জন ব্যতীত আর কেহই উহাকে নিবারণ করিতে পারিবে না; অতএব সত্বরে ভগদত্তের সমীপে গমন কর। আমি আজি হস্তিবলে গর্বিত বয়ঃপ্রভাবে প্রদীপ্ত ভগদত্তকে পুরন্দরপুরে আতিথ্য গ্রহণ করাইব। মহাত্মা বাসুদেব অর্জ্জুনের বচনানুসারে ভগদত্তাভিমুখে রথ সঞ্চালন করিতে লাগিলেন।

মহাবীর ধনঞ্জয় ভগদত্তের সহিত সংগ্রাম করিবার বাসনায় তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইয়াছেন; এমন সময় ত্রিগৰ্ত্তদেশীয় দশ সহস্র ও কৃষ্ণের পূর্ব্বানুচর চারি সহস্র মহারথ, এই চতুর্দ্দশ সহস্র সংশপ্তক তাঁহাকে সংগ্রামার্থ আহ্বান করিতে লাগিল। এ দিকে ভগদত্ত সৈন্যগণকে সংহার করিতেছে; ওদিকে সংশপ্তকগণ যুদ্ধার্থ আহ্বান করিতেছে; এই উভয় সঙ্কট সমুপস্থিত হওয়াতে মহাত্মা ধনঞ্জয়ের চিত্ত দোলার ন্যায় দুই দিকে ধাবমান হইতে লাগিল। কি করি! এই স্থান হইতে প্রতিনিবৃত্ত হই অথবা যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করি, এই চিন্তা করিয়া মহাবীর ধনঞ্জয় নিতান্ত ব্যাকুল হইলেন। পরিশেষে বহুক্ষণ বিবেচনা করিয়া একাকী বহু সহস্র সংশপ্তকগণকে সংহার করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়া তাহাদের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। মহাবীর দুৰ্য্যোধন ও কর্ণ অর্জ্জুনের বধসাধনার্থই দুই দিকে সংগ্রাম সমুপস্থিত করিয়াছিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় সংশপ্তক বধে কৃতনিশ্চয় হইয়া তাঁহাদের সে আশা বিফল করিলেন।

অর্জ্জুন কর্ত্তৃক বহু সংসপ্তক সংহার

তখন মহারথ সংশপ্তকগণ অর্জ্জুনের উপর সহস্র সহস্র নতপর্ব্ব শর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। সংশপ্তকগণের শরজালে চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন হওয়াতে কি অর্জ্জুন কি কৃষ্ণ কি অশ্বগণ কি রথ, কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। জনার্দ্দন সংশপ্তকগণের পরাক্রম দর্শনে বিমুগ্ধ ও স্বেদাক্তকলেবর হইবামাত্র অর্জ্জুন ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপপূর্ব্বক সংশপ্তকগণকে প্রায় সংহার করিলেন। শত শত শর, শরাসন ও জ্যাসনাথ হস্ত এবং শত শত কেতু, অশ্ব, সারথি ও রথিগণ ছিন্নকলেবর হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। দ্রুম, অচল ও অম্বুধরতুল্য কলেবর, সুসজ্জিত, আরোহী বিহীন, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হস্তিগণ পার্থশরে নিহত হইয়া ধরাতলশায়ী হইল। আরোহী সমেত কুঞ্জরগণ অর্জ্জুনের শরনিকরে ছিন্নকুথ, ছিন্নভরণ ও গতজীবন হইয়া ধরাশয্যায় শয়ন করিতে লাগিল। বীরগণ ঋষ্টি, প্রাস, অসি, মুগর ও পরশু সমবেত বাহুসকল ভল্ল প্রহারে ছিন্ন হইয়া ধরাতলে পতিত হইল। বালাদিত্য, অম্বুজ ও চন্দ্র সদৃশ নরমস্তক সকল অর্জ্জুন-শরে ছিন্ন হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল।

এই রূপে মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ হইয়া শত্রু নিপাতে প্রবৃত হইলে সেনাগণ প্রাণনাশক শরনিকরে সন্তাপিত হইয়া উঠিল। হস্তী যেমন পদ্মবন প্রমথিত করে, তদ্রূপ মহাবীর ধনঞ্জয় হেন সৈন্য সংহার করিতে দেখিয়া সকলেই তাঁহাকে সাধু সাধু বলিয়া প্রশংসা করিতে লাগিল।
মহামতি মধুসূদন অর্জ্জুনকে ইন্দ্রসদৃশ কর্ম্ম করিতে দেখিয়া যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতে লাগিলেন, হে পার্থ! অদ্য তুমি সংগ্রামস্থলে যেরূপ কাৰ্য্য করিলে, বোধ হয়, তাহা ইন্দ্র, যম ও কুবেরেরও দুষ্কর। তুমি এক কালে শত শত সহস্র সহস্র মহারথ সংশপ্তকগণকে সংহার করিয়াছ।

মহাবীরধনঞ্জয় এইরূপে বহুসংখ্যক সংশপ্তককে সংহার করিয়া কৃষ্ণকে ভগদত্তাভিমুখে রথচালন করিতে আদেশ করিলেন।