০২০. ত্রয়োদশ দিন যুদ্ধ – ব্যূহরচনা

২০তম অধ্যায়

ত্রয়োদশ দিন যুদ্ধ – ব্যূহরচনা

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারথ দ্রোণাচার্য্য রজনী অতিবাহিত করিয়া মহারাজ দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, হে বৎস! আমি তোমারই বংশদ। আমি অর্জ্জুনের সহিত সংশপ্তকগণের সমর উদ্ভাবিত করিআছি। অনন্তর অর্জ্জুন সংশপ্তকগণের সহিত সমরানল প্রজ্বলিত করিয়া তাঁহাদিগকে সংহার করিবার নিমিত্ত নির্গত হইলে দ্রোণ ব্যূহরচনা করত ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিবার অভিলাষে পাণ্ডব সেনাভিমুখে নির্গত হইলেন। রাজা যুধিষ্ঠির ভারদ্বাজ বিরচিত সুপর্ণ ব্যূহ নিরীক্ষণ করিয়া মণ্ডলার্দ্ধ ব্যূহ প্ৰস্তুত করিলেন। মহাবীর দ্রোণ সুপর্ণ ব্যূহের মুখ, সানুচর সহোদরগণে পরিবেষ্টিত রাজা দুৰ্য্যোধন তাহার মস্তক, কৃতবর্ম্মা ও তেজস্বী গৌতম চক্ষু দ্বয়, ভূতশর্ম্মা, ক্ষেমশৰ্ম্মা করকাক্ষ এবং কলিঙ্গ, সিংহল, প্রাচ্য, শূদ্র, আভীর, দাশেরক, শক, যবন, কাম্বোজ, হংসপদ, শূরসেন, দরদ, মদ্রও কেকয়গণ আর শত শত সহস্র সহস্র হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতি উহার গ্রীবা, ভূরিশ্রবা, শল্য, সোমদত্ত ও বাহ্লিক অক্ষৌহিণী পরিবৃত হইয়া দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থান করিলেন। অবন্তিদেশীয় বিন্দানুবিল ও কাম্বোজ সুদক্ষিণ, ইঁহারা বাম পার্শ্ব আশ্রয় করিয়া অশ্বত্থামার অগ্রে অবস্থান করিতে লাগিলেন। উহার পৃষ্ঠ ভাগে অম্বষ্ঠ, কলিঙ্গ, মাগধ, পৌণ্ড, মদ্রক, গান্ধার, শকুন, প্রাচ্য, পার্ব্বতীয় ও বসাতিগণ এবং পুচ্ছদেশে মহাবীর কর্ণ পুত্র, জ্ঞাতি, বান্ধবগণ এবং নানা দেশ সমাগত বহুল বল সমভিব্যাহারে অবস্থান করিলেন। জয়দ্রথ, ভীমরথ, যাজ, ভোজ, ভূমিঞ্জয়, বৃষ, ক্ৰাথ ও মহাবল পরাক্রান্ত নৈষধ, ইঁহারা বহুসংখ্য সৈন্য সমভিব্যাহারে ব্যূহের বক্ষস্থলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। দ্রোণাচার্য্য কর্ত্তৃক হত্যশ্বরথপদাতি পরিকল্পিত সুপর্ণ ব্যূহ যেন বায়ুক্ষুভিত মহাসাগরের ন্যায় নৃত্য করিতেছে বোধ হইল। যোদ্ধা সকল সমরাভিলাষে উহার পক্ষ ও প্রপক্ষ হইতে জলদকালীন বিদ্যুদ্দাম মণ্ডিত গর্জ্জমান মেঘমণ্ডলের ন্যায় নির্গত হইতে লাগিল। ঐ ব্যূহের মধ্যে প্রাগেজ্যাতিষেশ্বর ভগদত্ত সুসজ্জিত মাতঙ্গে আরোহণ করিলে এবং ভৃত্যেরা পূর্ণিমা রজনীতে কৃত্তিকা নক্ষত্রযুক্ত চন্দ্রমাসদৃশ মাল্যদাম বিভূষিত, শ্বেতছত্র তাহার মস্তকে ধারণ করিলে তিনি উদয়কালীন দিবাকরের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। তাঁহার অঞ্জনপুঞ্জ সদৃশ মদমত্ত মাতঙ্গ বারিধারাভিষিক্ত উভঙ্গ শৈলের ন্যায় নিরীক্ষিত হইল। যেমন দেবগণ দেবরাজ ইন্দ্রকে বেষ্টন করিয়া থাকেন, তদ্রূপ বিবিধায়ুধধারী বিচিত্র অলঙ্কারে অলঙ্কৃত পার্ব্বতীয় নৃপতিগণ তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া রহিল।

যুধিষ্ঠিরের সতর্কতা – ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্ম্মুখ যুদ্ধ

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির নিতান্ত দুর্ভেদ্য অমানুষ ব্যূহ নিরীক্ষণ করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে কহিলেন, হে বীর! আজি আমি যাহাতে ব্রাহ্মণের বশবর্তী না হই, তাহার উপায় বিধান কর। ধৃষ্টদ্যুম্ন কহিলেন, হে মহারাজ! দ্রোণাচার্য্য বহু যত্নেও আপনাকে বশবর্তী করিতে সমর্থ হইবেন না; আমি তাঁহাকে ও তাহার অনুচরগণকে সমরে নিবারণ করিব। আমি জীবিত থাকিতে আপনি কদাচ উদ্বিগ্ন হইবেন না; দ্রোণাচাৰ্য্য আমারে পরাজয় করিতে কিছুতেই সমর্থ হইবেন না।

এই বলিয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন শরজাল বিস্তার পূর্ব্বক দ্রোণের অভিমুখে ধাবমান হইলে দ্রোণাচার্য্য সেই অশুভদৰ্শন ধৃষ্টদ্যুম্নকে অবলোকন করিয়া ক্ষণমধ্যেই সাতিশয় অপ্রসন্ন হইয়া উঠিলেন। তখন আপনার পুত্র দুর্ম্মুখ দ্রোণাচাৰ্য্যকে একান্ত বিমনায়মান নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার প্রিয়ানুষ্ঠান বাসনায় ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিবারণ করিলেন। তখন উভয়ের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্ম্মুখকে সত্বরে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া অনবরত শরবর্ষণ পূর্ব্বক দ্রোণকে নিবারণ করিলেন। দুর্ম্মুখ দ্রোণকে নিবারিত দেখিয়া সত্বরে আগমন পূর্ব্বক নানা লক্ষণলাঞ্ছিত শরজালে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিমোহিত করিলেন। তাঁহারা এই রূপে ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে দ্রোণাচার্য্য রাজা যুধিষ্ঠিরের সেনাগণকে শর প্রহার করিতে লাগিলেন। যেমন বায়ুবেগ বশত মেঘমণ্ডল ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যায়, তদ্রূপ রাজা যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণ কোন কোন স্থলে নিতান্ত বিচ্ছিন্ন হইতে লাগিল।

ঐ যুদ্ধ মুহুৰ্তকাল মধুরদর্শন হইয়াছিল; পরিণামে উন্মত্তের ন্যায় নিতান্ত মৰ্যাদা শূন্য হইয়া প্রবর্ত্তিত হইল। তখন উভয় পক্ষে আত্মপর বিবেচনা কিছুই রহিল না; কেবল অনুমান ও সংজ্ঞা দ্বারা লোক সকল উদ্ভাবিত হইতে লাগিল। তাঁহাদিগের চূড়ামণি, নিষ্ক, অন্যান্য ভূষণ ও বৰ্ম্ম সমুদায়ে আদিত্যসঙ্কাশ প্রভাজাল উদ্ভাসিত হইল। পতাকামণ্ডিত হস্তী, অশ্ব ও রথ সকল বলাকাসনাথ জলপটলের ন্যায় রমণীয় শোভা ধারণ করিল। মনুষ্য মনুষ্যকে, অশ্ব অশ্বকে, রথী রথীকে ও হস্তী হস্তীকে বিনাশ করিতে লাগিল। ক্ষণকাল মধ্যে গজে গজে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সেই সমস্ত মদস্রাবী দ্বিরদগণের গাত্র ঘর্ষণ ও দশনাঘাতে সধূম পাবক সমুত্থিত হইতে লাগিল। তখন স্থলিতপতাক বিষাণজ্বলিত হুতাশন করিনিকর নভোমণ্ডলে বিদ্যুদ্দামমণ্ডিত মেঘের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইল। যেমন শরৎকালে গগনতল জলদজালে সমাচ্ছন্ন হয়, তদ্রূপ মাতঙ্গ সকল রণস্থল সমাচ্ছন্ন করিয়া ইতস্তত বিকীর্ণ হইল, কেহ কেহ নিনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল, কেহ কেহ বা তথায় নিপতিত হইল। কোন কোন হস্তী বাণ ও তোমর দ্বারা আহত হইয়া প্রলয়কালীন মেঘের ন্যায় শব্দ করিতে লাগিল। কোন কোন হস্তী বাণ ও তোমর দ্বারা বিদ্ধ হইয়া নিতান্ত ভীত হইল। কতকগুলি হস্তী বিষাণ সমাহত হইয়া প্রলয়কালীন জলদের ন্যায় ঘোরতর আর্ত্তস্বর পরিত্যাগ করিতে লাগিল। কতক গুলি হস্তী অন্য হস্তী দ্বারা প্রতিকূলগামী হইলে অঙ্কুশাহত হইয়া পুনরায় উন্মথিত করত শত্রুগণকে আঘাত করিল।

মহামাত্র সকল মহামাত্র কর্ত্তৃক শর তোমর দ্বারা তাড়িত হইয়া প্রহরণ ও অঙ্কুশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক করিপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে নিপতিত হইল। মহামাত্র শূন্য মাতঙ্গ সকল নিনাদ পরিত্যাগ পূর্ব্বক ছিন্ন অভ্রখণ্ডের ন্যায় পরস্পর সংশ্লিষ্ট হইয়া নিপতিত হইতে লাগিল। কতক গুলি হস্তী নিহত, পাতিত ও পতিতায়ুধ ব্যক্তিদিগকে বহন করিয়া গণ্ডারের ন্যায় চতুর্দ্দিকে গমন করিতে লাগিল। কতকগুলি হস্তী তোমর, ঋষ্টি ও পরশু দ্বারা আহত ও আহন্যমান হইয়া আর্ত্তস্বর পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিপতিত হইল। উহাদিগের অচলোপম বৃহৎ কলেবরে পৃথিবী আহত হইয়া সহসা কম্পিত ও শব্দায়মান হইতে লাগিল। বিনষ্ট আরোহীযুক্ত, পতাকা সমলঙ্কৃত মাতঙ্গগণ নিপতিত হওয়াতে পৃথিবী ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পর্ব্বত দ্বারা পরিকীর্ণের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইল। করিসমারূঢ় মহামাত্র সকল রথী দ্বারা ভল্লাস্ত্রে নির্ভিন্নহৃদয় হইয়া অঙ্কুশ ও তোমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক ভূপৃষ্ঠে পতিত হইল। কোন কোন হস্তী নারাচে আহত হইয়া ক্রৌঞ্চের ন্যায় চীৎকার করিয়া উভয় পক্ষীয় বীরগণকে বিমর্দ্দিত করত দশদিকে গমন করিল। তখন বসুন্ধরা হস্তী, অশ্ব ও রথে পরিপূর্ণ এবং মাংস, শোণিত ও কর্দ্দমে নিতান্ত দুর্গম হইয়া উঠিল। বারণগণ সচক্র, বিচক্ৰ, অতি বৃহৎ রথ সকল দশনে মথিত করিয়া রথীর সহিত উৎক্ষিপ্ত করিতে লাগিল। রথ সকল রথী শূন্য, অশ্ব ও মাতঙ্গগণ আরোহী শূন্য ও নিতান্ত ভীত হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিল। তথায় পিতা পুত্রকে ও পুত্র পিতাকে সংহার করিতে লাগিল। এই রূপে অতি তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইলে তৎকালে কিছুই অনুভূত হইল না। লোহিতবর্ণ কর্দ্দমে মনুষ্য সকলের গুল্‌ফ পৰ্য্যন্ত নিমগ্ন হইল; তখন বোধ হইতে লাগিল যেন পাদপ সকল প্রদীপ্ত দাবানলে প্রোথিত হইয়াছে। বস্ত্র, কবচ, ছত্র ও পতাকা সকল শোণিতসিক্ত হওয়াতে সমস্ত শোণিত বলিয়াই প্রতীয়মান হইতে লাগিল। নিপাতিত অশ্ব, রথ ও নর সমুদায় রথনেমির প্রত্যাবর্ত্তনে বহুধা ছিন্ন হইল। সেই সৈন্যসাগর গজসমূহ রূপ মহাবেগশালী, বিনষ্ট মনুষ্য রূপ শৈবাল শোভিত, রথসমূহ রূপ তুমুল আবর্ত্তযুক্ত হইয়া উঠিল। জয়াভিলাষী বীর পুরুষেরা বাহনরূপ বৃহৎ নৌকা দ্বারা তাহাতে অবগাহন করত নিমগ্ন না হইয়া বিপক্ষগণকে মোহাবিষ্ট করিতে লাগিলেন। চিহ্নসম্পন্ন যোদ্ধাগণ শর জালে সমাচ্ছন্ন হইলে কোন ব্যক্তিই চিহ্নবিহীন হইয়াছে উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইল না। মহাবীর দ্রোণ সেই ভয়ঙ্কর ঘোরতর সমরে শত্রুগণকে মোহাবিষ্ট করিয়া যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইলেন।