০১১. কৃষ্ণের প্রভাবচিন্তায় ধৃতরাষ্ট্রের হতাশ

১১শ অধ্যায়

কৃষ্ণের প্রভাবচিন্তায় ধৃতরাষ্ট্রের হতাশ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! বাসুদেব যে সকল অনন্য পুরুষ সাধারণ দিব্য কর্ম্ম সম্পাদন করিয়াছেন, তাহা শ্রবণ কর। মহাত্মা বাসুদেব বাল্যকালে যখন গোপকুলে বর্দ্ধিত হইতেছিলেন, তৎকালেই তাঁহার বাহুবল ভুবনয়ে বিখ্যাত হইয়াছিল। তিনি উচ্চৈঃশ্রবার তুল্য বল ও সমীরণের ন্যায় বেগশালী যমুনা বনবাসী অশ্বরাজকে বধ করিয়াছেন; তিনি গোসমূহের যম স্বরূপ ঘোরকৰ্ম্মা বৃষরূপধর দানবকে বাল্যকালে ভুজযুগলে সংহার করিয়াছেন; সেই পুণ্ডরীকাক্ষ প্রলম্ব, নরক, জম্ভ, মহাসুর, পীঠ ও সুরতুল্য মুরকে বিনাশ করিয়াছেন; তিনি বিক্রম পূর্ব্বক জরাসন্ধের প্রতিপালিত মহাতেজা কংসকে স্বদলের সহিত সংগ্রামে নিপাতিত করিয়াছেন; সেই অমিত্রঘাতী বাসুদেব বলদেবকে সহায় করিয়া বলবিক্রমশালী, সমগ্র অক্ষৌহিণীর ঈশ্বর, ভোজরাজের মধ্যস্থ, কংসের ভ্রাতা, সুনামা নামক শূরসেনের রাজাকে সসৈন্যে দগ্ধ করিয়াছেন; একদা কোপনস্বভাব বিপ্রর্ষি দুর্ব্বাসা পত্নী সমভিব্যাহারে তাঁহার আরাধনা করিলে, তিনি তাঁহাকে বর প্রদান করিয়াছিলেন; বাসুদেব গান্ধাররাজকন্যার স্বয়ম্বরে ভূপালগণকে পরাভূত করিয়া তাঁহাকে বিবাহ করিয়াছিলেন; অমর্ষপরবশ নরপতিগণ তাঁহার বৈবাহিক রথে যোজিত হইয়া তোদনদণ্ডে আহত ও ক্ষত বিক্ষত হন; সেই জনার্দ্দন অক্ষৌহিণীপতি মহাবাহু জরাসন্ধকে অন্য দ্বারা নিপাতিত করিয়াছেন; যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় সময়ে রাজসেনাপতি পরাক্রমশালী চেদিরাজ শিশুপাল অর্ঘ বিষয়ে বিবাদ করিয়াছিলেন বলিয়া তিনি তাঁহাকে পশুবৎ ছেদন করিলেন; সেই মাধব দৈত্যদিগের আকাশস্থ, শাল্বরক্ষিত, দুরাসদ সৌভনগর সমুদ্রগর্ভে নিক্ষিপ্ত করিয়াছেন; সেই পুণ্ডরীকাক্ষ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মাগধ, কাশি, কৌশল, বাৎস্য, গার্গ্য, করূষ, পৌণ্ড্র, আবন্ত্য, দাক্ষিণাত্য, পার্ব্বত, দশেরক, কাশ্মীরক, ঔরসিক, পিশাচ, মুগল, কাম্বোজ, বাটধান, চোল, পাণ্ড্য ত্রিগৰ্ত্ত, মালব, দরদ, নানা দিক্‌ হইতে সমাগত খস ও শকগণ এবং সানুচর যবনগণকে জয় করিয়াছিলেন। তিনি জলজন্তু সমাকীর্ণ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইয়া সলিলান্তৰ্গত বরুণকে পরাজিত করিয়াছেন; সেই হৃষীকেশ যুদ্ধে পাতালতলবাসী পঞ্চজনকে সংহার করিয়া পাঞ্চজন্য দিব্য শঙ্খ গ্রহণ করিয়াছেন; সেই মহাবল বাসুদেব ধনঞ্জয়ের সহিত খাণ্ডবারণ্যে হুতাশনকে সন্তুষ্ট করিয়া আগ্নেয় অস্ত্র ও দুর্দ্ধর্ষ চক্র লাভ করিয়াছেন; সেই বীর গরুড়ের উপর আরোহণ পূর্ব্বক অমরাবতী ত্রাসিত করিয়া মহেন্দ্রভবন হইতে পারিজাত পুষ্প আনয়ন করিয়াছেন; দেবরাজ তাঁহার পরাক্রম অবগত আছেন: বলিয়াই তখন উহা সহ্য করিয়াছিলেন।

হে সঞ্জয়! ইহা কখন শ্রবণগোচর হয় নাই যে, রাজাদিগের মধ্যে এক জনও কৃষ্ণ কর্ত্তৃক পরাজিত হন নাই। সেই পুণ্ডরীকাক্ষ কৌরব সভামধ্যে যেরূপ অদ্ভুত ব্যাপার সম্পাদন করিয়াছিলেন, তিনি ব্যতীত আর কে সেরূপ করিতে সমর্থ হয়? আমি ভক্তিলাভে নিৰ্ম্মল হইয়া সেই ঈশ্বরকে অবলোকন ও তাঁহার অনুষ্ঠান সকল প্রত্যক্ষবৎ প্রতীতি করিয়াছিলাম। বিক্রম ও বুদ্ধিশালী হৃষীকেশের কৰ্ম্মের অন্ত প্রাপ্ত হওয়া যায় না। বোধ হয়, সেই বাসুদেব আহ্বান করিলে গদ, শাম্ব, প্রদ্যুম্ন, বিদূরথ, অগাবহ, অনিরুদ্ধ, চারুদেষ্ণ, সারণ, উল্মুখ, নিশঠ, ঝিল্লীবভ্রু, পৃথু, বিপৃথু, শমীক, ও অরিমেজয় প্রভৃতি মহাবল বৃষ্ণিগণও যে কোন রূপে হউক, যুদ্ধকালে পাণ্ডব সৈন্যকেই আশ্রয় করিবেন; তাহা হইলে আমার সকলই সংশয়াপন্ন হইবে। যে স্থানে জনার্দ্দন অবস্থান করিবেন, অযুত নাগের তুল্য বল, কৈলাস শিখর সদৃশ, কুলমালী বলরামও সেই স্থানে গমন করিবেন তাহার সন্দেহ নাই।

হে সঞ্জয়! দ্বিজগণ যাঁহাকে সকলের পিতা বলিয়া নির্দেশ করেন, সেই বাসুদেব কি পাণ্ডবগণের নিমিত্ত যুদ্ধ করিবেন? তিনি যখন পাণ্ডবগণের নিমিত্ত সন্নদ্ধ হইবেন, তখন কেহই তাঁহার প্রতিযোদ্ধা হইতে পারিবেন না। যদি কৌরবগণ পাণ্ডবগণকে জয় করেন, তাহা হইলে মহাবাহু বাসুদেব তাঁহাদিগের নিমিত্ত উৎকৃষ্ট শস্ত্র গ্রহণ পূর্ব্বক সমুদায় নরপতি ও কৌরবকে সংহার করিয়া কুন্তীকে মেদিনী প্রদান করিবেন। যে রথে কৃষ্ণ সারথি ও অর্জ্জুন রথী, কোন রথ সমরে সেই রথের প্রতিপক্ষ হইবে? অতএব কোন ক্রমেই কুরুগণের জয় লাভ দেখিতেছি না। এক্ষণে যে রূপে যুদ্ধ হইয়াছিল, সমুদায় বল।

অর্জ্জুন কেশবের ও কেশব অর্জ্জুনের আত্মা; অর্জ্জুন নিত্য বিজয়ী, কেশব সনাতন কীর্ত্তিমান; ধনঞ্জয় সকল লোকের অজেয়; বাসুদেব অপরিমিত প্রধান গুণের আকর; দুৰ্য্যোধন দৈবদুর্ব্বিপাকে মোহিত ও আসন্নমৃত্যু হইয়া সেই অর্জ্জুনকে ও সেই বাসুদেবকে অবগত হইতেছে না। এই দুই মহাত্মা পূৰ্ব্বদেব নর ও নারায়ণ; ইহারা উভয়ে একাত্মা, দ্বিধাভূত হইয়া মানবগণের নয়নগোচর হইতেছেন; ইহাদিগের পরাভব একবার মনেও উদয় হয় না। এই দুই যশস্বী পুরুষ ইচ্ছা করিলেই এই সমস্ত সেনা বিনাশ করিতে পারেন; মানুষ বিগ্রহ পরিগ্রহ করিয়াছেন বলিয়াই সেরূপ ইচ্ছা করিতেছেন না। যুগবিপর্য্যয় যেমন মনুষ্যের মোহ উৎপাদন করে, মহাত্মা ভীষ্ম ও দ্রোণের মৃত্যুও সেইরূপ মোহ উৎপাদন কৱিতেছে। কি ব্রহ্মচর্য্য কি বেদাধ্যয়ন, কি শস্ত্র, কিছুতেই কেহ মৃত্যু হইতে পরিত্রাণ প্রাপ্ত হয় না।

হে সঞ্জয়! লোকপূজিত, কৃতাস্ত্র, যুদ্ধদুৰ্ম্মদ, মহাবীর ভীষ্ম ও দ্রোণ নিহত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া আমি কি নিমিত্ত জীবিত রহিলাম? আমরা পূর্ব্বে যুধিষ্ঠিরের যে রাজলক্ষী নিরীক্ষণ করিয়া অসূয়াপরবশ হইয়াছিলাম, ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য্যের বিনাশে আজি তাহারই অনুজীবী হইতে হইল। আমার নিমিত্তই কুরুগণের এই মহাক্ষয় উপস্থিত হইয়াছে; কালপরিণত ব্যক্তিদিগের পক্ষে তৃণ সকলও বজ্রের ন্যায় কাৰ্য্য করে। যাহার কোপে মহাধনুর্দ্ধর ভীষ্ম ও দ্রোণ নিপাতিত হইলেন, সেই যুধিষ্ঠিরই পৃথিবীর এই অনন্ত ঐশ্বৰ্য্য হস্তগত করিয়াছেন; অতএব ধৰ্ম্ম আমার আত্মজগণের প্রতি পরাঙ্মুখ হইয়া স্বভাবত যুধিষ্ঠিরকেই আশ্রয় করিয়াছে। এই ক্রূর কাল সর্ব্বনাশ না করিয়া অতীত হইবে না। আর দেখ, মনস্বিগণ বিষয় সকল যেরূপ মনে করেন, দৈব বশত উহা অন্য প্রকার হইয়া থাকে; সে যাহা হউক, এই যে দুশ্চিন্ত্য বিষম কাণ্ড উপস্থিত হইয়াছে, ইহা পরিহার করিবার সাধ্য নাই; এক্ষণে যথার্থ যুদ্ধবৃত্তান্ত বৰ্ণন কর।