০১০. শোককাতর ধৃতরাষ্ট্রের শুশ্রূষা

১০ম অধ্যায়

শোককাতর ধৃতরাষ্ট্রের শুশ্রূষা

রাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে এই রূপ জিজ্ঞাসা করিয়া আন্তরিক শোকে সাতিশয় কাতর, পুত্রগণের জয়লাভে হতাশ ও হতচেতন হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। পরিচারকগণ তাঁহাকে বীজন ও পবিত্রগন্ধ অতিমাত্ৰ শীতল জলে অভিষেক করিতে লাগিল। ভরতকুলের কামিনীগণ মহারাজকে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া বেষ্টন পূর্ব্বক করতল দ্বারা তাঁহার কলেবর স্পর্শ করিতে লাগিলেন এবং বাষ্পকুলকণ্ঠ হইয়া ধীরে ধীরে তাঁহাকে ভূমিতল হইতে উত্থিত করিয়া আসনে উপবেশন করাইলেন। তথাপি তাঁহার মূর্চ্ছাপনোদন হইল না। তখন চতুর্দ্দিক হইতে বীজন আরম্ভ হইল।

ধৃতরাষ্ট্রের পুনঃ সমর-সংবাদ প্রশ্ন

অনন্তর তিনি অল্পে অল্পে সংজ্ঞা লাভ করিয়া কম্পিত কলেবরে পুনরায় সঞ্জয়কে যথাযথ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন।

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, ‘হে সঞ্জয়! যেমন প্রতিহস্তীর অজেয় প্রমত্ত মাতঙ্গ অন্য হস্তীকে করিণীসমাগমে প্রসন্ন বদন নিরীক্ষণ করত ক্রুদ্ধ হইয়া দ্রুত গমন করে, জ্যোতিঃ দ্বারা অন্ধকার বিনষ্ট করিয়া যেমন আদিত্য উদিত হন, সেইরূপ অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির দ্রোণের নিকট আগমন করিতেতছিলেন; যে বীর পুরুষ আমাদের বহু বীরকে নিহত করিয়াছেন, যে মহাবাহু একাকী ঘোর চক্ষু দ্বারা দুর্য্যোধনের সমস্ত সৈন্য দগ্ধ করিতে পারেন, আমাদিগের কোন্ সকল বীর পুরুষ সেই দুর্দ্ধর্ষ অজাতশত্রুরে নিবারণ ও তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন? যিনি মহাবল, মহাকায়, মহোৎসাহ ও বলে অযুত মাতঙ্গ তুল্য; যিনি অতি বেগে আগমন করিয়া দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিপীড়ন করিয়াছিলেন, যিনি শত্রুগণের সমক্ষে মহৎ, কর্ম্ম সম্পাদন করিতেছিলেন কোন্ কোন্ বীর পুরুষ তাঁহার গতি রোধ করিয়াছিলেন?

যিনি জলদের ন্যায় দীপ্তিমান্ ও মহাবীর; যিনি পর্জ্জন্যের অশনিবর্ষণের ন্যায়, দেবরাজের বারি বর্ষণের ন্যায় শরজালবর্ষণ করিতেছিলেন; যাঁহার তল শব্দে ও নেমি-নির্ঘোষে দশ দিক্ পরিপূর্ণ হইতেছিল; যাঁহার ধনু বিদ্যুৎ সদৃশ, রথগুল্ম মেঘ তুল্য ও নেমি-নির্ঘোষ মেঘ গর্জ্জনের ন্যায়; যিনি শর শব্দে অতি দুর্দ্ধর্ষ হইয়াছিলেন; যিনি রোষরূপ মেঘ সকল নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন; যিনি মন ও অভিপ্ৰায়ের ন্যায় গমন করিতে পারেন এবং মৰ্ম্ম পর্য্যন্ত প্রবিষ্ট হয়েন; যিনি অন্তকের ন্যায় মানবগণের শোণিতজলে দশদিক্‌ পাবিত করিয়া গৃধ্রুপত্ৰ শিলাশিত শরজালে দুৰ্য্যোধন প্রভৃতিরে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন; সেই অর্জ্জুন যখন শরসমূহে গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করিয়া গাণ্ডীব হস্তে আগমন করিলেন, তখন তোমাদিগের মন কি প্রকার হইয়াছিল? তিনি কি গাণ্ডীব শব্দে সৈন্যগণকে বিনাশ করিয়া ভয়ঙ্কর কাৰ্য্য করিতে করিতে তোমাদের অভিমুখীন হইয়াছিলেন? বায়ু যেমন মেঘ রাশি ও শরবন ছিন্ন ভিন্ন করে, ধনঞ্জয় কি সেইরূপ তোমাদিগের প্রাণ বিনাশ করেন নাই? যিনি সেনাগ্রে অবস্থান করিতেছেন শ্রবণ করিলেই লোকে বিহবল হইয়া উঠে, কোন মানব সেই গাণ্ডীব ধন্বাকে সহ্য করিতে পারে? যে যুদ্ধে সেনাগণ কম্পিত ও বীরগণ ভয়াবিষ্ট হইয়াছিল, সেই যুদ্ধ উপস্থিত হইলে কে কে দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরিত্যাগ করেন নাই ও কোন্ সকল দুর্ব্বল ভয়ে পলায়ন করিয়াছিল? কাহারাই বা দেহত্যাগ করিয়াও প্রতিকুল মৃত্যু প্রাপ্ত হইয়াছে? আমার সৈন্যগণ দেবগণেরও জেতা ধনঞ্জয়ের তেজ তাঁহার শ্বেতশ্বের বেগ ও বর্ষাকালীন মেঘের ন্যায় গাণ্ডীবধ্বনি সহ্য করিতে সমর্থ হইবে না। ফলত বাসুদেব যে রথে সারথি, ও অর্জ্জুন যে রথে রথী, দেবাসুরগণও তাহা পরাজয় করিতে সমর্থ হন না। সুকুমার, যুবা, শৌর্য্যশালী, দর্শনীয়, মেধাবী, সত্যপরাক্রম নকুল যখন বিপুল নিনাদ সহকারে সমুদায় সৈন্য ব্যথিত করিয়া দ্রোণাচার্য্যের নিকটবর্তী হইলেন, তখন কোন্ সকল বীর তাঁহাকে নিবারণ করিয়াছিলে? শ্বেতাশ্ব, আর্য্যব্রত, অমোঘাস্ত্র শ্রীমান্ অপরাজিত সহদেব আশীবিষের ন্যায় রোষাবিষ্ট হইয়া শত্রুগণকে নিপীড়িত করিবার নিমিত্ত আগমন করিলে কোন্ কোন্ বীর তাঁহাকে নিবারণ করিয়াছিলেন? যিনি সৌবীর রাজের মহতী সেনা প্রমথিত করিয়া তাঁহার মহিষী সৰ্বাঙ্গসুন্দরী ভোজকন্যারে গ্রহণ করিয়াছিলেন; যাঁহার সত্য, ধৃতি, শৌর্য্য ও ব্রহ্মচর্য্য প্রতিনিয়ত অব্যাহত আছে; যিনি বলবান্‌, সত্যকৰ্ম্মা, অদীন, অপরাজিত, সমরে বাসুদেবের সমান ও বাসুদেবের অনন্তরজাত, যিনি ধনঞ্জয়ের উপদেশে শর ও অস্ত্র প্রয়োগে অন্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতা ও ধনঞ্জয়ের সমকক্ষতা লাভ করিয়াছেন, কোন্ বীর সেই যুযুধানকে দ্রোণের নিকট হইতে নিবারণ করিয়াছিলেন; যিনি বৃষ্ণিবংশের ও ধনুর্দ্ধরগণের শ্রেষ্ঠ, অস্ত্র প্রয়োগ, যশ ও বিক্রমে পরশুরামের সমান এবং কেশব যেমন ত্রৈলোকের আশ্রয়, সেইরূপ যাহাতে সত্য, ধৃতি, বুদ্ধি, শৌৰ্য্য, ব্রহ্মচর্য্য ও উৎকৃষ্ট অস্ত্র প্রতিষ্ঠিত আছে, কোন্ সকল বীর সেই মহাধনুর্দ্ধর সাত্বতকে নিবারণ করিয়াছিলেন? যিনি পাঞ্চালগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; কুলীনগণের প্রীতিভাজন; উত্তমকৰ্ম্মা; ধনঞ্জয়ের হিতকার্য্যে ব্যাপৃত; আমার অনর্থের নিমিত্ত উৎপন্ন; যম, কুবের, আদিত্য, ইন্দ্র ও বরুণের সমান এবং মহারথ বলিয়া বিখ্যাত; সেই উত্তমৌজা প্রাণপণে দ্রোণের সহিত যুদ্ধে সমুদ্যত হইলে কোন্ সকল বীর তাঁহাকে নিবারণ করিয়াছিলেন? যে বীর একাকী চেদিগণ হইতে আগমন করিয়া পাণ্ডবগণের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই ধৃষ্টকেতু দ্রোণের নিকট আগমন করিলে কে তাঁহাকে নিবারণ করিয়াছিলেন যে বীর গিরিদ্বারে পলায়িত দুর্জ্জয় রাজপুত্রকে বধ করিয়াছিলেন, কোন ব্যক্তি সেই কেতুমানকে দ্রোণের নিকট হইতে নিবারণ করিয়াছিলেন?

যে নরব্যাঘ্র স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই গুণাগুণ অবগত আছেন; যিনি মহাত্মা ভীষ্মের মৃত্যুর হেতুস্বরূপ; সেই অম্লানচেতা শিখণ্ডী দ্রোণের অভিমুখীন হইলে কোন্ সকল বীর তাঁহাকে নিবারণ করিয়াছিলেন? যিনি ধনঞ্জয় অপেক্ষা অধিক গুণবান; যাহাতে অস্ত্র, সত্য ও ব্রহ্মচর্য্য নিরন্তর প্রতিষ্ঠিত আছে; যিনি বীরত্বে বাসুদেবের ন্যায়, বলে ধনঞ্জয়ের ন্যায়, তেজে আদিত্যের ন্যায় ও বুদ্ধিতে বৃহস্পতির ন্যায়; ব্যাদিতবদন কৃতান্তের ন্যায় সেই অভিমন্যু দ্রোণাভিমুখে আগমন করিলে কোন্ সকল বীর তাঁহারে নিবারণ করিয়াছিলেন? সেই তরুণ প্রজ্ঞ যুবা যখন দ্রোণের প্রতি ধাবমান হইয়াছিলেন, তখন তোমাদিগের মন কি প্রকার হইয়াছিল? যেমন নদ সমূহ সমুদ্রাভিমুখে গমন করে, সেইরূপ দ্রৌপদীর পুত্রগণ দ্রোণাচার্যের প্রতি ধাবমান হইলে কোন্ সকল বীরগণ তাঁহাদিগকে নিবারণ করিয়াছিলেন? যাঁহারা বাল্য কালে দ্বাদশ বৎসর ক্রীড়া পরিত্যাগ করিয়া কঠোর ব্রত ধারণ পূর্ব্বক অস্ত্র শিক্ষার নিমিত্ত ভীষ্মের নিকট বাস করিয়াছিলেন, ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র সেই ক্ষত্ৰঞ্জয়, ক্ষত্রদেব, ক্ষত্ৰধৰ্ম্মা ও মানদ, এই চারি বালককে কোন্ সকল বীর নিবারণ করিয়াছিলেন? বৃষ্ণিগণ যাঁহারে এক শত বীর অপেক্ষাও অধিকতর বলবান্ বিবেচনা করেন, সেই মহাধনুৰ্ধর চেকিতানকে দ্রোণের নিকট হইতে কে নিবারণ করিয়াছিলেম? ধৰ্ম্মপরায়ণ, সত্যবিক্রম, রক্ত ধ্বজ, রক্ত আয়ুধ ও রক্ত বৰ্ম্মে সুশোভিত, ইন্দ্রগোপসদৃশ, পাণ্ডবগণের মাতৃস্বীয় এবং তাঁহাদিগের জয়ার্থী কেকয়েরা পঞ্চ ভ্রাতা দ্রোণ বিনাশে আগমন করিলে কাহারা তাহাদিগকে নিবারণ করিয়াছিলেন? রাজগণ বারণাবত নগরে জাতক্ৰোধ ও জিঘাংসা পরতন্ত্র হইয়া ছয় মাস যুদ্ধ করিয়াও যাহাকে পরাজয় করিতে পারেন নাই; যিনি বারাণসী নগরে স্ত্রীলোলুপ মহারথ কাশিরাজ পুত্রকে ভল্ল দ্বারা রথ হইতে নিপাতিত করিয়াছিলেন, কোন্ সকল বীর সেই ধনুর্দ্ধর্দ্ধর 
সত্যসন্ধ যুযুৎসুকে দোণের নিকট হইতে নিবারণ করিয়া ছিলেন
? যে মহাধনুর্দ্ধর পাণ্ডবগণের মন্ত্রধারী, দুর্য্যোধনের অহিতকারী; যিনি দ্রোণবধের নিমিত্ত সৃষ্ট হইয়াছেন; সেই ধৃষ্টদ্যুম্ন যোদ্ধাগণকে দগ্ধ ও বিদীর্ণ করিতে করিতে দ্রোণের অভিমুখে আগমন করিলে কোন্ সকল বীর তাঁহাকে নিবারণ করিয়াছিলেন? যে অস্ত্রবেত্তা প্রায় দ্রুপদের উৎসঙ্গেই পরিবর্দ্ধিত হইয়াছিলেন; কাহারা সেই অরক্ষিত শিখণ্ডীকে দ্রোণের নিকট হইতে নিবারণ করিয়াছিলেন?

হে সঞ্জয়! যিনি চৰ্ম্মবৎ পৃথিবী পরিবেষ্টন করিয়াছিলেন; যে শত্রু নিপাতন মহারথের রথ হইতে ভয়ঙ্কর শব্দ বহির্গত হইত; যিনি সুস্বাদু অন্ন, পান ও সুন্দর দক্ষিণা সহকারে নির্ব্বিঘ্নে সৰ্ব্ব যজ্ঞ স্বরূপ দশ অশ্বমেধ নিৰ্বাহ করিয়াছিলেন; যিনি প্রজাগণকে পুত্রবৎ প্রতিপালন করিতেন; গঙ্গাস্রোতে যতগুলি সৈকত আছে, যিনি যজ্ঞে তৎসংখ্যক ধেনু দান করিয়াছিলেন; পূর্ব্বে বা পরে যাহার ন্যায় কোন মনুষ্য এরূপ গোদানে সমর্থ হন নাই, এই দুষ্কর কর্ম্ম সম্পাদিত হইলে দেবগণ যাহার নাম উল্লেখ করিয়া কহিয়াছিলেন যে, “চরাচর ত্রিভুবনে উশীনর তনয়ের ন্যায় দ্বিতীয় ব্যক্তি জন্মে নাই, জন্মিবে না এবং বর্ত্তমানও নাই”। কে সেই ঔশীনরের নপ্তা শৈব্যকে নিবারণ করিয়াছিলেন? বিরাটরাজের রথ-সৈন্য দ্রোণাচার্য্যের অভিমুখীন হইলে কাহারা তাঁহাকে নিবারণ করিয়াছিলেন? যে মহাবল পরাক্রান্ত মায়াবী রাক্ষস বৃকোদরের ঔরসে হিড়িম্বা গর্ভ হইতে সদ্য ভূমিষ্ট হইয়াছিল’ যাহাকে আমি যৎপরোনাস্তি ভয় করিয়া থাকি; পাণ্ডবগণের জয়ার্থী, আমার পুত্রগণের কণ্টক সেই মহাকায় ঘটোৎকচকে দ্রোণের নিকট হইতে কাহারা নিবারণ করিয়াছিলেন?

হে সঞ্জয়! এই সকল ও অন্যান্য বীরগণ যাঁহাদিগের নিমিত্ত প্রাণ সমর্পণ করিয়া যুদ্ধ করিতেছেন এবং পুরুষোত্তম বাসুদেব যাঁহাদিগের আশ্রয় ও হিতার্থী হইয়াছেন, কি নিমিত্ত তাঁহাদিগের পরাজয় হইবে। বাসুদেব লোকগুরু, লোকনাথ, সনাতন, যুদ্ধে নরগণের শরণ্য, দিব্যাত্মা ও প্রভু; মনীষিগণ ইঁহার দিব্য কর্ম্ম সকল উচ্চারণ করিয়া থাকেন; আমিও আত্মস্থৈৰ্য্যের নিমিত্ত ভক্তি পূর্ব্বক তৎসমুদায় কীৰ্ত্তন করিব।