০৪. পয়লা বৈশাখ সকালে উঠিয়া

পয়লা বৈশাখ সকালে উঠিয়াই তপতীর মনে পড়িল, নববর্ষের নিমন্ত্রণ-লিপি কেনা হয় নাই। আজই বন্ধুগণকে তাহা পাঠানো উচিত। বৎসরের প্রথম দিন বলিয়া হয়তো তপনের উপর তাহার মনটা একটু প্রসন্ন ছিল।

মাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিল,–আমার নববর্ষের নিমন্ত্রণ-লিপি কেনা হয়নি মা, এখুনি যেতে হবে। সে আবার সেই কলেজ স্ট্রীট,—এ পাড়ায়, পাওয়া যায় না।

মা বলিলেন,—তা যা-না কলেজ স্ট্রীট, কিনে আগে।

—একা যাবো মা? ওদিকে আমি বেশী যাইনে।

মা এক মুহূর্ত কি ভাবিলেন, তারপরই হাস্যদীপ্তকণ্ঠে কহিলেন, একা কেন যাবি তপনকে নিয়ে যা। যাও তো তপন, নববর্ষের কার্ড কিনে আনো গিয়ে।

এতোটা তপতীর ইচ্ছা ছিল না। ঐ অভদ্র লোকটাকে লইয়া বাজার করিতে যাইতে সে নারাজ। কিন্তু মা যেভাবে কথাটা বলিলেন তপতী আর না যাইয়া পারে নাই। সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়িয়া বলিল,–বেশ, গাড়ীটা বের করুন।

তপন নীরবে চা পান শেষ করিয়া উঠিয়া গেল এবং গ্যারেজ হইতে গাড়ী বাহির করিয়া চালকের আসনে বসিয়া তপতীর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল।

সুন্দর একটা হালকা রং-এর শাড়ী পরিয়া তপতী নামিয়া আসিল। কিন্তু ঐ সুবেশা তরুণীকে একটা চন্দন-তিলক আঁকা কিম্ভুতের পাশে দেখিলে লোকে ভাবিবে কি। দুই মুহূর্ত ভাবিয়া তপতী ভিতরে আসনে উঠিয়া বসিল-তপন গাড়ী ছাড়িয়া দিল।

কলেজ স্ট্রীটের একটা বড় দোকানের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল গাড়ী। নামিয়া তপতী দোকানে ঢুকিল। সম্রান্ত তরুণী দেখিয়া দোকানের কর্মীরাও প্রয়োজন জানিবার জন্য ব্যস্ত হইল।

তপতী কার্ড দেখিতে চাহিল, একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল তপন গাড়ীতে বসিয়া রাস্তার ওপারে ফুলের দোকানটায় সাজানো ফুলগুলির দিকে চাহিয়া আছে। দোকানের একজনকে তপতী আদেশ করিল,—ওকে বলুন তো দুটাকার ফুল কিনে আনুক।

সে ব্যক্তি দোকানের ভিতর হইতে চীকার করিয়া কহিল,–এ ড্রাইভার, দুরুপেয়াকো ফুল লে-আও।

তপন নীরবেনামিয়া ফুলের দোকানে চলিয়া গেল। তাহাকে ড্রাইভার সম্বােধন করায় তপতীর প্রথমটা লজ্জাই হইয়াছিল, কিন্তু ভাবিয়া দেখিল, দোকানের কর্মচারীর কিছুমাত্র অপরাধ নাই। মৃদু ভাবিয়া সেকার্ড চাহিয়া লইয়া এবং মূল্য দিয়া গাড়ীতে ফিরিয়া চালকের আসনে নিজে বসিল।

তপন অনেকগুলি ফুলের বোঝয় মুখ আড়াল করিয়া ফিরিতেই তপতী নিজের বাঁদিকের খালি জায়গাটা দেখাইয়া দিয়া বলিল,–রাখুন।

তপন ফুলগুলি সেখানে রাখিয়া দেখিল, তপতীর পাশে বসিবার আর স্থান নাই। সে ভিতরের সীটে আসিয়া বসিবামাত্র তপতী গাড়ী ছাড়িয়া দিল।

মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি একটি লোককে দেখিয়া তপতী গাড়ী থামাইয়া প্রশ্ন করিল,–এখানে কোথায়?

–রুগী দেখিতে গিয়াছিলাম—ফিরছি।

—আসুন গাড়ীতে। বলিয়া ফুলগুলি তুলিয়া নিজের কোলের উপর রাখিয়া ভদ্রোলোকের বসিবার স্থান করিয়া দিল আপনার পাশে। ভদ্রলোক তপনকে চিনেন না কিন্তু তপতী পরিচয় করাইয়া না দেওয়ায় তাহার দিকে একবার চাহিয়াই মুখ ফিরাইলেন।

তপন নীরবেই বসিয়া রহিল। তাহাকে এইভাবে অপমান করিবার জন্যই তবে তপতী সঙ্গে আসিযাছে! ভালই। ব্যথা তপনের অন্তরে জাগিতেছে কিন্তু মহাশক্তিও তাহার অসীম। ওদিকে তপতী গাড়ী চালাইতে চালাইতে কথা বলিতেছে,—এইখানেই নিমন্ত্রণ করছি, নিশ্চয়ই যাবেন বিকালে।

–নিশ্চয়ই যাবো। আপনার হাতের লিপি না পেলে বছরটাই মিছে হবে।

–খোসামুদি খুব ভালো শিখেছেন, দেখছি। কার কার স্তব করছেন আজকাল?

—স্তব করবার যোগ্য মেয়ে কমই থাকে মিস্ চ্যাটার্জি।

—যেমন আমি একজন। বলিয়াই তপতী উচ্ছলভাবে হাসিয়া উঠিল।

ভদ্রলোক বিব্রত হইতে গিয়া সামলাইয়া লইলেন, বলিলেন,—কথাটা সত্যি।

—ওঃ! এইখানে নামবেন আচ্ছা–নমস্কার।

ভদ্রলোক তাঁহার বাড়ির দরজায় নামিয়া গেলেন। তপতী আবার গাড়ী চালাইল। তপনকে সে যথেষ্ট অপমান আজ করিয়াছে। যদি সে মাকে গিয়া সব কথা বলিয়া দেয়। তপতীর মাথায় এতক্ষণে একটা দুশ্চিন্তা জাগিল। পিছন ফিরিয়া দেখিল, তপন গাড়ীর কিনারায় মাথা রাখিয়াছে। তাহার কৃষ্ণ কুঞ্চিত কেশগুলি বাতাসে উড়িয়া বিপর্যস্ত হইয়া গিয়াছে। তপতী দেখিয়াছে তপনের মুণ্ডিত মস্তক, আজ দেখিল তাহার মার্থার চুলগুলি নরম রেশমের মতো থোকা থোকা হইয়া উড়িতেছে। তপতীর বুকে অকস্মাৎ একটা শিহরণ জাগিল। গাড়ী বাড়ির কাছাকাছি আসিয়াছে। গেটে ঢুকিয়া তপতী নামিতেই দেখিতে পাইল, তপন নামিয়া দারোয়ানকে বলিতেছে,—মাকে বলে দিও, আমি বারোটা নাগাদ ফিরবো।

তপতী কত কি ভাবিতে ভাবিতে উপরে উঠিয়া আসিল।

বিকালে স্নান সারিয়া তপন যখন খাইতে আসিল, তপতীর বন্ধুরা তখন মহাসমারোহে আহারে বসিয়াছে। তপনকে দেখিয়া দুএকজন একটু নাক সিটকাইল। অধিকাংশই তাহাকে চেনে না।

বন্ধুরা যে বারান্দায় খাইতে বসিয়াছে, তপন তাহা পার হইয়া ওদিকের ঘরে তাহার নিত্যকার খাইবার স্থানে গিয়া বলিল,–কৈ মা, খাবার দিন।

—ওখানে বসবে না বাবা—ওদের সঙ্গে?

–না মা, আমার অসুবিধা বোধ হয়! ওদের দতোর তো আমি নই মা।

তপতী উৎকর্ণ হইযা ছিল, মার সহিত তপনের কি কথা শুনিবার জন্য। যেটুকু সহানুভূতি আজ তপনের উপর জন্মিয়াছিল, মুহূর্তে তাহা উবিয়া গেল। উনি ওদের দলের নন কি বাহাদুরী? উহার জন্য তবে তপতীকে বুঝি ভদ্র-সমাজ ত্যাগ করিতে হইবে। রাগিয়া তপতী চলিয়া যাইতেছিল, কিন্তু আরো কি কথা হয় শুনিবার জন্য দাঁড়াইল; মা হাসিয়া বলিলেন—আচ্ছা বাবা, এইখানেই বোস। তিনি একটা চপ ও একটা কাটলেট তপনকে খাইতে দিলেন।

তপন নিতান্ত বিনয়ের সহিত বলিল,–ওসব আমি ভালবাসিনে মা, মাছ মাংস তো আমি খুব কম খাই, আমায় রুটি-মাখন, আর জেলি দিন।

তপতী আর শুনিল না। ঐ দারুণ বর্বরকে লইয়া তাহাকে ঘর করিতে হইবে, ইহা অপেক্ষা তপতী যেন মরিয়া যায়। মা জানুক সব কথা, তপতী ঐ হতভাগাকে যেমন করিয়াই হউক বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিবে।

মনের ভিতরটা যেন আগুনের মতো পুড়িয়া যাইতেছে। ইহার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতেছে বন্ধুগণের প্রতি তাহার স্নেহাধিক্যে। সকলেই পরিতৃপ্ত হইয়া ভোজ সমাধা করিল, তপতীর জয়গান করিল এবং নূতন তৈরী লন্টাতে খেলিবার জন্য গিয়া জমায়েত হইল।

তপনকে আর একচোট অপমান করিবার জন্য চেঁচাইয়া তপতী বলিল,–আমি খেলতে যাচ্ছি মা, বারান্দা থেকে দেখো কেমন খেলা শিখেছি।

মা বলিলেন, তুমি টেনিশ খেলবে না বাবা?

-ও খেলা আমি খেলিনে মা, ওটা বড়লোকদের খেলা, আমাদের পোষায় না।

–হলোই বা, যাও, একটু খেলা কর গিয়ে।

–না মা, আমি একটু বেড়াতে যাচ্ছি।

তপন বাহির হইয়া গেল।

মার মন সন্তানের কল্যাণকামনায় সর্বদাই ব্যস্ত থাকে। খুকীর কাণ্ডকারখানা দেখিয়া মিসেস চ্যাটার্জি অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছেন। স্বামীকে সব করা খুলিয়া বলিতেও তাহার ভয় হয় কারণ তিনি জানেন, স্বামীই এই ব্যাপারের মূল। খুকী তপনকে দেখিতে পারে না শুনিলেই তিনি অত্যন্ত ব্যথা পাইবেন। আর খুকী ঠিক কি ভাবে তপনকে দেখিতেছে, তাহা মাও সঠিক জানিতে পারিতেছেন না। এ যুগের তরুণ-তরুণীকে লইয়া ফ্যাসাদ বড় কম নয়। যাহা হউক, আজ তিনি উহাদের ফুলশয্যার আয়োজন করিয়াছেন। খুকীর ঘরে তপনকেই আজ তিনি পাঠাঁইয়া দিবেন।

রাত্রে খাওয়া শেষ হইলে স্নেহকোমল কণ্ঠে মা বলিলেন-খুকীর এখন আর পড়াশুনার চাপ নেই, এবার ওর সঙ্গে একটু মেলামেশা কর বাবা।

তপন একটু চকিত হইল, তৎক্ষণাৎ সামলাইয়া লইয়া বলিল,–ওর মনের উপর চাপ দিচ্ছেন কেন মা? এ যুগের মেয়ের মনের উপর চাপ সহ্য করে না।

—কিন্তু বাবা…

বাধা দিয়া তপন বলিল,আপনি সব কথা বুঝবেন না মা, আর আমি বলতেও পারবো না। তবে আমার হাতে আপনার খুকীকে সম্প্রদান করেছেন,–এ কথা যদি সঠিক হয় তাহলে তার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হবে সে ভার আমার হাতেই ছেড়ে দিন। আপনাদের উদ্বেগ অনাবশ্যক। আরো কিছু দিন যাক।

মা তপনের কথা শুনিয়া কয়েক মিনিট নীরব হইয়া রহিলেন। তারপর করুণকণ্ঠে কহিলেন—খুকীর ঐ বন্ধুগুলোকে আমার ভয় করে বাবা–

কিছু ভয় নেই মা, মেয়ে আপনার যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। ওরা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর ক্ষতি যদি হয়ে থাকে, তাহলে অনেক আগেই তা হয়েছে।

–সে কি কথা বাবা! মাতা শিহরিয়া উঠিলেন।

–না মা বিচলিত হবেন না। আপনার মেয়েকে বুঝতে সময় লাগে। তবে যতদুর মনে হয়, সে আত্মরক্ষায় সক্ষম। আমার ঘুম পাচ্ছে মা, শুইগে।

মা আর কিছুই বলিলেন না, বলিতে তঁাহার বাধিতেছিল। আপন কন্যার সম্বন্ধে আপনারই জামাই-এর সহিত কতক্ষণই বা আলোচনা করা যায় এইরকম একটি বিষয় লইয়া! তপন চলিয়া গেলে তিনি তপতীর কক্ষে আসিয়া দেখিলেন, তপতী অনেকক্ষণ ঘুমাইয়া গিয়াছে। একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া তিনি শয়নকক্ষে ফিরিয়া গেলেন।

কিন্তু ফিরিয়া গিয়াও নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না। আধুনিক আলোকপ্রাপ্তা শিক্ষিত মেয়েকে তিনি অধিক আর কি বলিতে পারেন। যতদুর বলিয়াছে, তাহাই যথেষ্ট।এ সমাজে এতখানিও কেহ বলে না। কিন্তু তাহার আশ্চর্য বোধ হইতেছে যে, খুকী জানে তপন ওঘরে আজ যাইবে, অথচ খুকী নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া পড়িল! তপনের জন্য এতটুকু উদ্বেগ, একটুখানি উকণ্ঠাও কি তাহার মনে জাগে না? সমস্ত ব্যাপারটা মিসেস চ্যাটার্জির অত্যন্ত দুয়ে বোধ হইতেছে।

তপনই বা কেন ওভাবে জবাব দিল? তপন যাহা বলিল, হয়ত সেই কথাই সত্য; জোর করিলে খুকীর জেদ বাড়িয়া যাইবে, কিন্তু জোর করিতে হয় কিসের জন্য! আজ দুই আড়াই মাস তিনি তপনকে দেখিতেছেন, তাহার মতো চোখ জুড়ানো ছেলে তিনি কমই দেখিয়াছেন। খুকী যদি তাহাকে অভদ্র বা ইডিয়ট মনে করিয়া থাকে তবে অত্যন্ত ভুল করিয়াছে-খুকীর এ ভুল ভাঙ্গিয়া দিতে হইবে। মিসেস চ্যাটার্জি কন্যার ভবিষ্যৎ ভাবিয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিলেন ক্রমশ।

ওদিকে পদশব্দটা ফিরিয়া যাইবা মাত্র তপতী চোখ মেলিয়া চাহিল, দেখিল, তপন নহে, মা; তপন আসিতেছে ভাবিয়াই সে ঘুমের ভান করিয়াছিল, কিন্তু তৎপরিবর্তে মাকে আসিয়া ফিরিয়া যাইতে দেখিয়া একটু নিশ্চিন্ত হইল। হয়ত তপন আসিবে না, কিম্বা পরে আসিবে! রাত্রি তো এগারটা বাজিয়া গেল।

তপতী দরজা খোলা রাখিয়া অনেকক্ষণ জাগিয়া রহিল। তপন তাহা হইলে আজ আসিবে না। তপতী যেন বাঁচিয়া গেল। তপন আসলে তাহাকে একটা নির্মম আঘাত করিবার জন্য তপতী প্রস্তুত হইতেছিল,—আসিল না, ভালোই হইল। কিন্তু সত্যিই কি আসিবে না।

তপতী পা-টিপিয়া-টিপিয়া এদিকের বারান্দা পার হইয়া তপনের রুদ্ধদ্বার শয়ন কক্ষের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। ভিতর হইতে নিদ্রিত ব্যক্তির ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আসিতেছে। তপন তাহা হইলে ঘুমাইয়া গিয়াছে। কিন্তু কেন? তপতী মার কথায় সম্মতি দেয় নাই, কিন্তু প্রতিবাদও করেনাই। যাক, না আসিয়া ভালোই করিয়াছে। তপন তাহাহইলে বুঝিয়াছেতপতী তাহাকে চায় না। তপতী নিশ্চিন্ত হইতে গিয়া ঠিক বুঝিল না, আধুনিক যুগের বিকৃত শিক্ষা তাহার নৈরাশ্যকে নিশ্চিন্ততার রূপে দেখাইতেছে কিনা। তপতী ফিরিয়া আসিয়া শয়ন করিল। ঘুম তাহার ভালই হইবার কথা, কিন্তু অনেক-অনেকক্ষণ তপতী জাগিয়া রহিল সেদিন…

পরদিন সকালে তপতীর ক্লান্ত-বিষণ্ণ মুখশ্রী দেখিয়া মা সস্নেহে কহিলেন,বরের সঙ্গে ভাঙ্গা করগে খুকী, দেখবি, ছেলেটা খুব ভালো।

ঝঙ্কার দিয়া তপতী কহিল—তুমি বড় বাড়াবাড়ি করছে মা, থামো এবার। মা মুহূর্তে স্তব্ধ হইয়া গেলেন। একটা ভয়ানক কিছু উহাদের হইয়াছে, কিন্তু কী হইয়াছে? প্রশ্নের উত্তর মা খুঁজিয়া পাইলেন না তপতীর মুখের কোনো রেখায়। মায়ের চিন্তাকুল মুখ দেখিয়া তপতী নিজের কথাটা সম্বন্ধে সচকিত হইল, মৃদু হাসিয়া কহিল,—এত বড়ো মেয়েকে কিছু শেখাতে হয় না, তোমার অত ভাবনা কেন? ভাব সাব হয়েছে আমাদের। এক ঘরে না শুলেই বুঝি আর ভাব হয় না।

তপতীর মুখের হাসি দেখিয়া মা অত্যন্ত তৃপ্তি বোধ করিলেন। আজকালকার চালাক ছেলেমেয়ে, হয়ত মাকে ফাঁকি দিয়া বিদায় করিয়া উহারা দুজনে মিলিত হইয়াছে। তাই তপতীর জাগরণক্লান্ত মুখশ্রী মাকে অত্যন্ত আনন্দ দিল। স্নেহ বিগলিত স্বরে তিনি কহিলেন,—বেশ মা, আমার মনটা খুব চঞ্চল হয়েছিল কিনা, তাই বলছিলাম। এবার আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো তাহলে!

মধুর হাসিয়া তপতী কহিল,—একদম নিশ্চিন্ত হয়ে যাও, কিছু ভাবনার দরকার নেই তোমার।

তপন আসিয়াই ঘরের মধ্যে তপতীকে দেখিয়া দরজার কাছে থামিয়া গেল। মা ডাকিলেন,—এসসা বাবা, খাবে। তপতীর পাশ কাটাইয়া তপন ও-দিকের একটা চেয়ারে মুখ ফিরাইয়া বসিল। তপতী সন্ধানী দৃষ্টিতে তাহার আপাদ-মস্তক দেখিতে চাহিল, কিছুই দেখা যায় না। কোট-প্যান্টগুলো সমস্ত দেহটা ঢাকা। উর্ধ্বাংশে তিলক এবং চোখে সবুজ ঠুলি। মুখখানা অমন ভাবে ফিরাইয়া রাখিবার হেতু কি। তপতীর আশ্চর্য বোধ হইতে লাগিল। ভাবিল, মুখের ডােন্টা বোধ হয় ভালোনয়। হয়ত দাঁতগুলো উঁচু কিম্বা ঠোঁট দুইটা পুরু তাই তপতীকে দেখাইতে চাহে না। কিম্বা লজ্জাও হইতে পারে। তপতী মাথার চুলগুলি শুধু দেখিতে পাইতেছে! ভ্রমরকৃষ্ণ কুঞ্চিত চুলগুলি পিছনদিকে উল্টাইয়া দিয়াছে, সদ্যস্নাত চুলঝরা একটা জলধারা ঘাড়ের পাশে গড়াইয়া আসিতেছে, ঘাড় এবং কাধের সংযোগস্থলে একটা ডাগর কালো তিল! পিছনটা তো খুবই সুন্দর মনে হইতেছে, আর ফিগারটাও বেশ লম্বা দোহারা, বলিষ্ঠ।

সবই হয়ত ভাল, কিন্তু অসভ্য যে। আবার ঐ দারুণ গোঁড়ামী, তিলক-ফোটা, নিরামিষ খাওয়া, পাঁচালী পড়ানাঃ, উহাকে লইয়া তপতীর চলিবেনা। খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া গেল, কিন্তু একেবারে চলিয়া গেল না, বারান্দায় দাঁড়াইয়া রহিল তপনের সহিত মার কথা শুনিবার জন্য। মা বলিতেছে,কাল তোমার কথাটা আমি ভেবে দেখলাম বাবা, ঐ ঠিক। তবে তোমরা দুটি আমাদের সর্বস্ব-ধন তোমাদের ভালোর জন্য মন বড় ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

তপন সহাস্যে কহিল,—আচ্ছা মা আমার দ্বারা আপনার খুকীর কিছু মন্দ হবে বলে কেন আপনি মনে করছেন?

শুনিতে শুনিতে তপতী বিরক্ত হইয়া উঠিল। উনি তপতীর ভালো করিয়া দিবেন। কী আশুধা। মা বলিলেন,–তোমাদের দুটিকে সুখী দেখবার জন্যই বেঁচে আছি বাবা।

মার কণ্ঠে কল্যাণাশীষ ঝরিয়া পড়িতেছে। এই অপার্থিব মাতৃমূর্তির সম্মুখে বসিয়া প্রতারণার কথা বলিতে তপনের বিবেক পীড়িত হইতেছে! সে চুপ করিয়া খাইতে লাগিল। তপতী পুনরায় ঘরে ঢুকিয়া বলিল,আমায় আর এক কাপ চা দাও মা, কড়া করে!

মা অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিলেন! নিশ্চয়ই উহারা কাল মিলিত হইয়াছিল, রাত জাগার জন্য খুকীর কড়া চা খাইতে ইচ্ছা হইতেছে। বলিলেন—আর একটু ঘুমোগে, শরীরটা ঝরঝরে হয়ে যাবে।

তপনের খাওয়া হইয়া গিয়াছে। সে ধীরে ধীরে চলিয়া গেল, অনুভব করিল, খুকীর অভিনয় চমৎকার জমিতেছে। মা একেবারে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছেন। মাতৃত্বের এই ব্যাকুল আবেদন তপনের মনকে আর্ত করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু কিছুই সে করিতে পারে না। মার কন্যাই যখন অভিনয় করিতেছে, তখন সে আর কি করিবে?

বিষাদক্ষিন্ন তপন বাহিরে চলিয়া গেল। তপতীও কড়া চা খাইয়া আপন কক্ষে আসিল, হাসিল খানিক আপন মনে এবং কবিতার খাতাটা টানিয়া লইয়া বঞ্চিতের বেদনা লিখিতে বসিল।

 

শিখা কয়েকটি মেয়েকে কারখানার প্রাঙ্গণে নিয়া জড় করিয়াছে। উহাদের নিকট তাহার কি একটা প্রস্তাব আছে। বিনায়ক একধারে চুপচাপ দাঁড়াইয়াছিল, তপন এখনো আসিয়া পৌঁছে নাই। শিখা কহিল,–আচ্ছা মিতা, দাদার যদি দেরি থাকে তো আমরা আরম্ভ করি।

–বেশ তো; করুন আরম্ভ। বিনায়ক মৃদু হাসিয়া উত্তর দিল। শিখা আরম্ভ করিল,–ভগ্নিগণ আমাদেব অভাব এত বেশী, যে মেটাবার চেষ্টা করতেও ভয় হয়। কিন্তু ভয় করলে চলবে না। অভাব আমাদের যত অভাব বোধ তার চেয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে। অতএব এই ঠিক সুযোগ, যখন আমরা অভাবের প্রতিকার করতে কায়মনে লাগতে পারবো!

আমার প্রস্তাব এই যে, আপনারা দিনকয়েক এই কারখানায় খেলনাগুলো রং করতে শিখুন, ছোট ছোট পার্টসগুলোকে জোড়া দিতে শিখুন যাঁর হাত নিপুণ তিনি আরো কিছু বেশী শিখুন। তারপর সাজসরঞ্জাম নিয়ে আপনারা যাবেন অভাবগ্রস্তদের অন্তঃপুরে। সেখানে মেয়েদের এই কাজ শিখিয়ে দেবেন, তাদের কাঁচামাল সরবরাহ করবেন, তৈরী করাবেন এই সব খেলনা। তৈরী মাল বিক্রী করবার ভার আমাদের। মজুরী তাঁরাও পাবেন, আপনারাও পাবেন। অবসর সময়ে একাজ করে বেশ দুপয়সা রোজগার করা যাবে বাড়িতে বসে।

খেলনার সঙ্গে আমরা কার্ডবোর্ড বাক্স তৈরী শেখাবো আর শেখাবো আয়ুর্বেদীয় নানা রকম ঔষধ আর টয়লেট তৈরী করতে, যার গুণ আপনাদের বিলিতি ঔষধ, এসঙ্গে সাবানস্নাে-পাউডার থেকে অনেক বেশী। অথচ দাম হবে বিলাতীর অর্ধেক। এসব কাজের জন্য যা কিছু দরকার সবই এখান থেকে দেওয়া হবে। আপনারা শুধু কাজ করবেন। ছয়মাস করে দেখুন, না-পোষায় ছেড়ে দেবেন।

শুধু সৌখীন শিল্প, ঘর সাজাবার উপকরণ দিয়ে দেশের কিছু হবেনা। ওগুলোর দরকার আছে তরকারী হিসাবে, কিন্তু ডালভাতের দরকার আগে। অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন না করলে কিছুতেই সুসার হয় না।

এ কাজ যদি আমাদের সফল হয়; তাহলে পরের কাজ হবে আমাদের আরো বড়–আরো ব্যাপক! সে কাজ দেশের মানুষ তৈরী করার কাজ। আমরা প্রত্যেকে শুধু দুটিচারটি করে মানুষ গড়ে যাবো যারা নেতার আহ্বানে সাড়া দেবে, অকম্পিত হৃদয়ে মৃত্যুবরণ করবে শ্রেঃ লাভের জন্য। আমি আপনাদের নেত্রীত্ব চাইনে, আমিও আপনাদের মতন একজন কর্মী থাকতে চাই এবং সমান কাজ করতে চাই।

তপন আসিয়া পৌঁছিল এবং হাসিমুখে আসিয়া অভিবাদন করিল। শিখা বলিয়া চলিল–এই আমার দাদা, অন্তরাল থেকে উনি এবং ওঁর বন্ধু বিনায়কবাবু আমাদের সাহায্য করবেন—দেখবেন, ক্ষতি যাতে আমাদের না হয়। ওঁরা দুজনে এই কারবারটা গড়ে তুলেছেন; অতএব মাড়োয়ারীজনোচিত অভিজ্ঞতা যে ওঁদের আছে তা আমরা বিশ্বাস করিতে পারি। আর ওঁরা বলেছেন, ক্ষতি যদি হয় ওঁদের হবে, লাভ যদি হয় তো আমাদের; আর ক্ষতিই বা হবে কেন? আসুন, আজ থেকেই কাজ আরম্ভ করবে।

মেয়েগুলি সত্যই অভাবগ্রস্ত পরিবারের। কাজের প্ল্যান শুনিয়া ও সমস্ত দেখিয়া তাহাদের প্রত্যয় জন্মিল! অবসর সময়ে এ কাজ করিয়া কিছু উপার্জন করিতে পারে—তাহারা লাগিয়া গেল।

তপন শিখাকে ডাকিয়া বলিল,–বিয়ে-থা করতে হবে না বুড়ি? এই সব করবি নাকি তুই?

–বিয়ের হয়তো দরকার আছে দাদা, দিও যখন ইচ্ছে কিন্তু এ সবেরও দরকার আছে। তোমার বোন তোমার মর্যাদা রাখতে চায়।

হাসি মুখে তপন বলিল,—বেশ কথা, তবে বিয়েটাও দেব, আব এই মাসেই।

—কেন? বুড়িয়ে গেলুম নাকি দাদা?

–সেটা দেখবার ভার আমাদের উপর–তুই এখনও যা করছিস্ কর!

তপন অফিস ঘরে চলিয়া যাইবার কিছুক্ষণ পর বিনায়ক বিপন্ন মুখে কহিল,–শুনছেন মিতা আপনার দাদা বড় জ্বালাতন করছে।

আমার দাদা কাউকে জ্বালায় না—শিখা জবাব দিল।

বিনায়ক মাথা চুলকাইয়া বলিল,—কিন্তু আমায় করছে জ্বালাতন।

–কেন?

—আমি আর সব কাজ করতে পারি, লাউ-কুমড়ো কুটতে পারিনি। শিখা কলহাস্যে ঝঙ্কারিয়া উঠিল,—দাদা পারে কিন্তু…।

–আমি পারিনে যে—বিনায়কের মুখে অসহায়তার ছবি ফুটিয়া উঠিল।

শিখাব নারী হৃদয় স্নেহে উদ্বেল হইয়া উঠিতেছে। বলিল,—তা আমায় বুঝি আপনার কাজটা করে দিতে হবে? চলুন, যাচ্ছি।

শিখা আসিয়া একটা চড় কুটিতে বসিতেই তপন গম্ভীর মুখে বলিল,–ভাল হচ্ছে না ভাই শিখা, ওর কাজ কেন তুই করবি? তোর সঙ্গে ওর সম্পর্ক–?

–মিতা বলিয়া শিখা হাসিয়া উঠিল।

–ওঃ, তা হলে কিন্তু তপন হাসিমুখেই থামিয়া গেল!

–কিন্তু কি দাদা?-শিখার চোখে প্রশ্নের আকুতি!

কাঁঠালের আঠায় কুলবে না। ফুলের ফিতে দিয়ে বাঁধনটা পোক্ত করে দিতে হবে।

–মাও তুমি বড্ড ইয়ে–।

শিখা মুখ ফিরাইয়া তরকারী কুটিতে বসিল। তাহার লজ্জার মুখের পানে তাকাইয়া বিনায়ক বসিয়া ভাবিতে লাগিল, তপনের ইচ্ছা শিখার অন্তরে সঞ্চারিত হইয়াছে। শিখা বিনায়ককে গ্রহণ করিয়াছে কিন্তু শিখাকে পাইবার যোগ্যতা কি বিনায়কের আছে! তপনের ইচ্ছায় চিরদিনই আত্মসমর্পণ করিয়াছে, বিনায়ক আজও কিছুই বলিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *