০০২. ভীষ্মনিধন শ্রবণে কর্ণের বিলাপ

২য় অধ্যায়

ভীষ্মনিধন শ্রবণে কর্ণের বিলাপ

সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! মহারথ ভীষ্ম নিহত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া মহাবীর কর্ণ অগাধ সলিলনিমগ্ন নৌকা সদৃশ কৌরব সৈন্যগণকে সহোদরের ন্যায় উদ্ধার করিবেন এবং পিতা যেমন পুত্রকে রক্ষা করেন, সেই রূপ তিনি বিপদগ্রস্ত কৌরব সেনাকে পরিত্রাণ করিবেন বলিয়া তাঁহা দিগের নিকট গমন করিয়া কহিলেন, হে সৈন্যগণ! চন্দ্রমা যেমন নিরন্তর শশচিহ্নে অঙ্কিত, সেইরূপ যিনি ধৃতি, বুদ্ধি, পরাক্রম, ওজস্বিতা, সত্য, দম, সমুদায় বীরগুণ, দিব্য অস্ত্র নম্রতা, হ্রী, প্রিয়বাদিতা ও কৃতজ্ঞতায় নিরন্তর অলংকৃত এবং দ্বিজগণের শত্রু নিপাতন সেই ভীষ্ম যদি বিনাশ প্রাপ্ত হইলেন, তবে এক্ষণে স্পষ্টই প্রতীত হইতেছে যে, সমুদয় যোদ্ধাই নিহত হইয়াছেন। যখন মহাব্রত ভীষ্ম নিহত হইয়াছেন, তখন কালি যে সূর্য্যোদয় হইবে, ইহা কেহ নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারে না; অতএব কর্মের নিয়ত সম্বন্ধনিবন্ধন ইহলোকে কোন বস্তুই অবিনাশী নয়। বসুর ন্যায় প্রভাব সম্পন্ন, ও বস্তুতেজে সমুৎপন্ন ভীষ্ম বসুগণকেই প্রাপ্ত হইয়াছেন; এক্ষণে ধন, পুত্র, পৃথিবী, কৌরবগণ ও এই সকল সৈন্যের নিমিত্ত শোক কর। মহাপ্রভাব ভীষ্ম নিপাতিত ও কৌরবগণ পরাজিত হইলে, কর্ণ দুৰ্ম্মনা হইয়া গলদশ্রুলোচনে সাতিশয় আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন। আপনার পুত্র ও সৈনিকগণ কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া পরস্পর চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন; তাঁহাদিগের নয়ন হইতে চীৎকারের অনুরূপ শোকজল বিগলিত হইতে লাগিল।

পুনৰ্ব্বার মহাযুদ্ধ আরব্ধ হইলে সৈন্যগণ পার্থিবগণের নিয়োগানুসারে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিলে মহারথ শ্রেষ্ঠ কর্ণ আহ্লাদকর বাক্যে রথিগণকে কহিলেন, হে পার্থিবগণ! এই অনিত্য জগতে সকলই নিরন্তর মৃত্যুমুখে ধাবমান হইতেছে চিন্তা করিয়া আমি সকলকেই অস্থায়ী দেখিতেছি; দেখুন! আপনারা বিদ্যমান থাকিতেও গিরি সদৃশ কুরুপ্রধান ভীষ্ম কি প্রকারে নিপতিত হইলেন! মহাবীর ভীষ্ম ভূতলে পাতিত হইয়া গগনপতিত দিবাকরের ন্যায় লক্ষিত হইতেছেন; প্রধান প্রধান বীরগণ নিহত হইয়াছেন; সৈন্যগণ নির্ভর নিপীড়িত হইয়াছে; শত্রুগণ তাহাদিগের উৎসাহ বিনষ্ট করিয়াছে; তাহারা একবারে অনাথ হইয়া রহিয়াছে; এসময়ে অন্য পার্থিবগণ ধনঞ্জয়কে সহ্য করিতে সমর্থ হইবেন না; বৃক্ষগণ কি পর্ব্বতবাহি সমীরণের বেগ সহ্য করিতে পারে? অতএব আমি মহাত্মা ভীষ্মের ন্যায় সমরে এই কুরু সৈন্যকে পরিপালন করিব। এক্ষণে আমার প্রতি ঈদৃশ ভার সমর্পিত হইল এই জগৎ অনিত্য বোধ হইতেছে এবং রণবীর ভীষ্ম নিপাতিত হইয়াছেন; অতএব কি নিমিত্তই বা আমার ভয় না হইবে। সে যাহা হউক, আমি এই মহাযুদ্ধে বিচরণ পূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে শমন সদনে প্রেরণ করিয়া জগতে যশই পরমধন এই ভাবিয়া অবস্থান করিব অথবা তাহাদিগের হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে শয়ন করিব। যুধিষ্ঠির ধৈৰ্য্য, বুদ্ধি, ধর্ম্ম ও উৎসাহ সম্পন্ন; বৃকোদর শত মাতঙ্গ তুল্য বিক্রমশালী; অর্জ্জুন দেবরাজের আত্মজ ও যুবা; অতএব পাণ্ডব সৈন্যগণকে জয় করা অমরগণেরও অনায়াসসাধ্য নয়। যমোপম যমজ নকুল ও সহদেব এবং সাত্যকি সমেত দেবকীসুত যে সৈন্যে আছেন, তাহা কৃতান্তের মুখ স্বরূপ; কোন কাপুরুষই তাহার সম্মুখীন হইলে বিনিবৃত্ত হইতে পারিবে না; মনস্বিগণ তপস্যা দ্বারাই অত্যুগ্র তপস্যা নিবারিত করেন এবং বল দ্বারাই বলকে প্রতিহত করিয়া থাকেন।

সূত! আমার মন শত্রু নিবারণে ও স্বপক্ষ সংরক্ষণে কৃতনিশ্চয় হইয়াছে। আজি আমি শত্রুগণের প্রভাব প্রতিহত করিয়া গমন মাত্র তাহাদিগকে পরাজয় করিব। মিত্রদ্রোহ আমার সহ্য হয় না, সৈন্য ভগ্ন হইলে যিনি মিলিত হইবেন, তিনিই আমার মিত্র। হয়, আমি এই সৎপুরুষোচিত আৰ্য্য কর্ম্ম সম্পাদন করিব, না হয় প্রাণ পরিত্যাগ করিয়া ভীষ্মের অনুগামী হইব-হয়, সমুদায় শত্রু বিনাশ করিব, না হয় শত্রু হস্তে নিহত হইয়া বীরলোক প্রাপ্ত হইব। আমি জানি যে, স্ত্রী ও কুমারগণ ক্রন্দন ও মুক্তকণ্ঠে বিলাপ করিলে এবং ধার্ত্তরাষ্ট্রের পৌরুষ পরাহত হইলে ঐরূপ কার্য্যই আমার কর্ত্তব্য; অতএব আজি রাজা দুর্য্যোধনের শত্রুগণকে পরাজিত করিব এই সুঘোর সমরে প্রাণপণে কৌরবগণের রক্ষা পূর্ব্বক সমুদয় শত্রু নিহত করিয়া দুৰ্য্যোধনকে রাজ্য প্রদান করিব। এক্ষণে সুবর্ণময় মণিরত্নবিভূষিত বিচিত্র কবচ, সূর্য্যপ্রভ শিরস্ত্রাণ, অগ্নি, বিষ, ভুজঙ্গতুল্য ধনু ও শরাসন এবং ষোড়শ তূণীর বন্ধন করিয়া দাও; দিব্য ধনু, শর, মহতী গদা ও স্বর্ণখচিত শঙ্খ আহরণ কর; এই সুবর্ণময়ী নাগকক্ষা ও ইন্দীবরপ্রভা সম্পন্ন দিব্য ধ্বজ সূক্ষ্ম বস্ত্রে মার্জিত করিয়া জালসমবেত বিচিত্র মালার সহিত আনয়ন কর; আরও কতক গুলি শ্বেতাভ্রসঙ্কাশ হৃষ্ট পুষ্ট অশ্ব মন্ত্রপূত জলে স্নান করাইয়া তপ্ত কাঞ্চন ভূষণে ভূষিত করিয়া অনতিবিলম্বে আনয়ন কর; হেমমালা ও চন্দ্রসূৰ্য্য সদৃশ রত্ন সমুহে বিভূষিত, সমরোচিত উপকরণ সম্পন্ন, বাহন সংযোজিত রথ শীঘ্র আবৰ্ত্তিত কর; বেগসহ বিচিত্র চাপ, শত্রুসংহারোপযোগী উৎকৃষ্ট জ্যা, শরপরিপূর্ণ প্রকাণ্ড তূণীর ও গাত্রাবরণ সকল সজ্জিত কর; প্রস্থানকালোচিত কাংস্য ও হেমঘট দধিপূর্ণ করিয়া আনয়ন কর; মালা আনয়ন করিয়া অঙ্গে বন্ধন কর এবং জয়ভেরী সকল বাদ্য কর।

হে সূত! যে স্থানে অর্জ্জুন, বৃকোদর, যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব আছে, শীঘ্ৰ তথায় গমন কর, আমি তাহাদিগকে সংহার করিব অথবা তাহাদের হস্তে নিহত হইয়া ভীষ্মের সহিত মিলিত হইব। যে সৈন্যে সত্যধৃতি যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, অর্জ্জুন, সাত্যকি, বাসুদেব ও সৃঞ্জয়গণ অবস্থান করিতেছে, তাহা জয় করা ভূপালগণের সাধ্যায়ত্ত নয়। যদি সর্ব্বসংহার কর্তা কৃতান্ত অপ্রমত্ত হইয়া ধনঞ্জয়কে রক্ষা করেন, তথাপি তাহারে বিনাশ করিব, অথবা ভীষ্মের পথ দিয়া যমসমীপে উপস্থিত হইব। এক্ষণে আমি সেই সৈন্যগণের মধ্যে অবশ্যই গমন করিব; আমার এই সকল সহায় মিত্রদ্রোহী, ভক্তিবিহীন বা পাপাত্মা নন।

অনন্তর সুবর্ণ, মুক্তা, মণি ও রত্ন খচিত রথ সুসজ্জিত এবং পতাকা ও বায়ুর ন্যায় বেগবান্ অশ্ব সকল সংযোজিত হইল। যেমন দেবগণ দেবরাজকে পূজা করিয়া থাকেন সেইরূপ কুরুগণ মহাত্মা কর্ণকে সৎকার করিলেন। হুতাশনপ্রভ কর্ণ অনল সদৃশ মেঘস্বন রথে আরোহণ করিয়া বিমানারূঢ় বাসবের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইলেন এবং যে স্থানে ভরত শ্রেষ্ঠ ভীষ্ম বিনাশ প্রাপ্ত হইয়াছেন, তথায় গমন করিতে লাগিলেন।