১.২ জীবন ধারণের সামগ্রী লাভের কলাকৌশল

১.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – জীবন ধারণের সামগ্রী লাভের কলাকৌশল

মানুষ যে নগণ্য অবস্থা থেকে তার যাত্রা শুরু করেছিল তা নিখুঁতভাবে পরিস্ফুট হয় মানুষের জীবন ধারণের আনুক্রমিক সামগ্রী লাভের কলাকৌশলে। এর ওপর নির্ভর করছে পৃথিবীর ওপর মানুষের কতটা প্রাধান্য খাটবে। মানুষই একমাত্র প্রাণী খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের ওপর যার আছে পুরোপুরি দখল। একেবারে প্রাথমিক যুগে অবশ্য মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে কোনো অংশে ওপরে ছিল না। একই ধরনের খাবার এবং তার উৎপাদনের ব্যবস্থা পরিব্যাপ্ত না করতে পারলে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারত না। খাদ্যের বিভিন্নতা ও পরিমাণের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা না থাকলে জনবহুল জাতি গঠন সম্ভব হত না। মানবজাতির মধ্যে প্রগতির যে ঢল নামে সম্ভবত তা খাদ্যদ্রব্যের উৎসের ক্রমবর্ধমানতার দরুন সম্ভব হয়েছে।

মানুষের খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে আমরা পাঁচটি উৎস দেখতে পাই। প্রথম দুটি আদিম যুগে এবং বাকি তিনটি ঘটে বর্বর যুগে। আবির্ভাবক্রম অনুযায়ী এদের নিম্নলিখিতভাবে সাজানো গেল :

১। ফল-মূলনির্ভর আহার্য-দ্রব্য–যার উৎস ছিল খুব সীমিত

এ ব্যাপারটা আমাদের মানুষের শৈশব অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। যখন মানুষের সংখ্যা ছিল অতি অল্প, আহার্য-দ্রব্য ছিল অতি সাধারণ এবং মানুষ যখন ভূখণ্ডের অল্প এলাকা জুড়ে বসবাস করত। মানুষ তার নূতন জীবনযাত্রার পথে মাত্র পদক্ষেপ করেছে। এই সময় এমন কোনো শিল্প বা প্রতিষ্ঠান ছিল না যা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু একটা উদ্ভাবনের কথা স্বীকার করা দরকার, তা ভাষা। যে ধরনের আহার্য-দ্রব্যের উল্লেখ করা হয়েছে তাতে বোঝা যায় মানুষ বাস করত গ্রীষ্মমণ্ডল বা ক্রান্তীয় অঞ্চলে। এই অঞ্চলের জলবায়ুতেই আদিম মানুষ তাদের জীবন কাটিয়েছে। গ্রীষ্ম ও ক্রান্তীয় অঞ্চলের বনে ফল ও বাদাম পাওয়া যায় প্রচুর, এ থেকেই অনুমান করা যায় আমাদের পূর্বপুরুষরা কোন অঞ্চলে বসবাস করত।

কালের দিক থেকে বিচার করলে অন্যান্য প্রাণী মানুষের বহু পূর্বেই সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ যখন পৃথিবীতে আসে অন্যান্য প্রাণীরা অসংখ্য দলবল নিয়ে সদম্ভে রাজত্ব করছে। প্রাচীন কবিরা লিখে গেছেন যে বন্যপ্রাণীর[১] সাথে সংগ্রাম করে মানুষ বনে ও গুহায় বাস করত। আর আপনা থেকে গজিয়ে ওঠা ফল-মূল খেয়ে জীবন কাটাত। আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যে মানুষকে গাছের ওপর বাস করতে হত।

বাঁচার জন্যে খাবার অন্বেষণের বোঝা প্রতিটি প্রাণীর ওপরই সর্বদা চাপানো রয়েছে। আমরা মানুষের যত আদি অবস্থার দিকে নামতে থাকি দেখতে পাই মানুষের আহার্য-দ্রব্য গুটিকয়েক জিনিসে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। যত ওপরে উঠতে থাকি তা ধাপে ধাপে ঊর্ধ্বারোহণ করে এবং বিশেষ এক উন্নতির পর্যায়ে তা হঠাৎ ব্যাপক হয়ে উঠেছে। তখন থেকে মানুষের বুদ্ধিমত্তা একটা প্রধান উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। আহার্য হিসেবে পশুর মাংস সম্ভবত প্রাথমিক যুগেই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু মানুষ যখন ফল-মূল আহরণ পর্যায়ে তখন সচেতনভাবে পশু শিকার করত কি না অনুমানসাপেক্ষ। এই ধরনের আহার্য-ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবেই পড়ে আদিম পর্যায়ে।

২। আহার্য বস্তু হিসেবে মাছ

প্রথম কৃত্রিম খাদ্য হিসেবে মাছকেই ধরতে হবে, কারণ রান্না ছাড়া একে সম্পূর্ণ গ্রহণ করা কষ্টকর। আগুনের ব্যবহার হয়তো এই কাজেই প্রথম শুরু হয়। পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। খাবার হিসেবে তাই মাছকে সব সময়ই ব্যবহার করা যায়। আদিম যুগের খাবার সম্বন্ধে পুরো তথ্য জানা যায় নি। পশু শিকারে মানুষ সম্পূর্ণভাবে বাঁচতে পারে কি না সন্দেহের ব্যাপার। মাছের ওপর নির্ভর করতে শিখে মানুষ জলবায়ু ও আঞ্চলিক বন্ধনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। নদী, সমুদ্র ও হ্রদের তীর ধরে মানুষ আদিম যুগেই পৃথিবীর বিপুল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় প্রতিটি মহাদেশে এই স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া যায় আদিম পর্যায়ের চকমকি পাথর ও পাথরের জিনিসপত্রের নিদর্শন দেখে। শুধু প্রাকৃতিক ফল-মূলের ওপর নির্ভর করে মানুষের আদিম চরিত্র বদলানোর কোনো সুযোগই ছিল না।

খাবার হিসেবে মাছের ব্যবহার ও শস্য চূর্ণ করে আটা তৈরির মধ্যে অনেক সময় কেটে যায়। এই দুয়ের মধ্যে খাবারের পরিমাণও প্রকারে বাড়ে প্রচুর। যেমন মাটির চুলো তৈরি করে রুটি তৈরি করা এবং উন্নত অস্ত্র দিয়ে শিকার করা, বিশেষ করে তীর-ধনুকের[২] সাহায্যে শিকার। এই অস্ত্রটা আসে বর্শা আবিষ্কারের পর, কিন্তু অস্ত্র হিসেবে খুবই ফলপ্রসূ হয়ে দাঁড়ায়। এর উদ্ভাবন ঘটে আদিম যুগের শেষ পর্যায়ে। এই অস্ত্র আদিম সমাজকে বেশ শক্তিশালী করে তোলে, যেমন লোহার তরবারি শক্তিশালী করে বর্বর যুগকে। আর আগ্নেয়াস্ত্র শক্তিশালী করে সভ্য যুগকে।

মৎস্যজীবী অঞ্চলের বাইরে মানুষ আরেক ভয়ঙ্কর উপায়ে খাদ্য সন্ধানে লাগে তা নরখাদকতা।

৩। চাষের সাহায্যে শস্য উৎপাদন এবং শস্যকে আহার হিসেবে গ্রহণ

আদিম স্তর পার হয়ে আমরা এখন নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগে প্রবেশ করছি। পশ্চিম গোলার্ধে ধান-গম-যব ইত্যাদির চাষ ছিল অজ্ঞাত। যারা আদিম পর্যায় পার হয়ে এসেছিল এমন কিছু গোষ্ঠী অবশ্য তা জানত। পূর্ব গোলার্ধে এশিয়া এবং ইউরোপীয় গোষ্ঠীরাও এই ব্যাপারে ছিল অজ্ঞ। তারা সম্ভবত নিম্ন বর্বর পর্যায় শেষ করে মধ্য বর্বর যুগ ছুঁই ছুঁই অবস্থায় এই জ্ঞান লাভ করে। এ থেকে দেখা যাচ্ছে আমেরিকান আদিবাসীরা পূর্ব গোলার্ধের গোষ্ঠীগুলো থেকে সম্পূর্ণ এক জাতিতাত্ত্বিক বিভাগ আগেই এই জ্ঞান লাভ করে। এর কারণ দুই গোলার্ধে অগ্রগতি একইভাবে সাধিত হয় নি। পূর্ব গোলার্ধে প্রায় প্রয়োজনীয় সব পশুই তারা গৃহপালিত করে ফেলেছে এবং বেশ কিছু শস্যও চাষ করছে। এদিকে পশ্চিমে তখন মাত্র একটা শস্যের চাষ হয়। অবশ্য এই শস্যটি ছিল অন্যতম প্রধান শস্য। এতে দেখা যায়। বর্বর যুগ পূর্ব গোলার্ধে প্রথম দিকে বেশি সময় ধরে থাকলেও পরে তা থাকে বেশ অল্প সময়। কিন্তু অবস্থার আনুকূল্যে আমেরিকান আদিবাসীরা এই সময় তবু এগিয়ে ছিল। কিন্তু মধ্য বর্বর যুগে বহু পূর্ব গোলার্ধীয় গোষ্ঠী চাষবাস না জানলেও কিছু পশুপালনের ফলে দুধ ও মাংস সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হওয়ায় আমেরিকান আদিবাসী থেকে অনেকটা এগিয়ে যায়। যদিও এই আদিবাসীরা তখন যব-গম-ভুট্টা ইত্যাদি শস্যের চাষ ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। শুধু পশুপালনবিদ্যা জানা ছিল না বলে তারা ছিল পিছিয়ে। সেমিটিক ও আর্য পরিবারগুলোকে অন্যান্য বর্বর গোষ্ঠীদের থেকে আলাদা করা যায় তাদের এই পশুপালনের গুণের জন্যে।

আর্য পরিবারগণ পশুপালনের পর যে শস্য চাষের ব্যাপারটা শেখে তার প্রমাণ মেলে তাদের আঞ্চলিক কথায়। তাদের ভাষায় অনেক পশুর নাম প্রায় এক, কিন্তু কোনো শস্যের নাম এক নয়। মমসেন দেখিয়েছেন যে গ্রিক, সংস্কৃত ও ল্যাটিনে (যা মাক্সমুলার পরে আর্য ভাষাতেও দেখান)[৩] গৃহপালিত পশুর নাম এক। এতেই প্রমাণিত হয় তাদের পৃথক হবার আগে তারা সমানভাবে পশুপালন করেছে : “অপর দিকে এই সময় চাষের কোনো প্রমাণ আমরা পাই নি। ভাষা দেয় নেতিবাচক সাক্ষ্য। ল্যাটিন ও গ্রিক নাম সংস্কৃতে পাওয়া যায় না। একমাত্র যি (যব) ছাড়া। শব্দতত্ত্ব অনুযায়ী সংস্কৃতে যা যব, তা আসলে ভারতীয় বার্লি। আর গ্রিক ভাষা অনুযায়ী বোঝায় বুনো গম। এ থেকেই বোঝা যায় পশুপালনের মতো তারা একই সঙ্গে চাষবাস করে নি। ভারতীয়দের মধ্যে ধান, গ্রিকদের মধ্যে গম, আর জার্মান ও কেন্টদের মধ্যে রাই ও জই এ-সবের চাষ একই চাষ পদ্ধতির উৎস থেকে উৎসারিত।[৪] এই শেষোক্ত সিদ্ধান্তটি অবশ্য সঠিক নয়। উদ্যান-কৃষি ক্ষেত্ৰ-কৃষির আগেই এসেছে এবং এটাই স্বাভাবিক। প্রথমে ঘটে পলি পড়া সামান্য জায়গায় চাষ, এরপর আসে ঘেরা বাগান, আর সবশেষে পশু-চালিত লাঙলের সাহায্যে ক্ষেত্ৰ-কর্ষণ। মটর, বিট, শিম, তরমুজ ইত্যাদি শস্য চাষের আগে এসেছে কি না এ সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান লাভের উপায় নেই। গ্রিক ও ল্যাটিনে এদের কিছুকে প্রায় একই শব্দে প্রকাশ করা হয়, কিন্তু অধ্যাপক হুইটনের অভিমত, গ্রিক ও ল্যাটিনে এই শব্দ এক হলেও সংস্কৃতে তা নয়।

পশুপালনের চেয়ে উদ্যান-কৃষির প্রয়োজনটাই মানুষের কাছে বেশি করে দেখা দেয়। পশ্চিম গোলার্ধে জনার ও ভুট্টার সাথেই এই বিদ্যার আরম্ভ। এই নূতন যুগ যদিও দুই গোলার্ধে একইভাবে সৃষ্টি হয় নি তবু মানবজাতির গন্তব্যের একটা সুস্পষ্ট ধারণা জন্মে। চাষের ওপর প্রধানভাবে নির্ভর করতে অবশ্য বহু যুগ লেগে যায়।

আমেরিকার ইণ্ডিয়ানরা চাষ গ্রহণের ফলে নির্দিষ্ট গ্রাম গড়ে তুলতে সক্ষম হয় এবং পশু শিকার ও মাছ ধরার হাত থেকে মুক্তি পায়। শস্য আহার ও পুরোদস্তুর চাষবাসের সাহায্যে মানুষ আরো একটা জ্ঞান লাভ করে যে চাষের সাহায্যে তারা খাদ্যশস্য পেতে পারে।

এই শস্যের ওপর নির্ভরতা, আর এশিয়া-ইউরোপে পশুপালনবিদ্যার ফলে উন্নত গোষ্ঠীগুলো নরখাদকতা ত্যাগ করে। আমরা আগেই বলেছি আদিম যুগে নরখাদকতা ছিল। প্রায় সর্বজনীন। আদিম যুগেই বন্দীদের এবং দুর্ভিক্ষকালে বন্ধুবান্ধব, এমনকি ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত খেয়ে ফেলা হত। শুধু যে নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগেই যুদ্ধবন্দীদের খেয়ে ফেলা হত তা-ই নয়, এমনকি মধ্য বর্বর যুগেও ইরোকোয়া ও আজটেক গোষ্ঠীতে তা দেখা গেছে। কিন্তু তা সর্বজনীন ছিল না। এতেই বোঝা যায় আহার্য-বস্তুর পর্যাপ্ততার দরুনই এই পরিবর্তন ঘটে।

৪। আহার্য হিসেবে মাংস ও দুধের ব্যবহার

পশ্চিম গোলার্ধে পশুপালন সংঘটিত হয় নি। একমাত্র ‘লামা’ (এক প্রকার কুকুর)[৫] বাদে, আর শস্য ফলনের ব্যাপারটাও দুই গোলার্ধে দুই-রকমভাবে হওয়ায় মানব সমাজে প্রভাব পড়ে ভিন্নভাবে। অবশ্য অগ্রগতির এই অসম উন্নয়ন আদিম পর্যায়ে এমন কিছু হেরফের ঘটায় নি, এমনকি নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগেও। কিন্তু মধ্য পর্যায়ের বর্বর যুগে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা দেয়। পশুপালনের ফলে দুধ ও মাংসের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়। আর যে সমস্ত বর্বর গোষ্ঠী তা করতে শেখে অন্যদের থেকে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ঘটে। পশ্চিম গোলার্ধে মাংসের সরবরাহ ছিল ভীষণভাবে সীমিত কারণ শিকার তেমন পাওয়া যেত না। এই বিশেষ খাবারের অভাব গ্রামীণ আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের প্রতিকূল অবস্থায় ফেলে। আর নিঃসন্দেহে এই জন্যেই দেখা গেছে নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগ থেকে আদিম ইণ্ডিয়ানদের মস্তিষ্কে ঘিলুর আকার ছিল কম। পূর্ব গোলার্ধে পরিশ্রমী লোকেরা পশুপালনের দরুন দুধ ও মাংস সম্বন্ধে নিশ্চিত[৬] হয়। এর ফলে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান ছেলেমেয়ে জন্ম নিতে থাকে, নিঃসন্দেহে এটা একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। এটা অন্তত ধরে নেওয়া যায় যে আর্য ও সেমিটিক গোষ্ঠীগুলো প্রচুর পরিমাণে গৃহপালিত পশু রাখত। মোটকথা দুধ ও মাংসকে তারা জীবন ধারণের একটা প্রধান উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে। অন্য কোনো মানবজাতি এত প্রচুরভাবে পশুপালন গ্রহণ করে নি আর আর্যরা সেমিটিকদের চেয়েও তা বেশি করে গ্রহণ করে।

পশুদের গৃহপালিত করতে পারায় এক নূতন জীবনধারার সূত্রপাত ঘটে। বিশেষ করে মেষপালক দলের আবির্ভাব ঘটে ইউফ্রেটিস, ভারত ও এশিয়ার তৃণভূমিতে। এইভাবে প্রথম পশুপালন বৃহদাকারে গৃহীত হয়। এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এ সম্বন্ধে সমানভাবে সাক্ষ্য দেয়। এই অবস্থা থেকেই বোঝা যায় তারা আর আদিম পর্যায়ে নেই বা নেই বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে। যে পর্যায়ের জন্যে বনজঙ্গলই ছিল আদি-বাসস্থান। এই পশুপালন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পর তাদের পক্ষে ইউরোপের জঙ্গলে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ধান-যব-গম ইত্যাদি কিছু শস্যের চাষ না জানলে তারা তৃণভূমি ছেড়ে সমতলে যায় কী করে? এতেই মনে হয় পশুদের খাবারের জন্যেই হয়তো চাষের ব্যাপারটা এদের আয়ত্তে আসে। এইভাবেই তারা চাষের ব্যাপারটা শেখে।

পশ্চিম গোলার্ধে আদিবাসীরা নিম্ন বর্বর পর্যায় থেকে মধ্য পর্যায়ে ওঠে কোনো গৃহপালিত পশু ছাড়াই এবং শস্য বলতে ছিল ভুট্টা, জনার, শিম, তুলো, মরিচ ইত্যাদি… কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চল থেকে জমিতেই ভুট্টা ভালো হয়। তা ছাড়া কাঁচা-পাকা দু অবস্থাতেই সমান পুষ্টিকর। তাই এর চাষ অন্য সব শস্যের চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়। এর ফলে মার্কিন আদিবাসীরা পশুপালন ছাড়াই যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করে। এর মধ্যে পেরুবাসীরা ব্রোঞ্জের আবিষ্কার করে। যার ফলে এরা প্রায় লোহা গালানোর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।

৫। জমি চাষের জোরে প্রচুর খাদ্যশস্যের ফলন

গৃহপালিত পশুরা মানুষকে তার শ্রম দিয়েও সাহায্য করেছে। মানুষের অগ্রগতিতে এর একটা বিরাট অবদান আছে। কালক্রমে লোহার ব্যবহার শেখার পর লৌহ-ফলা ব্যবহার করে লাঙলের ব্যবহার ঘটে। তার সাথে আসে উন্নত কোদাল ও কুড়ুল। ফলে পূর্ব গোলার্ধে উদ্যান-কৃষির পর আসে ক্ষেত্র-কর্ষণ। এই প্রথম মানুষ প্রচুর শস্যের অধিকারী হয়। পশু চালিত লাঙলকে এক নূতন কলাকৌশলের উদ্বোধন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এই প্রথম মানুষের মাথায় আসে বনজঙ্গল সাফ করে চাষের ক্ষেত্র বাড়ানোর চিন্তা।[৭] তা ছাড়া এখন সীমিত জায়গায় ঘন-জনবসতি সম্ভব হয়ে ওঠে। ক্ষেত্র-কর্ষণ পদ্ধতির আগে পৃথিবীপৃষ্ঠের কোনো অংশেই এক সরকারের আওতায় পাঁচ লক্ষ জনসংখ্যার বসবাস সম্ভব হয় নি। আর যদি কোনো ব্যতিক্রম হয়ে থাকে তা সমভূমিতে পশুপালনের জন্যে বা উন্নত সেচ ব্যবস্থায় উদ্যান-কৃষির ফলে।

এই সূত্রে আমরা বিভিন্ন জাতিতাত্ত্বিক যুগের পারিবারিক গড়নের কাঠামো নিয়ে আলোচনা করব। যা যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়। তৃতীয় খণ্ডে এ সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। যেহেতু পরবর্তী খণ্ডেই বারবার এদের উল্লেখ করা হবে তাই পাঠকের সুবিধার্থে আগেই সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দিয়ে নিতে চাই। নিম্নে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল :

১। কনসাঙ্গুইন বা রক্ত-সম্পর্কিত জ্ঞাতি পরিবার

দলের মধ্যে নিজ ভাই-বোনদের বিয়ের ফলে এই পরিবারের সৃষ্টি হয়। এর নিদর্শন এখনো মেলে। মালয়ে এ ধরনের বিয়ে দেখা গেছে। সবচেয়ে পুরোনো ধরনের বিয়ে হল এই ভাই-বোনের বিয়ে। আদিম যুগেই এই পদ্ধতি ছিল প্রায় সর্বজনীন।

২। পলুয়ান বা দলগত বিবাহ সৃষ্ট পরিবার

এই নাম নেওয়া হয় হাওয়াইদের পুনালুয়া সম্পর্ক থেকে। এই পদ্ধতিতে নিজ দলের বিভিন্ন সম্পর্কের ভায়েরা অপরের স্ত্রীকে বিয়ে করে। আর বিভিন্ন সম্পর্কের বোনের বিয়ে করে নিজ দলের মধ্যে অপরের স্বামীকে। ভাই পদকে শুধু আপন ভাই বা চাচাতো ভাইকেই বোঝাবে না, খালাতো, ফুপাতো, মামাতো ইত্যাদি দূর-সম্পর্কের সব ভাইকেও বোঝাচ্ছে। যাদের সবাই একে অপরের ভাই হিসেবে গণ্য। যেমন আমরা নিজেদের ভাইদের গণ্য করি। অনুরূপভাবে বোনরাও সব ধরনের বোনকেই বোঝাচ্ছে। এই ধরনের পরিবার রক্ত সম্পর্কিত জ্ঞাতি পরিবারের ঠিক পরেই এসেছে। এই পদ্ধতি টুরানীয় গ্যানোয়া পদ্ধতির সগোত্রতা সৃষ্টি করে। বিয়ের এই পদ্ধতি ও উল্লিখিত পূর্বের পদ্ধতিটি ছিল সম্পূর্ণভাবে আদিম যুগে।

৩। সিনড্যামিয়ান বা জোড় পরিবার

শব্দটা সিনডিয়াজো বা জোড় দেওয়া ও সিনডিয়াসমস বা দুজনকে জোড়া লাগানো থেকে এসেছে। এখানে একজন মেয়ের সাথে একজন পুরুষের বিয়ের আকারে জোড় দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তাদের সহবাসের কোনো নির্দিষ্টতা নেই। এখানেই অবশ্য একবিয়ে পরিবারের বীজ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কোনো রকম বিবাহ বিচ্ছেদ স্বামী বা স্ত্রী যে-কোনো একজনের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত। এই ধরনের পরিবার রক্ত-সম্পর্কিত কোনো গোত্র বা জ্ঞাতি সৃষ্টি করতে পারে নি।

৪। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার

একজন পুরুষের কয়েকজন স্ত্রী গ্রহণ করে যে পরিবার তা-ই পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। এখানে কথাটাকে অবশ্য সীমিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। কারণ হিব্রু পশুপালন গোষ্ঠী প্রধান এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই কেবল বহু স্ত্রী গ্রহণ করত। এটা কোনো সর্বজনীন পদ্ধতি ছিল না।

৫। একবিয়ে পরিবার

এই পরিবার পদ্ধতিতে এক স্ত্রী ও এক পুরুষের বিয়ে এবং তাদের সম্পূর্ণ সহবাস। সম্পূর্ণ সহবাসটাই এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়। এর ফলে এটা একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পদ্ধতি প্রধানতই সভ্যতা সৃষ্ট। তাই একে বলতে হবে আধুনিক যুগের পরিবার। এই পারিবারিক পদ্ধতি স্বাধীনভাবে জ্ঞাতি পদ্ধতির জন্ম দেয়।

আগামীতে আমরা দেখব একেক জাতিতাত্ত্বিক পর্যায়ে এই বিভিন্ন ধারার পরিবার কীভাবে বিরাজ করছিল।

—–

১। Lucr. De Re. Nat., lib. v. 951.

২। নানা কারণে মনে হয় তীর-ধনুকের ব্যাপারটা হঠাৎ করেই পাওয়া। নানা গাছ বা তার স্থিতিস্থাপক ক্ষমতা এবং একে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা করা যায় এই ধারণা আদিবাসীদের মনে হঠাৎ করেই খেলে। তাই দেখা গেছে পলিনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে কোনো তীর-ধনুক দেখা যায় নি। এ থেকেই বোঝা যায় আদি অবস্থায় তীর-ধনুকের আবিষ্কার সমাজে একটা গুণগত পার্থক্য সৃষ্টি করে।

৩। “Chip. From a Jerman Workshop”, Comp. Table, iv. p. 42

৪। “রোমের ইতিহাস”, সাইবনারের সংস্করণ, ১৮৭১, ১ খণ্ড, পৃঃ ৩৮।

৫। প্রথম দিকের স্পেনীয় লেখকরা ওয়েষ্ট ইণ্ডিয়া আইল্যাণ্ডে একটি “বোবা কুকুরকে” গৃহপালিত করার উল্লেখ করে এবং মধ্য আমেরিকায় মেক্সিকোতেও তা দেখা যায়। হাঁস-মুরগি এমনকি টার্কিরও উল্লেখ আছে। নাহয়াটক গোষ্ঠীতে বুনো মুরগি পোষ মানার তথ্য জানা যায়।

৬। আমরা ইলিয়াড থেকে জানতে পারি গ্রিকরা গরু-ছাগল-ভেড়ার দুধ দুইত।

৭। Luer. De Re, Nat., V. T369

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *