১.১ জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগ

প্রথম খণ্ড – উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তার ক্রমবিকাশ

প্রথম পরিচ্ছেদ – জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগ

মানব জাতির সর্বাধুনিক অনুসন্ধানের ফলে আমরা জানতে পারছি যে মানুষ একেবারে নগণ্য অবস্থায় জীবন আরম্ভ করেছিল। তারপর সে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে ক্রমশ ধাপে ধাপে সভ্যতার দিকে অগ্রসর হয়েছে।

এটা অনস্বীকার্য সত্য যে মানব মহাপরিবারের কিছু অংশ ছিল আদিম অবস্থায়, কিছু অংশ বর্বর অবস্থায় আবার কিছু অংশ ছিল সভ্যতায় যা মানব সমাজের প্রগতির স্বাভাবিক পরিণতি। এ থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে উক্ত তিন অবস্থা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মানব-পরিবারের প্রতিটি শাখার ব্যাপারেই এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। যেসব কারণে প্রগতি সম্ভব সেই ধারা অবলম্বন করেই প্রতিটি শাখার অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

আগামীতে আমরা আদিম মানবের জীবনের ছয়টি প্রাথমিক অবস্থার কথা তুলে ধরব। তা ছাড়া দেখব তাদের মানসিক ও নৈতিক শক্তির ক্রমবিবর্তন এবং অন্যান্য বাধা জয় করে। সভ্যতার পথে অগ্রসর হবার কথা। এর কিছুটা আমরা জানতে পারব উদ্ভাবন ও আবিষ্কার সম্বন্ধে পাঠ করে, আর বাকিটুকু জানতে পারব গার্হস্থ্য বা পারিবারিক জীবন থেকে যার মাঝে কিছু ধ্যান-ধারণা এবং আবেগ জন্মলাভ করেছে।

মানুষের আদিম অবস্থা থেকে প্রগতির বিভিন্ন ধারা ধরে অগ্রসর হলে আমরা দেখব এক দিকে বিরাজ করছে উদ্ভাবন ও আবিষ্কার এবং অন্য দিকে প্রতিষ্ঠানসমূহ। প্রগতির ক্ষেত্রে আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের এক স্তর আরেক স্তরকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানসমূহ খুব নগণ্য অবস্থা থেকে বর্ধিত হয়েছে। আধুনিক যুগের প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল রয়েছে বর্বর যুগে, আবার এই বর্বর যুগের মূল রয়েছে তার পূর্ববর্তী আদিম পর্যায়ে। ন্যায়সঙ্গতভাবেই যুগে যুগে তা একটি সরলরেখায় ক্রমোর্ধভাবে এগিয়ে গেছে।

এইভাবে আমরা আমাদের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দুটো স্পষ্ট পথ দেখতে পাচ্ছি। এক উদ্ভাবন ও আবিষ্কার, দুই প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। এ সম্বন্ধে পূর্ণভাবে জ্ঞাত হবার পর আমরা মানুষের প্রগতির মূল স্তরের আলোচনা করব। এক্ষেত্রে নজির নেওয়া হবে প্রধানত গার্হস্থ্য। প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে, অন্যান্য মানসিক কৃতিত্বের ব্যাপার এখানে গৌণ।

এইসব তথ্য বিভিন্ন ধ্যান ধারণা আবেগ ও রীতিনীতি সম্বন্ধে আলোকপাত করবে। আবার দেখা যাবে প্রধান ধারণাগুলোও সাধারণ ধারণার সাথে যুক্ত। উদ্ভাবন ও আবিষ্কার বাদ দিলে প্রধান ধারণাগুলো দাঁড়ায় নিম্নরূপ :

১। জীবন ধারণার্থে প্রয়োজনীয় সামগ্রী

২। সরকার

৩। ভাষা

৪। পরিবার

৫। ধর্ম।

৬। গার্হস্থ্য জীবন ও স্থাপত্য

৭। সম্পত্তি

১। বেশ কিছু শিল্পের উদ্ভাবনের দরুন জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী বৃদ্ধি পায় ও তাদের উন্নতি ঘটে। অবশ্য এই উদ্ভাবন ঘটেছে বহু যুগ পর পর এবং এই ব্যাপারটা উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের সাথে সরাসরি জড়িত।

২। সরকার নামক ধারণার উৎপত্তি সম্বন্ধে ঘেঁজ নিতে হলে আমাদের আদিম পর্যায়ের গণসংগঠনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এই ধারণা ক্রমশ রাজনৈতিক সমাজে এসে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

৩। মানুষের ভাষা তার সাধারণ মনোভাব প্রকাশের প্রয়োজনেই বেড়ে উঠেছে। লুক্রেশিয়াস পরিষ্কার দেখিয়েছেন যে অঙ্গভঙ্গি ও ইশারা দিয়ে মনোভাব প্রকাশ উচ্চারিত ভাষার পূর্বে আসে। কারণ, চিন্তা চলে কথার আগে। যেমন একস্বর শব্দ বহুস্বর শব্দের আগে এসেছে। যেমন বহুস্বর শব্দ সৃষ্টি হয়েছে কোনো সম্পূর্ণ শব্দের আগে। মানুষ তার অগোচরেই কণ্ঠস্বরকে কাজে লাগিয়ে স্পষ্ট-উচ্চারিত ভাষায় রূপান্তরিত করেছে। ভাষার বিষয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা পূর্ণাঙ্গ বিভাগ। তা আমাদের বর্তমান অনুসন্ধানের আওতাধীন নয়।

৪। পরিবারের বিভিন্ন পর্যায় দেখা যায় সগোত্র ও আত্মীয়তার মধ্যে। আর বিবাহ পদ্ধতির সাহায্যে পরিবারকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যায়, যা একের পর এক এগিয়েছে।

৫। ধর্ম নামক ধারণাটির মধ্যে এমনি এক জটিলতা বিরাজমান যে এর সৃষ্টির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। ধর্ম বড় বেশি কাল্পনিক ও আবেগের সাথে জড়িত তাই এ সম্বন্ধে সঠিক হওয়া মুশকিল। তা ছাড়া দেখা গেছে সব আদিম ধৰ্মই অদ্ভুত, অনেকটা দুর্বোধ্য। তাই একেও আমাদের পাঠের ক্ষেত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য দু-এক জায়গায় সংক্ষিপ্ত মন্তব্য থাকতে পারে।

৬। স্থাপত্য জিনিসটা পারিবারিক সংগঠন ও গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আদিম যুগ থেকে সভ্যতায় আসার একটা পূর্ণ চিত্র তাই স্থাপত্যের পক্ষে দেওয়া সম্ভব। আদিবাসীর কুঁড়েঘর, বর্বর যুগে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যৌথ বাড়ি থেকে শুরু করে সভ্য সমাজে একক পরিবারের বাড়ির মধ্যে ক্রমোন্নতির চিহ্ন স্পষ্ট। প্রতিটি দূরের জিনিসই মাঝের জিনিসের মাধ্যমে পারম্পর্য রক্ষা করছে। প্রসঙ্গক্রমে আমরা স্থাপত্য সম্বন্ধেও দু-চার কথা আলোচনা করতে পারি।

৭। সম্পত্তির ধারণা মানুষের মাঝে ধীরে ধীরে জন্মলাভ করেছে। বহু যুগ ধরে তা ছিল খুব নগণ্য অবস্থায়। আদিম যুগেই এর সূত্রপাত। পরবর্তী যুগে এর বীজ ক্রমশ ডালপালা মেলে বেড়ে ওঠে এবং মানুষকে এই সম্পত্তিই অনেকটা চালনা করছে। সম্পত্তির নেশা অন্যান্য চিন্তাধারার ওপর স্থানলাভ করে সভ্যতার সূত্রপাত করেছে। সম্পত্তি মানুষকে সভ্যতার পথের বাধাকে দূর করতেই শুধু সাহায্য করে নি বরং অঞ্চল ও সম্পত্তির ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাজের স্থাপন করেছে। সম্পত্তি ধারণার বিবর্তনের খুঁটিনাটি তথ্য মানুষের মানসিক ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য দিককে তুলে ধরবে।

এই সমস্ত বিষয়ের আলোকে আমার কাজ হবে বিভিন্ন জাতিতাত্ত্বিক যুগে যে প্রগতি সাধিত হয়েছে তা তুলে ধরা। অর্থাৎ সরকার, পরিবার ও সম্পত্তি এই তিন ধারণা কেন্দ্র করে যে অগ্রগতি হয়েছে তা দেখানো।

সরকারকে দুই বিশিষ্ট ভাগে বিভক্ত করা যায়। সময়ের ক্রমের দিক থেকে দেখতে গেলে প্রথমে যে সরকার আসে তাতে জনগণের সম্পর্ক ব্যক্তিগত সম্পর্কে স্থাপিত এবং একে সমাজ বলে পৃথক করা যায় (societas)। এই সংগঠনের ভিতে হল গণসংগঠন। যার ঠিক পরেই আসছে ভ্রাতৃত্ব, গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীদের মিত্রসংঘ (populus)। পরে গোষ্ঠীরা একাঙ্গীভূত হয়ে নিজেদের স্বাধীন এলাকা নিয়ে বাস করতে শুরু করে। গণসংগঠনের পর বহু যুগ লাগে এই পর্যায়ে পৌঁছতে এবং আদিম যুগে এটা ছিল প্রায় সর্বজনীন। সভ্যতায় প্রবেশ করেও গ্রিক ও রোমানদের মধ্যে অনেক বছর এই ব্যবস্থা চলেছে। দ্বিতীয় ধারা হল অঞ্চল ও সম্পত্তিভিত্তিক, যাকে রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে (Civitas)। এই দ্বিতীয় ধারার ভিত হল প্রাচীর তোলা শহর। এর ফলে রাজনৈতিক সমাজের উদ্ভব। কোনো অঞ্চলের জনসাধারণ ও তাদের সম্পত্তি নিয়ে রাজনৈতিক সমাজ সংগঠিত। পরবর্তী পর্যায়ে শহর এই সংগঠনের ভিত হিসেবে কাজ করতে থাকে। প্রদেশ বা কাউন্টি হল ওয়ার্ড বা শহরের সমষ্টি। জাতীয় রাজ্য বা অঞ্চল হল প্রদেশ বা কাউন্টির সমষ্টি। এই সমস্ত প্রদেশের লোকেরা একটি রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে নিজেদের সংঘবদ্ধ করেছে। সভ্যতায় আসার পর গ্রিক ও রোমানরা তাদের সমগ্র ক্ষমতা নিয়োগ করে শহর বা ওয়ার্ডকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সমাজ গঠনের পেছনে। গ্রিক ও রোমানদের এই মহাপরিকল্পনা আজ পর্যন্ত সত্য জাতিদের মধ্যে চলছে। আদি সমাজে এই অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা ছিল অজানা। এই ঘটনা ঘটে যাবার পর আদিম ও আধুনিক সমাজের একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা পাওয়া যাচ্ছে।

বর্বর ও আদিম অবস্থায় থাকা সমাজে এখনো আমরা আমাদের আদি-পুরুষদের জীবনযাত্রা দেখতে পাই এবং আরো দেখতে পাই মানব সমাজের প্রগতির বিভিন্ন স্তর। সমাজ গঠনের প্রথমে দেখা যাচ্ছে লিঙ্গভিত্তিক সংগঠন, তারপর জাতি-সম্পর্কভিত্তিক সংগঠন এবং সবশেষে আসে অঞ্চলভিত্তিক সংগঠন। আরো যেসব জিনিসের সাহায্যে আমরা মানব জাতি সম্বন্ধে জানতে পারি তা বিয়ে ও পরিবার সংগঠনের ধারা, যার দরুন রক্ত-সম্পর্কিত ধারার সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া আছে গার্হস্থ্য জীবন ও স্থাপত্য। তা ছাড়া সম্পত্তির মালিকানা ও তার উত্তরাধিকারের নিয়ম ধরেও আদিম সমাজ সম্বন্ধে জানা যায়।

আদিবাসী ও বর্বরদের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে উন্নত অবস্থা থেকে তাদের অবনতি ঘটেছে, এ কথা এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যাখ্যা হিসেবে যে প্রয়োজনেই একে দাঁড় করানো হয়ে থাকুক এখন আর তা গ্রহণ করা চলে না। এই তত্ত্ব আদিবাসীদের অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে অপারগ কারণ এর পেছনে প্রামাণ্য তথ্য নেই।

যে অবস্থায় আদিম ও বর্বর যুগের গোষ্ঠীরা আছে ধরে নেওয়া যায় আর্য জাতিগুলোর পূর্বপুরুষরাও সেই অবস্থার মাঝ দিয়ে এসেছে। যদিও সভ্য যুগের সমস্ত খবরই আর্যদের জানা, এমনকি বর্বর যুগের শেষ পর্যায়ের তথ্যও, কিন্তু তাদের আরো পূর্ববর্তী তথ্য জানতে গেলে বর্তমান বর্বর ও আদিবাসীদের অনুষ্ঠান ও আবিষ্কারের মাঝ থেকে জানতে হবে।

এ কথা বলা যায় যে মানুষের অভিজ্ঞতা প্রায় সমানভাবে একই খাতে রয়েছে। সম পরিবেশে মানুষের বস্তুগত প্রয়োজন ছিল একই রকমের। তা ছাড়া যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা এ কথা প্রমাণ করে যে মানুষের মস্তিষ্কের প্রক্রিয়া বা চিন্তাধারা প্রায় একইভাবে কাজ করে। মানুষ যা সৃষ্টি করেছে তা যে একই ধরনের তার আংশিক ব্যাখ্যা এটা। আদি অবস্থায় থাকা কালেই মানব সমাজে প্রধান প্রতিষ্ঠান ও জীবনধারা বেশ সুষ্ঠু রূপ ধারণ করেছিল।

প্রবর্তী বর্বর ও সভা যুগে এই সমস্ত প্রাথমিক জিনিসই আরো উন্নত হয়েছে মাত্র। ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে অবস্থিত সমাজের কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যদি মিল দেখা যায় বুঝতে হবে তারা এক সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত।

কয়েকটি জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগ করে নিলে নানা ধরনের তথ্যের আলোচনার ৰ্ণ্যসুবিৰ্ণ্যেধ হবে। যে বিভাগ একটি সমাজের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে ধারণা দেয় এবং এর বিশেষ জীবনধারা এই বিভাগের জন্যেই সীমাবদ্ধ। ডেনিশ পুরাতত্ত্ববিদ যে যুগবিভাগ করেছেন, প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জযুগ ও লৌহযুগ নামে এই বিভাগ বিশেষ কতগুলো প্রয়োজন মেটাতে পারে এবং প্রাচীন শিল্পকলার শ্রেণীর বিন্যাসের জন্যে তা বিশেষ দরকারি। কিন্তু জ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আরো বিভাগ-উপবিভাগ দেখা গেছে। লোহা ও ব্রোঞ্জ আবিষ্কৃত হবার সাথে সাথেই পাথরের হাতিয়ার একেবারে পরিত্যক্ত হয় নি। লোহা গালানোর সাথে আমরা এক জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগ করেছি, কিন্তু ব্রোঞ্জের সাথে তা পারি না। তা ছাড়া প্রস্তর ও ব্রোঞ্জ পরস্পরকে অতিক্রম করে যায়। আবার ব্রোঞ্জ ও লোহা পরস্পর পরস্পরকে অতিক্রম করে। তাই এরা এমন একটা পরিবেষ্টন সৃষ্টি করতে পারে না যা প্রতিটি যুগকে নির্দিষ্টভাবে পৃথক করে।

খাদ্য সামগ্রী লাভের জন্যে মানুষ যে কলাকৌশল ও হাতিয়ার উদ্ভাবন করে তা মানুষের সামাজিক পরিবেশের ওপর ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আর এই উদ্ভাবন যুগবিভাগের ক্ষেত্রে খুবই সন্তোষজনক উপাদান, কিন্তু এদিকে প্রয়োজনীয় তথ্য লাভের জন্যে তেমন অনুসন্ধান চালানো হয় নি। আমাদের বর্তমান জ্ঞানের সাহায্যেই কালবিভাগ করতে হবে। যদিও এই যুগবিভাগকে শর্তাধীনভাবে মেনে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা আমাদের কাজে বিশেষভাবে সাহায্য করবে। এই সমস্ত বিভাগ এক বিশেষ সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ফুটিয়ে তুলবে।

প্রথম ভাগ হল আদিম যুগ। এই যুগ সম্বন্ধে খুব বেশি জানা যায় নি। তবু আমরা একে তিন উপবিভাগে ভাগ করতে পারি। এদের নাম দেওয়া যায়, যথাক্রমে : প্রাচীন, মধ্য ও পরবর্তী আদিম যুগ। আর সমাজের অবস্থার নাম দেওয়া যায় যথাক্রমে নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের আদিম সমাজ।

ঠিক একইভাবে বর্বর যুগকে তিন উপবিভাগে ভাগ করা যায়, যথাক্রমে : প্রাচীন, মধ্য ও পরবর্তী বর্বর যুগ। আর সমাজের অবস্থা হল যথাক্রমে : নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের বর্বর সমাজ ।

এখানে যে বিভাগ করা হয়েছে বিভিন্ন মহাদেশের সমাজের অবস্থা পুরোপুরি আমাদের বিভাগ অনুযায়ী না মিলতে পারে। আমরা বলছি না যে এর ব্যতিক্রম হতে পারে না, তবে মানবজাতির প্রধান গোষ্ঠীগুলোকে শ্রেণী-বিভক্ত করতে পারলেই হল।

১। নিম্ন পর্যায়ের আদিম সমাজ

মানবজাতির শৈশব থেকে এর আরম্ভ। আর এর সমাপ্তি ঘটে মানুষ যখন মৎস্য আহার করছে এবং আগুনের ব্যবহার জ্ঞাত হয়। মানুষ তখন তার আদিম প্রবৃত্তির দ্বারাই চালিত হত এবং ফল ও বাদাম জাতীয় ফল খেয়ে জীবন ধারণ করত। স্পষ্টভাবে উচ্চারিত ভাষা এই যুগেই শুরু হয়। ঐতিহাসিক যুগে এই অবস্থার কোনো মানব গোষ্ঠীর অস্তিত্ব মেলে নি।

২। মধ্য পর্যায়ের আদিম সমাজ

মাছকে আহার্য হিসেবে গ্রহণ ও আগুনের ব্যবহার থেকে এই উপবিভাগের আরম্ভ এবং শেষ হয় তীর-ধনুক আবিষ্কারের সঙ্গে। এই যুগে মানবজাতি তাদের আদিম অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে অস্ট্রেলীয় ও পলিনেশীয় গোষ্ঠীদের কথা। এদের বেশির ভাগ গোষ্ঠীই যখন আবিষ্কৃত হয় ছিল আদিম যুগের মধ্য পর্যায়ে। আমাদের আলোচনার জন্যে একটি পর্যায়ের এক বা একাধিক উদাহরণই যথেষ্ট।

৩। উচ্চ পর্যায়ের আদিম সমাজ

এই পর্যায়ের আরম্ভ তীর-ধনুক আবিষ্কারের সঙ্গে এবং এর সমাপ্তি ঘটে মৃৎশিল্প আবিষ্কারের সাথে। হাডসন উপসাগরীয় অঞ্চলের এথাপ্যাস্কান গোষ্ঠী, কলম্বিয়া উপত্যকার গোষ্ঠীগুলো এবং উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকার আরো কিছু গোষ্ঠী যখন আবিষ্কৃত হয় ছিল এই পর্যায়ে। এই সাথেই পড়ে আদিম সমাজের যবনিকা।

৪। নিম্ন পর্যায়ের বর্বর সমাজ

অন্যান্য সব আবিষ্কারের মধ্যে মৃৎশিল্পের স্থান গুরুত্বপূর্ণ। তাই একে আদিম ও বর্বর সমাজের সীমারেখা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। দুই অবস্থার বিশেষত্ব বহু পূর্বেই নির্ণয় করা হয়েছে, কিন্তু পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে পরবর্তী অগ্রগতির সীমানা নির্ধারণে কোনো মূল্যমান ধরা হয় নি। যেসব গোষ্ঠী মৃৎশিল্পের ব্যবহার সম্বন্ধে অজ্ঞ তাদের আদিম সমাজের পর্যায়ে ফেলতে হবে। আর যারা এই শিল্প আয়ত্ত করেছে কিন্তু ধ্বনিসম্মত বর্ণমালা ও লেখার ব্যবহার শেখে নি তাদের ফেলতে হবে বর্বর সমাজে ।

বর্বর যুগের প্রথম উপবিভাগের শুরু মৃৎশিল্প আয়ত্তের সঙ্গে। এ শিল্প কোনো জনগোষ্ঠী নিজেরা উদ্ভাবন করে থাকুক বা অন্য গোষ্ঠীর কাছ থেকে অনুকরণ করেই শিখে থাকুক। এই পর্যায়ের সমাপ্তি এবং মধ্য পর্যায়ের আরম্ভ সম্বন্ধে নির্ণয় করতে গিয়ে দুই গোলার্ধে দুই সমান্তরাল উন্নয়ন দেখতে পাই। পূর্ব গোলার্ধে ঘটে পশু গৃহ-পালন এবং পশ্চিম গোলার্ধে জল সেচের সাহায্যে ভুট্টা ও জনারের চাষ। এই সাথে দেখা যায় পোড়া ইট ও পাথর দিয়ে গৃহ নির্মাণ। এ-সবই নিম্নপর্যায় থেকে মধ্য পর্যায়ের বর্বর যুগে যাবার ক্রান্তিকাল। উদাহরণত মিসৌরী নদীর পূর্ব তীরের যুক্তরাষ্ট্রের ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীসমূহ। তা ছাড়া ইউরো এশিয়ার যেসব গোষ্ঠী মৃৎশিল্পের ব্যবহার করত কিন্তু যাদের কোনো গৃহপালিত পশু ছিল না সেইসব গোষ্ঠী।

৫। মধ্য পর্যায়ের বর্বর সমাজ

পূর্ব গোলার্ধে এই পর্যায়ের শুরু হয় পশু গৃহপালিত করার সাথে। আর পশ্চিম গোলার্ধে জল সেচের সাহায্যে কৃষিকাজ ও গৃহ নির্মাণ ক্ষেত্রে রোদে পোড়া ইট ও পাথরের ব্যবহার থেকে এই পর্যায়ের শুরু। এ সম্বন্ধে আমরা আগেই বলেছি। লৌহ-আকর গালানো আবিষ্কৃত হবার সাথেই এই পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এই পর্যায়ে পড়ে নিউ-মেক্সিকো, মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ও পেরুর গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানরা আর পূর্ব গোলার্ধের সেইসব গোষ্ঠী যাদের গৃহপালিত পশু ছিল, কিন্তু যারা লৌহ-আকর গালাতে জানত না। আদিম ব্রিটন্সরা লোহা গালানোর পদ্ধতি জানত, তাই তারাও এই পর্যায়ে পড়ে। পার্শ্ববর্তী বহু ইউরোপীয় গোষ্ঠী কিন্তু বেশ কিছু অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল।

৬। উচ্চ পর্যায়ের বর্বর সমাজ

এই পর্যায়ের শুরু হয় লৌহ-হাতিয়ার ব্যবহারের সাথে, আর এর সমাপ্তি ঘটে। ধ্বনিসমৃদ্ধ বর্ণমালা উদ্ভাবন ও সাহিত্যমূলক রচনা সৃষ্টির সাথে। এখান থেকেই সভ্যতা শুরু হয়। এই পর্যায়ে পড়ে হোমারীয় যুগের গ্রিক গোষ্ঠীসমূহ, রোম সাম্রাজ্য স্থাপনের পূর্বের ইটালির সব গোষ্ঠী এবং জার্মান গোষ্ঠীসমূহ।

৭। সভ্য পর্যায়ের সমাজ

এর সূচনা সম্বন্ধে আমরা পূর্বেই আলোকপাত করেছি। ধ্বনিসমৃদ্ধ বর্ণমালা উদ্ভাবন ও সাহিত্য সৃষ্টির সাথে সভ্যতার উদ্ভব। সভ্যতাকে দু ভাগে বিভক্ত করা হয়, প্রাচীন ও আধুনিক। পাথরের গায়ে লিখিত হায়ারোগ্লাইফিক লেখা যে সমাজে চলত তাদেরও সভ্যতার আওতায় ধরতে হবে।

সংক্ষিপ্তসার

যুগ – অবস্থা

১। আদিম প্রাচীন যুগ – ১। নিম্ন পর্যায়ের আদিম সমাজ

২। আদিম মধ্য যুগ – ২। মধ্য পর্যায়ের আদিম সমাজ

৩। আদিম পরবর্তী যুগ – ৩। উচ্চ পর্যায়ের আদিম সমাজ

৪। বর্বর প্রাচীন যুগ – ৪। নিম্ন পর্যায়ের বর্বর সমাজ

৫। বর্বর মধ্য যুগ – ৫। মধ্য পর্যায়ের বর্বর সমাজ

৬। বর্বর পরবর্তী যুগ – ৬। উচ্চ পর্যায়ের বর্বর সমাজ

১। নিম্ন পর্যায়ের আদিম সমাজ – মানব জাতির শৈশব থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগের আরম্ভ পর্যন্ত।

২। মধ্য পর্যায়ের আদিম সমাজ – আহার্য হিসেবে মাছের ব্যবহার এবং আগুন ব্যবহারের জ্ঞান লাভ থেকে ইত্যাদি।

৩। উচ্চ পর্যায়ের আদিম সমাজ – তীর-ধুনক উদ্ভাবন থেকে, ইত্যাদি।

৪। নিম্ন পর্যায়ের বর্বর সমাজ – মৃৎশিল্প উদ্ভাবন থেকে, ইত্যাদি।

৫। মধ্য পর্যায়ের বর্বর সমাজ – পূর্ব গোলার্ধে পশু গৃহপালিত করা আর পশ্চিম গোলার্ধে জল সেচের সাহায্যে ভুট্টা ও জনার চাষ, তা ছাড়া গৃহ নির্মাণে রোদে পোড়া ইট ও পাথর ব্যবহার, ইত্যাদি।

৬। উচ্চ পর্যায়ের বর্বর সমাজ – লৌহ-আকর গালানো থেকে শুরু করে লৌহ হাতিয়ার ব্যবহার, ইত্যাদি।

৭। সভ্য পর্যায়ের সমাজ – ধ্বনিসম্মত বর্ণমালার আবিষ্কার ও লেখা আবিষ্কার থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত।

এই যুগবিভাগগুলো এক নির্দিষ্ট সংস্কৃতি ও জীবনধারা ফুটিয়ে তোলে, যা এক এক বিভাগের জন্যে বিশিষ্ট। এই জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগগুলো কোন সমাজ কতদূর অগ্রসর হয়েছে তার নির্দেশক। একই মহাদেশে এমনকি একই ভাষাভাষী বিভিন্ন গোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে থাকতে পারে। কারণ সময়টা বড় কথা নয়, তাদের পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতই বড় কথা।

পশু গৃহপালিত করা, লোহা গালানোর জ্ঞান ও ধ্বনিসমৃদ্ধ বর্ণমালার ব্যবহার মৃৎশিল্পের ব্যবহার থেকে বিশিষ্ট ও উন্নত। উপরোক্ত বস্তুগুলোর সাহায্যে আমল্লা এক এক জাতির উন্নতির ব্যাখ্যা করেছি। তাই এখন আমাদের দেখিয়ে দেওয়া দরকার ওইসব জিনিসের ব্যবহার কেন ঘটেছে। মৃৎশিল্প সৃষ্টির পূর্বনির্ধারিত শর্ত হল গ্রামীণ জীবন এবং সমাজে অন্যান্য সাধারণ শিল্পের কিছুটা উন্নতি।[১] চকমকি পাথর ও অনানির পাথুরে অস্ত্র মৃৎশিল্পের চেয়ে পুরোনো। অনেক জায়গায় পাথুরে জিনিসপত্র পাওয়া গেছে কিন্তু তার সাথে মাটির কোনো জিনিস পাওয়া যায় নি। মৃৎশিল্প ব্যবহারের পূর্বেই বেশ কিছু জিনিসের চাহিদা প্রবল হয়ে উঠেছিল। গ্রামীণ জীবনের পত্তন ঘটে এবং মানুষ বেশ কিছু তৈজসপত্র নির্মাণের দক্ষতা অর্জন করে। বিশেষ করে ঝুড়ি তৈরি, গাছের বাকল সেলাই করে কাজে লাগানো, কাঠের তৈজসপত্র এবং তীর-ধনুক আবিষ্কার, এ-সবই ঘটে মৃৎশিল্পের আগে। মধ্য বর্বর যুগের অবস্থায় থাকা জুনি, আজটেক ও চোলুলা গোষ্ঠীগুলো মৃৎশিল্পে বেশ দক্ষতা অর্জন করে। নিম্ন বর্বর যুগের অবস্থায় থাকা চোকটা, ইরোকোয়া ও চেরোকি এরাও মৃৎশিল্প ব্যবহার করত, কিন্তু ততটা দক্ষতা অর্জন করে নি। আদিম যুগের পর্যায়ে থাকা এ্যাথাপ্যাস্কান ও ক্যালিফোর্নিয়ার বহু গোষ্ঠী চাষবাস জানত না, তারা মৃৎশিল্প সম্বন্ধেও ছিল অজ্ঞ।[২] লুববকের ‘প্রি হিস্টোরিক টাইমস’, টাইলরের ‘আর্লি হিস্ট্রি অব মাানকাইও’ ও পেসকেলের ‘রেসেস অব ম্যান’ থেকে এই শিল্প সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য পাওয়া গেছে। পলিনেশিয়া টোঙ্গা ও ফিজি দ্বীপ ছাড়া), অস্ট্রেলিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া ও হাড়সন উপসাগরীয় অঞ্চলবাসীরা মৃৎশিল্পের ব্যবহার জানত না। টাইলর মন্তব্য করেছেন, “এশিয়া মূল ভূখণ্ডের থেকে দূরের দ্বীপসমূহে বয়ন শিল্পের অস্তিত্ব ছিল না” আর “উত্তর সাগরের বেশির ভাগ দ্বীপেই মৃৎশিল্পের কোনো অস্তিত্ব ছিল না”।[৩] অষ্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী রেভারেণ্ড লোরিমার লেখককে জানিয়েছেন, “অস্ট্রেলিয়ানরা বয়ন, মৃৎশিল্প এবং তীর-ধনুক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।” সমগ্র পলিনেশীয়রাও তীর-ধনুক সম্বন্ধে ছিল অজ্ঞ। সিরামিক বা চীনামাটি-শিল্প গার্হস্থ্য জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য আরো প্রচুর পরিমাণে বাড়ায়। চকমকি পাথর ও অন্যান্য পাথুরে অস্ত্র, ডিঙি, কাঠের পাত্র, অন্যান্য তৈজসপত্র ও কাঠের তক্তা তৈরি করে স্থাপত্য[৪] নির্মাণে বিশেষ সাহায্য করেছে, কিন্তু কাজ করেছে বড় ধীর গতিতে। মৃৎপাত্রের ফলে খাবার সেদ্ধ করা খুব সহজ হয়। যার আগে একটা ৰ্ণ্যড়িতে কাদা মাখিয়ে, তার উপর চামড়া বসিয়ে পাথরের উপর রেখে সিদ্ধ করা হত।[৫]

আদিবাসীরা মাটি পোড়াত না রোদে শুকিয়ে শক্ত করে নিত এটা অবশ্য সঠিক জানা যায় নি। অধ্যাপক ই. টি. কক্স প্রাচীন মৃৎশিল্প ও জলবাহী সিমেন্টের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, “রাসায়নিক উপাদান দেখে মনে হয় মৃৎপাত্রগুলো জলবাহী পাথরের উপাদানের মতো।[৬] তিনি আরো মন্তব্য করেন, “যে সমস্ত মৃৎপাত্র প্রতিরক্ষার জন্যে প্রাচীর তৈরির যুগের, তাতে পলিমাটি আর বালি মেশানো। এই মিশ্রণের ফলে যে পিণ্ড তৈরি হয় তার গুণ পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের মতোই। এই মিশ্রিত মাটি দিয়ে তৈরি কলসি না পোড়ালেও সিমেন্টের মতো শক্ত হবে। ঝিনুকের খোলের অংশ নুড়ি পাথরের কাজ করে যেমন আজকাল কৃত্রিম পাথর তৈরির কাজে কলিচুন ব্যবহার হয়।” ইণ্ডিয়ান মৃৎশিল্পের সাথে তুলনা করলে এই পদ্ধতি বেশ জটিল মনে হয় এবং এতেই বোঝা যায় এটা অনেক পরের আবিষ্কার। অধ্যাপক কক্সের মতামত অস্বীকার না করেও বলা যায় সম্ভবত কৃত্রিম তাপযোগে মৃৎশিল্পের কাজ সমাধা করা হত। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা স্পষ্ট দেখা গেছে। উপসাগরীয় গোষ্ঠী সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে এ্যাড়ায়ার বলেছেন, তারা নানা আকারের বোল, ডিস, গামলা ইত্যাদি গড়েছে। একেকটা এত বড় যে দশ গ্যালন পানি ধরতে পারে। এই সব পাত্রের পায়ে গ্লেজ দেবার জন্যে পিচ বা পাইন কাঠের ধোয়ার উপর ধরা হত। যার ফলে পাত্রগুলো কালো, মসৃণ আর শক্ত হয়ে উঠত।”[৭]

জাতিতাত্ত্বিক এই যুগবিভাগের আর একটা সুবিধা হল যে সমস্ত গোষ্ঠী এই বিশেষ যুগ পর্যায়ে পড়ে তাদের সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় এবং অনুসন্ধান চালানোও সহজ হয়। কিছু গোষ্ঠী ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে, যাদের অগ্রগতি নির্ভর করছে তাদের নিজস্ব মানসিক প্রচেষ্টার ওপর। এই সমস্ত গোষ্ঠীর শিল্প এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ পূর্বের আদিম ও অকৃত্রিম চরিত্র নিয়েই বিরাজ করছে। আবার বহু গোষ্ঠী বাহ্যিক প্রভাবে সংমিশ্রিত হয়ে গেছে। আফ্রিকায় দেখা যায় আদিম ও বর্বর যুগের একটা মিশ্র অবস্থা, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ও পলিনেশিয়ার গোষ্ঠীরা সহজ সরল শিল্পকলা ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে আদিম যুগেই রয়ে গেছে। আবার আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগের তিনটি পর্যায়ই দেখা যায়, যা অন্য আর কোথাও দেখা যায় না। কোনো রকম বাইরের প্রভাবমুক্ত এই বিরাট মহাদেশের লোকেরা একই পূর্বপুরুষ উদ্ভূত। এরা সম প্রকৃতির প্রতিষ্ঠান নিয়ে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ের বর্বর যুগকে বিশেষভাবে পরিস্ফুট করে তোলে। অন্য কোনো মানবজাতি এমন সুস্পষ্ট উদাহরণ হয়ে দেখা দেয় নি। একেবারে উত্তরের ইণ্ডিয়ান ও উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকার কিছু উপসাগরীয় গোষ্ঠী আদিম যুগের উচ্চ পর্যায়ে ছিল। অংশত মিসিসিপির পূর্বাঞ্চলে কিছু গ্রামীণ ইণ্ডিয়ান ছিল বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানরা ছিল বর্বর যুগের মধ্য পর্যায়ে। ঐতিহাসিক যুগে মানবজাতির শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের এমন নিখুঁত তথ্যের পুনরুদ্ধারের সুযোগ আর তেমন করে মেলে নি।

নিঃসন্দেহে পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধে একই সময়ে সংস্কৃতির পার্থক্য ছিল। তার কারণ মহাদেশসমূহের অসম পরিবেশ। কিন্তু সমাজ স্তরের যে বিভাগ করা হয়েছে তা দু দেশে ছিল একই অবস্থায়।

গ্রিক, রোম ও জার্মান গোষ্ঠীদের পূর্বপুরুষগণও উক্ত সব পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। একেবারে শেষ পর্যায়ে তাদের কেন্দ্রবিন্দুতে ইতিহাসের আলোকপাত ঘটে। সম্ভবত মধ্য বর্বর যুগ আসার আগ থাকতেই তাদের অন্যান্য বর্বর জনদের থেকে আলাদা করা হয় নি। এই গোষ্ঠীগুলো তাদের অতীত অভিজ্ঞতা হারিয়ে ফেলেছে। তবে ইতিহাসের আওতায় আসার পর তাদের যে রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠান আমরা দেখতে পাই সেসব পূর্বের অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য দেয়। হোমারীয় ও রোমুলীয় যুগের গ্রিক ও ল্যাটিন গোষ্ঠীগুলোই উচ্চ পর্যায়ের বর্বর যুগের নিদর্শন। তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পূর্ণভাবে সমশ্রেণীর এবং তাদের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষভাবে সভ্যতার সাথে সম্পর্কযুক্ত

এইভাবে অস্ট্রেলীয় ও পলিনেশীয় গোষ্ঠীদের থেকে শুরু করে আমেরিকান ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীদের মাঝ দিয়ে গ্রিক ও রোমানদের মাঝে এসে, মধ্য আদিম যুগ থেকে শুরু করে প্রাচীন সত্যতা পর্যন্ত মানব সভ্যতার এই ছয়টি ধাপকে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এখন আর্য জাতিরা তাদের পূর্বপুরুষদের অবস্থা দেখে নিতে পারে। তাদের আদিম অবস্থা ছিল অস্ট্রেলীয় ও পলিনেশীয়দের মতো। বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায় দেখতে পাবে অংশত গ্রামীণ আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে। আর মধ্য পর্যায় দেখতে পাবে গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে। এদের রীতি নীতি উচ্চ পর্যায়ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাই দেখা যাচ্ছে একেক পর্যায়ে প্রতিটি মহাদেশের লোকের জীবনধারা, রীতিনীতি, শিক্ষাসমূহ প্রায় এক। গ্রিক ও রোমানদের আদিম অবস্থা জানতে চাইলে আমেরিকান আদিবাসীদের মাঝে খোঁজ করতে হবে। যে সমস্ত তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে এ কথাই প্রমাণ হয় মানুষের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো চিন্তাধারার প্রাথমিক উৎস থেকে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে। মানুষের উন্নতির ধারা পূর্বনির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ীই ঘটেছে। আর সে পূর্বনির্ধারিত নিয়ম হল মানুষের যুক্তি ও চিন্তার জগৎ প্রায় একই ধারায় চলে। পার্থক্যটা ঘটে খুব সীমিত ক্ষেত্রে। তাই মহাদেশগুলোর মধ্যে অনেক জায়গাতেই যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও একইরকম প্রগতি সংঘটিত হয়েছে। এই যুক্তি বা অনুমানকে আমরা যদি আরো প্রসারিত করি তা মানবজাতির উৎসের ঐক্যই প্রমাণ করে।

বিভিন্ন জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগের আওতার মাঝে যেসব গোষ্ঠী ও জাতি আছে তাদের সম্বন্ধে জেনেই আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পারছি।

—-

১। স্যার ই. বি. টাইলর লক্ষ করেছেন যে গোকেট “প্রথম গত শতাব্দীতে ব্যাখ্যা দেন কীভাবে মৃৎশিল্প তৈরি হয়, প্রথমে মানুষ ঝুড়ির গায়ে মাটি লেপে রাখত যাতে কোনোরকমে আগুন না লাগে। পরে মাটিই যে সেই ঝুড়ির কাজ দিতে পারে এই জ্ঞান লাভ করে মৃৎশিল্প তৈরি করতে শিখে এবং বিশ্ব এইভাবে মৃৎশিল্প লাভ করে”–আর্লি হিস্ট্রি অব ম্যানকাইণ্ড, পৃঃ ২৭৩। গোকেট ও ক্যাপটেন গনেভিলের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, যিনি ১৫০৩ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে গিয়েছিলেন। তিনি দেখেন, “তাদের কাঠের পাত্রের গায়ে প্রায় এক আঙুল পুরু এক-রকম কাদা লেপা থাকত, যাতে ঐসব পাত্র আগুনে না পুড়ে যায়।” ঐ পৃঃ ২৭৩।

২। ফষ্টারের প্রিহিস্ট্রিক রেসেস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস” প্রথম খণ্ড ১৫২ পৃষ্ঠায় আছে তিনি দেখিয়েছেন কিছু বছর আগেও অরেগন- এ আদিবাসীদের মধ্যে মৃৎপাত্র ছিল। মার্কিন আদিবাসীরা সম্ভবত উইলো ডাল দিয়ে ঝুড়ি করে উঁচ হিসেবে ব্যবহার করত, তার গায়ে কাদা লাগাত, তারপর আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করে নিত। কাদা শক্ত হয়ে যেত আর ঝুড়িটা যেত পুড়ে। এই তথ্য দিয়েছেন জেনস্ তার এ্যানটিকুইটিস অব দ্য সাউদার্ন ইন্ডিয়ান” পুস্তকে–পৃঃ ৪৬১। এই ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায় অধ্যাপক রাউ-এর মৃৎশিল্প” প্রবন্ধে। এ ছাড়া আছে “স্মিথসোনিয়ান রিপোর্ট” ১৮৬, পৃঃ ৩৫২।

৩। “আর্লি হিস্ট্রি অব মানকাইণ্ড” পৃঃ ১৮১। “প্রি-হিস্টোরিক টাইমস্” পৃঃ ৪৩৭, ৪৪১, ৪৬২, ৫৩৩, ৫৪২।

৪। লুই এবং ক্লার্ক ১৮০৫) কলম্বিয়া নদী গোষ্ঠীদের মধ্যে বাড়ি তৈরিতে তক্তার ব্যবহার লক্ষ করেছেন—”ট্রাভেলস” ১৮১৪, পৃঃ ৫০৩। জন কিষ্ট লর্ড “ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপের ইণ্ডিয়ানদের বাড়িতে সিডার গাছের তার বাবহার দেখেছেন। এই ত পাথরের অস্ত্র দিয়ে তৈরি করা হয়েছে”–”ন্যাচারালিস্ট ইন ব্রিটিশ কলম্বিয়া” প্রথম খণ্ড পৃঃ ১৬৯।

৫। টাইলর-এর “আর্লি হিষ্ট্রি অব ম্যানকাইও” পৃঃ ২৬৫।

৬। “জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ানা” ১৮৭৩, পৃঃ ১১৯। তিনি “প্রাচীন মৃৎশিল্প” এর রাসায়নিক বিশ্লেষণ দেন :

আর্দ্রতা ২১২° ফারেনহাইট – ১.০০

সিলিকা – ৩৬.০০

চুনা কার্বোনেট – ২৫.৫০

ম্যাঙ্গানিজ কার্বোনেট – ৩.০০

এ্যালুমিনা – ৫.০০

লৌহ পেরক্সাইড – ৫.৫০

সালফিউরিক এ্যাসিড – .৪০

অর্গানিক মাটার – ২৩.৬০

মোট : ১০০.০০

৭। “হিস্ট্রি অব দ্য এ্যামেরিকা ইণ্ডিয়ান”, ১৭৭৫, পৃঃ ৪ ২৪। ইরাকোয়ারা জানায় যে তাদের পূর্বপুরুষরা প্রাচীন কালে আগুনের ওপর ধরে মৃৎপাত্র পুড়িয়ে নিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *