১১৪. ভীমার্জ্জুনের অশ্বত্থামাদি অতিক্রমণ-ঘোর যুদ্ধ

১১৪তম অধ্যায়

ভীমার্জ্জুনের অশ্বত্থামাদি অতিক্রমণ-ঘোর যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “মহাত্মা দ্রোণের বাক্য শ্রবণ করিয়া ভগদত্ত, কৃপ, শল্য, কৃতবর্ম্মা, অবস্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ, সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ, চিত্ৰসেন, বিকর্ণ ও দুর্ম্মাির্ষণ, এই দশ মহারথ ভীষ্মের সমরে যশোলাভের বাসনায় নানাদেশীয় সেনাগণসমভিব্যাহারে ভীমসেনের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। শল্য ও কৃপ নয়-নয় বাণে, কৃতবর্ম্মা ও জয়দ্ৰথ তিন-তিন বাণে, চিত্ৰসেন, বিকর্ণ ও ভগদত্ত দশ-দশ বাণে, বিন্দ ও অনুবিন্দ পাঁচ-পাঁচ বাণে এবং দুর্ম্মাির্ষণ বিংশতিবাণে ভীমসেনকে আহত করিলেন। ভীমসেন শল্যাকে সাতবাণে, কৃতবর্ম্মকে আটবাণে, কৃপাচাৰ্য্যের সশর শরাসন ছেদন করিয়া তাহাকে সাতবাণে, বিন্দ ও অনুবিন্দকে পাঁচ-পাঁচ বাণে, দুর্ম্মাির্ষণকে বিংশতিবাণে, চিত্ৰসেনকে পাঁচবাণে, বিকৰ্ণকে দশবাণে এবং জয়দ্রথকে প্রথমে পাঁচবাণে, পরিশেষে তিনবাণে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। ছিন্নধনু কৃপাচাৰ্য্য ক্রুদ্ধ হইয়া অন্য ধনু গ্রহণপূর্ব্বক নিশিত দশবাণে ভীমসেনকে বিদ্ধ করিলেন। ভীমসেন তোদানদণ্ডবেধিত মহাগজের ন্যায় বাণবিদ্ধ হইয়া সরোষচিত্তে কৃপাচাৰ্য্যকে আহত করিয়া তিনশরে জয়দ্রথের সারথি ও অশ্বগণের প্রাণসংহার করিলেন। মহারথ জয়দ্ৰথ অশ্বহীন রথ হইতে শীঘ্র অবতীর্ণ হইয়া ভীমসেনের প্রতি অতি তীক্ষ্ন শরজাল নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন দুই ভল্লে মহাত্মা জয়দ্রথের শরাসনের মধ্যভাগ দুই খণ্ড করিয়া ফেলিলেন; জয়দ্ৰথ এইরূপে বিরথ হইলেন, তাঁহার শরাসন ছেদিত এবং অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট হইল; সুতরাং তিনি সত্বর হইয়া চিত্ৰসেনের রথে আরোহণ করিলেন। হে মহারাজ! ভীমসেন একাকী এইরূপে শরজালে মহারথীগণকে নিবারিত করিয়া সকল লোকের সমক্ষে সিন্ধুরাজকে বিরথ করিলেন; ইহা অল্প আশ্চর্য্যের বিষয় নহে।

“শল্য ভীমসেনের পরাক্রম সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া কর্ম্মকার-পরিমার্জ্জিত তীক্ষ্ন শর সন্ধানপূর্ব্বক ‘থাক থাক’ বলিয়া ভীমসেনকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। কৃপ, কৃতবর্ম্মা, ভগদত্ত, বিন্দ, অনুবিন্দ, চিত্ৰসেন, দুর্ম্মর্ষণ, বিকর্ণ ও জয়দ্ৰথ শল্যের নিমিত্ত ভীমসেনকে অতি শীর্ঘ আহত করিতে লাগিলেন। ভীমসেন সেই মহারথদিগকে পাঁচ-পাঁচ বাণে ও শল্যকে প্রথমে সপ্ততিবাণে, পরে দশবাণে বিদ্ধ করিলেন। শল্যও ভীমসেনকে অগ্রে নয়-বাণে আহত করিয়া ভল্লদ্বারা তাঁহার সারথির মর্ম্মদেশে দৃঢ়তর আঘাত করিলেন। প্রতাপবান ভীমসেন নিজ সারথি বিশোককে বাণবিদ্ধ দেখিয়া শল্যের বাহুযুগলে ও বক্ষে তিন বাণ নিক্ষেপ করিলেন এবং তিন-তিন বাণে অন্যান্য যোদ্ধাদিগকে আহত করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। সেইসকল মহাধনুৰ্দ্ধর ভীমসেনের মর্ম্মস্থলে অকুন্ঠিতাগ্র তিন-তিন বাণ আঘাত করিলেন। ভীমসেন অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া শোণিতলিপ্তকলেবরে বারিধারাভিষিক্ত পর্ব্বতের ন্যায় অব্যথিতচিত্তে অবস্থান করিতে লাগিলেন এবং রোষাবিষ্ট হইয়া শল্যকে তিনবাণে, ভগদত্তকে শত ও কৃপকে বহুসংখ্যক বাণে বিদ্ধ করিয়া লঘুহস্ততা প্রদর্শনপূর্ব্বক সুতীব্র ক্ষুরপ্র-অস্ত্ৰে মহাত্মা কৃতবর্ম্মার সশর শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। কৃতবর্ম্মা অন্য ধনুগ্রহণ করিয়া নারাচদ্বারা ভীমসেনের ভ্রূযুগলের মধ্যে আঘাত করিলেন। ভীমসেন শল্যকে লৌহময় নয়শরে, ভগদত্তকে তিনশরে, কৃতবর্ম্মাকে আটশরে ও কৃপাচাৰ্য্যপ্রভৃতি রথিগণকে দুই-দুই শরে বিদ্ধ করিলেন। তাঁহারাও নিশিতশরজালে তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন সেইসকল সর্ব্বাস্ত্রসম্পন্ন মহারথের বাণে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াও তাঁহাদিগকে তৃণ,তুল্য বিবেচনা করিয়া অব্যথিত-চিত্তে বিচরণ করিতে লাগিলেন; তাঁহারাও ভীমের প্রতি সহস্ৰ সহস্র শর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবল ভগদত্ত মহাবেগসম্পন্ন স্বর্ণদণ্ড শক্তি, মহাভুজ জয়দ্ৰথ তোমর ও পট্টিশ, কৃপাচাৰ্য্য শতঘ্নী, শল্য এক শর ও অন্য মহাধনুৰ্দ্ধরগণ পাঁচ-পাঁচ বাণ ভীমসেনকে লক্ষ্য করিয়া বলপূর্ব্বক নিক্ষেপ করিলেন। ভীমসেন ক্ষুরপ্র-অস্ত্রে তোমর, তিন-তিন বাণে পট্টিশ ও কঙ্কপত্ৰবিশিষ্ট নয়বাণে শতঘ্নী তিলবৎ ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং সেই সমস্ত মহাধনুৰ্দ্ধারকে তিন-তিন বাণে বিদ্ধ করিলেন।

“মহারথ ভীমসেন সমরে সায়কসমূহে শত্ৰুগণকে নিহত করিতেছেন দেখিয়া ধনঞ্জয় রথারোহণপূর্ব্বক তথায় সমাগত হইলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরপুরুষেরা সেই দুই মহাত্মাকে সমবেত নিরীক্ষণ করিয়া জয়লাভের আশা পরিত্যাগ করিলেন। ভীমসেন যে দশ মহারথের সহিত যুদ্ধ করিতেছিলেন, ধনঞ্জয় ভীষ্মের নিধন ও ভীমের হিতসাধনকামনায় শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া ভীমের ন্যায় তাঁহাদিগকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন সুশর্ম্মাকে ভীম ও অর্জ্জুনবধে নিয়োগ করিয়া কহিলেন, “হে সুশর্ম্মন! শীঘ্র বলসমূহে পরিবৃত হইয়া গমনপূর্ব্বক ভীম ও অর্জ্জুনকে বধ কর।” প্রস্থলাধিপতি সুশর্ম্মা দুৰ্য্যোধনের বাক্যে সত্বর অনেক সহস্ররথে পরিবৃত হইয়া ভীম ও অর্জ্জুনকে বেষ্টন করিলেন। অনন্তর অর্জ্জুনের সহিত কৌরবগণের যুদ্ধারম্ভ হইল।”