১১৩. উৎপাতদর্শনে দ্রোণাচাৰ্য্যের পরাজয়শঙ্কা

১১৩তম অধ্যায়

উৎপাতদর্শনে দ্রোণাচাৰ্য্যের পরাজয়শঙ্কা

সঞ্জয় কহিলেন, “মহাধনুৰ্দ্ধার, মত্তবারণবিক্রম, মহাবল, নিমিত্তজ্ [কার্যকারণজাত ভাবী ফলে অভিজ্ঞ] দ্রোণাচাৰ্য্য মত্তমাতঙ্গবারণ মহাশরাসন গ্রহণপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সেনাসাগরে অবগাহন করিয়া শত্ৰুগণকে নির্ভরনিপীড়িত করিতে লাগিলেন। অনন্তর চতুর্দ্দিকে দুর্নিমিত্ত সকল দর্শন করিয়া অশ্বত্থামাকে কহিলেন, “বৎস! মহাবল ধনঞ্জয় ভীষ্মকে বধ করিবার নিমিত্ত যে দিনে যত্নের পরাকাষ্ঠা অবলম্বন করিবেন, আজি সেই দিন উপস্থিত হইয়াছে। আমার বাণীসকল উৎপতিত হইতেছে; শরাসন স্পন্দিত হইতেছে; অস্ত্ৰসকল বিশ্লিষ্ট [স্খলিত] হইতেছে; অন্তঃকরণ ক্রুরকর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতেছে; মৃগ ও পক্ষিগণ চতুর্দ্দিকে অশান্ত ও ঘোরতর চীৎকার করিতেছে; গৃধ্রগণ কৌরবসৈন্যের উপর নিপতিত হইতেছে; আদিত্য প্রভাশূন্য হইয়াছে; দিকসকল লোহিতবর্ণ হইয়াছে; পৃথিবী যেন শব্দিত, ব্যথিত ও সাতিশয় কম্পিত হইতেছে; কঙ্ক, গৃধ্র, বলাকা ও শিবাগণ মুহুর্ম্মুহুঃ মহৎ ভয়সূচক অশিব চীৎকার করিতেছে; আদিত্যমণ্ডলের মধ্য হইতে উল্কাপাত হইতেছে; দিবাকর কবন্ধ [কিবাট] ও অর্গলে আবৃত হইয়াছে, রাজগণের বিনাশসূচক চন্দ্ৰসূৰ্য্যের ভয়ানয় পরিবেশ [মণ্ডলাকারে চতুর্দ্দিকের পরিবেষ্টন] হইয়াছে; কৌরবরাজের দেবমন্দিরস্থ দেবতাগণ কখন কম্পিত হইতেছেন, কখন হাস্য করিতেছেন, কখনও নৃত্য করিতেছেন ও কখন রোদন করিতেছেন; গ্রহগণ দিবাকরকে প্রতিকূল করিয়া অলক্ষণ্য [অলক্ষণযুক্ত] করিয়াছে; ভগবান চন্দ্ৰমা অবাকশিরাঃ [অধঃশিরা-কাটদ্বয়কে অধোদিক্‌ করিয়া উল্টা রকমে] হইয়া উদিত হইতেছেন; নরেন্দ্রগণের কলেবর প্রভাশূন্য দৃষ্ট হইতেছে। তাঁহারা সৈন্যে পরিবৃত হইয়াও সমুচিত শোভা প্রাপ্ত হইতেছেন না এবং উভয় সৈন্যের চতুর্দ্দিক হইতেই পাঞ্চজন্য শঙ্খ ও গাণ্ডীবের নিনাদ শ্রবণগোচর হইতেছে। অতএব ধনঞ্জয় নিঃসংশয় উত্তমাস্ত্রসমূহে যোদ্ধৃগণকে পরাস্ত করিয়া ভীষ্মকে আক্রমণ করিবেন।”

অর্জ্জুনাদির গতিরোধাৰ্থ অশ্বথামাদির নিয়োগ

“দ্রোণাচাৰ্য্য কহিলেন, “ভীমার্জ্জুন-সমাগত চিন্তা করিয়া আমার লোমসকল পুলকিত ও অন্তঃকরণ অবসন্ন হইতেছে। ধনঞ্জয় সেই নিকৃতিজ্ঞ [ধূর্ত্ত] পাপচেতাঃ শিখণ্ডীকে অগ্ৰে করিয়া ভীষ্মের সহিত যুদ্ধে গমন করিয়াছেন। ভীষ্ম পূর্ব্বে কহিয়াছিলেন যে, আমি অমঙ্গল্যধ্বজ [অশুভচিহ্নযুক্ত] শিখণ্ডীকে বধ করিব না; বিধাতা উহাকে স্ত্রীরূপ করিয়াছিলেন, দৈববশতঃ পুরুষরূপ প্রাপ্ত হইয়াছে; অতএব তিনি তাহাকে কদাচ প্রহার করিবেন না; কিন্তু শিখণ্ডী ক্রুদ্ধ হইয়া ভীষ্মকে আক্রমণ করিয়াছে; এই চিন্তায় আমার অন্তঃকরণ অবসন্ন হইতেছে। বিশেষতঃ যুধিষ্ঠিরের ক্ৰোধ, ভীমার্জ্জুন সমাগম ও আমার সমরোদ্যোগ প্ৰজাগণের অমঙ্গলের হেতু, তাহাতে সন্দেহ নাই এবং মহানুভব ধনঞ্জয় বলবান, শৌৰ্য্যশালী, কৃতাস্ত্ৰ, লঘুবিক্রম, দূরঘাতী [দূরে স্থির লক্ষ্য], নিমিত্তজ্ঞ, ইন্দ্ৰাদি দেবগণেরও অজেয়, বুদ্ধিমান, ক্লেশসহিষ্ণু ও নিত্যবিজয়ী; তুমি তাঁহার পথরোধের নিমিত্ত শীঘ্ৰ গমন কর। দেখ, আজি এই ঘোর যুদ্ধে মহামারী উপস্থিত হইবে। কিরীটী ক্রুদ্ধ হইয়া সন্নতপর্ব্ব শরসমূহে শূরগণের হেমচিত্রিত কবচ, ধ্বজাগ্র, তোমর, শরাসন, প্রাস, কনকোজ্জ্বল শক্তি ও হস্তিগণের পতাকাসকল ছেদন করিবেন। হে পুত্ৰ! ইহা উপজীবিগণের [আশ্রিতসমূহের] প্রাণরক্ষার কাল নয়; স্বর্গের প্রতি লক্ষ্য করিয়া যশ ও বিজয়ের নিমিত্ত অগ্রসর হও। ধনঞ্জয় রথদ্বারা রথ, হস্তী ও অশ্বরূপ আবর্ত্তশালী মহাঘোর সাতিশয় দুৰ্গম সংগ্রামনদী উত্তীর্ণ হইতেছেন; ধনঞ্জয়, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব যাঁহার ভ্রাতা এবং কৃষ্ণ যাঁহার রক্ষাকর্ত্তা, তাঁহার ব্রহ্মনিষ্ঠ, দম, দান ও তপ ইহলোকেই প্রত্যক্ষ হইতেছে। সেই তপোদগ্ধকলেবর [বনবাসাদি ক্লেশদ্বারা উত্তাপিত দেহ] যুধিষ্ঠিরের শোকপ্রভাব কোপোনল দুর্ম্মতি দুৰ্য্যোধনের সেনাগণকে দগ্ধ করিতেছে। ঐ দেখ, বাসুদেবসহায় ধনঞ্জয় দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণকে প্রতিহত করিতেছেন; সৈন্যগণ তিমিকুম্ভীরভীষণ মহোর্ম্মিসঙ্কুল সাগরের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া হাহাকার ও কিলকিলা শব্দ করিতেছে। তুমি পাঞ্চালতনয়ের সম্মুখীন হও, আমি যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করি। রাজা যুধিষ্ঠিরের ব্যূহের অভ্যন্তরভাগ চতুর্দ্দিকস্থ অতিরথগণে সাগরকুক্ষির [সমুদ্রগর্ভের] ন্যায় নিতান্ত দুৰ্গম হইয়াছে। সাত্যকি, অভিমন্যু, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বৃকোদর, নকুল ও সহদেব রাজা যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করিতেছেন। কৃষ্ণসদৃশ, সমুন্নত মহাশালসম, শ্যাম কলেবর ঐ মহাবীর অভিমন্যু দ্বিতীয় অর্জ্জুনের ন্যায় সেনাগণের অগ্রভাগে আগমন করিতেছেন। তুমি সত্বর উত্তম অস্ত্র ও শরাসন গ্ৰহণ করিয়া তাঁহার নিকট গমন কর ও ভীমসেনের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও। প্রিয়পুত্র চিরকাল জীবিত থাকে, ইহা কাহার অভিলষণীয় নয়? কিন্তু আমি কেবল ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম আলোচনা করিয়াই তোমাকে যুদ্ধে নিয়োগ করিতেছি। দেখ, এই ভীষ্ম যম ও বিরুণের ন্যায় মহাসৈন্য দগ্ধ করিতেছেন।’ ”