১১২. ভীষ্মৈর অঙ্গরক্ষক অলম্বুষসহ সাত্যকির সমর

১১২তম অধ্যায়

ভীষ্মৈর অঙ্গরক্ষক অলম্বুষসহ সাত্যকির সমর

সঞ্জয় কহিলেন, “মহাধনুৰ্দ্ধার ঋষ্যশৃঙ্গনন্দন রাক্ষস অলম্বুষ ক্রুদ্ধ হইয়া, ভীষ্মের সহিত সমরোদ্যত সাত্যকির পথ রোধ করিল। সাত্যকি ক্রুদ্ধ হইয়া সহাস্যবদনে নয়বাণে অলম্বুষকে আহত করিলেন, অলম্বুষও নয়বাণে সাত্যকিকে নিপীড়িত করিল; সাত্যকিও অলম্বুষের প্রতি শরজাল বর্ষণ করিলেন। অলম্বুষ তীক্ষ্ন শরসমূহে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করিল। তেজস্বী সাত্যকি বিদ্ধ হইয়াও বীৰ্য্যসহকারে হাস্য ও সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর যেমন তোদানদণ্ডদ্বারা মহাগজকে তাড়না করে, প্ৰাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত সেইরূপ নিশিত শরসমূহে সাত্যকিকে তাড়না করিতে লাগিলেন। তখন রথিশ্রেষ্ঠ সাত্যকি রাক্ষসকে পরিত্যাগ করিয়া ভগদত্তের প্রতি সন্নতপর্ব্ব শরসমূহ নিক্ষেপ করিলেন। লঘুহস্ত ভগদত্ত শিতধারা ভল্লদ্বারা সাত্যকির বৃহৎ ধনু ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সাত্যকি অন্য দৃঢ়তর ধনু ধারণ করিয়া তীক্ষ্ণ শরসমূহে ভগদত্তকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভগদত্ত অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া সৃক্কণীদ্বয় পরিলেহনপূর্ব্বক কনক ও বৈদূর্য্যশোভিত, অলঙ্কৃত, লৌহনির্ম্মিত যমদণ্ডসদৃশ ভয়ঙ্কর শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। সাত্যকি অমনি সায়কসমূহে তাহা দুই খণ্ড করিয়া ফেলিলেন; সেই দ্বিধাচ্ছিন্ন শক্তি প্রভাশূন্য মহোল্কার ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইল।

“শক্তি বিফল হইল দেখিয়া রাজা দুৰ্য্যোধন। রথপরম্পরায় সাত্যকিকে বেষ্টিত করিয়া ভ্রাতৃগণকে কহিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ! সাত্যকি যেন এই রথবেষ্টন হইতে প্ৰাণ লইয়া বহির্গত হইতে না পারে; সাত্যকি বিনষ্ট হইলে বোধ হয়, পাণ্ডবগণের মহৎ বল বিনষ্ট হইবে।” মহারথ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ দুৰ্য্যোধনের বাক্য গ্ৰহণ করিয়া ভীষ্মের সম্মুখে সাত্যকির সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

ভীষ্মবধার্থী অভিমন্যুপ্রভৃতির অগ্রগতিরোধ

“কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ ভীষ্মের অভিমুখে গমনে সমুদ্যত অভিমন্যুকে নিবারিত করিতে লাগিলেন, অভিমন্যু প্রথমে সন্নতপর্ব্বশরসমূহে, পরে চতুঃষষ্টিবাণে সুদক্ষিণকে বিদ্ধ করিলেন; সুদক্ষিণও ভীষ্মের জীবনরক্ষার্থ অভিমন্যুকে পাঁচবাণ ও তাঁহার সারথিকে নয়বাণে আঘাত করিলেন। তাঁহাদিগের এইরূপ ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল।

“মহারথ বিরাট ও দ্রুপদ রোষাবেশে কৌরবগণের মহাসৈন্য প্রতিহত করিতে করিতে ভষ্মের প্রতি ধাবমান হইতেছিলেন, এমন সময় অশ্বত্থামা ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাদিগের অভিমুখীন হইলেন। অনন্তর তাঁহাদের উভয়ের সহিত অশ্বত্থামার যুদ্ধ আরম্ভ হইল। অশ্বত্থামার প্রতি বিরাট দশ ভল্ল ও দ্রুপদ তিন শর নিক্ষেপ করিলেন। অশ্বত্থামা ভুরি ভুরি শরে বিরাট ও দ্রুপদকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু সেই দুই বৃদ্ধ যে অশ্বত্থামার দারুণ শরজাল প্রতিহত করিতে সমর্থ হইলেন, তাহাই আশ্চৰ্য্য বোধ হইল।

“যেমন প্ৰমত্ত আরণ্য গজ অন্য আরণ্য মত্ত গজকে আক্রমণ করে, সেইরূপ শৌৰ্য্যশালী কৃপাচাৰ্য্য মহারথ সহদেবের সম্মুখীন হইয়া সুবৰ্ণভূষণ সপ্ততি শর নিক্ষেপ করিলেন। সহদেব শরসমূহে কৃপাচাৰ্য্যের ধনু দ্বিধাছিন্ন করিয়া নয়বাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। ভীষ্মের জীবিতাকাঙ্ক্ষী কৃপাচাৰ্য্য ভারসহ শরাসনাস্তুর গ্রহণ করিয়া দশবাণে সহদেবের এবং ভীষ্মবধার্থী সহদেবও শরজালে কৃপাচাৰ্য্যের বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলেন। এইরূপে তাঁহারা ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

“শক্রিতাপন বিকৰ্ণ ষষ্টিসায়কে নকুলকে বিদ্ধ করিলেন; নকুল অতিমাত্ৰ বিদ্ধ হইয়া সপ্তসপ্ততিবাণে বিকর্ণকে আহত করিলেন। এইরূপে দুই নরসিংহ ভীষ্মের নিমিত্ত গোষ্ঠস্থিত বৃষভদ্বয়ের ন্যায় পরস্পর আঘাত করিতে লাগিলেন।

“ঘটোৎকচ। কুরুসৈন্যগণকে আঘাত করিতে করিতে গমন করিতেছিলেন; পরাক্রমী দুর্ম্মুখ তাঁহার সম্মুখীন হইলেন। ঘটোৎকচ ক্রুদ্ধ হইয়া আনতপর্ব্বশরে দুর্ম্মুখের বক্ষঃস্থল ও দুর্ম্মুখ শাণিত ষষ্টিশরে ঘটোৎকচকে বিদ্ধ করিলেন।

“রথিশ্রেষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুন্ন ভীষ্মবধার্থ গমন করিতেছিলেন; মহারথ হার্দ্দিক্য তাঁহার গতিরোধ করিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন লৌহময় পঞ্চবাণে হার্দ্দিক্যকে বিদ্ধ করিয়া অনতিবিলম্বে পুনরায় তাঁহার বক্ষঃস্থলে পঞ্চাশৎ বাণ নিক্ষেপ করিলেন; হার্দ্দিক্যও ধৃষ্টদ্যুম্নকে কঙ্কপত্রভূষিত নয়বাণে আহত করিলেন। তাঁহারা উভয়ে স্ব স্ব উৎকর্ষ অনুসারে ইন্দ্র ও বৃত্ৰাসুরের ন্যায় ভীষ্মের নিমিত্ত মহাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন।

“মহাবল ভীমসেন ভীষ্মের অভিমুখে গমন করিতেছিলেন; সোমদত্তনন্দন ভূরিশ্রবা ‘থাক থাক’ বলিয়া শীঘ্র তাঁহার সম্মুখীন হইয়া অতি তীক্ষ্ন স্বর্ণপুঙ্খ নারাচে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। প্রতাপবান ভীমসেন সেই নারাচে বিদ্ধ হইয়া শক্তিবিদ্ধ ক্ৰৌঞ্চ-অসুরের ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিলেন। অনন্তর রোষাবেগ সহকারে কর্ম্মকারপরিমার্জ্জিত [বাণিনির্ম্মাতাকর্ত্তৃক শাণিত] সূর্য্যসদৃশ শরজালে ভীষ্মের বধ্যপ্রার্থী ভীমসেন ভূরিশ্রবাকে এবং ভীষ্মের জয়ার্থী ভূরিশ্রবা ভীমসেনকে আহত করিলেন। যুদ্ধে ও প্রতিযুদ্ধে যত্নবান বীরদ্বয় এইরূপে পরস্পর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

“রাজা যুধিষ্ঠীর মহতী সেনাপরিবৃত হইয়া ভীষ্মের অভিমুখে গমন করিতেছিলেন; দ্রোণাচাৰ্য্য তাঁহার গতি রোধ করিলেন। প্রভদ্রগণ দ্রোণাচাৰ্য্যের ঘনগর্জ্জনাসদৃশ রথনির্ঘোষ শ্রবণ করিয়া কম্পিত হইতে লাগিল এবং সেই মহতী সেনা দ্রোণকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইয়া একপদও গমন করিতে সমর্থ হইল না।

“মহারাজ! আপনার পুত্র মহারথ পরাক্রান্ত চিত্ৰসেন চেকিতানের পথ রোধ করিলেন। অনন্তর উভয়েই স্ব স্ব শক্তির পরাকাষ্ঠা অবলম্বন করিয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! এ দিকে দুঃশাসন কি প্রকারে ভীষ্মের জীবনরক্ষা হইবে, এই চিন্তায় সাধ্যানুসারে অর্জ্জুনের পথ রোধ করিয়াছিলেন; কিন্তু অর্জ্জুন বারংবার নিবারিত হইয়াও পরিশেষে দুঃশাসনকে নিরস্ত করিয়া কুরুসৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত করিতে লাগিলেন। দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণ পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণকর্ত্তৃক এইরূপে নিপীড়িত হইতে লাগিল।”