১১০. ভীষ্ম-অৰ্জনযুদ্ধ—কৌরবীপরাজয়

১১০তম অধ্যায়

ভীষ্ম-অৰ্জনযুদ্ধ—কৌরবীপরাজয়

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পাঞ্চালনন্দন শিখণ্ডী কি প্রকারে মহাত্মা ভীষ্মকে আক্রমণ করিয়াছিল, কোন সকল মহারথ জয়াভিলাষে আয়ুধ গ্রহণপূর্ব্বক সেই সময়ে ত্বরান্বিত হইয়া শিখণ্ডীকে রক্ষা করিয়াছিল এবং মহাবীর ভীষ্ম সেই দশম দিবসে পাণ্ডব ও সোমকগণের সহিত কি প্রকারে যুদ্ধ করিয়াছিলেন? শিখণ্ডী যে ভীষ্মকে আক্রমণ করিয়াছিল, ইহা আমি সহ্য করিতে পারি না। ভীষ্মের কি রথ ভগ্ন হইয়াছিল অথবা শরক্ষেপসময়ে তাঁহার শরাসন বিশীর্ণ হইয়াছিল?”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! ভীষ্ম যখন সন্নতপর্ব্ব শরনিকরে অরাতিগণকে সংহার করেন, তখন তাহার ধনুও বিশীর্ণ হয় নাই, রথও ভগ্ন হয় নাই। অনেক সহস্ৰ মহারথ, গজারোহী ও অশ্বরোহী যুদ্ধার্থ সুসজ্জিত হইয়া ভীষ্মকে অগ্রসর করিয়া রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন; ভীষ্মও স্বকৃত প্ৰতিজ্ঞাক্ৰমে প্রতিনিয়ত পাণ্ডবগণের সৈন্য ক্ষয় করিতে লাগিলেন। তিনি শরজালে শত্রুদলকে দলন করিতে আরম্ভ করিলে পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ তাঁহাকে নিবারণ করিতে অবতীর্ণ হইলেন। দশম দিবসের যুদ্ধে ভীষ্ম বাণসমূহে শত-শত ও সহস্ৰ-সহস্র রিপুসেনা ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিলেন; কিন্তু পাণ্ডবগণ পাশহস্ত কৃতান্তসদৃশ ভীষ্মকে পরাজয় করিতে পারিলেন না।

“অনন্তর অপরাজিত অর্জ্জুন সিংহের ন্যায় উচ্চস্বরে গর্জ্জন, মুহুর্ম্মুহুঃ জ্যাবিক্ষেপ ও শরপরম্পরা বর্ষণ করিতে করিতে সমুদয় রথিগণকে ত্ৰাসিত করিয়া কৃতান্তের ন্যায় আগমন করিলেন; যেমন মৃগগণ সিংহনাদ শ্রবণে ভয়বিহ্বল হইয়া পলায়ন করে, সেইরূপ কৌরবসৈন্যগণ অর্জ্জুনের শব্দে ভীত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। দুৰ্য্যোধন ধনঞ্জয়কে জয়শীল ও আপন সৈন্যগণকে নিপীড়িত দেখিয়া ভীত হইয়া ভীষ্মকে কহিলেন, “হে পিতামহ! যেমন হুতাশন অরণ্যকে দগ্ধ করে, সেইরূপ এই শ্বেতাশ্ব [শ্বেতবর্ণ-অশ্বযুক্ত রথে আরূঢ়] কৃষ্ণসারথি পাণ্ডব আমার সমুদয় সৈন্যগণকে দগ্ধ করিতেছে। দেখুন, আমার সৈন্যগণ অর্জ্জুনের হস্তে নিপীড়িত হইয়া পলায়ন করিতেছে। যেমন পশুপাল অরণ্যে পশুগণকে তাড়না করে, সেইরূপ ধনঞ্জয় ইহাদিগকে তাড়িত করিতেছে। একে উহারা ধনঞ্জয়ের শরে ছিন্নভিন্ন ও পলায়মান হইতেছে, তাহাতে আবার দুৰ্দ্ধৰ্ষ ভীমসেন, সাত্যকি, চেকিতান, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ঘটোৎকচ উৎপীড়ন করিতেছে; অতএব আপনি ভিন্ন অন্য কেহ এইসকল বীরের সহিত যুদ্ধে অবস্থান করিতে সমর্থ নহে। আপনি দেবতুল্য পরাক্রমশালী; এক্ষণে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইয়া পীড়িত সৈন্যগণের আশ্রয় হউন।”

ভীষ্মের পূর্ব্বপ্রতিজ্ঞা—বহু পাণ্ডবসৈন্যবধ

“দেবব্রত ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণ করিয়া মুহূর্ত্তকাল চিন্তা ও কর্ত্তব্য অবধারণ করিয়া কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! স্থির হইয়া শ্রবণ কর। আমি পূর্ব্বে তোমার নিকটে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যে, প্রতিদিন পূর্ব্বাহ্ণে মহাত্মা ক্ষত্রিয়গণের দশসহস্ৰ ব্যক্তিকে নিহত করিয়া সমর হইতে নিবৃত্ত হইব। আমি সেই প্রতিজ্ঞানুযায়ী কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতেছি, অদ্য আরও এক মহৎ কর্ম্ম করিব; হয় আপনি নিহত হইয়া শয়ন করিব, না হয় পাণ্ডবগণকে নিহত করিব। আজি সেনামুখে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়া স্বামিপ্রদত্ত অন্নের ঋণ হইতে বিমুক্ত হইব।”

“মহাবীর ভীষ্ম এই কথা কহিয়া শরবর্ষণ করিতে করিতে পাণ্ডবসৈন্যের সমীপবর্ত্তী হইলেন। পাণ্ডবগণ সেনামধ্যে অবস্থিত ক্ৰোধপর বিষধরসদৃশ ভীষ্মকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু দশম দিবসের যুদ্ধে ভষ্মি আত্মশক্তি প্রদর্শনপূর্ব্বক শতসহস্র বীরকে ধরাশায়ী করিলেন। সূৰ্য্য যেমন করজাল[কিরণসমূহ]দ্বারা জল গ্রহণ করেন, তিনি সেইরূপ পাঞ্চালদিগের প্রধান প্রধান মহারথগণের তেজগ্রহণ করিতে লাগিলেন। পরে তিনি দশসহস্ৰ বেগগামী কুঞ্জর, আরোহিসমেত দশসহস্ৰ অশ্ব ও একলক্ষ পদাতি সংহার করিয়া ধূমশূন্য হুতাশনের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। পাণ্ডবগণের কেহই উত্তরায়ণপ্রস্থিত দিবাকরের ন্যায় তাপপ্ৰদ ভীষ্মকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইলেন না। ভীষ্মকর্ত্তৃক নির্ভরনিপীড়িত [একান্ত ব্যথিত] পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ বধ করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন। যুধ্যমান ভীষ্ম সেই বীরগণে পরিবৃত হইয়া মেঘাবৃত সুমেরুশিখরীর [পর্ব্বতের] ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন দুর্য্যোধন মহতী সেনাসমভিব্যাহারে ভীষ্মের চতুর্দ্দিকে অবস্থান করিলেন। অনন্তর যুদ্ধ আরম্ভ হইল।”