৩৪. মৃত্যু সংসারে ধ্রুব

দেখ, বিনয়, মৃত্যু সংসারে ধ্রুব। যে জন্মায় তার মৃত্যু হবেই। মৃত্যুর বহু পথ, সে অনিবার্য। কেউ রোগে মরে, কেউ আঘাতে মরে, কেউ ইচ্ছে করে মরে,-আত্মহত্যা করে। তবে রোগই হল মৃত্যুর সিংহদ্বারের পাকা সড়ক। রোগমাত্ৰেই মৃত্যুর স্পর্শ বহন করে; সব রোগে মানুষ মরে না কিন্তু খানিকটা এগিয়ে দেয়; জীবনীশক্তি ক্ষয় করে ঠেলে দেয় খানিকটা। চিকিৎসক চিকিৎসা করে, তার জ্ঞানমত যে বাঁচবে বলে মনে হয় তাকে সে মরবে বলে না। যে মরবে বলে মনে হয় তার ক্ষেত্রে কেউ আকারে ইঙ্গিতে জানায়, বলে বড় ডাক্তার আনুন, কেউ নিজের মত স্পষ্ট। করে বলে দেয়। তারও ক্ষেত্র আছে। শশাঙ্কের বউ আমার মতে বাঁচবে। তাই বলেছি।

বিনয়ের দোকানে বসেই কথা বলছিলেন মশায়। আরও একদিন পর। শশাঙ্কের স্ত্রীকে দেখে মশায় যা বলে এসেছেন তাই নিয়ে এখানে বেশ খানিকটা উত্তাপের সৃষ্টি হয়েছে। নবগ্রামের ডাক্তারেরা—হরেন, চারুবাবু, প্ৰদ্যোত তিন জনে ভ্রূ কুঞ্চিত করেছেন। প্রদ্যোত বলেছে—হাত দেখে বলেছে যক্ষ্মা নয়?

কথাটা নিয়ে হইচই করছে শশী ডাক্তার। সে বলে বেড়াচ্ছে—শতমারী ভবেদ্ বৈদ্য, সহস্ৰমারী চিকিৎসক! দু-চার হাজার রোগী মেরে জীবনমশায় আবার মরা বাঁচাতে লেগেছে। রামহরে বেটাকে আমাশা পেটের অসুখ থেকে বাঁচিয়ে এবার শশাঙ্কের বউকে যক্ষ্মা থেকে বাঁচাবে। রানা পাঠককে বাঁচাবে।

শশীর দোয়ারকি করছে দাঁতু ঘোষাল। বিনয় বললেসে বামুন হাসপাতাল থেকে কাল চলে এসে শশীর সঙ্গে জুটেছে। শশী তাকে বলেছে, পেঁতো, জীবন দত্ত যদি যক্ষ্মা ভাল করতে পারে তো আমি আর তোর বদহজম সারাতে পারব না! খুব পারব। ক্যানাবিসিন্ডিকা খাইয়ে তোকে সারিয়ে দেব।

মশায় চকিত হয়ে উঠলেন—দাঁতু হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে, না ডাক্তার ছেড়ে দিয়েছে?

—জোর করে চলে এসেছে। হাসপাতালে ভূত ভূত গুজব শুনেছে—তার ওপর পরশু রাত্রে পরানের বিবি মরেছে বিষ খেয়ে হাসপাতালের টেবিলের উপর। দাঁতু কাল বন্ড লিখে দিয়ে চলে এসেছে।

মশায় অকস্মাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, বাইরের জানালা দিয়ে গাছের পল্লবের মাথায় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনটা যেন খোলা পথে শূন্যলোকের অন্তহীনতার মধ্যে কিছু খুঁজে বেড়াতে লাগল। মুখে ফুটে উঠল ক্ষীণ রেখায় একটু হাসি।

—মশায়!

ভারী গলায় ডাক দিয়ে ঘরে এসে ঢুকল রানা পাঠক।

–আমি একটু ভাল আছি মশায়। দু-তিন দিন থেকে জ্বর কম হয়ে গিয়েছে। কাল বোধহয় হয়ই নাই।

সে এসে বেঞ্চে বসল। মেঝের উপর নামিয়ে দিলে সের পাঁচেক একটা মাছ।

মশায় রানার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ওকে দেখতে লাগলেন। রানার মুখে কোনো পরিবর্তনের ছাপ দেখা যায় কি না। রানা বললে–হাসপাতালের ডাক্তার, হরেন ডাক্তার, চারুবাবু ওদের আজ দুটো কথা বলে এলাম গো!

মুখের দিকে দেখতে দেখতেই ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন– কী বলে এলে?

রানা বললেওই ওদের কো-অপারেটিভ না ফো-অপারেটিভ ডাক্তারখানা হয়েছে, সেইখানে ওরা শশাঙ্কের বউয়ের রোগ নিয়ে, আমার রোগ নিয়ে আপনার নামে পাঁচ কথা বলছিল। আমি দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। শুনে আমিও দু-কথা বললাম। তা ওই নতুন ডাক্তার ফট করে বললে–তুমি বচবে না বাপু। মশায় তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। বাঁচতে চাও তো কোথাও কোনো যক্ষ্মা-হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হও। তা আমিও দু-চার কথা বললাম।

—কটু কথা বলেছ নাকি?

—তা দু-চারটে শক্ত কথা বলেছি। কটু নয় এমন কিছু বলেছি দু-চারটে। কত বড় শক্ত রোগ আরাম করেছেন তার কথা। সেই কাহারের রক্তবমি-করা যক্ষ্মা ভাল করার কথা বলেছি।

–না-না। সে কাহারের রোগটা যক্ষ্মা ছিল না বাবা। রক্তপিত্ত হয়েছিল তার।

–তা চক্রধারী তো বলেছিল যক্ষ্মা। চারুবাবুও বলেছিল।

–মানুষ মাত্রেরই ভুল হয় বাবা।

–এই তো শশাঙ্কের স্ত্রীকেও বলেছিল যক্ষ্মা। আপনি বলেছেন যক্ষ্মা নয়।

–হ্যাঁ। আমার বিচারে এটাও ওঁরা ভুল করেছেন। শশাঙ্কের স্ত্রী সেরে উঠবে। এক্স-রে করলে এখুনি বুঝতে পারবেন। ভাল নাড়ি দেখতে পারলেও ধরতে পারতেন। আসল হল যকৃতের দোষ। বিধবা মেয়ে, শরীরকে বড় কষ্ট দেয়, অবেলায় খায়, উপবাস মাসে তিনচারটে। লিভার খারাপ থেকেই কাশিটা হয়েছে। তার ওপর পুরনো জ্বর। ওঁরা ধরতে পারেন নি।

–আমার তো যক্ষ্মা বটে। তা আমিও তো ভাল আছি।

–ভাল আছ?

—তাই তো মনে হচ্ছে। জ্বর আজ দুদিন কমে গিয়েছে। সামান্য, খুব সামান্য। নিজেও তো নাড়ি দেখতে জানি। ওদের ওই পারাকাঠি আমার লাগে না। নিয়ম করে খাইদাই! ভাল লাগছে একটু। তা ছাড়া সে সব্বনাশী তো খালাস দিয়েছে আমাকে।

সেই মেয়েটি মরেছে। আশান্বিত হয়ে উঠেছে রানা।

—দেখুন, হাতটা দেখুন।

হাত দেখে বুক দেখে মশায় বললেন– ওই ওষুধই খেয়ে যাও। ওই নিয়মই করে যাও বাবা। দেখ!

—কী দেখলেন বলুন। আমার কাছে আপনি লুকুবেন না মশায়। আপনি তো রানাকে জানেন। মরণকে আমার ভয় নাই। মরতে সাধও নাই। মরব শুনলে কদব না আমি। তবে যদি ভাল হই, আর কিছুকাল বঁচি, তা কেন চাইব না! যক্ষ্মা যখন হয়েছে তখন যাবার নোটিশ আমার হয়ে গিয়েছে, সে আমি জানি। এখন যদি দশদিন মানে কিছুদিন জামিনে খালাস পাই তো সাধআহ্লাদটা মিটিয়ে নি। এই আর কি! ভগবানের নাম ভাল করে করি নাই, তাও করে নি। এই আর কি। আপনি নিৰ্ভয়ে বলুন।

—বলবার সময় এখনও হয় নাই বাবা। তবে খারাপ হয় নাই—এটুকু বলতে পারি। আরও পনের দিন পরে তুমি এসো বাবা।

–ব্যস, ব্যস! তাই আসব। এখন মাছটা রইল। ওটা আপনার জন্যে এনেছিলাম।–মাছ কেন আনলে রানা? আমার বাড়িতে খাবে কে? –পেলাম পথে, নিয়ে এলাম আপনার জন্যে। ইচ্ছে হল। জেলেরা নদীতে মাছ ধরছিল, নদী আমার এলাকা, জমা পাই। দাঁড়ালাম। দেখলাম বেশ মন দুই-আড়াই মাছ উঠল। এ মাছটা চমৎকার লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আপনাকে নিয়ে এলাম। ঘরে খান, বিনয়-টিনয়কে দেন। পাড়ায় দেন। আমাকে আশীর্বাদ করুন। বাঁচি মরিশিগগির শিগগির হয়ে যাক, যেন না ভুগি। চললাম তা হলে—

বিচিত্র মানুষ রানা। ভয় নাই। কিন্তু রানা বাঁচবে না।

বিনয় বললে—আজ রাত্রে তা হলে আপনার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া। বাজার করে মাছ নিয়ে দি গিন্নিমায়ের কাছে।

মশায় হাসলেন–দে! বিনয় চলে গেল।

ঘরে একা বসে নিজের নাড়ি দেখছিলেন। আজকাল প্রায় দেখেন। মৃত্যুর পদধ্বনি যদি শুনতে পান। এখন ওই একটি কল্পনা তার মনে দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে। তিনি তাকে সৰ্বেন্দ্রিয় দিয়ে প্রত্যক্ষ করবেন। সতর্ক হয়ে বসে থাকবেন। তার পদধ্বনি, তার রূপ, তার স্বর, তার স্পৰ্শ, তার স্বাদ তিনি প্রত্যক্ষ করবেন। রূপ থাকলে দেখবেন, স্বর থাকলে শুনবেন, স্পর্শ যদি থাকে তা তিনি অনুভব করবেন। পারলে বলে যাবেন।

সে আতর–বউ? সে মঞ্জরী? সে কেমন? সে কে?

***

একটি তরুণী মেয়ে এসে তাঁর ঘরে ঢুকল। সবিস্ময়ে তিনি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

শান্ত দৃষ্টি, বড় বড় দুটি চোখ, প্রসন্ন মুখশ্রী, ফরসা রঙ, বাইশতেইশ বছরের একটি মেয়ে। সাদা ব্লাউজ, ফিতেপাড় সাদা শাড়ি, গলায় একছড়া সরু তার চিকচিক করছে, হাত দুখানি নিরাভরণ, বাঁ হাতে একটি কালো ট্র্যাপে বাধা ছোট হাতঘড়ি। প্রসন্নতা মেয়েটির সর্বাঙ্গে।

দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।

মেয়েটি বললে—আমি এখানে নার্স হয়ে এসেছি। আপনার নাম শুনেছি। হাসপাতালের সামনে দিয়ে আসেন যান দেখি। বড় ইচ্ছে হয় কথা বলতে আজ বাজারে এসেছিলাম, দেখলাম আপনি একা বসে আছেন।

—বোসো মা, বোসো। আলাপ করতে এলে, দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে কেন? আর আমার মত বুড়ো মানুষকে তোমার সঙ্কোচ কী? বোসো। সেদিন রাত্রে হাসপাতালের দাওয়ায় তুমিই দাঁড়িয়ে ছিলে?

–আপনাকে দেখছিলাম।

–আমাকে?

–আপনার অনেক গল্প শুনেছি আমি।

–কার কাছে?

–আমার মার কাছে। আমার মাকে, আমাকে আপনি বাঁচিয়েছিলেন। আমি তখন খুব ছোট। আমার জন্ম এইখানে। ওই আপনাদের গ্রামে।

—কে মা তুমি? আমি তো। বিস্ময়ের আর সীমা রইল না তার।

–কী করে চিনবেন? আমার মায়ের বাবা এখানে চাকরি করতে এসেছিলেন। সে আপনার মনে থাকবে কী করে? কত লোককে আপনি বাঁচিয়েছেন—আপনার কি মনে আছে? কিন্তু যারা বেঁচেছে তাদের মনে থাকে।

—থাকে? হাসলেন জীবনমশায়।

–আমার তো রয়েছে। আমি প্রায় মরে গিয়েছিলাম। মা বলে। তাই তো আমি হাসপাতালে সকলের সঙ্গে তর্ক করি। ওরা বলে পাস-করা তো নন, কোয়াক তো!

মশায় হাসলেন।

মেয়েটি বললে—আমি বলি, না। তা উনি নন। আমি মায়ের কাছে শুনেছি। আপনারা মশায়। মানে মহাশয়ের বংশ।

বিস্ময়ের আর সীমা রইল না মশায়ের।—তোমার মা কে ভাই?

হেসে বললেন–ভাই বললাম, তুমি আমার ছেলের ছেলের বয়সী, কিছু মনে কোরো না।

—না। আপনি আমার দাদুই তো। আমার মা আপনাকে জ্যেঠামশায় বলত।

–কে? কে তোমার মা?

চুপ করে রইল মেয়েটি। একটু পর বললে—একদিন আপনার বাড়ি যাব। সব বলব।

মেয়েটি হেঁট হয়ে টুপ করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে। মশায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

—আমাকে প্রণাম করছ? আমি কায়স্থ। তুমি ব্ৰাহ্মণ কি বৈদ্য নও তো?

–না। আর হলেই বা কী? আপনি মশায়।

আর মশায়! শেষ হয়ে গিয়েছে মহাশয়ত্ব। কিন্তু আশ্চর্য, পৃথিবীতে এমন কৃতজ্ঞতাও আছে? কবে কোন কালে ওকে ওঁর স্মৃতির কালের সীমার বাইরে কোন অসুখ থেকে বাঁচিয়েছিলেন তার জন্য ওর এত কৃতজ্ঞতা!

–আজ আমি যাই দাদু।

সচেতন হয়ে উঠলেন মশায়, বললেন–তোমার পরিচয় তো ঠিক পেলাম না। কিন্তু তোমার নাম?

–সীতা।

–সীতা?

লঘু পদক্ষেপে চলে গেল মেয়েটি।

—মহাশা! কদ্‌রু এসে দাঁড়াল ভাল আছি মহাশা। আওর থোড়া দাওয়াই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *