৫০. কর্ণ যুধিষ্ঠির যুদ্ধ–কৌরবপলায়ন

৫০তম অধ্যায়

কর্ণ যুধিষ্ঠির যুদ্ধ–কৌরবপলায়ন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর কর্ণ সহস্র সহস্র হস্তী, অশ্ব, রথ এবং পদাতিগণে পরিবেষ্টিত হইয়া পাণ্ডবসৈন্য ভেদপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের অভিমুখে গমন করিলেন এবং শত্ৰুনিক্ষিপ্ত বিবিধ শরনিকর ছেদনপূর্ব্বক অবলীলাক্রমে তাহাদিগকে বিদ্ধ করিয়া তাহাদিগের মস্তক, বাহু ও উরুদেশ ছেদন করিতে লাগিলেন। সূতপুত্রের ভীষণ শরাঘাতে অরাতিপক্ষীয় অসংখ্য বীর নিহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল এবং কতকগুলি বিকলাঙ্গ হইয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিল। ঐ সময়ে দ্রাবিড় ও নিষাদদেশীয় পদাতিকগণ সাত্যকিকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া কর্ণের বিনাশবাসনায় ধাবমান হইল; মহাবীর কর্ণও তাহাদিগকে ছিন্নবাহু, ছিন্ন-উষ্ণীষ ও বিগতাসু করিয়া ছিন্নমূল শালবনের ন্যায় যুগপৎ ভূতলে নিপাতিত করিলেন। বীরগণ এইরূপে অকুতোভয়ে কর্ণের সম্মুখীন হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করাতে তাহাদের যশোঘোষণায় দশদিক পরিপূর্ণ হইল।

‘অনন্তর পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ ক্রুদ্ধ অন্তকের ন্যায় কর্ণকে রণস্থলে অবস্থান করিতে অবলোকন করিয়া মন্ত্র ও ঔষধ যেমন ব্যাধিকে অবরুদ্ধ করে, তদ্রূপ তাঁহাকে অবরোধ করিলেন। মহাবীর সূতপুত্রও মন্ত্রৌষধপ্রমাথী উন্বণ ব্যাধির ন্যায় তাহাদিগকে মর্দ্দিত করিয়া যুধিষ্ঠিরের অনতিদূরে উপস্থিত হইলেন; কিন্তু যুধিষ্ঠিরহিতার্থী পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও কেকয়গণকর্ত্তৃক রুদ্ধ হইয়া ব্ৰহ্মবেত্তাও যেমন মৃত্যুকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়েন না, তদ্রূপ তাঁহাদিগকে অতিক্রম করিতে অসমর্থ হইলেন। অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির রোষারুণিতলোচনে অদূরস্থিত অরাতিনিপাতন সূতপুত্রকে কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি সতত বলবান্ অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রাম করিবার নিমিত্ত স্পর্ধা করিয়া থাক এবং দুৰ্য্যোধনের মতানুসারে নিয়ত আমাদিগকেও পীড়ন করিতেছ। এক্ষণে তোমার যতদূর বলবীৰ্য্য ও আমাদিগের প্রতি বিদ্বেষবুদ্ধি থাকে, পৌরুষ অবলম্বনপূর্ব্বক তাহা প্রকাশ কর। আমি আজ তোমার রণবাসনা নিঃশেষিত করিব।’ হে মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সূতপুত্রকে এই কথা বলিয়া সুবর্ণপুঙ্খ লৌহময় দশশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাধনুৰ্ধর শত্রুতাপন কর্ণ হাস্য করিয়া দশ বৎসদন্ত শরে যুধিষ্ঠিরকে প্রতিবিদ্ধ করিলেন। ধর্ম্মরাজ সূতপুত্রের শরে বিদ্ধ হইয়া তাঁহার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনপূর্ব্বক হুতাশনের ন্যায় ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। তখন তাহার কলেবর কল্পান্তকালীন বিশ্বদহনপ্রবৃত্ত, জ্বালাসমাকীর্ণ সংবর্ত্তাগ্নির ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে সেই প্রদীপ্তায়ুধধারী সৈন্যগণ মাল্যাম্বর পরিত্যাগপূর্ব্বক দশদিকে ধাবমান হইল।

কর্ণকরে চন্দ্রদেব ও দণ্ডধার বধ

“তখন মহাবীর যুধিষ্ঠির সূতপুত্রের বিনাশবাসনায় অতি সত্বর সুবর্ণভূষিত মহাকোদণ্ড বিস্ফারিত করিয়া তাহাতে পৰ্বতবিদারণক্ষম সুশাণিত যমদণ্ডসদৃশ শর সংযোগ ও আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক কর্ণের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। সেই বজ্ৰনিঃস্বন শর মহাবীর সূতপুত্রের বামপার্শ্বে প্রবিষ্ট হওয়াতে তিনি সাতিশয় কাতর ও বিকলাঙ্গ হইয়া স্যন্দনোপরি শাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক মূর্চ্ছিত হইলেন। ঐ সময় মহাবীর কর্ণকে তদবস্থ ও তাঁহার মুখচ্ছবি বিবর্ণ নিরীক্ষণ করিয়া, কৌরবসৈন্যমধ্যে মহান্ হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। পাণ্ডবগণ যুধিষ্ঠিরের পরাক্রম দর্শন করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ ও কিলকিলা শব্দ করিতে লাগিলেন। তখন ভীষণপরাক্রম কর্ণ অনতিবিলম্বেই সংজ্ঞালাভ করিয়া ধর্ম্মরাজের নিধনার্থ কৃতসঙ্কল্প হইলেন এবং কনকময় শরাসন বিস্ফারিত করিয়া যুধিষ্ঠিরের উপর নিশিত শর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় যুধিষ্ঠিরের চক্ররক্ষক পাঞ্চালবংশীয় চন্দ্রদেব ও দণ্ডধার শশধরপার্শ্ববর্তী পুনর্ব্বসুর ন্যায় ধর্ম্মরাজের উভয় পার্শ্বে বিদ্যমান ছিলেন। মহাবীর সুতপুত্র দুই ক্ষুরদ্বারা তাঁহাদিগকে নিহত করিলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির নিশিতশরনিকরে কর্ণকে বিদ্ধ করিয়া সুষেণের উপর তিন, সত্যসেনের উপর তিন, শল্যের উপর নবতি এবং সূতপুত্রের উপর পুনরায় ত্রিসপ্ততি শর নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার রক্ষকগণকে তিন তিন বক্রবাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ হাস্যমুখে কার্ম্মুক বিকল্পিত করিয়া একভল্লে ধর্ম্মরাজের দেহ বিদারণপূর্ব্বক তাঁহাকে যষ্টিশরে বিদ্ধ। করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ঐ সময়, পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ অমর্ষিতচিত্তে যুধিষ্ঠিরের পরিরক্ষণার্থ সূতপুত্রের উপর শর পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর সাত্যকি, চেকিতান, যুযুৎসু, পাণ্ড্য, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীতনয়গণ, প্রভদ্রকগণ, নকুল, সহদেব, ভীমসেন, শিশুপালপুত্র এবং কারূষ, মৎস্য, কেকয়, কাশি ও কোশলদেশোদ্ভব বীরগণ সত্বর বসুষেণকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন এবং পাঞ্চাল বংশোদ্ভব জনমেজয় শরনিকরনিপাতে কর্ণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন অন্যান্য পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ অসংখ্য রথী, গজারোহী ও অশ্বারোহী সৈন্যসমভিব্যাহারে বরাহকৰ্ণ, নারাচ, নিশিত নালীক, বৎসদন্ত, বিপাঠ, ক্ষুর ও চটকামুখ প্রভৃতি নানাপ্রকার শর নিক্ষেপ করিয়া সূতপুত্রের বিনাশবাসনায় চতুর্দ্দিক হইতে তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইল।

কর্ণযুদ্ধে নিপীড়িত যুধিষ্ঠিরপলায়ন

“হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ এইরূপে পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ কর্ত্তৃক পরিবেষ্টিত হইয়া ব্রহ্মাস্ত্রের আবির্ভাব করিয়া শরবর্ষণে দিঙ্মণ্ডল পরিপূরিত করিলেন এবং শররূপ অগ্নিশিখাদ্বারা পাণ্ডবসৈন্যরূপ বন দগ্ধ করিয়া চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে তিনি মহাস্ত্ৰ সন্ধানপূর্ব্বক ঈষৎ হাস্য করিয়া ধর্ম্মরাজের কোদণ্ড দ্বিখণ্ড করিয়া ফেলিলেন এবং নিমেষমধ্যে নতপৰ্ব্বর্ব্বনবতি বাণ সন্ধানপূর্ব্বক তাঁহার কনকমণ্ডিত কবচ ভেদ করিলেন। তখন যুধিষ্ঠিরের সেই সুবর্ণচিত্রিত কবচ কর্ণশরে ছিন্ন হইয়া সূর্যকিরণসংশ্লিষ্ট চপলাবিরাজিত বাতাহত জলধরের ন্যায় ও নিশাকালীন বিগতা নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা ধারণপূর্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইল। ধর্ম্মতনয় এইরূপে বর্ম্মবিহীন ও রুধিরাক্তকলেবর হইয়া ক্রোধভরে সূতপুত্রের প্রতি এক লৌহময় শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কর্ণ সাতশরে আকাশপথেই সেই প্রজ্বলিত শক্তি ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন যুধিষ্ঠির বলপূর্ব্বক সূতপুত্রের বক্ষঃস্থলে চারি তোমর নিক্ষেপ করিয়া পরমাত্মাদে গৰ্জন করিতে লাগিলেন। সূতনন্দন সেই তোমরাঘাতে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া রুধির ক্ষরণ ও রোষাবিষ্ট সর্পের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক একভল্লে ধর্ম্মতনয়ের ধ্বজ ছেদন ও তিনভল্লে তাঁহার দেহ বিদারণপূর্ব্বক তাঁহার তূণীরদ্বয় ও রথ চুর্ণ করিয়া ফেলিলেন। তখন ধর্ম্মনন্দন অসিতপুচ্ছ শ্বেতাশ্বসংযুক্ত অন্য রথে আরোহণ করিয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রস্থান করিতে লাগিলেন, কোনক্রমেই কর্ণের সমক্ষে অবস্থান করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন মহাবীর রাধেয় বেগে গমনপূর্ব্বক বজ্র, ছত্র, অঙ্কুশ, মৎস্য, ধ্বজ, কুর্ম্ম ও শঙ্খ প্রভৃতি লক্ষণযুক্ত পাণ্ডুরবর্ণ শরদ্বারা পাণ্ডুনন্দনের স্কন্ধদেশ স্পর্শপূর্ব্বক স্বয়ং পবিত্র হইয়া তাঁহাকে বলপূর্ব্বক গ্রহণ করিতে মানস করিলেন। তৎকালে কুন্তীর বাক্য তাঁহার স্মৃতিপথে আরূঢ় হইল।

কর্ণকর্ত্তৃক উপহসিত যুধিষ্ঠিরের যুদ্ধাদেশ

“হে মহারাজ! ঐ সময়ে মদ্ররাজ শল্য কর্ণকে যুধিষ্ঠির গ্রহণে সমুদ্যত দেখিয়া নিষেধপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! তুমি এই প্রধানতম নরপতিকে গ্রহণ করিও না। উঁহাকে গ্রহণ করিলেই উনি তোমাকে বিনাশ করিয়া আমাকে ভস্মসাৎ করিবেন।’ তখন সূতপুত্র হাস্য করিয়া যুধিষ্ঠিরকে নিন্দাপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে পাণ্ডুনন্দন! তুমি ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ ও ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম অবলম্বন করিয়া কিরূপে প্রাণভয়ে সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতেছ? আমার বোধ হয়, তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম অবগত নহ। তুমি নিয়ত বেদপাঠ ও যজ্ঞকর্ম্ম অনুষ্ঠান করিয়া থাক; অতএব যুদ্ধ করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। এক্ষণে সংগ্রামেচ্ছা পরিত্যাগ কর, আর বীরপুরুষদিগের নিকট গমন করিও না এবং তাহাদিগকে অপ্রিয় কথাও বলিও না।’ মহাবীর কর্ণ ধর্ম্মরাজকে এইরূপ কহিয়া তাহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক বজ্রহস্ত পুরন্দরের ন্যায় পাণ্ডবসৈন্যগণকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। নরনাথ যুধিষ্ঠিরও লজ্জিতভাবে পলায়ন করিতে লাগিলেন। চেদি, পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ এবং মহারথ সাত্যকি, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদীতনয়গণ যুধিষ্ঠিরকে অপসৃত দেখিয়া সকলেই তাহার অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন।

“তখন মহাবীর কর্ণ যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণকে সমরপরাঙ্মুখ অবলোকন করিয়া হৃষ্টচিত্তে কৌরবসৈন্যগণসমভিব্যাহারে তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। কৌরব সৈন্যমধ্যে ভীষণ কার্ম্মুক নিঃস্বন, সিংহনাদ এবং ভেরী, শঙ্খ ও মৃদঙ্গের ধ্বনি সমুত্থিত হইল। ঐ সময় রাজা যুধিষ্ঠির শ্রুতকীর্তির রথে আরোহণপূর্ব্বক কর্ণের বিক্রম অবলোকন করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি কৌরবগণকর্ত্তৃক পাণ্ডবসৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত দেখিয়া রোষাবিষ্টচিত্তে স্বপক্ষীয় যোধগণকে কহিলেন, ‘হে বীরগণ! তোমরা কেন নিশ্চিন্ত রহিয়াছ, সত্বর বিপক্ষদিগকে বিনাশ কর। তখন ভীমসেনপ্রমুখ পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ ধর্ম্মরাজের আদেশানুসারে আপনার পুত্রগণের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে অসংখ্য যোদ্ধা, হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতি ও অস্ত্রসমূহের তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইল। যোধগণ ‘গাত্রোত্থান কর, প্রহার কর, অভিমুখীন হও’ এইরূপ বলিতে বলিতে পরস্পরকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। আকাশমণ্ডল জলদজালের ন্যায়। শরজালে আচ্ছাদিত হইল। শরসমাচ্ছন্ন নরবীরগণ পরস্পর প্রহারপূর্ব্বক বিকলাঙ্গ এবং পতাকা, ধ্বজ, অশ্ব, সারথি ও আয়ুধবিহীন হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিলেন। আরোহিসমবেত মাতঙ্গগণ প্রভূত বলশালী বজ্ৰভিন্ন শৈলশিখরের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। বৰ্মধারী দিব্যভূষণভূষিত পদাতিগণ প্রতিপক্ষ বীরগণের শরে ছিন্নভিন্ন হইয়া ভূতলশায়ী হইল। ঐ সময় সমপরায়ণ বীরগণের বিশাল লোহিতনেত্রযুক্ত পূর্ণেন্দুসদৃশ মুখপদ্মে সমরভূমি সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। অপ্সরাগণ অভিমুখাগত, সমরনিহত, অসংখ্য বীরগণকে গীতবাদ্যাদিযুক্ত বিমানে আরোপিত করিয়া গমন করাতে ভূমণ্ডলের ন্যায় নভোমণ্ডলেও তুমুল শব্দ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। বীরগণ সেই আশ্চর্য ব্যাপার দর্শনে পরমাহ্লাদিত হইয়া স্বর্গবাসবাসনায় সত্বর পরস্পরকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। রথীগণ রথীদিগের, পদাতিগণ পদাতিদিগের, মাতঙ্গগণ মাতঙ্গদিগের এবং অশ্বগণ অশ্বদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল।

বহু বীরক্ষয়-কৌরবপলায়ন

“হে মহারাজ! এইরূপে সেই অসংখ্য গজরাজী ও মনুষ্যের ক্ষয়জনক তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইলে সেনাগণের পদাঘাতসমুত্থিত ধূলিপটলে সমরাঙ্গন সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। তখন বীরগণ কি স্বপক্ষীয় কি পরপক্ষীয় যাহাকে সম্মুখে দেখিলেন, তাহাকেই বিনাশ করিতে লাগিলেন। অনন্তর সৈন্যগণ কেশাকেশি, দন্তাদন্তি, মুষ্ট্যামুষ্টি, নখানখি ও বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। তখন তাহাদিগের দেহবিনির্গত শোণিতে সমরাঙ্গনে ভীরুজনভীষণ ঘোরতর নদী সমুৎপন্ন হইল। উহার স্রোতে অসংখ্য গজ, অশ্ব ও নরদেহ প্রবাহিত হইতে লাগিল। বীরগণমধ্যে কেহ কেহ সেই নদীপারে, কেহ কেহ বা তাহার মধ্যে গমন করিলেন এবং সন্তরণপূর্ব্বক সেই শোণিতমধ্যে একবার নিমগ্ন ও একবার উন্মগ্ন হওয়াতে বর্ম্ম, অস্ত্র ও বস্ত্রের সহিত রুধিরাক্ত হইয়া সেই শোণিতে স্নান ও সেই শোণিত পান করিয়া তাহাতে অবসন্ন হইতে লাগিল। তখন হস্তী, অশ্ব, রথ, আয়ুধ, আভরণ, বসন, বর্ম্ম, হত ও আহত বীরগণ এবং ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল প্রায় সমুদয়ই লোহিতবর্ণ হইয়া উঠিল। রুধিরের গন্ধ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গমনশব্দে সৈন্যগণের মহাবিষাদ উপস্থিত হইল। ঐ সময়ে ভীমসেন ও সাত্যকি প্রভৃতি বীরসকল সেই নিহত প্রায় সৈন্যগণের প্রতি বারংবার ধাবমান হইতে লাগিলেন। তখন আপনার পুত্রগণের চতুরঙ্গ বল সেই ধাবমান বীরদিগের পরাক্রম সহ্য করিতে না পারিয়া চর্ম্ম, কবচ ও আয়ুধবিহীন হইয়া সিংহার্পিত হস্তিযুথের ন্যায় চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।”