৪৫. কর্ণকর্ত্তৃক শল্যবংশগ্লানি প্রকাশ

৪৫তম অধ্যায়

কর্ণকর্ত্তৃক শল্যবংশগ্লানি প্রকাশ

“শল্য কহিলেন, হে রাধেয়! তুমি অরাতিগণকে উদ্দেশ করিয়া যাহা কহিলে, উহা প্রলাপমাত্র। তোমার ন্যায় সহস্র কর্ণও তাহাদিগকে পরাজিত করিতে সমর্থ নহে।

“মদ্ররাজ সূতপুত্রের প্রতি এইরূপ পরুষবাক্য প্রয়োগ করিলে, কর্ণ যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া তাহার প্রতি দ্বিগুণতর নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করিয়া কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! আমি ধৃতরাষ্ট্রসমীপে ব্রাহ্মণমুখে যাহা শ্রবণ করিয়াছি, তুমি অবহিত হইয়া তাহা শ্রবণ কর। ব্রাহ্মণগণ ধৃতরাষ্ট্রমন্দিরে বিবিধ বিচিত্র দেশ ও পূর্ব্বতন ভূপতিগণের বৃত্তান্তবর্ণন করিতেন। তথায় একদা এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বাহীক ও মদ্রদেশোদ্ভব ব্যক্তিদিগকে নিন্দা করিয়া কহিতে লাগিলেন,—হে রাজন! যাহারা হিমালয়, গঙ্গা, সরস্বতী, যমুনা ও কুরুক্ষেত্রের বহির্ভাগে এবং যাহারা সিন্ধুনদী ও তাহার পাঁচ শাখা হইতে দূরপ্রদেশে অবস্থিত, সেই সমস্ত ধর্ম্মবর্জ্জিত অশুচি বাহীকগণকে পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। গোবর্দ্ধন, বট ও সুভদ্র নামে চত্বর বাল্যাবধি আমার স্মৃতিপথে জাগরূক রহিয়াছে। আমি নিতান্ত নিগূঢ় কার্য্যানুরোধবশতঃ বাহীকগণের সহিত বাস করিয়াছিলাম। তন্নিবন্ধন তাহাদের ব্যবহার বিদিত হইয়াছি। শাকলনামে নগর, অপগাননামে নদী ও জৰ্ত্তিকাভিধেয় বাহীকগণের ব্যবহার যারপরনাই নিন্দনীয়। তথায় আচারভ্রষ্ট ব্যক্তিরা গৌড়ী সুরাপান এবং লশুনের সহিত সৃষ্ট যব, অপূপ [পিষ্টক— পিঠা] ও গোমাংস ভোজন করিয়া থাকে। কামিনীগণ মত্ত, বিবস্ত্র ও মাল্যচন্দনরহিত হইয়া নগরের গৃহপ্রাচীরসমীপে নৃত্য এবং গর্দ্দভ ও উষ্ট্রের ন্যায় চীৎকার করিয়া অশ্লীল সঙ্গীত করিয়া থাকে। তাহারা স্বপরপুরুষবিবেকবিহীন হইয়া স্বেচ্ছাক্রমে বিহারপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে পুরুষগণের প্রতি আহ্লাদজনক বাক্য প্রয়োগ করে। একদা একজন বাহীক কুরুজাঙ্গলে অবস্থানপূর্ব্বক অপ্রফুল্লমনে কহিয়াছিল, আহা! সেই সূক্ষ্মকম্বলবাসিনী গৌরী আমাদের স্মরণ করিয়া শয়ন করিতেছে। হায়! আমি কতদিনে রম্যা শতদ্রু ও ইরাবতী উত্তীর্ণ হইয়া স্বদেশে গমনপূর্ব্বক সেই কম্বলাজিনসংবীত স্থূলললাটাস্থিসম্পন্ন গৌরীগণের মনঃশিলার ন্যায় উজ্জ্বল অপাঙ্গদেশ, ললাট, কপোল ও চিবুকে অঞ্জনচিহ্ন এবং গর্দ্দভ, উষ্ট্র ও অশ্বতরের শব্দতুল্য মৃদঙ্গ, আনক, শঙ্খ ও মর্পলের নিঃস্বনসহকারে কেলিপ্রসঙ্গ অবলোকন করিব। হায়! কতদিনে শমী, পীলু ও করীরের অরণ্যে তক্রসমবেত অপূপ ও শক্তুপিণ্ড ভোজন করিয়া সুখী হইব এবং মহাবেগে গমনপূর্ব্বক পথিমধ্যে পথিকদিগের বস্ত্রাপহরণ করিয়া বারংবার তাহাদিগকে তাড়ন করিব? হে মহারাজ! দুরাত্মা বাহীকদিগের এইরূপ দুশ্চরিত। তাহাদের দেশে কোন্ সহৃদয় ব্যক্তি অবস্থান করিতে পারে?

‘হে শল্য! তুমি যে বাহীকগণের পুণ্যপাপের ষষ্ঠাংশ ভোগ করিয়া থাক, সেই ব্রাহ্মণ তাহাদিগের এইরূপ ব্যবহার কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন। সেই ব্রাহ্মণ পুনর্ব্বার যাহা কহিলেন, তাহাও শ্রবণ কর। বাহীকদেশে শাকলনামে এক নগর আছে। তথায় এক রাক্ষসী প্রতি কৃষ্ণাচতুর্দ্দশীর রজনীতে দুন্দুভিধ্বনি করিয়া এইরূপ সঙ্গীত করিয়া থাকে যে, আহা! আমি কতদিনে পুনরায় এই শাকলনগরে সুসজ্জিত হইয়া গৌরীগণের সহিত গৌড়ী সুরাপান এবং গোমাংস ও পলাযুক্ত মেষমাংস ভোজন করিয়া বাহেয়িক [বৃষবধকালীন কৌতুককর] সঙ্গীত করিব? যাহারা বরাহ, কুক্কুট, গো, গর্দ্দভ, উষ্ট্র ও মেষের মাংস ভোজন না করে, তাহাদের জন্ম নিরর্থক। হে শল্য! শালদেশের আবালবৃদ্ধ সকলেই সুরাপানে মত্ত হইয়া এইরূপ সঙ্গীত করিয়া থাকে; অতএব তাহাদিগের ধর্ম্মজ্ঞান কিরূপে সম্ভাবিত হইতে পারে?

‘হে মদ্ররাজ! আর এক ব্রাহ্মণ কুরুসভায় যাহা কহিয়াছিলেন, তাহাও শ্রবণ কর। হিমাচলের বহির্ভাগে, যে স্থানে পীলুবন বিদ্যমান আছে এবং সিন্ধু ও তাহার শাখা শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা নদী প্রবাহিত হইতেছে, সেই অরট্টদেশ নিতান্ত ধর্ম্মহীন; তথায় গমন করা অবিধেয়। ব্রাহ্মণ, দেবতা ও পিতৃলোক ধর্ম্মভ্রষ্ট, সংস্কারহীন, অরট্টদেশীয় বাহীকদিগের পূজা গ্রহণ করেন না। সেই ঘৃণাশূন্য-মূর্খেরা শক্ত ও মদ্যবিলিপ্ত কুকুরাবলীঢ় [কুকুরের আস্বাদিত-কুকুর চাটা] কাষ্ঠময় ও মৃন্ময়পাত্রে উষ্ট্র, গর্দ্দভ ও মেষের দুগ্ধ ও তজ্জাত দধি প্রভৃতি ভক্ষণ করিয়া থাকে। সেই দুরাচারগণ কোন প্রকার অন্নভক্ষণে বা ক্ষীরপানে পরাঙ্মুখ নহে। তাহাদের কাহারও পিতার নির্ণয় নাই। পণ্ডিতগণ কদাচ তাহাদের সংসর্গ করেন না।

‘হে শল্য! কুরুসভায় বিপ্র আরও যাহা কহিয়াছিলেন, আমি তাহা তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিতেছি। যে ব্যক্তি যুগন্ধরে উষ্ট্রাদির দুগ্ধপান, অচ্যুতস্থলে বাস ও ভূতিলয়ে [ব্রাহ্মণচণ্ডালের কূপাদি—একই ক্ষুদ্র জলাশয়ের জল ব্যবহার] স্নান করে, তাহার কিরূপে স্বর্গলাভ হইবে? পঞ্চনদী পৰ্বত হইতে নিঃসৃত হইয়া যে স্থলে প্রবাহিত হইতেছে, সেই স্থানের নাম অরট্ট; সাধুলোকে তথায় কদাচ দুইদিন অবস্থান করিবেন না। বিপাশানদীতে বাহ ও বাহীকনামে দুইটি পিশাচ আছে। বাহীকেরা তাহাদেরই অপত্য। উহারা প্রজাপতির সৃষ্ট নহে; সুতরাং হীনযোনি হইয়া কিরূপে শাস্ত্রবিহিত ধর্ম্ম পরিজ্ঞাত হইবে? ধর্ম্মবিবর্জ্জিত কারস্কর, মাহিষক, কালিঙ্গ, কেরল, কর্কোটক ও বীরগণকে পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। হে মদ্ররাজ! সেই ব্রাহ্মণ তীর্থগমনানুরোধে সেই অরট্টদেশে একরাত্রি অবস্থান করিয়াছিলেন। ঐ রজনীতে এক উলূখলমেখলা [কোমরে ব্যবহার্য্য কাঞ্চীনামক অলঙ্কারের স্থলে উলূখল অর্থাৎ উখল বা উথলী বাঁধা] রাক্ষসী তাঁহাকে এই সকল বৃত্তান্ত কহিয়াছিল। সেই অরট্টদেশ বাহীকগণের বাসস্থান, তথায় যেসকল হতভাগ্য ব্রাহ্মণ বাস করে, তাহাদের বেদাধ্যয়ন বা যজ্ঞানুষ্ঠান কিছুই নাই। দেবগণ সেই ব্রতবিহীন দুরাচারদিগের অন্ন ভোজন করেন না। অরষ্ট্রদেশের ন্যায় প্রস্থল, মদ্র, গান্ধার, খস, বসাতি, সিন্ধু ও সৌবীরদেশে এইরূপ কুৎসিত ব্যবহার প্রচলিত আছে।