৪১. ক্রুদ্ধ কর্ণকর্ত্তৃক মদ্রবংশের নিন্দাবাদ

৪১তম অধ্যায়

ক্রুদ্ধ কর্ণকর্ত্তৃক মদ্রবংশের নিন্দাবাদ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবলপরাক্রান্ত শল্য সূতপুত্রকে এইরূপ তিরস্কার করিলে মহাবীর কর্ণ তাঁহার বাকশল্যে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া রোষাবিষ্টচিত্তে কহিতে লাগিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! গুণগ্রাহী ভিন্ন গুণবান ব্যক্তির গুণাবধারণে সমর্থ হয় না। তুমি গুণবিহীন; কিরূপে গুণাগুণ পরিজ্ঞানে সমর্থ হইবে? মহাবীর অর্জ্জুনের মহাস্ত্রনিচয়, শরাসন, ক্রোধ ও বলবিক্রম এবং মহাত্মা কেশবের মাহাত্ম্য আমার যেরূপ জ্ঞানগোচর আছে, তোমার তদ্রূপ নাই। আমি আপনার ও অর্জ্জুনের বীর্য্যের বিষয় সবিশেষ অবগত হইয়াই গাণ্ডীবধারীকে যুদ্ধার্থ আহ্বান করিতেছি। হে শল্য! আমার নিকট একতূণীরশায়ী সুন্দর পুঙ্খযুক্ত শোণিতলোলুপ স্বর্ণময় শর বর্ত্তমান আছে। আমি বহুকাল উহাকে পূজা করিয়া চন্দনচূর্ণমধ্যে রাখিয়াছি। সেই বিষয়যুক্ত ভীষণ শর নর, হস্তী ও অশ্বসমূহের বিনাশ সম্পাদন ও একেবারে বর্ম্ম ও অস্থি বিদারণ করিতে সমর্থ হয়। আমি তদ্দারা সুমেরুপর্ব্বতকে বিদীর্ণ করিতে পারি। আমি সত্য বলিতেছি, দেবকীপুত্র কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন ভিন্ন অন্যের প্রতি কদাচ সেই বাণ নিক্ষেপ করিব না। হে মদ্ররাজ! আমি এই শরপ্রভাবে ক্রোধাবিষ্ট চিত্তে বাসুদেব ও ধনঞ্জয়ের সহিত সমরে অবতীর্ণ হইয়া আপনার বিক্রমানুরূপ কাৰ্য্য করিব। সমস্ত বৃষ্ণিবীরমধ্যে কৃষ্ণে লক্ষ্মী ও পাণ্ডুতনয়গণমধ্যে অর্জ্জুনের উপর জয় প্রতিষ্ঠিত আছে। ঐ উভয়ের হস্ত হইতে কেহই পরিত্রাণলাভে সমর্থ হয় না; কিন্তু আজ সেই রথস্থিত মহাপুরুষদ্বয় আমার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে। তুমি অদ্য আমার আভিজাত্য সন্দর্শন কর। আজ আমি সেই পিতৃস্বস্রেয়ে [পিসতুত-মামাত ভাই কৃষ্ণার্জ্জুনকে] ও মাতুলজ ভ্রাতৃদ্বয়কে বিনাশ করিয়া সূত্রগ্রথিত মণিদ্বয়ের ন্যায় সমরাঙ্গনে নিপাতিত করিব! হে মদ্ররাজ! অর্জ্জুনের গাণ্ডীব ও কপিধ্বজ এবং কৃষ্ণের চক্র ও গরুড়ধ্বজ ভীরুজনের ভয়ঙ্কর বটে কিন্তু আমার হর্ষোৎপাদন করে। তুমি নিতান্ত মূঢ় ও মহাযুদ্ধে একান্ত অনভিজ্ঞ; সুতরাং ভয়প্রযুক্ত বহুবিধ অসম্বদ্ধ প্রলাপ এবং কোন কারণবশতঃ তাহাদিগের স্তব করিতেছ। আমি আজ সমরে কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয়কে বিনাশ করিয়া তোমাকেও বন্ধুবান্ধবের সহিত নিপাতিত করিব। রে দুর্ব্বুদ্ধে! ক্ষুদ্রাশয়! ক্ষত্রিয়কুলাঙ্গার! তুই সুহৃৎ হইয়াও শত্রুর ন্যায় কি নিমিত্ত আমাকে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন হইতে ভীত করিতেছিস? যাহা হউক, আজ তাহারাই আমাকে বিনাশ করুক আর আমিই বা তাহাদিগকে বিনাশ করি, কিন্তু স্বীয় সামর্থ্য অবগত হইয়া কখনই তাহাদিগের নিকট ভীত হইব না। সহস্র বাসুদেব ও শত শত অর্জ্জুন সমরে আগমন করিলেও আমি একাকী তাহাদিগকে বিনষ্ট করিব। তোর কোন কথা কহিবার আবশ্যক নাই।

‘রে মূঢ়! স্ত্রী, বালক, বৃদ্ধ ও স্বেচ্ছাগত ব্যক্তিরা দুরাত্মা মদ্রকদিগের যে বিষয় অধ্যয়ন ও কীৰ্ত্তন করে এবং পূর্ব্বে, ব্রাহ্মণগণ রাজসভায় যাহা কীৰ্ত্তন করিতেন, অবহিতচিত্তে তাহা শ্রবণ করিয়া, হয় তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন, না হয় উত্তর প্রদান কর। মদ্রকেরা মিত্রদ্রোহী, নিয়ত পরবিদ্বেষী। তাহাদিগের পরস্পর ঐক্য নাই। তাহারা নীচাশয়, নরাধম, দুরাত্মা, মিথ্যাবাদী ও উদ্ধতস্বভাব, তাহাদের সহিত প্রণয় করা অকৰ্ত্তব্য। আমরা শুনিয়াছি, মদ্রকেরা জন্মাবধি মরণ পৰ্য্যন্ত সমস্ত দুষ্কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। মদ্রদেশে পিতা, পুত্র, মাতা, শ্বশ্রূ, শ্বশুর, মাতুল, জামাতা, দুহিতা, ভ্রাতা, নপ্তা [পৌত্র], অন্যান্য বন্ধুবান্ধব, অভ্যাগত ও দাসদাসীসকলে একত্র মিলিত এবং কামিনীগণ স্বেচ্ছাক্রমে পুরুষদিগের সহিত সুরতে [রতিক্রিয়ায়] প্রবৃত্ত হইয়া মদ্যপানপূর্ব্বক শক্তু [ছাতু], মৎস্য ও গোমাংস প্রভৃতি ভোজন করিয়া কখন রোদন, কখন হাস্য, কখন গান ও কখন কখন অসম্বদ্ধ প্রলাপ করিয়া থাকে। মদ্রকেরা বিরুদ্ধকর্ম্মা ও অহঙ্কৃত বলিয়া বিখ্যাত আছে; অতএব তাহাদিগের ধর্ম্মে প্রবৃত্তি কিরূপে সম্ভাবিত হইতে পারে? মদ্রকদিগের সহিত বৈর বা সৌহার্দ্দ করা কর্ত্তব্য নহে। কেহই উহাদিগের সহিত মিলিত হয় না। উহারা মলস্বরূপ। গান্ধারকদিগের শৌচ ও মদ্ৰকদিগের সঙ্গতি নাই।

“হে মদ্রেশ্বর! প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা এইমাত্র বলিয়া বৃশ্চিকদষ্ট ব্যক্তির চিকিৎসা করিয়া থাকেন যে, ‘রাজা যেমন যজ্ঞে ঋত্বিক হইলে হবিঃ নষ্ট হয়, ব্রাহ্মণ শূদ্রকে অধ্যয়ন করাইলে যেমন অপমানিত হয়েন এবং ব্রাহ্মণদ্বেষী যেমন সকলের অবজ্ঞাভাজন হয়, তদ্রূপ। লোকে মদ্রকদিগের সহিত সৌহার্দ্য করিলে পতিত হইয়া থাকে; অতএব মদ্রকদিগের সহিত প্রণয় করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। হে বৃশ্চিক! তোমার বিষক্ষয় হইল, আমি অথর্ব্ববেদোক্ত মন্ত্রদ্বারা সমুদয় শান্তি করিলাম। হে শল্য! আমি এইরূপে বৃশ্চিকদষ্ট ব্যক্তির চিকিৎসা করিতে প্রত্যক্ষ করিয়াছি, অতএব তুমি ইহা বিশেষ বিবেচনা করিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূর্ব্বক পরে যাহা বলিতেছি, তাহাতে কর্ণপাত কর।

‘হে মদ্ররাজ! যে কামিনীগণ মদমত্ত হওয়াতে পরিধানবস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক নৃত্য, যাহারা ব্যভিচারদোষে দূষিত হইয়া অভিমত পুরুষের সংসর্গ এবং যাহারা উদ্ধতস্বভাব হইয়া উষ্ট্র ও গর্দ্দভের ন্যায় মূত্র পরিত্যাগ করে, তুমি সেই ধর্ম্মভ্রষ্ট নির্ল্লজ্জ স্ত্রীগণের অন্যতরের তনয় হইয়া কিরূপে ধর্মোপদেশপ্রদানে অভিলাষ করিতেছ? মদ্রদেশীয় কামিনীগণের নিকট কাঞ্জিক [কাঁজী—মাদক দ্রব্য] প্রার্থনা করিলে তাহারা তাহা প্রদানে অসম্মত হইয়া নিতম্বদ্বয়ে করাঘাতপূর্ব্বক কহিয়া থাকে যে, কাঞ্জিক আমাদিগের অতিশয় প্রিয়, উহা কেহ যাঞ্চা করিও না। আমরা পতি বা পুত্রকে প্রদান করিতে পারি, কিন্তু কাঞ্জিক প্রদান করিতে পারি না। হে মদ্ররাজ! আমরা আরও শুনিয়াছি যে, মদ্রদেশীয় গৌরীরা নির্ল্লজ্জ, কম্বলাবৃত, উদরপরায়ণ ও অশুচি। আমি হই অথবা অন্য ব্যক্তি যে কেহই হউক না কেন, সকলেই অতীব নিন্দনীয় কুকর্ম্মশালী মদ্রকদিগের এইরূপ কীৰ্ত্তন করিতে পারে। মদ্রক, সৈন্ধব ও সৌবীরগণ পাপদেশসম্ভূত ম্লেচ্ছ ও নিতান্ত অধর্ম্মপরায়ণ। তাহারা কিরূপে ধর্ম্মকীৰ্ত্তনে সমর্থ হইবে? যুদ্ধে নিহত ও সজ্জনগণ কর্ত্তৃক পূজিত হইয়া রণশয্যায় শয়ন করাই ক্ষত্রিয়ের প্রধান ধর্ম্ম। হে শল্য! অস্ত্রযুদ্ধে প্রাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বর্গলাভ করাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য। বিশেষতঃ আমি দুৰ্য্যোধনের প্রিয়সখা, অতএব তাঁহার নিমিত্ত আমার প্রাণ ও ধন পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি পাপদেশজ ও ম্লেচ্ছ; এক্ষণে তুমি আমাদিগের সহিত শত্রুর ন্যায় ব্যবহার করাতে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, পাণ্ডবগণ ভেদের নিমিত্ত তোমাকে প্রেরণ করিয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে নাস্তিকেরা যেমন ধর্ম্মজ্ঞ ব্যক্তিকে ধর্ম্মচ্যুত করিতে পারে না, তদ্রূপ তোমার সদৃশ একশত ব্যক্তিও আমাকে সমর-পরাঙ্মুখ বা ভীত করিতে সমর্থ হইবে না। তুমি ঘর্ম্মাক্ত মৃগের ন্যায় বিলাপ কর বা শুল্কহৃদয় হও, আমি অস্ত্রগুরু পরশুরামের বাক্যানুসারে রণে অপরাঙ্মুখ স্বর্গগত নরপালগণের গতি স্মরণ এবং প্রধানতম পুরূরবার ব্যবহার অবলম্বন করিয়া কৌরবগণের উদ্ধার ও শত্রুগণের বিনাশে উদ্যত হইয়াছি; কখনই নিবৃত্ত হইব না। এক্ষণে বোধ হয়, আমাকে এই অভিপ্রায় হইতে বিরত করে, এরূপ লোক ত্রিলোকমধ্যে জন্মগ্রহণ করে নাই। অতএব তুমি তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন কর; ভীত হইয়া যেন বৃথা বাগাড়ম্বর করিতেছ; হে মদ্ৰকাধম! আমি তোমাকে বিনাশ করিয়া ক্রব্যাদগণকে উপহার প্রদান করিব না। মিত্ৰকাৰ্য্যসংসাধন, দুর্য্যোধনের অনুরোধ ও তিতিক্ষা—এই তিন কারণে তুমি এ যাত্রা আমার নিকট পরিত্রাণ পাইলে। কিন্তু পুনরায় এরূপ বাক্য প্রয়োগ করিলে বজ্রকল্প গদাদ্বারা তোমার মস্তক অধঃপাতিত করিব। হে কুদেশজ শল্য! অদ্য বীরগণ আমাকে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের হস্তে বিনষ্ট অথবা তাহাদিগকে আমার হস্তে নিহত দর্শন ও শ্রবণ করিবে। হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ এইরূপ কহিয়া নির্ভীচিত্তে পুনরায় বারংবার মদ্ররাজকে অসঞ্চালনে আদেশ করিতে লাগিলেন।”