৩৬. কর্ণপ্রভাবশ্রবণে শল্যের অবজ্ঞা-অপনয়ন

৩৬তম অধ্যায়

কর্ণপ্রভাবশ্রবণে শল্যের অবজ্ঞা-অপনয়ন

“দুৰ্য্যোধন কহিলেন, ‘হে মহারাজ! সর্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা এইরূপে রুদ্রদেবের সারথ্য স্বীকার করিয়াছিলেন। ফলতঃ রথী অপেক্ষা সমধিক বলশালী ব্যক্তিকে সারথি করা কৰ্ত্তব্য। অতএব হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! আপনি রণস্থলে সূতপুত্রের তুরঙ্গমগণকে সংযত করুন। ব্রহ্মা মহাদেব অপেক্ষা অধিক বীৰ্য্যসম্পন্ন বলিয়া দেবগণ যেমন বিধাতাকে শঙ্করের সারথি করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আপনি কর্ণ অপেক্ষা বলশালী বলিয়া আমরা আপনাকে সূতপুত্রের সারথ্যগ্রহণে নিয়োগ করিতেছি।

“মদ্ররাজ কহিলেন, ‘হে মহারাজ! যেরূপে পিতামহ ব্রহ্মা রুদ্রদেবের সারথ্যকাৰ্য্য করিয়াছিলেন এবং যেরূপে ভগবান্ ভূতভাবন একবাণে অসুরগণ সংহার করিয়াছিলেন, সেই অমানুষিক দিব্য-উপাখ্যান অনেকবার আমার শ্রবণগোচর হইয়াছে। ভূতভবিষ্যদবেত্তা মহাত্মা হৃষীকেশও এ বৃত্তান্ত আনুপুর্ব্বিক অবগত আছেন এবং ইহা অবগত হইয়াই বিধাতা যেমন বৃষভধ্বজের সারথ্য স্বীকার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তিনি অর্জ্জুনের সারথ্য স্বীকার করিয়াছেন। যদি সূতপুত্র কোনক্রমে অর্জ্জুনকে নিহত করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে কেশবস্বয়ং শঙ্খ, চক্র ও গদা ধারণপূর্ব্বক তোমার সৈন্যগণকে উন্মূলিত করিবেন। বাসুদেব ক্রুদ্ধ হইলে কৌরবসৈন্যমধ্যে অবস্থান করে, কাহার সাধ্য?’ ”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মদ্ররাজ এইরূপ কহিলে আপনার পুত্র মহাবাহু দুৰ্য্যোধন অকাতরে তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে মাতুল! আপনি অস্ত্রবিদ্‌গণের অগ্রগণ্য সশস্ত্রবিশারদ কর্ণকে, অবজ্ঞা করিবেন না। যাঁহার ভীষণ জ্যানির্ঘোষশব্দ পাণ্ডবসৈন্যের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইলে তাহারা, দশদিকে পলায়ন করে, মায়াবী রাক্ষস ঘটোৎকচ আপনারই সমক্ষে রাত্রিকালে যাঁহার মায়াপ্রভাবে নিহত হইয়াছে, মহাবীর অর্জ্জুন নিতান্ত ভীত হইয়া এতদিন যাঁহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় নাই, যে মহারথ মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদরকে কার্ম্মুককোটিদ্বারা সঞ্চালিত করিয়া বারংবার মূঢ় ও ঔদরিক বলিয়া ভৎর্সনা করিয়াছিলেন, যিনি মাদ্ৰীতনয় নকুল ও সহদেবকে পরাজয় করিয়া কোন গৃঢ় কারণবশতঃ বিনাশ করেন নাই, যিনি বৃষ্ণিপ্রবীর সাত্যকিকে বলপূর্ব্বক পরাজিত ও রথবিহীন করিয়াছিলেন, যিনি হাস্যমুখে ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রমুখ পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে বারংবার পরাজিত করেন এবং যিনি সমরে রোষপরবশ হইয়া বজ্রধর পুরন্দরকেও সংহার করিতে পারেন, পাণ্ডবেরা কিরূপে সেই মহাবীর কর্ণকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে? হে মদ্ররাজ! আপনি সকল বিদ্যা ও অস্ত্রে পারদর্শী; এই পৃথিবীমধ্যে আপনার তুল্য ভুজবীৰ্য্যসম্পন্ন আর কেহই নাই। আপনার পরাক্রম নিতান্ত দুঃসহ এবং আপনি শত্রুগণের শল্যস্বরূপ; এই নিমিত্তই লোকে আপনাকে শল্য বলিয়া আহ্বান করিয়া থাকে। সাত্বতগণ আপনার ভুজবলে পরাজিত হইয়াছিল। আপনার অপেক্ষা বাসুদেব কি বলশালী? হে মহাবীর! মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয় নিহত হইলে বাসুদেব যেমন পাণ্ডবসৈন্য রক্ষা করিবে, তদ্রূপ কর্ণ কলেবর পরিত্যাগ করিলে আপনাকেই কৌরবসৈন্য রক্ষা করিতে হইবে। বাসুদেব যে আমাদের সৈন্যসকল নিবারণ করিবে, আর আপনি যে উহাদের সৈন্য সংহার করিতে সমর্থ হইবেন না, একথা নিতান্ত অসম্ভব। হে মদ্ররাজ! আমি আপনার নিমিত্ত মৃতসহোদর ও মহীপালগণের পদবীতে পদার্পণ করিতে প্রস্তুত আছি।

“তখন শল্য কহিলেন, মহারাজ! তুমি সৈন্যগণের সমক্ষে আমাকে যে বাসুদেব অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বলিয়া কীৰ্ত্তন করিলে, ইহাতেই আমি তোমার প্রতি প্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছি। এক্ষণে আমি তোমারই অভিলাষানুসারে ধনঞ্জয়ের সহিত সংগ্রামার্থ সমুদ্যত সূতপুত্রের সারথ্য স্বীকার করিতেছি; কিন্তু কর্ণের সহিত আমার এই একটি নিয়ম নির্দ্দিষ্ট রহিল যে, আমি. উহারই সমক্ষে স্বেচ্ছানুসারে বাক্যপ্রয়োগ করিব। অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন কর্ণের সহিত ক্ষত্রিয়গণসমক্ষে শস্যের বাক্য স্বীকার করিলেন।

শল্যের সবিশেষ সন্তোষজন্য দুর্য্যোধনের স্তব

“হে মহারাজ! এইরূপে মদ্ররাজ কর্ণের সারথ্য স্বীকার করিলে রাজা দুৰ্য্যোধন একান্ত আশ্বাসিত হইয়া হৃষ্টমনে সূতপুত্রকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক পুনরায় কহিলেন, ‘হে মহাবীর! পূর্ব্বে সুররাজ যেমন অসুর সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি এক্ষণে পাণ্ডববিনাশে প্রবৃত্ত হও। তখন মহাবীর কর্ণ পুলকিতমনে দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে মহারাজ! মদ্ররাজ অনতিহৃষ্টমনে অশ্বের প্রগ্রহগ্রহণে অঙ্গীকার করিতেছেন, অতএব তুমি পুনরায় মধুরবাক্যে উহাকে প্রসন্ন কর।’

“রাজা দুৰ্য্যোধন কর্ণের বাক্যশ্রবণে মেঘগর্জনের ন্যায় স্নিগ্ধগম্ভীরবাক্যে দিঙ্মণ্ডল পরিপূর্ণ করিয়া শল্যকে কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! মহাবীর কর্ণ অদ্য ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন বলিয়া অধ্যবসায় করিয়াছেন; অতএব আপনি এক্ষণে তাহার, সারথ্য স্বীকার করুন। তিনি অন্যান্য বীরগণকে বিনাশপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে সংহার করিবেন। এই নিমিত্ত আমি আপনাকে তাঁহার সারথ্য গ্রহণ করিতে বারংবার অনুরোধ করিতেছি। এক্ষণে বাসুদেব যেমন অর্জ্জুনের সারথি হইয়াছেন, তদ্রূপ আপনিও কর্ণের সারথি হইয়া তাঁহাকে সকল বিপদ হইতে রক্ষা করুন।

“তখন মদ্ররাজ রাজা দুৰ্য্যোধনকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে প্রিয়দর্শন! তুমি যদি এইরূপই নিশ্চয় করিয়া থাক, তাহা হইলে আমি তোমার সমস্ত প্রিয়কার্য্যের অনুষ্ঠান করিব। আমি তোমার যে যে কার্য্যের উপযুক্ত, প্রাণপণে সেই সমস্ত কাৰ্য্যভার বহন করিতে সম্মত আছি; কিন্তু আমি হিতবাসনাপরবশ হইয়া কর্ণকে প্রিয় বা অপ্রিয়ই হউক, যাহা কিছু বলিব, তৎসমুদয় কর্ণকে ও তোমাকে ক্ষমা করিতে হইবে। তখন কর্ণ কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! ব্রহ্মা যেমন রুদ্রদেবের মঙ্গলচিন্তা করিয়াছিলেন এবং বাসুদেব যেমন ধনঞ্জয়ের শুভানুষ্ঠান করেন, তদ্রূপ আপনিও নিরন্তর আমার শুভচিন্তা করুন। শল্য কহিলেন, ‘হে কর্ণ! আত্মনিন্দা ও আত্মপ্রশংসা এবং পরনিন্দা ও পরের স্তুতিবাদ— এই চারিটি সাধুলোকের নিতান্ত অনভ্যস্ত। কিন্তু আমি তোমার মনে বিশ্বাস উৎপাদনের নিমিত্ত যাহা কিছু আত্মপ্রশংসা করিতেছি, তাহা তুমি শ্রবণ কর। আমি অবধানতা, অশ্বচালন, ভবিষ্যৎ দোষের অবেক্ষণ [দর্শন], দোষপরিহারজ্ঞান [দোষ প্রতিকারের উপায়-বোধ] ও পরিহারসামর্থ্য [দোষপ্রতিকার শক্তি] এই কয়েকটি গুণে মাতলির ন্যায় সুররাজ ইন্দ্রেরও সারথ্যকাৰ্য্যে সম্যক উপযুক্ত হইতে পারি; অতএব এক্ষণে তুমি নিশ্চিন্ত হও। তুমি ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে আমিই তোমার অশ্বসঞ্চালন করিব।”