৩১. সঙ্কুলযুদ্ধ—পাণ্ডবপরাজয়

৩১ম অধ্যায়

সঙ্কুলযুদ্ধ—পাণ্ডবপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর আপনার পক্ষীয় বীরগণ মহাবীর কর্ণকে পুরোবর্তী করিয়া পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হইয়া দেবাসুরযুদ্ধসদৃশ ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। গজারোহী, অশ্বারোহী, রথী ও পদাতিগণ করিবৃংহিত, নরকোলাহল, রথঘর্ঘরশব্দ ও শঙ্খনিঃস্বনদ্বারা অতিশয় পুলকিত হইয়া ক্রোধভরে বিবিধ আয়ুধ প্রয়োগপূর্ব্বক পরস্পরকে প্রহার করিতে লাগিল। অসংখ্য হস্তী ও অশ্ব রথীবীরপুরুষনিক্ষিপ্ত শাণিত পরশু, অসি, পট্টিশ ও বহুবিধ শরে নিহত হইয়া গেল। চন্দ্ৰসূৰ্য্য ও কমলতুল্য, ধবল দশনরাজিবিরাজিত, নাসাবংশ[দীর্ঘনাসিকা]-সুশোভিত, কমনীয় লোচন, রুচির, কিরীট ও কুণ্ডলে সমলঙ্কৃত নরমস্তকসমূহে রণস্থল সমাকীর্ণ হইল। অসংখ্য পরিঘ, মুষল, শক্তি, তোমর, নখর, ভূশুণ্ডী ও গদাদ্বারা হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণ নিহত হইলে সমরাঙ্গনে ভীষণ রুধিরনদী প্রবাহিত হইতে লাগিল। এইরূপে অসংখ্য নিহত রথী, পদাতি, অশ্ব ও কুঞ্জর ক্ষতবিক্ষত ও ভীষণদর্শন হওয়াতে সমরাঙ্গন লোকক্ষয়কালীন যমরাজ্যের ন্যায়। শোভা ধারণ করিল।

“হে মহারাজ! অনন্তর আপনার দেবকুমারসদৃশ আত্মজ ও সৈনিকগণ বহুল বলসমভিব্যাহারে সাত্যকির অভিমুখে ধাবমান হইলেন। সেই অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিসম্পন্ন কৌরবসৈন্য গমনকালে সমুদ্রের ন্যায় গভীর শব্দ করিয়া সুররাজের সেনার ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তখন সুররাজসম বিক্রমসম্পন্ন মহাবীর কর্ণ দিনকরকিরণের ন্যায় প্রখর শরনিকরদ্বারা উপেন্দ্রতুল্য সাত্যকিকে প্রহার করিতে লাগিলেন; সাত্যকিও সত্বর বিবিধ শরদ্বারা সর্পবিষের ন্যায় নিতান্ত উগ্র পুরুষপ্রবীর কর্ণকে রথ, অশ্ব ও সারথির সহিত সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। হে মহারাজ! অনন্তর আপনার সুহৃদ অতিরথগণ সাত্যকিনিক্ষিপ্ত শরজালে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিগণের সহিত সত্বর বসুষেণের নিকট গমন করিলেন। তখন মহার্ণবসন্নিভ কৌরবসৈন্যসমুদয় সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক ধাবমান হইলে দ্রুপদতনয় প্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ উহাদিগের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় বহুসংখ্যক বেহমনুষ্য, অশ্ব ও হস্তী বিনষ্ট হইয়া গেল।

‘ইত্যবসরে মহাবীর অর্জ্জুন ও বাসুদেব শত্ৰুসংহারে কৃতনিশ্চয় হইয়া সায়ংকালোচিত কাৰ্য্য সমাধানানন্তর ভগবান্ ভবানীপতির যথাবিধি অর্চনা করিয়া কৌরবসৈন্যের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। কৌরবগণ বিস্মিত হইয়া তাঁহাদের অম্বুদের ন্যায় গভীরনিঃস্বনযুক্ত, পবনবিকম্পিত, ধ্বজপটসম্পন্ন, শ্বেতাশ্ব সংযোজিত রথ সম্মুখে আগমন করিতে নিরীক্ষণ করিয়া বিমোহিত প্রায় হইলেন। অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক নৃত্য করিয়াই যেন শরনিকরে দিঙ্মমণ্ডল ও গগনতল সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন এবং বায়ু যেমন মেঘমণ্ডল ছিন্নভিন্ন করে, তদ্রূপ সুসজ্জিত যন্ত্র, আয়ুধ ও ধ্বজদণ্ডসমন্বিত বিমানপ্রতিম রথসমুদয় সারথির সহিত শরনিকরে খণ্ড খণ্ড করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি শরপ্রয়োগপূর্ব্বক বৈজয়ন্তী আয়ুধ ও ধ্বজসম্পন্ন গজ, মহামাত্র, অশ্ব, সাদী ও পদাতিগণকে বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

“হে মহারাজ! তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন একাকীই সেই সংক্রুদ্ধ অন্তকসদৃশ দুর্নিবার অর্জ্জুনকে শরনিকরদ্বারা সমাহত করিয়া তথায় আগমন করিলেন। মহারথ অর্জ্জুন তাঁহাকে সমাগত দেখিয়া সাতসায়কে তাঁহার কার্ম্মুক, অশ্ব, ধ্বজ ও সারথিকে ছেদনপূর্ব্বক একশরে তাঁহার ছত্রদণ্ড দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে তিনি দুৰ্য্যোধনকে লক্ষ্য করিয়া আর একটি প্রাণনাশক শর নিক্ষেপ করিলে মহাবীর অশ্বত্থামা উহা সাতখণ্ডে ছেদন করিলেন। তখন ধনঞ্জয় শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক দ্রোণপুত্রের ধনু ও অশ্বগণকে ছেদনপূর্ব্বক কৃপাচার্য্যের কার্ম্মুক খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন এবং তৎপরে হার্দ্দিক্যের শাসন, ধ্বজ ও অশ্বগণ এবং দুঃশাসনের শাসন ছেদন করিয়া সূতপুত্রের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর কর্ণ সাত্যকিকে পরিত্যাগপূর্ব্বক সত্বর তিনশরে অর্জ্জুনকে ও বিংশতিশরে বাসুদেবকে বিদ্ধ করিয়া শরনিকরে বারংবার ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তিনি ঐ সময় রোষপরবশ সুররাজ ইন্দ্রের ন্যায় শত্রুগণকে সংহার ও অনবরত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেও তাঁহার কিছুমাত্র গ্লানি উপস্থিত হইল না।

“অনন্তর সাত্যকি তথায় আগমনপূর্ব্বক কর্ণকে প্রথমতঃ নিশিতনবতিশরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় তাঁহার প্রতি একশত শর নিক্ষেপ করিলেন। তৎপরে মহাবীর যুধামন্যু, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, উত্তমৌজা, যমজ নকুল ও সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, চেকিতান, ধর্ম্মরাজ এবং প্রভদ্রক, চেদি, কারূষ, মৎস্য ও কৈকয়গণ অসংখ্য রথ, অশ্ব, হস্তী ও পদাতিদিগের সহিত কর্ণবধে অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টন ও কটুক্তি প্রয়োগপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি বিবিধ শস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহারথ কর্ণ শিতশরনিকরে [তীক্ষ্ণধার] ঐ শস্ত্র ছেদন করিয়া, বায়ু যেমন মহীরুহ [দুরে নিক্ষেপ] ভগ্ন করিয়া অপবাহিত করে, সেইরূপ তথা হইতে, তৎসমুদয় অপসারিত করিলেন। তৎপরে তিনি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া রথী, মহামাত্রসমবেত গজ, সাদীর সহিত অশ্ব ও পদাতিগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। এইরূপে পাণ্ডবসৈন্যগণ মহাবীর কর্ণের অসুপ্রভাবে বিশস্ত্র, ক্ষতবিক্ষত ও বধ্যমান হইয়া প্রায় সকলেই সমরে পরাঙ্মুখ হইল।

রাত্রিযুদ্ধে ভীত কৌরবগণের পলায়ন

“তখন মহাবীর অর্জ্জুন হাস্যমুখে অস্ত্রজাল বর্ষণপূর্ব্বক সেই কর্ণনিক্ষিপ্ত অস্ত্রসমুদয় প্রতিহত করিয়া শরনিকরদ্বারা ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিলেন। অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত শরজাল মুষলের ন্যায়, পরিঘের ন্যায়, শতঘ্নীর ন্যায় ও অতি কঠোর বজ্রের ন্যায় নিপতিত হইতে লাগিল। কৌরবসৈন্যগণ অর্জ্জুনের অস্ত্রবলে নিহন্যমান হইয়া নিমীলিতলোচনে ভ্রমণ ও আর্ত্তনাদ করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্য সংগ্রামে কলেবর পরিত্যাগ করিল এবং কতকগুলি শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত ও ভীত হইয়া ধাবমান হইল।

“হে মহারাজ! অনন্তর ভগবান্ ভানুমান্ অস্তাচলশিখরে আরোহণ করিলেন। গাঢ়তর অন্ধকার ও ধূলিপটল প্রভাবে আর কোন বস্তুই নিরীক্ষিত হইল না। তখন কৌরবপক্ষীয় মহারথগণ রাত্রিযুদ্ধে নিতান্ত ভীত হইয়া সৈন্যগণসমভিব্যাহারে ক্রোধভরে রণস্থল হইতে অপগমন করিলেন; পাণ্ডবেরাও জয়শ্রী লাভ করিয়া বিবিধ বাদিত্র বাদন ও সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক শত্রুগণকে উপহাস এবং কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের স্তুতিবাদ করিয়া স্বশিবিরে গমন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে উভয়পক্ষীয় বীরগণ যুদ্ধে অবহার [বিশ্রাম] করিলে ভূপালগণ, পৈাণ্ডবদিগকে আশীর্ব্বাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন পাণ্ডবেরা সেই নিশাকালে শিবিরে সমাগত হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। অনন্তর রাক্ষস, পিশাচ ও শ্বাপদগণ দলবদ্ধ হইয়া রুদ্রদেবের আক্রীড়সন্নিভ [সংহারক্রীড়াক্ষেত্রতুল্য] সেই ভীষণ রনস্থলে সমাগত হইতে লাগিল।’