২৭. কৃপাচার্য্য-ধৃষ্টদ্যুম্নযুদ্ধ

২৭তম অধ্যায়

কৃপাচার্য্য-ধৃষ্টদ্যুম্নযুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এ দিকে শরভ যেমন বনমধ্যে সিংহকে দেখিয়া নিবারণ করে, সেইরূপ কৃপাচার্য্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন মহাবলপরাক্রান্ত কৃপকর্ত্তৃক নিবারিত হইয়া একপদও গমন করিতে সমর্থ হইলেন না। প্রাণীগণ ধৃষ্টদ্যুম্নের রথসন্নিধানে কৃপাচার্য্যের রথ নিরীক্ষণপূর্ব্বক নিতান্ত ভীত হইয়া দ্রুপদতনয়কে বিনষ্ট বলিয়া অবধারণ করিল। তখন রথী ও সাদিগণ একান্ত বিমনায়মান হইয়া কহিতে লাগিল, ‘বোধ হয়, মহাত্মা কৃপ দ্রোণনিধনে জাতক্রোধ হইয়াছেন। ইনি মহাতেজস্বী, দিব্যাস্ত্রবেত্তা ও উদারধীশক্তিসম্পন্ন। আজ কি ধৃষ্টদ্যুম্ন ইহার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবেন? এই সমস্ত সৈন্য কি মহাভয় হইতে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইবে? ঐ মহাবীর কি আমাদিগকে সংহার না করিয়া ক্ষান্ত হইবেন? ইহার রূপ কৃতান্তের ন্যায় নিতান্ত করাল। আজ ইনি সংগ্রামে দ্রোণাচার্য্যের ন্যায় ভয়ঙ্কর কার্য্যানুষ্ঠান করিবেন, সন্দেহ নাই। ঐ সমরবিজয়ী মহারথ লঘুহস্ত এবং মহাস্ত্র ও বলবীৰ্য্যসম্পন্ন। অদ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন নিঃসন্দেহেই উহার সহিত সমরে পরাঙ্মুখ হইবেন।’ হে মহারাজ! উভয়পক্ষীয় বীরগণ এইরূপে নানাপ্রকার জল্পনা করিতে লাগিল।

পলায়মান ধৃষ্টদ্যুম্নের পশ্চাদ্‌ধাবন

“অনন্তর মহারথ কৃপ ক্রোধভরে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক শরনিকরদ্বারা নিশ্চেষ্ট ধৃষ্টদ্যুম্নের মর্ম্মদেশে আঘাত করিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন আচার্য্যের শরজালে একান্ত সমাহত ও মোহে নিতান্ত অভিভূত হইয়া কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন। তদ্দর্শনে তাঁহার সারথি তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে মহাবীর! আপনার মঙ্গল ত’? আমি যুদ্ধকালে আপনার এইরূপ বিপদ ত’ কখন নিরীক্ষণ করি নাই। এক্ষণে দুর্দৈববশতঃই আপনি মর্ম্মভেদী শরনিক্ষেপে অসমর্থ হইয়াছেন। কিন্তু ঐ বিপ্রবর আপনার মর্ম্মভেদ লক্ষ্য করিয়া শরনিকর নিক্ষেপ করিতেছেন, অতএব আমি অবিলম্বে অর্ণবমুখ হইতে প্রতিনিবৃত্ত নদীবেগের ন্যায় এই রথ প্রতিনিবৃত্ত করিব। এক্ষণে যিনি তোমার বিক্রম বিনষ্ট করিয়াছেন, ঐ ব্রাহ্মণ অবধ্য।’ মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন সারথির মুখে এই সমস্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া মৃদুবচনে কহিলেন, ‘হে সূত! আমার চিত্ত বিমোহিত ও দেহ হইতে স্বেদজল [ঘর্ম্ম] নির্গত হইতেছে এবং সর্ব্বাঙ্গ কণ্টকিত ও অনবরত বিকম্পিত হইতেছে। অতএব এক্ষণে ব্রাহ্মণকে পরিত্যাগ করিয়া অর্জ্জুনসন্নিধানে রথ উপনীত কর। আমার নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, অর্জ্জুন বা ভীমসেনের নিকট সমুপস্থিত হইলে অদ্য আমার শ্রেয়োলাভ হইবে।’ হে মহারাজ! তখন সারথি অশ্বপৃষ্ঠে কশাঘাতপূৰ্কক যে স্থানে ভীমসেন আপনার সৈন্যগণের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিতেছিলেন, তথায় রথ লইয়া গমন করিতে লাগিল। মহাবীর কৃপাচার্য্য ধৃষ্টদ্যুম্নের রথ দ্রুতবেগে ধাবমান হইয়াছে দেখিয়া অসংখ্য শরবর্ষণ ও মুহুর্ম্মুহুঃ শঙ্খধ্বনি করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। এইরূপে কৃপাচার্য্য দেবরাজ ইন্দ্র যেমন নমুচি দানবকে বিভ্রাসিত করিয়াছিলেন, সেইরূপ ধৃষ্টদ্যুম্নকে ভীত করিলেন।

হার্দ্দিক-শিখণ্ডী-সমর—পাণ্ডবপলায়ন

“ঐ সময় মহাবীর হার্দ্দিক্য হাস্যমুখে ভীষ্মের সংহারহেতু একান্ত দুর্দ্ধর্ষ শিখণ্ডীকে বারংবার নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর শিখণ্ডী সুশাণিত পাঁচভল্লে হার্দ্দিক্যের জত্রুদেশে আঘাত করিলেন। তখন হৃদিকাত্মজ কৃতবর্ম্মা ক্রোধাবিষ্টচিত্তে ষষ্টিসায়কে শিখণ্ডীকে বিদ্ধ করিয়া হাস্যমুখে একশরে তাঁহার কার্ম্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। দ্রুপদত্মজ তৎক্ষণাৎ অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক ক্রোধভরে কৃতবর্ম্মাকে ‘থাক্ থাক’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া নবতি শর নিক্ষেপ করিলেন; কিন্তু ঐ সমস্ত বাণ তাঁহার বর্ম্মে লগ্ন হইবামাত্র স্খলিত হইয়া পড়িল। শিখণ্ডী স্বীয় শরনিকর ব্যর্থ ও ক্ষিতিতলে নিপতিত দেখিয়া সুতীক্ষ্ণ ক্ষুরপ্ৰদ্বারা কৃতবর্ম্মার কার্ম্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে মহাবীর কৃতবর্ম্মা ছিন্নকার্ম্মুক হইয়া ভগ্নশৃঙ্গ বৃষভের ন্যায় প্রভাব-প্রকটনে অসমর্থ হইলে দ্রুপদতনয় রোষভরে অশীতিশরে তাঁহার বাহুযুগল ও বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। হৃদিকাত্মজ শিখণ্ডিনিক্ষিপ্ত শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত কলেবর ও একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইলেন। কুম্ভমুখ হইতে বিনির্গত সলিলের ন্যায় তাঁহার দেহ হইতে অনবরত রুধিরধারা নির্গত হইতে লাগিল। তখন তিনি রুধিরলিপ্ত কলেবর হইয়া ধাতুধারারঞ্জিত শৈলের ন্যায় শোভমান হইলেন এবং তৎপরে অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া শিখণ্ডীর স্কন্ধদেশে বহুসংখ্যক শর বিদ্ধ করিলেন। দ্রুপদাত্মজ স্কন্ধদেশবিদ্ধ শরসমূহদ্বারা শাখাপ্রশাখা শোভিত অতি বৃহৎ পাদপের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইলেন। অনন্তর সেই বীরদ্বয় পরস্পর পরস্পরের শরাঘাতে রুধিরলিপ্তকলেবর হইয়া পরস্পর শৃঙ্গাভিহত বৃষভদ্বয়ের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। এইরূপে হারা পরস্পরের বধে অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া অসংখ্য মণ্ডল প্রদর্শনপূর্ব্বক রথারোহণে সঞ্চরণ করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর কৃতবর্ম্মা সুশাণিত সপ্ততিশরে শিখণ্ডীকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার উপর এক জীবিতান্তকর ভয়ঙ্কর শর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর শিখণ্ডী ভোজরাজনিক্ষিপ্ত শরে একান্ত অভিহত হইয়া ধ্বজযষ্ঠি অবলম্বনপূর্ব্বক মোহে অভিভূত হইলেন। তাঁহার সারথি তাঁহাকে হার্দ্দিক্যশরাঘাতে নিতান্ত কাতর ও বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া অবিলম্বে রণস্থল হইতে অপসারিত করিল। হে মহারাজ! এইরূপে দ্রুপদাত্মজ শিখণ্ডী কৃতবর্ম্মাকর্ত্তৃক পরাজিত হইলে পাণ্ডবসৈন্যগণ শরনিপীড়িত হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল।”