২৫. কর্ণ-কুলযুদ্ধ-নকুলপরাজয়

২৫তম অধ্যায়

কর্ণ-কুলযুদ্ধ-নকুলপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে মহাবীর কর্ণ মাদ্ৰীতনয় নকুলকে কৌরবসৈন্যবিদ্রাবণে [উপদ্রুতকরণে] প্রবৃত্ত দেখিয়া ক্রোধভরে তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন নকুল হাস্যমুখে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে সূতনন্দন! আমি বহুকালের পর অনুকূল দৈবপ্রভাবে তোমার নেত্রগোচরে নিপতিত হইলাম। হে পাপাত্মন! তুমিই এই অনর্থপরম্পরা বৈর [পরস্পর বিঘ্নকারক শত্রুতা] ও কলহের মূল। তোমার দোষেই কৌরবগণ পরস্পর মিলিত হইয়া বিনষ্ট হইতেছে। অতএব এক্ষণে তুমি আমার প্রভাব নিরীক্ষণ কর। আজ আমি তোমাকে সংহার করিয়া কৃতকাৰ্য্য ও বিগতজ্বর [তীব্ৰসর্পবিষতুল্য] হইব। মহাবীর সূতনন্দন নকুলের মুখে রাজপুত্রের, বিশেষতঃ ধনুর্ধারীর সমুচিত বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে বীর! তুমি আমাকে প্রহার কর; অদ্য আমি তোমার পৌরুষ প্রত্যক্ষ করিব। হে শূর! অগ্রে যুদ্ধে বীরজনোচিত কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া পশ্চাৎ বাগ্‌জাল বিস্তার করা তোমার কর্ত্তব্য। বীরগণ বৃথা বাক্যব্যয় না করিয়া শক্তি অনুসারে যুদ্ধ করিয়া থাকেন। এক্ষণে তুমি আমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। আমি আজ তোমার মস্তক চূর্ণ করিব।’ মহাবীর কর্ণ এই বলিয়া সত্বর ত্রিসপ্ততিশরে নকুলকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবল নকুল সূতপুত্রশরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া আশীবিষসদৃশ ভীষণ অশীতিশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন কর্ণ স্বর্ণপুঙ্খনিশিতশরনিকরে নকুলের কার্ম্মুক ছেদন করিয়া ত্রিংশৎবাণে তাঁহাকে নিপীড়িত করিলে সেই সমুদয় শর ভুজঙ্গগণ যেমন পৃথিবী ভেদ করিয়া সলিল পান করিয়াছিল, সেইরূপ তাঁহার কবচ ভেদপূর্ব্বক শোণিত পান করিল।

“অনন্তর নকুল অন্য এক হেমপৃষ্ঠ কার্ম্মুক গ্রহণপূর্ব্বক বিংশতিশরে কর্ণকে ও তিনশরে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিয়া ক্রোধভরে খরধার-ক্ষুরপ্ৰদ্বারা তাঁহার শরাসনচ্ছেদনপুরঃসর হাস্যমুখে তিনশত সায়কে পুনরায় তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন অন্যান্য রথী ও সমরদর্শনার্থ সমাগত দেবগণ নকুলের শরনিকরে সূতপুত্রকে নিপীড়িত দেখিয়া সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। অনন্তর মহাবীর কর্ণ অন্য এক ধনু গ্রহণ করিয়া পাঁচবাণে নকুলের জঞদেশ বিদ্ধ করিলেন। ভুবনদীপন [অখিললোক উজ্জ্বলকারী] ভগবান ভাস্কর স্বীয় রশ্মিজালপ্রভাবে যেমন শোভমান হয়েন, মহাবীর মাদ্ৰীতনয় সেই কর্ণনিক্ষিপ্ত জঞদেশে বিদ্ধ শরসমুদয়দ্বারা সেইরূপ সুশোভিত হইলেন এবং অবিলম্বে সাতশরে কর্ণকে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় তাঁহার ধনুষ্কোটি [ধনুকের অগ্রভাগ] ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ অন্য কার্ম্মুক গ্রহণ করিয়া শরজালে নকুলের চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন করিলেন। নকুল কর্ণচাপচ্যুত শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া শরজাল প্রয়োগপূর্ব্বক অবিলম্বে তৎসমুদয় ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন নভোমণ্ডল সেই শরজালে সমাচ্ছন্ন হইয়া খদ্যোতসঙ্কুলের ন্যায়, শলভ সমাকীর্ণের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল এবং সেই শ্ৰেণীভূত শরনিকর অনবরত নিপতিত হইয়া শ্রেণীভূত ক্রৌঞ্চপক্ষীর ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তৎকালে নভোমণ্ডল শরজালে এককালে সমাচ্ছন্ন ও দিবাকর তিরোহিত হইলে আকাশগামী কোন প্রাণীই আর ভূতলে অবতীর্ণ হইতে সমর্থ হইল না।

“হে মহারাজ! এইরূপে চতুর্দ্দিক শরনিকরে নিরুদ্ধ হইলে মহাবীর কর্ণ ও নকুল উদিত কালসূৰ্য্যদ্বয়ের ন্যায় সুশোভিত হইলেন। সোমকগণ কর্ণচাপচ্যুত শরজালে সমাহত ও নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া কলেবর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। কৌরবসৈন্যগণও নকুলশরে সমাহত হইয়া সমীরণসঞ্চালিত অম্বুদের ন্যায় চতুর্দ্দিকে ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। তখন উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ সেই বীরদ্বয়ের শরাঘাতে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া তাঁহাদিগের শরপাতপথ [বাণের গমনস্থান] অতিক্রমণপূর্ব্বক সেই ঘোরতর সংগ্রাম নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। এইরূপে সৈন্যসকল উৎসারিত হইলে তাঁহারা পরস্পর বধাভিলাষে দিব্যাস্ত্রজাল বিস্তারপূর্ব্বক পরস্পরকে সমাচ্ছন্ন ও বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। নকুলনির্ম্মুক্ত কঙ্কপত্রযুক্ত শরসকল সূতপুত্রকে এবং সূতপুত্রনির্ম্মুক্ত শরজাল নকুলকে বিদ্ধ করিয়া গগনতলে অবস্থান করিতে লাগিল। এইরূপে সেই বীরদ্বয় পরস্পরের শরে সমাচ্ছন্ন হইয়া জলদজাল-সমাবৃত চন্দ্র-সূৰ্য্যের ন্যায় সকলের অদৃশ্য হইলেন।

“অনন্তর মহাবীর কর্ণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভীষণ আকার ধারণপূর্ব্বক নকুলকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলে মহাবীর নকুল কর্ণের শরে পরিবৃত হইয়া মেঘাচ্ছন্ন দিবাকরের ন্যায় কিছুমাত্র ব্যথিত হইলেন না। তখন সূতপুত্র ঈষৎ হাস্য করিয়া তাঁহার উপর সহস্র সহস্র শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। সেই অনবরত নিক্ষিপ্ত শরজালে সমরাঙ্গন এককালে মেঘচ্ছায়ার ন্যায় শরচ্ছায়ায় সমাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। তৎপরের মহাত্মা সূতপুত্র নকুলের শরাসন ছেদনপূর্ব্বক হাস্যমুখে তাঁহার সারথিকে রথ হইতে নিপাতিত করিয়া চারি বাণে তাঁহার চারি অশ্বকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিলেন এবং শরনিকরদ্বারা তাঁহার দিব্যরথ চূর্ণ করিয়া পতাকা, গদা, খড়্গ, শতচক্ৰযুক্তচর্ম্ম ও অন্যান্য উপকরণসকল এবং চক্ররক্ষকগণকে ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর নকুল রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া পরিঘ উদ্যত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। সূতপুত্র তীক্ষ্ণধারসায়কদ্বারা সেই ভীষণ পরিঘ ছেদনপূর্ব্বক নকুলকে নিরস্ত্র করিয়া সন্নতপর্ব্বশরদ্বারা তাঁহাকে সাতিশয় পীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। অস্ত্রবিশারদ মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ এইরূপে মহাত্মা নকুলকে প্রহার করিলে তিনি সূতপুত্রকে প্রহার করিতে অসমর্থ হইয়া সহসা ব্যাকুলিতচিত্তে প্রস্থান করিতে লাগিলেন।

কর্ণকর্ত্তৃক নকুলের উপহাস

“তখন সূতপুত্র হাস্য করিয়া মাদ্ৰীতনয়ের পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া তাঁহার গলদেশে জ্যারোপিত কার্ম্মুক সমর্পণ করিলেন। পাণ্ডুনন্দন কর্ণের শরাসনে রুদ্ধকণ্ঠ হইয়া মণ্ডলমধ্যগত শশধরের ন্যায় কিংবা চক্ৰচাপশোভিত নিবিড় মেঘমণ্ডলের ন্যায় শোভমান হইলেন। অনন্তর মহাবীর কর্ণ মহাত্মা নকুলকে কহিলেন, ‘হে মাদ্ৰীতনয়! তুমি ইতিপূর্ব্বে বৃথা বাক্যব্যয় করিয়াছ। যাহা হউক, এক্ষণে লজ্জিত হইবার প্রয়োজন নাই। তুমি আর মহাবলপরাক্রান্ত কৌরবদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইও না। এখন হয় সদৃশ ব্যক্তির সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, না হয় গৃহে প্রতিগমন বা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের সমীপে গমন কর।’ হে মহারাজ! ধৰ্মাত্মা মহাবীর কর্ণ তৎকালে নকুলকে এইমাত্র বলিয়া পরিত্যাগ করিলেন। তিনি মাদ্ৰীতনয়কে ঐ সময় অনায়াসে বিনাশ করিতে পারিতেন, কিন্তু কুন্তীর বাক্য স্মরণ করিয়া তদ্বিষয়ে বিরত হইলেন। এইরূপে পাণ্ডুতনয় নকুল কর্ণকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া দুঃখিত মনে কুম্ভস্থিত ভুজঙ্গের ন্যায় নিশ্বাসপরিত্যাগ করিয়া লজ্জাবনত মুখে গমনপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের রথে আরোহণ করিলেন; মহাবীর সূতপুত্রও নকুলকে পরাজিত করিয়া অবিলম্বে শুভ্রবর্ণ অশ্বসংযুক্ত ও ভূরিপতাকাশোভিত রথে সমাসীন হইয়া পাঞ্চালগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। সেই মধ্যাহ্নকালে সেনাপতি সূতপুত্রকে পাঞ্চালগণের প্রতি ধাবমান দেখিয়া পাণ্ডবগণের মধ্যে মহা কোলাহল সমুত্থিত হইল। তখন মহাবীর কর্ণ চক্রাকারে পরিভ্রমণ করিয়া পাঞ্চালগণকে মর্দ্দিত করিতে লাগিলেন।

কর্ণসমরে পাণ্ডবপলায়ন

“হে মহারাজ! ঐ সময়ে কোন কোন সারথি চক্র, ধ্বজ, পতাকা, অশ্ব ও অক্ষবিহীন রথে অবসন্ন পাঞ্চালদেশীয় রথীগণকে লইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। রথকুঞ্জরসকল দাবানলে দগ্ধ হইয়া যেন রণস্থলে বিচরণ করিতে লাগিল। অন্যান্য করিগণ বিদীর্ণকুম্ভ, রুধিরাক্তকলেবর, বিরহিতশুণ্ড ও নিকৃক্তলাঙ্গুল হইয়া বিদলিত অভ্রখণ্ডের [মেঘ] ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। কোন কোনটা নারাচ, শর ও তোমরের আঘাতে ভয়বিহ্বল হইয়া হুতাশনে পতনোন্মুখ পতঙ্গের ন্যায় কর্ণের অভিমুখে গমন করিল, আর কোন কোনটা পরস্পরের আঘাতে শোণিত ক্ষরণ করিয়া জলস্রাবী পৰ্ব্বতের ন্যায় লক্ষিত হইল। অশ্বগণ ঊরুচ্ছদ গ্রথিতকেশর, স্বর্ণ, রৌপ্য ও কাংস্যময় আভরণ, কবিকা [লাগাম], চামর, চিত্রকম্বল, তূণীর এবং আরোহিবিহীন হইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিল। খড়্গ, প্ৰাস ও ঋষ্টিদ্বারা বিদ্ধ, কুঞ্চুক ও উষ্ণীষধারী। অশ্বারোহিগণের মধ্যে কেহ কেহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গবিহীন, কেহ কেহ নিহত, কেহ কেহ নিহন্যমান [প্রহারিত] ও কেহ কেহ বা কম্পিত হইতে লাগিল। রথীগণ নিহত হওয়াতে বেগগামী অশ্বসংযুক্ত, সুবর্ণমণ্ডিত রথসকল অক্ষ, কূবর, চক্র, ধ্বজ, পতাকা ও ঈশাদণ্ডবিহীন হইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিল। অসংখ্য রথী নিহত ও অনেকেই ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। অনেকে অস্ত্রহীন হইয়া এবং অনেকে অস্ত্রহীন না হইয়াই প্রাণত্যাগ করিল। তারকাজালসমাকীর্ণ উৎকৃষ্ট ঘণ্টাযুক্ত, বিচিত্রবর্ণ পতাকা পরিশোভিত বীরগণ চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। অসংখ্য মস্তক, ঊরুদেশ, বাহু এবং অন্যান্য অবয়ব সকল ছিন্ন হইয়া নিপতিত হইতে লাগিল।

“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর সূতপুত্রের সায়কপ্রভাবে যুদ্ধে প্রবৃত্ত যোধগণের দুর্দ্দশার আর পরিসীমা রহিল না। সৃঞ্জয়গণ সূতপুত্রের শরনিকরে বিদ্ধ হইয়া অনলে পতনোন্মুখ পতঙ্গের ন্যায় পুনরায় তাঁহারই অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। তখন হতাবশিষ্ট পাঞ্চালমহারথগণ সেই যুগান্তকালীন অগ্নির ন্যায় সেনানিপাতন মহারথ কর্ণের সম্মুখে থাকিতে না পারিয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ তাঁহাদিগের অনুসরণ ও শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া মধ্যাহ্নকালীন সূর্য্যের ন্যায় তাঁহাদিগকে সন্তাপিত করিতে লাগিলেন।”