২০. অর্জ্জুনের যুদ্ধপ্রশংসা-রণভূমিপ্রদর্শন

২০তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের যুদ্ধপ্রশংসা-রণভূমিপ্রদর্শন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে জয়শীল অর্জ্জুন দণ্ডধার ও দণ্ডের নিধনানন্তর প্রত্যাগত হইয়া মঙ্গলগ্রহের ন্যায় বক্রভাবে সঞ্চরণপূর্ব্বক পুনরায় সংশপ্তকগণকে নিহত করিতে আরম্ভ করিলেন। কৌরবপক্ষীয় অশ্ব, রথ, কুঞ্জর ও যোধগণ পার্থশরে নিপীড়িত হইয়া বিচলিত, ঘূর্ণিত, ম্লান, পতিত ও বিনষ্ট হইতে লাগিল। মহাবীর ধনঞ্জয় ভল্ল, ক্ষুর, অর্দ্ধচন্দ্র ও বৎসদন্ত [বাছুরের ছোট ছোট দাঁতের মত অস্ত্র] দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বী বীরগণের পরাক্রান্ত বাহন, ধ্বজ, শর, শরাসন, হস্তস্থিত শস্ত্র, বাহু, মস্তক ও সারথিসমুদয়কে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। বৃষভযূথ যেমন গাভীলাভার্থে অন্য বৃষভকে আক্রমণ করিতে অগ্রসর হয়, তদ্রূপ সহস্র সহস্র শূরগণ অর্জ্জুনকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইল। হে মহারাজ! ত্রৈলোক্যবিজয়কালে ইন্দ্রের সহিত দৈত্যগণের যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, এক্ষণে অর্জ্জুনের সহিত সেই বীরগণের তদ্রূপ লোমহর্ষণ, সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। ঐ সময় উগ্ৰায়ুধতনয় দন্দশূক [পুনঃ পুনঃ—অতিশয় দংশনকারী] সর্পের ন্যায় তিনশরে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিল। ধনঞ্জয় তাঁহার শরাঘাতে ক্রুদ্ধ হইয়া সত্বর তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন বর্ষাকালীন বায়ুপ্রেরিত মেঘমণ্ডল যেমন হিমালয়কে আবৃত করে, তদ্রূপ সেই বিপক্ষপক্ষীয় যোধগণ ক্রুদ্ধ হইয়া বিবিধ অস্ত্রদ্বারা অর্জ্জুনকে সমাচ্ছন্ন করিল। মহাবীর ধনঞ্জয় স্বীয় অস্ত্রনিকরে বিপক্ষপক্ষের অস্ত্রসমুদয় নিবারণপূর্ব্বক শরজালে বহুসংখ্যক বীরকে সংহার করিয়া রথীগণের ত্রিবেণু, আয়ুধ, তূণীর, চক্র, রথ, ধ্বজ, রশ্মি, যোক্ত্র, অক্ষ, রথের অধোভাগস্থ কাষ্ঠদ্বয়, বৰ্মসমুদয় এবং অসংখ্য অশ্ব, পার্ষ্ণি ও সারথিকে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অর্জ্জুনবিধ্বস্ত রথসমুদয় ধনিগণের অগ্নি, অনিল ও সলিলপ্রভাবে বিনষ্ট গৃহসমুদয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। মাতঙ্গগণ অশনিসদৃশ শরনিকরে ছিন্নকবচ হইয়া বজ্রাগ্নিনির্ভিন্ন [বজ্রের অগ্নিতে ভগ্ন] পর্ব্বতাগ্রস্থিত গৃহসমুদয়ের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইল। অশ্বগণ অর্জ্জুনের ভীষণ আঘাতে জিহ্বা ও অন্ত্র নির্গত হওয়াতে শোণিতার্দ্রকলেবরে ধরাশয্যা গ্রহণ করিল। অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্য অর্জ্জুনের নারাচে বিদ্ধ হইয়া শব্দায়মান ম্লান, বিঘূর্ণিত, স্থলিত ও নিপতিত হইতে লাগিল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় দৈত্যঘাতন মহেন্দ্রের ন্যায় শিলাধৌত অশনিসদৃশ শরনিকরে বিপক্ষপক্ষীয় অসংখ্য বীরকে নিহত করিলেন। মহামূল্য বর্ম্ম ও ভূষণে মণ্ডিত মহাস্ত্রধারী নানারূপ বীরগণ রথ ও ধ্বজের সহিত ধনঞ্জয়ের শরে নিহত হইয়া রণশয্যায় শয়ন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! ঐ যুদ্ধে পুণ্যকর্ম্মা, সৎকুলোদ্ভব, জ্ঞানসম্পন্ন বীরগণ নিহত হইয়া স্ব স্ব উৎকৃষ্ট কর্ম্মফলে স্বর্গারোহণ করিলেন; কেবল তাঁহাদের শরীর সমুদয় বসুধাতলে পতিত রহিল। অনন্তর নানা জনপদের অধ্যক্ষ জাতক্রোধ যোধগণ স্বগণসমভিব্যাহারে মহারথ অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলেন। গজারূঢ়, অশ্বারোহী, রথী ও পদাতিগণ জিঘাংসাপরবশ হইয়া বিবিধ শস্ত্রবর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার অভিমুখীন হইতে লাগিল। তখন মহাবীর অর্জ্জুন বায়ু যেমন মহামেঘনির্ম্মুক্ত বারিধারা নিবারণ করে, সেইরূপ নিশিতশরনিকরে সেই যোধগণপরিমুক্ত আয়ুধবর্ষণ নিবারণ করিয়া তাঁহাদিগকে অশ্ব, পদাতি, হস্তী ও রথসমুদয়ের সহিত বিধ্বস্ত করিতে আরম্ভ করিলেন।

“তখন মহাত্মা বাসুদেব অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! তুমি কেন বৃথা ক্রীড়া করিয়া সময় নষ্ট করিতেছ? সত্বর এই সংশপ্তকগণকে নিপাতিত করিয়া কর্ণবধের চেষ্টা কর। মহাবীর ধনঞ্জয় কৃষ্ণের বাক্য স্বীকার করিয়া দানবহন্তা ইন্দ্রের ন্যায় বলপ্রকাশপূর্ব্বক অবশিষ্ট সংশপ্তকগণকে নিপাতিত করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে মহাবীর অর্জ্জুন যে কখন শরগ্রহণ, কখন শরসন্ধান আর কখনই বা শরনিক্ষেপ করিলেন, তাহা অবহিত হইয়াও কেহ জানিতে পারিল না। মহাত্মা বাসুদেব অর্জ্জুনের হস্তলাঘব-দর্শনে চমৎকৃত হইলেন। হংসগণ যেরূপ সরোবরে প্রবিষ্ট হয়, তদ্রূপ সেই শুভ্রবর্ণ শরনিকর সৈন্যগণমধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল।

“এইরূপে সেই মহান্ জনসংক্ষয় সমুপস্থিত হইলে মহামতি কেশব সমরভূমি সন্দর্শন করিয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে পার্থ! এক দুর্য্যোধনের অপরাধে এই অতি ভয়ঙ্কর ভরতকুলক্ষয় ও পার্থিবগণের বিনাশ সমুপস্থিত হইয়াছে। ধনুর্দ্ধরগণের রাশি রাশি হেমপৃষ্ঠ কার্ম্মুক, শরমুষ্টি, তূণীর, সুবর্ণপুঙ্খ নতপর্ব্ব শর, নির্মোকনির্ম্মুক্ত পন্নগ-সদৃশ তৈলধৌত নারাচ, হেমভূষিত বিচিত্র তোমর, কনকপৃষ্ঠ চর্ম্ম, সুবর্ণনির্ম্মিত প্রাস, কনকভূষিত শক্তি, হেমসূত্ৰবেষ্টিত বিপুল গদা, সুবর্ণ যষ্ঠি, সুবর্ণমণ্ডিত পট্টিশ, সুবর্ণদণ্ডযুক্ত পরশু, ভীষণ পরিঘ, ভিন্দিপাল, ভূশুণ্ডী, লৌহময় প্রাস ও ভীষণ মুষল প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র নিপাতিত রহিয়াছে, জয়লোলুপ বীরগণ বিবিধ অস্ত্রধারণপূর্ব্বক নিহত হইয়াও জীবিতের ন্যায় দৃষ্ট হইতেছে। ঐ দেখ, সহস্র সহস্র যোদ্ধা গদাবিমথিতকলেবর, মুষলচুৰ্ণিতমস্তক এবং হস্তী, অশ্ব ও রথদ্বারা ক্ষতবিক্ষত হইয়া নিপতিত রহিয়াছে। শর, শক্তি, ঋষ্টি, তোমর, খড়্গ, প্রাস, পট্টিশ, নখর ও লগুড় প্রভৃতি অস্ত্রে ছিন্ন ভিন্ন ও রুধিরপরিপ্লুত মনুষ্য, অশ্ব ও হস্তীদিগের দেহে রণভূমি পরিপূর্ণ হইয়াছে। বীরগণের তলত্র [দস্তানা] ও অঙ্গদযুক্ত চন্দনদিগ্ধ বাহু, অঙ্গুলিত্ৰাণযুক্ত [দস্তানা] অলঙ্কৃত ভুজাগ্র, হস্তিশুণ্ডসদৃশ ঊরু এবং চূড়ামণি ও কুণ্ডলে অলঙ্কৃত মস্তকসমুদয়দ্বারা সমরভূমি অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। হেমকিঙ্কিণীযুক্ত রথসকল চূর্ণ হইয়া গিয়াছে; ঐ দেখ, অসংখ্য শোণিতলিপ্ত অশ্ব, রথাধঃস্থিত কাষ্ঠ, তূণীর, পতাকা, ধ্বজ, যোধগণের মহাশঙ্খ, পাণ্ডুরবর্ণ প্রকীর্ণক [চামর], নিস্তব্ধ রণশয়ান পর্ব্বতাকার মাতঙ্গ, বিচিত্র পতাকা, নিহত গজযোধী, মাতঙ্গগণের বিচিত্র কম্বল, গজচুৰ্ণিত ঘন্টা, বৈদূর্য্যমণিমণ্ডিত দণ্ড অঙ্কুশ, অশ্বগণের যুগশেখর, রত্নবিচিত্ৰ বর্ম্ম, সাদিগণের ধ্বজাগ্রে বন্ধ সুবর্ণমণ্ডিত চিত্রকম্বল, অশ্বগণের সুবর্ণখচিত মণিমণ্ডিত রাঙ্কব [মেষলোমনির্ম্মিত] আস্তরণ, ভূপালগণের কাঞ্চনমালা, চূড়ামণি, ছত্র ও চামরসকল নিপতিত রহিয়াছে। নরপতিদিগের কুণ্ডলালঙ্কৃত চন্দ্রনক্ষত্রপ্রভ, শ্মশ্রুলবদনমণ্ডল [দাড়িওয়ালা মুখসকল] সমন্তাৎ নিপতিত থাকাতে রণভূমি বিকশিত পদ্ম ও কুমুদযুক্ত সরোবরের ন্যায় ও শরৎকালীন চন্দ্রনক্ষত্র ভূষিত নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছে। হে অর্জ্জুন! এই সমুদয় অবলোকনে বোধ হইতেছে যে, তুমি সমরস্থলে আপনার অনুরূপ কর্ম্ম করিয়াছ। তুমি যেরূপ যুদ্ধ করিয়াছ, দেবরাজ ভিন্ন আর কাহারও এরূপ করিবার সাধ্য নাই।’

“হে মহারাজ। অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন মহাত্মা বাসুদেব অর্জ্জুনকে এইরূপে সমরভূমি প্রদর্শনপূর্ব্বক গমন করিতে করিতে দুর্য্যোধনের বলমধ্যে শঙ্খ, দুন্দুভি, ভেরী পণবের [মর্দ্দলের] ধ্বনি এবং হস্তী, অশ্ব, রথ ও অস্ত্রের তুমুল শব্দ শ্রবণ করিলেন। তখন তিনি সেই বায়ুবেগগামী অসমুদয় সঞ্চালনপূর্ব্বক তথায় প্রবেশ করিয়া পাণ্ড্যরাজকে কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণকে শরপীড়িত করিতে দেখিয়া অতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। ঐ সময় অস্ত্রবিশারদ মহাবীর পাণ্ড্য অন্তকের ন্যায়, অসুরনিপাতী ইন্দ্রের ন্যায় নানাবিধ অস্ত্রদ্বারা অরাতিগণের সায়ক-সমুদয় ছেদনপূর্ব্বক অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যের দেহ বিদারণ করিয়া তাহাদিগকে নিপাতিত করিতেছিলেন।”