১৮. অর্জ্জুনসহযুদ্ধে অশ্বত্থামার পলায়ন

১৮শ অধ্যায়

অর্জ্জুনসহযুদ্ধে অশ্বত্থামার পলায়ন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! তখন নভোমণ্ডলস্থ শুক্র ও বৃহস্পতির ন্যায় মহাবীর অশ্বত্থামা ও অর্জ্জুনের ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইল। সেই লোকভীষণ বীরদ্বয় বিমার্গস্থ [বক্র অতিচারাদি গতিযুক্ত—উপদ্ৰবকারক] গ্রহদ্বয়ের ন্যায় পরস্পরকে শরনিকরে সন্তাপিত করিতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন নারাচদ্বারা দ্রোণপুত্রের মধ্য বিদ্ধ করিলে অশ্বত্থামা ঊর্দ্ধরশ্মি সূর্য্যের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন; কৃষ্ণ-সমবেত অর্জ্জুনও অশ্বত্থামার শত শত শরে সাতিশয় বিদ্ধ হইয়া রশ্মিজালজড়িত যুগান্তকালীন দিবাকরদ্বয়ের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাত্মা বাসুদেব অশ্বত্থামার শরে অভিভূত হইলে অর্জ্জুন চতুর্দ্দিকে শতধারা সৃষ্টি করিয়া বজ্ৰাগ্নিসদৃশ প্রাণনাশক শরনিকরে দ্রোণপুত্রকে আহত করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন তেজস্বী রৌদ্রকর্ম্মা দ্রোণকুমার মৃত্যুরও ব্যথাজনক অতি তীব্ৰবেগসম্পন্ন সুমুক্ত শরজালে বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর, দ্রোণপুত্র যতগুলি শর পরিত্যাগ করিলেন, মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয় তাহা অপেক্ষা দ্বিগুণ বাণ নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার সায়কনিকর নিবারণপূর্ব্বক তাঁহাকে অশ্ব, সারথি ও ধ্বজের সহিত আবৃত করিয়া সংশপ্তক-সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। সুমুক্ত শরজালে অপরাঙ্মুখ শত্রুগণের শর, শরাসন, তূণীর, মৌর্ব্বী, হস্ত, করস্থিত, শস্ত্র, ছত্র, ধ্বজ, মনোহর বস্ত্র, মাল্য, ভূষণ, চৰ্ম্ম, বর্ম্ম এবং মস্তকসমূহ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সুসজ্জিত রথ, নাগ ও অশ্বসমুদয়ে সমারূঢ় যোধগণ অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত অসংখ্যশরে বাহনগণের সহিত বিদ্ধ হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তাঁহাদের পূর্ণচন্দ্র, সূৰ্য্য ও কমলের ন্যায় মনোহর কিরীট ও মাল্য প্রভৃতি বিবিধ ভূষণে ভূষিত মস্তকসকল ভল্ল, অর্দ্ধচন্দ্র ও ক্ষুরদ্বারা ছিন্ন হইয়া নিরন্তর ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল।

“তখন অরাতিঘাতন অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ ও নিষাদদেশীয় বীরগণ গজাসুরতুল্য মাতঙ্গসমুদয় লইয়া দৈত্যদর্পনিসূদন ধনঞ্জয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় সেই গজযুথের চর্ম্ম, বর্ম্ম, শুণ্ড, ধ্বজ, পতাকা ও নিষাদি সমুদয়কে ছেদন করিয়া বজ্রাহত গিরিশৃঙ্গের ন্যায় ভূতলে পাতিত করিলেন। এইরূপে সেই গজসৈন্য ছিন্নভিন্ন হইলে মহাবীর ধনঞ্জয় বায়ু যেমন মহামেঘ দ্বারা দিবাকরকে সমাচ্ছন্ন করিত সেইরূপ অশ্বত্থামাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা স্বীয় শরনিকরে অর্জ্জুনের শরসমুদয় নিবারণপূর্ব্বক বর্ষাকালীন জলদজাল যেমন চন্দ্রসূৰ্য্যকে তিরোহিত করিয়া গভীর গর্জন করে, তদ্রূপ বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন অশ্বত্থামার শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া পুনরায় তাঁহার সৈন্যগণের প্রতি শরপ্রয়োগে প্রবৃত্ত হইলেন এবং সহসা দ্রোণপুত্রের শরান্ধকার নিরাস করিয়া সুপুঙ্খসায়কদ্বারা তাঁহার সৈন্যগণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তিনি যে কখন শরসন্ধান, কখন শরগ্রহণ আর কখনই বা শর পরিত্যাগ করিলেন, তাহা কিছুই লক্ষিত হইল না; কেবল তাঁহার বিপক্ষে যুধ্যমান রথী, অশ্বারোহী, গজারোহী ও পদাতিগণকে শরবিদ্ধকলেবর ও নিহত হইতে নয়নগোচর হইল। তখন মহাবীর দ্ৰোণতনয় অতি সত্বর এককালে দশ নারাচ সন্ধানপূর্ব্বক নিক্ষেপ করিলে তন্মধ্যে পাঁচটি অর্জ্জুনের ও পাঁচটি কেশবের অঙ্গ বিদ্ধ করিল। কুবের ও ইন্দ্রের তুল্য মনুজপ্রধান কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় সেই সমুদয় নারাচে আহত হইয়া রুধির ক্ষরণপূর্ব্বক নিতান্ত অভিভূত হইলেন। তদ্দর্শনে সকলেই তাঁহাদিগকে নিহত বলিয়া বোধ করিল। তখন দশার্হনাথ কেশব অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! আর কেন উপেক্ষা করিতেছ, অশ্বত্থামাকে অবিলম্বে বিনাশ কর। উঁহাকে উপেক্ষা করিলে উনি প্রতিকারশূন্য ব্যাধির ন্যায় নিতান্ত কষ্টকর হইয়া উঠিবেন।’ প্রমাদশূন্য অর্জ্জুন অচ্যুতের বাক্য স্বীকার করিয়া যত্নসহকারে গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত মেষকৰ্ণতুল্যাগ্রে শরনিকরে দ্রোণতনয়ের চন্দনদিগ্ধ বাহু, বক্ষস্থল, মস্তক ও অনুপম উরুদেশ ক্ষতবিক্ষত করিয়া রথরশ্মি ছেদনপূর্ব্বক অশ্বগণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। অশ্বগণ অর্জ্জুনশরনিপীড়িত হইয়া অশ্বত্থামাকে লইয়া অতি দূরে পলায়ন করিল। মতিমান দ্রোণতনয় ইতিপূৰ্বে অর্জ্জুনের শরনিকরে নিতান্ত ব্যথিত ও হীনাস্ত্র হইয়াছিলেন, এক্ষণে সেই বায়ুবেগগামী তুরঙ্গমগণকর্ত্তৃক দূরে সমানীত হইয়া ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের জয় নিশ্চয় করিয়া আজ ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধ করিতে বাসনা করিলেন না। তিনি হতোৎসাহ হইয়া অশ্বগণকে নিয়ন্ত্রিত করিয়া সূতপুত্রের রথাশ্বনরসঙ্কুল বলমধ্যে প্রবেশ করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে পাণ্ডবগণের প্রবল শত্রু অশ্বত্থামা মন্ত্রৌষধিনিরাকৃত ব্যাধির ন্যায় রণস্থল হইতে অপসারিত হইলে কেশব ও অর্জ্জুন বায়ুবিকম্পিত পতাকাযুক্ত মেঘগভীরনিঃস্বন স্যন্দনে সমারূঢ় হইয়া সংশপ্তকগণের অভিমুখে গমন করিলেন।’