১১. যুদ্ধার্থ অশ্বত্থামাদির মন্ত্রণা

১১দশ অধ্যায়

যুদ্ধার্থ অশ্বত্থামাদির মন্ত্রণা

সঞ্জয় কহিলেন, “হে কুরুরাজ! মহাধনুর্দ্ধর দ্রোণাচার্য্যের নিধনদিবসে মহারথ দ্রোণপুত্রের প্রতিজ্ঞা ব্যর্থ ও কৌরবসৈন্যগণ ইতস্ততঃ ধাবমান হইলে, মহাবীর অর্জ্জুন ভাতৃগণে পরিবেষ্টিত হইয়া স্বীয় সৈন্যসমুদয় রক্ষা করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন অর্জ্জুনকে রণস্থলে অবস্থান ও স্বীয় সৈন্যগণকে পলায়ন করিতে অবলোকন করিয়া পুরুষকার প্রকাশপূর্ব্বক তাহাদিগকে নিবারণ করিলেন এবং স্বীয় ভুজবলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত জয়লাভপ্রহৃষ্ট পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া পরিশেষে সন্ধ্যাসময় সমাগত সন্দর্শন করিয়া সমরে বিরত হইলেন। তখন কৌরবগণ সৈন্যগণের অবহার করিয়া স্বীয় শিবিরমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক সকলে সমবেত ও অতিরমণীয় আস্তরণসমাবৃত মহাৰ্হ পৰ্য্যঙ্কে আসীন হইয়া সুখশয্যাধিরূঢ় অমরগণের ন্যায় পরস্পর মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে রাজা দুৰ্য্যোধন সুমধুর প্রিয়বচনে সেই সমস্ত মহাধনুর্দ্ধরদিগকে সম্ভাষণপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ধীমান নরপালগণ! যাহা হইবার হইয়াছে, এক্ষণে কি করা কর্ত্তব্য, তদ্বিষয়ে অবিলম্বে স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত কর।’

“হে মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন এইরূপ কহিলে সিংহাসনাধিরূঢ় যুদ্ধার্থী নরগতিগণ বিবিধ চেষ্টাদ্বারা সমরাভিলাষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তখন বাক্যজ্ঞ মেধাবী আচার্য্যপুত্র অশ্বত্থামা প্রাণত্যাগে উদ্যত নরপালগণের ইঙ্গিত অবগত হইয়াও রাজা দুৰ্য্যোধনের বালার্কসদৃশ [নবোদিত সূৰ্য্যতুল্য] মুখমণ্ডল সন্দর্শন করিয়া কহিলেন, “হে বীরগণ! পণ্ডিতেরা স্বামীভক্তি, দেশকালাদি সম্পত্তি, রণপটুতা ও নীতি— এই কয়েকটি যুদ্ধের সাধন বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন; কিন্তু এই সকল উপায়ে দৈববল অপেক্ষা করে আমাদিগের যে সমস্ত দেবতুল্য লোকপ্রবীর মহারথগণ নীতিজ্ঞ, রণদক্ষ, প্রভুপরায়ণ ও নিয়ত যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁহারা সকলেই নিহত হইয়াছেন; কিন্তু তন্নিবন্ধন জয়াশা পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য নহে। সুনীতি প্রয়োগ করিলে দৈবকেও অনুকূল করা যাইতে পারে; অতএব আজ আমরা সর্ব্বগুণান্বিত নরশ্রেষ্ঠ মহাবীর কর্ণকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করিয়া শত্রুগণকে বিনাশ করিব। মহাবলপরাক্রান্ত সূতপুত্র অস্ত্রবিশারদ, যুদ্ধদুর্ম্মদ ও অন্তকের ন্যায় অসহ্য। উনি অনায়াসে সমরাঙ্গনে শত্রুগণকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবেন।’

কর্ণের সৈনাপত্যে অশ্বত্থামাদির অনুমোদন

“হে মহারাজ! আপনার আত্মজ দুৰ্য্যোধন আচাৰ্য্যতনয়ের মুখে সেই পরমপ্রিয় হিতকর বাক্য শ্রবণ করিয়া যৎপরোনাস্তি প্রীত হইলেন। ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য্যের নিধনের পর মহাবীর কর্ণ পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিবে বলিয়া তাঁহার মনে মহতী আশা সঞ্জাত হইল। তখন তিনি আশ্বাসযুক্ত হইয়া বাহুবল অবলম্বনপূর্ব্বক সুস্থিরচিত্তে সূতপুত্রকে কহিলেন, ‘হে কর্ণ! আমি তোমার বলবীৰ্য্য ও আমার সহিত পরম সৌহার্দের বিষয়ে বিশেষরূপে অবগত আছি; তথাপি তোমাকে এই হিতকথা কহিতেছি, ইহা শ্রবণ করিয়া তোমার যাহা অভিরুচি হয়, কর। তুমি বিজ্ঞতম এবং আমারও তোমা ভিন্ন আর গতি নাই। আমার সেনাপতি মহারথ ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য্য নিহত হইয়াছেন। তুমি তাঁহাদিগের অপেক্ষা বলবান, অতএব তুমি সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হও। সেই মহাধনুর্দ্ধরদ্বয় বৃদ্ধ ও ধনঞ্জয়ের পক্ষে ছিলেন। আমি তোমার বাক্যানুসারে তাঁহাদিগকে বীর বলিয়া গণনা করিতাম। মহাবীর ভীষ্ম পিতামহ বলিয়াই দশ দিবস পাণ্ডুতনয়গণকে রক্ষা করিয়াছিলেন। পরিশেষে তুমি অস্ত্র পরিত্যাগ করিলেই ধনঞ্জয় শিখণ্ডীকে পুরোবৰ্ত্তী করিয়া মহাবীর ভীষ্মকে নিহত করিয়াছে। পিতামহ শরশয্যায় শয়ান হইলে তোমার বাক্যানুসারে দ্রোণাচাৰ্য্য সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। আমার বোধ হয়, তিনি শিষ্য বলিয়াই পাণ্ডবগণকে রক্ষা করিতেন। যাহা হউক, আজ তিনিও ধৃষ্টদ্যুম্নের হস্তে নিহত হইয়াছেন। হে কর্ণ! এক্ষণে তোমার সদৃশ অমিত পরাক্রম যোদ্ধা আর কাহাকেও নয়নগোচর হয় না। তোমা হইতেই আমাদিগের জয়লাভ হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। তুমি পূর্ব্বাপর আমাদিগের হিতসাধন করিতেছ। অতএব তুমি রণধুরন্ধর [সর্ব্বপ্রধান যোদ্ধা] হইয়া আপনি আপনাকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত কর। কার্ত্তিকেয় যেমন সুরগণের সেনাপতি হইয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমিও কৌরবদিগের সেনাপতি হইয়া সৈন্যগণকে রক্ষা করিয়া দৈত্যনিসূদন মহেন্দ্রের ন্যায় শত্ৰুনিপাতনে নিযুক্ত হও। দানবেরা পুরুষোত্তম বিষ্ণুকে অবলোকন করিয়া যেমন পলায়ন করিয়াছিল, তদ্রূপ মহারথ পাণ্ডব, সৃঞ্জয় ও পাঞ্চালগণ তোমাকে সমরে সমবস্থিত সন্দর্শন করিয়া অমাত্যসমভিব্যাহারে পলায়ন করিবে। অতএব দিবাকর যেমন অভ্যুদিত হইয়া স্বীয় তেজঃপ্রভাবে গাঢ়ান্ধকার উচ্ছেদ করেন, তদ্রূপ তুমি মহতী সেনা লইয়া অরাতিগণকে নিপাতিত কর। অর্জ্জুন কখনই তোমার সমক্ষে অবস্থানপূর্ব্বক যুদ্ধ করিতে পারিবে না।’

কর্ণের সেনাপতিত্ব গ্রহণ

“মহাবীর কর্ণ দুর্য্যোধনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, হে কুরুরাজ! আমি পূৰ্বেই তোমাকে বলিয়াছি যে, পাণ্ডবগণকে তাহাদের পুত্রগণ ও জনার্দ্দনের সহিত পরাজিত করিব। যাহা হউক, এক্ষণে আমি তোমার সেনাপতি হইব, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। অতএব তুমি প্রশান্তচিত্ত হইয়া পাণ্ডবগণকে পরাজিত বলিয়া স্থির কর।’ হে মহারাজ! আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন কর্ণকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন এবং সুরপতি যেমন দেবগণের সহিত উত্থিত হইয়া কাৰ্ত্তিকেয়কে সেনাপতিত্বে বরণ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ বিজয়াভিলাষী অন্যান্য ভূপালগণের সহিত গাত্রোত্থানপূর্ব্বক সুবর্ণময় ও মৃন্ময় পূর্ণকুম্ভ, হস্তী, গণ্ডার ও বৃষের বিষাণ, বিবিধ সুগন্ধি ঔষধ এবং সুসম্ভৃত অন্যান্য -উপকরণদ্বরা ক্ষৌমাচ্ছাদিত [পট্টবস্ত্ৰবেষ্টিত] তাম্রময় আসনে আসীন মহাবীর কর্ণকে বিধিপূর্ব্বক সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করলেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রগণ সেই বরাসনসমাসীন সূতপুত্রের স্তুতিবাদ করিতে লাগিলেন। অরাতিঘাতন কর্ণ এইরূপে সৈনাপত্যে অভিষিক্ত হইয়া বিপ্রগণকে নিষ্ক, ধন ও গোসমূহ প্রদানপূর্ব্বক তাঁহাদের আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করিলেন। তখন ব্রাহ্মণ ও বন্দিগণ কর্ণকে কহিলেন, ‘হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! সূৰ্য্য যেমন সমুদিত হইয়া উগ্র কিরণজালে তমোরাশি ধ্বংস করিয়া থাকেন, তদ্রূপ তুমি মহারণে অনুচরগণসমবেত কৃষ্ণসহায় পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে সংহার কর। উলূকীগণ [পেচক—পেঁচা] যেমন সূৰ্য্যরশ্মি-সন্দর্শনে অসমর্থ, তদ্রূপ কেশবসমবেত পাণ্ডবগণ কর্ণনিক্ষিপ্ত শরনিকর অবলোকন করিতে কোন মতেই সমর্থ নহে। দানবগণ যেমন সংগ্রামে গৃহীতশস্ত্র পুরন্দরের অগ্রে অবস্থান করিতে সমর্থ হয় নাই, তদ্রূপ পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ তোমার অগ্রে অবস্থান করিতে অক্ষম হইবে।’ হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ এইরূপে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হইয়া অমিততেজঃপ্রভাবে দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। আপনার পুত্র কালপ্রেরিত দুর্য্যোধন কর্ণকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করিয়া আপনাকে কৃতার্থ বোধ করিলেন। তখন মহাবীর সূতপুত্র প্রাতঃকালে সৈন্যগণকে সমবেত হইতে আজ্ঞাপ্রদানপূর্ব্বক আপনার পুত্রগণের সহিত মিলিত হইয়া তারকাসুরসংগ্রামে দেবগণে পরিবৃত কাৰ্ত্তিকেয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।”