০৭. কৌরবপক্ষীয় হতাবশিষ্ট বীরগণ-বৃত্তান্ত

৭ম অধ্যায়

কৌরবপক্ষীয় হতাবশিষ্ট বীরগণ-বৃত্তান্ত

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! যখন অস্মৎপক্ষীয় প্রধান প্রধান বীরগণ নিহত হইয়াছেন, তখন আমাদের হতাবশিষ্ট সৈন্যগণও নিঃশেষিত হইবে। মহাবীর ভীষ্মদেব ও দ্রোণাচাৰ্য্য আমার কাৰ্য্যসাধনে প্রবৃত্ত হইয়া কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, অতএব আমার আর জীবিত থাকিবার প্রয়োজন কি? যে মহাবীর লক্ষ কুঞ্জরতুল্য বাহুবলশালী ছিল, সেই সমরশোভী সূতপুত্রও একেবারে অদৃশ্য হইয়াছে। হে সঞ্জয়! আমাদের যে সমস্ত প্রধান প্রধান বীর নিহত হইয়াছে, তাহা কহিলে, এক্ষণে কে কে জীবিত আছে, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর। আজ তোমার মুখে অসাধারণ বলবীৰ্য্যসম্পন্ন বীরগণের নিধনবাৰ্তাশ্রবণে, যাহারা জীবিত আছে, তাহাদিগকেও আমার মৃত বলিয়া বোধ হইতেছে।”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! দ্বিজসত্তম দ্রোণাচার্য্য যাঁহাকে বিশুদ্ধ চতুর্ব্বিধ মহাস্ত্র ও দিব্যাস্ত্রজাল প্রদান করিয়াছেন, সেই ক্ষিপ্রহস্ত দৃঢ়ায়ুধ বীৰ্য্যবান মহারথ অশ্বত্থামা এবং দ্বারকাবাসী হৃদিকাত্মজ ভোজরাজ কৃতবর্ম্মা আপনাদের হিতার্থ সমরে সমবস্থিত রহিয়াছেন। যিনি আপনার বাক্য সত্য করিবার নিমিত্ত ভাগিনেয় পাণ্ডবগণকে পরিত্যাগ করিয়াছেন, যিনি যুধিষ্ঠিরের সমক্ষে ‘কর্ণের তেজ নিরাশ করিব’ বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, সেই শত্রুসমানবীর্য্য দুরাধর্ষ আৰ্ত্তায়ননন্দন শল্য আপনাদের হিতসাধনার্থ যুদ্ধার্থী হইয়াছেন। মহাবীর গান্ধাররাজ আপনার হিতার্থ আজানেয়, সৈন্ধব, নদীজ, কম্বোজ, বনায়ুজ ও পাৰ্বতীয়গণসমভিব্যাহারে সংগ্রামস্থলে উপস্থিত রহিয়াছেন। চিত্রযোধী মহাবাহু কৃপ বিচিত্র শরাসন সমুদ্যত করিয়া এবং মহারথ কেকয়রাজপুত্র সদশ্ব ও পতাকাযুক্ত রথে সমারূঢ় হইয়া আপনার হিতকামনায় যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইয়াছেন। আপনার পুত্র পুরুমিত্র অনল ও সূৰ্য্যসদৃশ প্রভাসম্পন্ন রথে আরোহণপূর্ব্বক মেঘরহিত গগনমণ্ডলে বিরাজমান সূর্য্যের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। পুরুষপ্রধান রাজা দুর্য্যোধন অসংখ্য মাতঙ্গের মধ্যস্থলে অবস্থানপূর্ব্বক মৃগেন্দ্রের ন্যায় এবং সুবর্ণবিচিত্র বর্ম্ম ধারণপূর্ব্বক হেমভূষিত রথে আরোহণ করিয়া অল্পধূম বহ্নির ন্যায় ও মেঘান্তরিত দিবাকরের ন্যায় রাজগণমধ্যে বিরাজমান রহিয়াছেন। আপনার পুত্র অসিচর্ম্মপাণি [ঢাল-তরবালধারী] সুষেণ ও সত্যসেন চিত্রসেনের সহিত মিলিত হইয়া আদিতচিত্তে সমরবাসনায় অবস্থান করিতেছেন। মহাবীর ক্ষণভোজী, সুদর্শ, জরাসন্ধের প্রথম পুত্র অদৃঢ়, চিত্রায়ুধ, জয়, শ্রুতিবর্ম্মা, শল্য, সত্যব্রত ও দুঃশল-ইঁহারা সংগ্রামার্থ প্রস্তুত রহিয়াছেন। শত্রুঘাতক শূরাভিমানী রাজপুত্ৰকৈতব্যাধিপতি অসংখ্য রথ, অশ্ব, হস্তী ও পদাতিসমভিব্যাহারে সমরে অবস্থান করিতেছেন। মহাবীর শ্রুতায়ু, ধৃতায়ুধ, চিত্রাঙ্গদ ও চিত্রসেন এবং কর্ণের পুত্র সত্যসন্ধ- ইঁহারা সংগ্রামার্থ সৈন্যগণসমভিব্যাহারে সমস্থলে সমবস্থিত রহিয়াছেন। মহাবীর কর্ণের আর দুই পুত্র অল্পবীৰ্য্যসম্পন্ন সৈন্যগণসমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের প্রভূত সৈন্য আক্রমণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন। ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন বিজয়কামনায় এই সমুদয় ও অন্যান্য অপরিমিত প্রভাবশালী শ্রেষ্ঠ যোধগণে সমবেত হইয়া প্রভূত মাতঙ্গসৈন্যমধ্যে অবস্থান করিতেছেন।”

ধৃতরাষ্ট্রের শোকজনিত মহামোহাবেশ

ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের বাক্য শ্রবণানন্তর কহিলেন, “হে সঞ্জয়! অস্মৎপক্ষীয় যে যে বীরগণ বিপক্ষের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়া জীবিত রহিয়াছে, তাহাদের নাম কীৰ্ত্তন করিলে। তুমি ইতিপূর্ব্বে মৃতব্যক্তিগণের নাম উল্লেখ করাতেই আমি কোন্ কোন্ ব্যক্তি জীবিত রহিয়াছে, তাহা অবগত হইয়াছি।”

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! রাজা ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ বলিতে বলিতে শ্রেষ্ঠ বীরগণের বিনাশ ও সৈন্যের অল্পমাত্র অবশেষবার্ত্তাশ্রবণজনিত শোকে নিতান্ত ব্যাকুলিত ও মূর্চ্ছিতপ্রায় হইয়া কহিলেন, “হে সঞ্জয়! ক্ষণকাল বিলম্ব কর, এই সুদারুণ অমঙ্গল সংবাদ শ্রবণ করিয়া আমার মন নিতান্ত ব্যাকুলিত ও অঙ্গসকল অবসন্ন হইয়াছে, আমি কোনক্রমেই সুস্থির হইতে পারিতেছি না।” কুরুরাজ সঞ্জয়কে এই কথা কহিয়া নিতান্ত উদ্ভ্রান্তচিত্ত হইলেন।