১৯২. শিখণ্ডীর পুরুষত্বপ্রাপ্তি

১৯২তম অধ্যায়

শিখণ্ডীর পুরুষত্বপ্রাপ্তি

ভীষ্ম কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! দৈবাপহত [ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত—অদৃষ্টদোষে বিড়ম্বিত] যক্ষ শিখণ্ডীর বাক্যশ্রবণ ও মনে মনে চিন্তা করিয়া কহিল, “হে ভদ্রে! আমাকে দুঃখভোগের নিমিত্ত স্ত্রীবিগ্ৰহ পরিগ্রহ করিতে হইবে, অতএব এই অবকাশে আমি তোমার অভীষ্টসাধন করিব। কিন্তু আমার সহিত একটি সময় [প্রতিজ্ঞা-শপথ] নির্দ্দেশ করিতে হইবে। আমি কিয়ৎকালের নিমিত্ত তোমাকে আমার পুরুষাকৃতি প্ৰদান করিব। কিন্তু তোমাকে কালক্রমে এই স্থানে আগমন করিয়া উহা প্রত্যাৰ্পণ করিতে হইবে; অগ্ৰে এইটি সত্য করিয়া বল। আমি কামচারী [ইচ্ছানুরূপ গতিশীল] ও গগনবিহারী, তুমি আমার অনুগ্রহে স্বীয় নগর ও বন্ধুবৰ্গকে রক্ষা কর। তুমি প্রতিজ্ঞা করিলে পর আমি তোমার স্ত্রীরূপধারণ ও প্রিয়ানুষ্ঠান করিব।”

“শিখণ্ডিনী কহিলেন, “হে নিশাচরণ [রাক্ষস—যক্ষ রাক্ষসজাতীয়]! আমি কিয়াৎ কালান্তর পুরুষাকৃতি আপনাকে প্রত্যপণ করিব। আপনি কিয়াৎকালের নিমিত্ত স্ত্রীরূপ ধারণ করুন। দশার্ণাধিপতি প্রতিনিবৃত্ত হইলে আমি পুনরায় স্বরূপপ্রাপ্ত হইব; আপনিও পুরুষত্বলাভ করিবেন।’

তাঁহারা এইরূপ পরস্পর শপথ করিয়া লিঙ্গপরিবর্ত্তন [স্ত্রী পুরুষচিহ্নের অদল-বদল] করিলে স্থূণাকৰ্ণ স্ত্রীরূপ ও শিখণ্ডিনী প্ৰদীপ্ত যক্ষরূপপ্রাপ্ত হইলেন।

“অনন্তর শিখণ্ডিনী হৃষ্টমনে নগরপ্রবেশ ও দ্রুপদসন্নিধানে গমন করিয়া আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। দ্রুপদরাজ তাহা শ্রবণ করিয়া একান্ত হৃষ্ট ও নিতান্ত সন্তুষ্ট হইলেন। তখন ভগবান শূলপাণির বাক্য তাঁহার ও তাঁহার মহিষীর স্মৃতিপথে আরূঢ় হইল।

পুনঃ পুত্ৰত্ব-প্রতিপাদক সংবাদ-পুনঃ অনুসন্ধান

“অনন্তর তিনি দশার্ণাধিপতি সুবর্ণবর্ম্মার নিকট এই সংবাদ প্রেরণ করিলেন যে, মহারাজ! আমার পুত্র পুরুষ, আপনি এ কথায় কদাচ অবিশ্বাস করিবেন না।”

“অনন্তর রাজা হিরণ্যবর্ম্মা দুঃখশোকসমন্বিত হইয়া কম্পিল্যনগরে আগমনপূর্ব্বক এক ব্ৰাহ্মণকে যথোচিত সৎকার করিয়া কহিলেন, “মহাশয়! আপনি আমার বাক্যানুসারে সেই নৃপাধম দ্রুপদকে বলিবেন,-হে দুৰ্মতে! তুমি যে আপনার কন্যার নিমিত্ত আমার কন্যাকে প্রার্থনা করিয়াছিলে, আজি সেই অহঙ্কারের প্রতিফল অবশ্যই প্রাপ্ত হইবে।”

“তখন পুরোহিত ব্ৰাহ্মণ দ্রুপদভবনে প্রবেশপূর্ব্বক দ্রুপদরাজের সম্মুখে সমুপস্থিত হইলেন। দ্রুপদরাজ ও শিখণ্ডী তাঁহাকে গো ও অর্ঘ্য প্রদানপূর্ব্বক পূজা করিলেন। ব্রাহ্মণ তদ্দত্ত পূজা প্রতিগ্রহ না করিয়া, মহারাজ হিরণ্যবর্ম্মা যেরূপ কহিয়াছিলেন, তাহাই করিতে লাগিলেন,-“হে দুরাশয়! তুমি যে আমাকে প্রতারণা করিয়াছিলে, আজ সেই পাপের প্রতিফল প্রাপ্ত হইবে। এক্ষণে তুমি আমার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। আমি তোমাকে, তোমার পুত্র, অমাত্য ও বন্ধুবান্ধবগণকে বিনাশ করিব।”

প্ৰকৃতাবস্থা-পরিজ্ঞাত হিরণ্যবর্ম্মার রোষশান্তি

“মহারাজ দ্রুপদ মন্ত্রিগণমধ্যে পুরোহিতমুখে এইরূপ তিরস্কারবাক্য শ্রবণ করিয়া প্রীতিপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন্! আপনি মহারাজ সুবর্ণবর্ম্মার বচনানুসারে আমাকে যাহা কহিলেন, আমার এক দূত গমন করিয়া তাঁহাকে প্রত্যুত্তর প্রদান করিবে।” এই বলিয়া দ্রুপদ হিরণ্যবর্ম্মার নিকট বেদপারগ এক ব্রাহ্মণকে প্রেরণ করিলেন। ব্রাহ্মণ দশার্ণাধিপতির সন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ! শিখণ্ডী পুরুষ; আপনি বরং তাহা পরীক্ষা করুন। বোধহয়, কোন ব্যক্তি আপনার নিকট মিথ্যা কহিয়া থাকিবে; আপনি তাহাতে শ্রদ্ধা প্ৰদৰ্শন করিবেন না।”

“তখন দশার্ণাধিপতি একান্ত চিন্তিত হইয়া শিখণ্ডী স্ত্রী কি পুরুষ, ইহা সবিশেষ বিদিত হইবার নিমিত্ত সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী রমণীগণকে প্রেরণ করিলেন। তাহারা তত্ত্বাৰ্থ [যথার্থ-যথাযথ ঘটনা] অবগত হইয়া দশার্ণাধিপতিকে কহিল, “মহারাজ! শিখণ্ডী পুরুষ, তদ্বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নাই।” রাজা এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র অতিমাত্র প্রীশ্ৰীতিপ্ৰাপ্ত হইলেন এবং দ্রুপদরাজের ভবনে সমাগত হইয়া হৃষ্টমনে অবস্থান করিতে লাগিলেন। পরে তিনি শিখণ্ডীকে হস্তী, অশ্ব, গো, বহুসংখ্যক দাসী ও প্রভূত অর্থ প্ৰদান করিয়া স্বীয় দুহিতাকে ভৎসনা করিয়া নিজ রাজধানীতে প্ৰস্থান করিলেন। দশার্ণাধিপতি রোষমুক্ত [বিগতক্ৰোধ] ও পরামপ্রীত হইয়া প্রস্থান করিলে শিখণ্ডীও নিতান্ত সন্তুষ্ট হইলেন।

অনুচর-গৃহাগত কুবেরের ক্ৰোধ

“কিয়ৎকাল অতীত হইলে একদা ধনাধিপতি কুবের লোকযাত্ৰা [এক লোক হইতে অন্যলোকে বিচরণ ব্যাপার] নির্ব্বাহ করিবার নিমিত্ত স্থূণাকর্ণের গৃহাভিমুখে আগমন করিলেন এবং গৃহের উপরিভাগ হইতে সেই প্রাসাদ বিচিত্র মাল্যসমলঙ্কৃত, উশীরগন্ধামোদিত, ধূপধূপিতা [সুগন্ধ ধূপধুমে আমোদিত], বিতানধ্বজপতাকা-পরিশোভিত [চন্দ্ৰতাপধ্বজপতাকাশোভিত], অন্নপানমিষপরিপূর্ণ [মাংসাদি উপকরণসহ অন্ন ও পানীয় পূর্ণ] ও মণিরত্নসুবর্ণমণ্ডিত অবলোকন করিয়া তাঁহার অনুচরদিগকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, ‘স্থূণাকর্ণের গৃহ পরম সুশোভিত দেখিতেছি; কিন্তু সেই মূঢ় কেন আজি আমার নিকট আগমন করিতেছে না? আমি এই স্থানে আগমন করিয়াছি, ইহা অবগত হইয়াও যখন সে আমার নিকট উপস্থিত হইতেছে না, তখন তাহাকে আমার অভিলাষানুসারে অতিতীক্ষ্ন দণ্ড সহ্য করিতে হইবে।”

“যক্ষগণ কহিল, “হে যক্ষরাজ! স্থূণাকৰ্ণ বিশেষ প্রয়োজনবশতঃ শিখণ্ডিনীনামে দ্রুপদরাজের এক কন্যাকে পুরুষলক্ষণ প্রদান এবং স্বয়ং স্ত্রীচিহ্ন ধারণ করিয়া গৃহে অবস্থান করিতেছেন; এই নিমিত্ত লজ্জিত হইয়া আপনার সন্নিধানে আগমন করিতেছেন না। এক্ষণে আপনি বিমান হইতে অবতীর্ণ হইয়া এই বিষয় শ্রবণপূর্ব্বক যাহা কর্ত্তব্য, তাহার অনুষ্ঠান করুন।” “কুবের কহিলেন, “হে যক্ষগণ! তোমরা সেই স্থূলাকর্ণকে আমার নিকট আনয়ন কর। আমি তাহার যথোচিত দণ্ডবিধান করিব।”

“তখন স্থূণাকৰ্ণ অনুচরমুখে সমুদয় বৃত্তান্ত শ্রবণানন্তর কুবের সন্নিধানে উপনীত হইয়া লজ্জাবনতমুখে তাহার সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলেন।

অনুচরের প্রতি কুবেরের শাপ

“তখন কুবের নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে শাপ প্রদান করিয়া কহিলেন, “হে স্থূণ! তুমি যক্ষগণের অবমাননা ও পাপাচরণ করিয়া শিখণ্ডিনীকে আপনার পুরুষলক্ষণ প্ৰদান ও তাহার স্ত্রীলক্ষণ গ্রহণ করিয়াছ। অতএব তোমার এই নারীরূপই থাকিবে। তুমি এতাদৃশ বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছ, এই নিমিত্ত তুমি স্ত্রী ও শিখণ্ডিনী পুরুষ হইবে।”

‘অনন্তর যখন স্থূণাকর্ণের নিমিত্ত ধনাধিপতি কুবেরকে প্রসন্ন করিয়া বারংবার কহিতে লাগিল, “ভগবন! আপনি এই শাপের অবসান করুন।” তখন কুবের অনুচরদিগকে কহিলেন, “শিখণ্ডী নিহত হইলে স্থূণাকৰ্ণ পুনরায় স্বরূপপ্রাপ্ত হইবে, এক্ষণে স্থূণাকৰ্ণ নিরুদ্বিগ্ন হউক।” এই বলিয়া কুবের শীঘ্রগামী যক্ষগণের সহিত প্রস্থান করিলেন। স্থূণাকৰ্ণ এইরূপ অভিশাপগ্ৰস্ত হইয়া সেই অরণ্যমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

‘অনন্তর শিখণ্ডী সময়ানুসারে তথায় আগমন করিয়া স্থূণাকৰ্ণকে কহিলেন, “হে যক্ষরাজ! আমি আগমন করিলাম।”

স্থূণাকৰ্ণকর্ত্তৃক পূর্ণমনোরথ শিখণ্ডীর আনন্দ

“স্থূণ রাজকুমার শিখণ্ডীকে অকপটে আগমন করিতে দেখিয়া কহিলেন, “হে শিখণ্ডী! আমি তোমার প্রতি অতিশয় প্রীতি ও প্রসন্ন হইলাম।” পরে স্থূণ তাঁহার নিকট স্ববৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণন করিয়া কহিলেন, “হে শিখণ্ডি! আমি তোমার নিমিত্তই কুবেরকর্ত্তৃক অভিশপ্ত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি স্বেচ্ছানুসারে গমন ও পরমসুখে সমস্ত লোকে সঞ্চরণ কর। তুমি এ স্থান হইতে প্রস্থান করিলে আমি পৌলস্ত্যকে [পুলস্তানন্দন কুবেরকে] অবলোকন করিলাম; অতএব বোধ হইতেছে, ভাগ্যকে অতিক্রম করা নিতান্ত সুকঠিন।”

“শিখণ্ডী যক্ষকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া পুলকিতমনে নগরাভিমুখে আগমনপূর্ব্বক গন্ধমাল্যদ্বারা দ্বিজাতি, দেবতা, চৈত্য [দেবতাধিষ্ঠিত পূজ্য বৃক্ষ্য] ও চতুস্পথসকল পূজা করিতে লাগিলেন। দ্রুপদরাজও বান্ধবগণের সহিত নিতান্ত সন্তুষ্ট হইলেন; পরে ধনুর্ব্বেদে শিক্ষালাভ করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে দ্রোণহস্তে সমর্পণ করিলেন। হে মহারাজ! শিখণ্ডী তোমাদের সমভিব্যাহারে চতুষ্পাদপূর্ণ ধনুর্ব্বেদ সম্যক শিক্ষালাভ করিতে লাগিলেন। আমি যেসকল অন্ধ, বধির ও জড়াকার চরদিগকে দ্রুপদের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলাম, তাহারাই আমাকে এই বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক নিবেদন করিয়াছে। অম্বানামে বিশ্রুতা কাশিরাজদুহিতা এই শিখণ্ডীরূপে দ্রুপদকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। আমি এই শিখণ্ডীকে যুদ্ধার্থ সমুপস্থিত দেখিয়াও মুহুর্ত্তকালের নিমিত্ত নিরীক্ষণ বা প্রহার করিব না। পৃথিবীতে আমার এইরূপ এক ব্ৰত প্রচারিত আছে যে, আমি স্ত্রী, স্ত্রীপূর্ব্ব পুরুষ, স্ত্রীনামধারী ও স্ত্রীস্বরূপ পুরুষের প্রতি কদাচ শরপ্রয়োগ করি না। হে রাজন! আমি শিখণ্ডীর এইরূপ জন্মবৃত্তান্ত অবগত হইয়াছি; এই নিমিত্তই ইহাকে প্রহার করিব না। যদি আমি স্ত্রীরূপ শিখণ্ডীকে বিনাশ করি, তাহা হইলে সকলে আমার অপযশ ঘোষণা করিবে। আমি ইহাকে সমরে অবস্থান করিতে নিরীক্ষণ করিয়াও কদাচ সংহার করিব না।”

তখন রাজা দুৰ্য্যোধন পিতামহ ভীষ্মের মুখে এ কথা শ্রবণ করিয়া মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া স্থির করিলেন, এইরূপ প্রতিজ্ঞা করা মহাবীর ভীষ্মের সমুচিতই হইয়াছে।