১৯১. যুদ্ধশঙ্কায় দ্রুপদের রাজ্যরক্ষার ব্যবস্থা

১৯১তম অধ্যায়

যুদ্ধশঙ্কায় দ্রুপদের রাজ্যরক্ষার ব্যবস্থা

ভীষ্ম কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! অনন্তর শিখণ্ডীর জননী স্বীয় পতি দ্রুপদরাজকে যথাযথ বৃত্তান্ত জ্ঞাপন করিলেন। তিনি কহিলেন, “হে মহারাজ! আমি সপত্নীগণের [সতীন] ভয়প্রযুক্ত জন্মগ্রহণকালে শিখণ্ডিনীকে পুরুষ বলিয়া নিবেদন করিয়াছিলাম। আপনি প্রীতিপূর্ব্বক আমাকে তদ্বিষয়ে অনুমোদন করিয়া ইহার পুত্ৰোচিত কাৰ্য্যজাতের [কর্ত্তব্যকর্ম্মসমূহের] অনুষ্ঠান এবং দশার্ণাধিপতির কন্যার সহিত ইহার পরিণয়কাৰ্য্য [শিবদত্ত বরানুসারে] সমাধান করিয়াছেন। দেববাক্যানুসারে তৎকালে আপনাকে কহিয়াছিলাম, শিখণ্ডিনী পরিণামে পুরুষরূপ পরিগ্রহ করিবে, এইরূপে [এইরূপ ভরসায়] ইহার কন্যাভাব উপেক্ষিত হইয়াছিল।”

“অনন্তর রাজা যজ্ঞসেন মন্ত্রিদিগকে এই সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিয়া প্ৰজাগণের রক্ষাবিধান করিবার নিমিত্ত তাঁহাদের সহিত মন্ত্রণা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন এবং পূর্ব্ববৎ প্রতারণা করিয়া দশার্ণাধিপতির সহিত সম্বন্ধ সমর্থিত করিতেই অভিলাষ করিলেন। অনন্তর তিনি স্বভাবতঃ সুরক্ষিত নগরকে বিপৎকালে সাবধানে রক্ষা করিতে লাগিলেন এবং দশার্ণাধিপতি সুবর্ণবর্ম্মার সহিত বিরোধ উপস্থিত হইয়াছে বলিয়া মহিষীর সহিত সাতিশয় ব্যথিত হইলেন। তখন যাহাতে সুবর্ণবর্ম্মার সহিত যুদ্ধ না হয়, মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া দেবার্চ্চনা করিতে লাগিলেন। এই অবসরে রাজমহিষী তাঁহাকে দেবপূজায় নিরত নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! দুঃখের সময়ে ও সুখের সময়ে সতত দেবপূজা করা বিধেয়; আপনি দেবতা ও ব্রাহ্মণের অর্চ্চনা এবং দশার্ণাধিপতির প্রতিনিবৃত্তির নিমিত্ত প্রভূত দক্ষিণাদানসহকারে হুতাশনে আহুতিপ্ৰদান করুন। যাহাতে যুদ্ধ না করিয়া তাঁহাকে প্রতিনিবৃত্ত করা যাইতে পারে, তাহা অবধারণ করা কর্ত্তব্য। আমার বোধ হইতেছে, দেবগণের প্রসাদে ইহা অবশ্যই সফল হইবে। দেবকাৰ্য্য মানুষকাৰ্য্যের সহিত মিলিত হইলে অবশ্যই সিদ্ধ হয়; কিন্তু পরস্পরের বিরোধ উপস্থিত হইলে কদাচ সফল হয় না। অতএব আপনি মন্ত্রিদিগের সহিত পরামর্শপূর্ব্বক নগরের রক্ষাবিধান করিয়া স্বেচ্ছানুসারে দেবগণের আরাধন করুন।”

লজ্জিত শিখণ্ডীর বনগমন—যক্ষানুগ্রহলাভ

“তখন শিখণ্ডিনী তাঁহাদিগকে শোকাকুলিতচিত্তে এইরূপ কথোপকথন করিতে দেখিয়া অতিশয় লজ্জিত হইলেন এবং “আমার জনকজননী আমার নিমিত্তই এইরূপ দুঃখভোগ করিতেছেন, এই ভাবিয়া প্ৰাণনাশ অভিলাষে গৃহ পরিত্যাগপূর্ব্বক শোকসন্তপ্তমনে এক গহনবনে গমন করিলেন। স্থূণাকৰ্ণ নামে ঐশ্বৰ্য্যশালী এক যক্ষ ঐ বন রক্ষা করিত; তাহার ভয়ে কেহই তথায় গমন করিতে সমর্থ হইত না। সেই কাননে স্থূণাকর্ণের উন্নত প্রাকার [প্রাচীর] ও তোরণসম্পন্ন [দেউড়ী—ফটক] সুধাধবলিত [বিশুদ্ধ শুভ্রবর্ণ] উশীরপরিমলযুক্ত [বেনামূলের খসখসের সুগন্ধসমন্বিত] ধূমসমাচ্ছন্ন [ধূপ-ধূমে সমাচ্ছাদিত—গুপ্তভাবে স্থিত] এক প্রাসাদ [অট্টালিকা] ছিল। দ্রুপদনন্দিনী শিখণ্ডিণী সেই অরণ্যানী [নিবিড় বন] প্রবেশ করিয়া বহুদিবস অনাহারে শরীর শুষ্ক করিতে লাগিলেন।

“একদা সেই যক্ষ শিখণ্ডিনীসিন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া মৃদুবচনে কহিলেন, “হে রাজকন্য! তুমি কি নিমিত্ত এইরূপ অনুষ্ঠান করিতেছ, শীঘ্ৰ বল, আমি তোমার বাসনা পরিপূর্ণ করিব।” শিখণ্ডিনী কহিলেন, “তুমি আমার কাৰ্য্য সম্পাদন করিতে কদাচ সমর্থ হইবে না।” যক্ষ কহিল, “হে রাজপুত্র! আমি যক্ষরাজ কুবেরের অনুচর; তোমাকে বর প্রদান করিতে উপস্থিত হইয়াছি। তুমি আমার সমক্ষে স্বীয় অভিলাষ প্রকাশ কর। আমি অদেয় বস্তুও তোমাকে প্ৰদান করিব, সন্দেহ নাই।”

“তখন শিখণ্ডিনী যক্ষপ্রধান স্থূণাকৰ্ণকে আত্মবৃত্তান্ত নিবেদন করিতে লাগিলেন, “হে যক্ষ! মহাবল পরাক্রান্ত উৎসাহসম্পন্ন দশার্ণাধিপতি সুবর্ণবর্ম্মা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া আমার পিতার প্রতিকূলে আগমন করিতেছেন; আমার পিতা পুত্ৰহীন, তিনি যেন অবিলম্বেই বিনষ্ট না হয়েন, আপনি আমাকে ও আমার জনকজননীকে রক্ষা করুন। আমার দুঃখ শান্তি করিবার নিমিত্ত আপনি অঙ্গীকার করিয়াছেন, অতএব আমি যেন আপনার প্ৰসাদে পুরুষত্ব লাভ করি। হে মহাযক্ষ। যে পৰ্য্যন্ত সেই রাজা আমার পুরপ্রবেশ না করেন, তৎকালমধ্যে আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ প্ৰদৰ্শন করুন।’ ”