১৯০. হিরণ্যবর্ম্মার নিকট দ্রুপদের দূতপ্রেরণ

১৯০তম অধ্যায়

হিরণ্যবর্ম্মার নিকট দ্রুপদের দূতপ্রেরণ

ভীষ্ম কহিলেন, “দূতমুখে এইরূপ শ্রবণ করিয়া লোপ্তসহকারে [অপহৃত ধন] ধৃত চোরের ন্যায় দ্রুপদের বাক্যস্ফুর্ত্তি হইল না। তিনি মধুরভাষী দূতগণকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “হে দূতগণ! তোমরা মহারাজ হিরণ্যবর্ম্মার নিকট গমন করিয়া কহিবে, মহারাজ! আপনি যেরূপ কহিয়াছেন, তাহার কিছুই যথার্থ নহে।” এইরূপ বলিয়া তাঁহাদিগকে সন্দিগ্ধচিত্ত বৈবাহিকের নিকট প্রেরণ করিলেন। দশার্ণাধিপতি হিরণ্যবর্ম্মা পুনর্ব্বার প্রকৃত বিষয় অনুসন্ধান করিয়া শিখণ্ডীকে কন্যা বলিয়া বিদিত হইলেন। পরে ধাত্রীগণের বচনানুসারে দুহিতার [কন্যার] বিপ্ৰলম্ভবৃত্তান্ত মিত্ৰগণসন্নিধানে প্রেরণ করিয়া সৈন্যসংগ্রহপূর্ব্বক দ্রুপদরাজের প্রতিকূলে যুদ্ধযাত্রা করিবার অভিলাষ করিলেন।

“অনন্তর দ্রুপদরাজের প্রতি কর্ত্তব্য অবধারণ করিবার নিমিত্ত মন্ত্রিগণের সহিত পরামর্শ করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে অন্যান্য ভূপালগণ কহিলেন, “মহারাজ! যদি শিখণ্ডী যথার্থই কন্যা হয়, তাহা হইলে আমরা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে বন্ধন করিয়া আনয়ন করিব এবং তাঁহাকে ও তাঁহার কন্যা শিখণ্ডীকে সংহার করিয়া পাঞ্চালরাজ্যে অন্য এক রাজাকে অভিষিক্ত করিব।”

“তখন দশার্ণাধিপতি হিরণ্যবর্ম্ম দূতাদিগকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “হে দূতগণ! তোমরা দ্রুপদরাজকে বলিবো,-হে দ্রুপদরাজ! তুমি স্থির হও, আমি অনতিবিলম্বেই তোমাকে বিনাশ করিব।” দূতগণকে এইরূপ আদেশ করিয়া পাঞ্চালদেশে প্রেরণ করিলেন। দূতগণ অবিলম্বে তথায় সমুপস্থিত হইয়া দ্রুপদসন্নিধানে এই কথা নিবেদন করিল।

দ্রুপদনৃপতির শিখণ্ডিবিষয়ক তথ্যনির্ণয়

“মহীপাল দ্রুপদ স্বভাবতঃই ভীত ছিলেন, এক্ষণে এইরূপ পাপাচরণদ্বারা নিতান্ত উদ্বিগ্ন হইলেন। অনন্তর তিনি দূতগণকে দশার্ণাধিপতির সন্নিধানে প্রেরণ করিয়া শোকাকুলিতমনে নির্জ্জনে প্ৰেয়সী মহিষীর নিকট সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “প্রিয়ে! মহাবলপরাক্রান্ত হিরণ্যবর্ম্মা ক্ৰোধাভরে সৈন্যগণসমভিব্যাহারে আমার প্রতিপক্ষে আগমন করিতেছেন। এক্ষণে আমরা নিতান্ত ভয়বিহ্বল হইয়াছি; অতএব এই কন্যার নিমিত্ত কিরূপে অনুষ্ঠান করিব? সুবর্ণবর্ম্মা [‘হিরণ্য’ শব্দের অর্থ সুবর্ণ। নাম হিসাবে হিরণ্যবর্ম্মাই হওয়া উচিত, নামের অর্থবোধক অন্য শব্দ নামস্থলে ব্যবহারের রীতি নাই। ব্যবহার করিলে অর্থবোধে বা লক্ষ্য নিশ্চয়ে বিলম্ব ঘটে] তোমার পুত্ৰ শিখণ্ডীকে কন্যা বলিয়াছেন এবং আপনাকে বঞ্চিত বিবেচনা করিয়া মিত্রবলসমভিব্যাহারে [স্ব স্ব সৈন্যসমন্বিত সামন্ত নৃপতিগণের সাহায্যে] আমাকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত আগমন করিতেছেন। এক্ষণে তুমি এই বিষয়ের সত্যমিথ্যা অবধারণ করিয়া বল; আমি তোমার বাক্য শ্রবণ করিয়া তদনুরূপ অনুষ্ঠান করিব। আমি অতিশয় সংশয়দশায় নিপতিত হইয়াছি এবং তুমি ও এই বালা শিখণ্ডিনী উভয়েই অতিশয় ব্যাকুল হইয়াছ। অতএব তুমি সকলের পরিত্রাণার্থ সদুপদেশ প্রদান কর; আমি অবিলম্বেই কর্ত্তব্যকাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিব।’ কণ্যাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে শিখণ্ডিনি! আমি পুত্রলাভে বঞ্চিত হইয়াছি বটে, কিন্তু তজ্জন্য তুমি ভীত হইও না; আমি তোমার ভরণপোষণ করিব। এক্ষণে দশার্ণাধিপতি আমা হইতেই প্রতারিত হইয়াছেন; অতএব এই বিষয়ে যাহা শ্রেয়স্কর হয় বল, আমি তাহার অনুষ্ঠান করিব।”

“তখন রাজমহিষী সর্ব্বসমক্ষে এইরূপ অভিহিত হইয়া মহারাজ দ্রুপদী সবিশেষ জানিলেও অন্যকে অবগত করিবার নিমিত্ত তাহাকে কহিতে লাগিলেন।”