২১. জীবনমশায়ই বটে

জীবনমশায়ই বটে। গলাইচী গ্রামে ডাকেই চলেছেন। শশীর রোগী রামহরি লেটকে দেখতে চলেছেন। আকাশের দিকেই চেয়ে আছেন। গাড়ির ঝকি খাচ্ছেনক্ষেপ নাই। এই ধারাই জীবন দত্তের চিরকালের ধারা। গরুর গাড়িতে চড়লেই এমনিভাবেই গভীর চিন্তামগ্ন বা শূন্য। মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

পিছনে বসে শশী বকেই চলেছে। সে বলছিল, মেয়েছেলেদের ওই বটে গো। টাকা লোকসান সয় না।

জীবনমশায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। বের হবার আগে আতর-বউকে যে কথা তিনি বলেছেন—শশী তা শুনেছে। তারই জের টেনে চলেছে সে। আরম্ভ করেছে প্রদ্যোত ডাক্তারও একদিন মরবে—এই কথা বলে। মশায়ের কাছে ধমক খেয়ে এখন এসেছে ফিয়ের কথায়।

শশী একটু চুপ করে থেকে আবার বললে, তা ওরা যখন নিজে থেকেই দিতে এল তখন নিলেন না কেন? তাতে কি দোষ হত?

জীবনমশায় এতেও সাড়া দিলেন না।

শশী আবার বললে–রাগলে আর বউঠাকরুনের মুখের আগল থাকে না। ওই দোষটা ওঁর আর গেল না!

জীবনমশায় আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছেন। আতর-বউয়ের কথাগুলি মনে ঘুরছে। কথা নয় বাক্যবাণ; কিন্তু জীবনমশায় ও বাণে বিদ্ধ হয়েও আহত হন না। স্থবির হাতির মত চলেন-বাণগুলি গায়ে বিঁধে থাকে, কিন্তু কোনো স্পৰ্শানুভূতি অনুভব করেন না, তারপর কখন। খসে পড়ে যায়। সমস্ত দেহই তো কিছু কিছু ক্ষতচিহ্নে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে।

শশী কিন্তু বিরক্ত হয়। এই বুড়োর মেজাজটা চিরকাল একরকম গেল। একশোেটা কথা। কইলে একটা উত্তর দেয়। বুঝতে পারা যায় না কোন কথায় লোকটার মন নাড়া খাবে সাড়া দেবে। বউঠাকরুন মুখরা বটেন; কিন্তু সে ওই স্বামীর কারণেই মুখরা। ঝগড়া কলহ সবই জীবন মশায়ের সঙ্গে। বাইরের লোকের সঙ্গে ব্যবহারে বউঠাকরুন অন্য মানুষ। শশীর প্রথম জীবনটা কেটেছে এই বাড়িতে; সে তো জানে! পুরো তিন বছর ওই বাড়িতে কেটেছে। বউঠাকরুন সে সময় যে আত্মীয়তা করেছেন সে তো তার মনে আছে। ডেকে জল খাইয়েছেন, না খেলে তিরস্কার করেছেন। কথাটি বড় ভাল বলতেন—রোজার ঘাড়েও ভূতের বোঝা চাপে শশী, ডাক্তার কবরেজেরও অসুখ করে। সময়ে খা। পিত্তি পড়াস নে।

শুধু এই নয়, বাড়িতে যখন যে জিনিস তৈরি করেছেন, ডেকে খাইয়েছেন। বলতেন—খা তো শশী। দেখ তো ভাই কেমন হল!

ভাল জিনিস ন্যাকড়ায় বেঁধে দিয়েছেন শশী নিয়ে যা বাড়ি। বউকে খাওয়াবি।

শশীর তখন নতুন বিয়ে হয়েছে। শশীর বউয়ের মুখ দেখে একটি আংটি দিয়েছিলেন বউঠাকরুন।

বউঠাকরুনকে তেতো করে দিয়েছে এই বৃদ্ধ! এই মত্ত হস্তী! মত্ত হস্তীই বটে। কোনো কিছুতেই ক্ৰক্ষেপ নাই। বসে আছে দেখ তো? যেন একটা পাথর।

কী বলবে শশী! শশীর আজ নিজের গরজ! গা চুলকাতে চুলকাতে শশী আবার স্তাবকতা শুরু করলে, বউঠাকরুনের দোষ নাই মশায়। সে আমল মনে পড়লে দুঃখ হয়, আফসোস হয় হবার কথাই বটে। ওঃ, সে কী পসার, কী ডাক, দিনে রাত্রে খাবার শোবার অবসর নাই। সেই সাদা ঘোড়াটা, এত বড় ঘোড়া দু বছরের মধ্যেই কুমরে ধরে গেল! আর দেশেও কী জ্বর। হো-হো করে কাপুনি কেঁকো করে জ্বর। তার ওপর প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত। ওরে বাবা রে বাবা! সে একটা আমল বটে। গঙ্গায় নৌকা চলা যাকে বলে। সেই হরিশ ডাক্তারের ছেলের মৃত্যু মনে আছে আপনার? এদিকে ঘরে ছেলের এখনতখন। ওদিকে মনের ভুলে মালিশের শিশিতে খাবার ওষুধ লিখে দিয়েছিল হরিশ–তাই খেয়ে নোটন গড়াঞ্চীর পুত্রবধূ যায় যায়, রাত্রি বারটায়। খোকা চাটুজ্জে ছুটে এসে পড়ল—তার বোন গলায় দড়ি দিয়েছে। দারোগা পুলিশ উঁক ঘুক করছে। ঘুষ খাবার জন্যে আপনি ওদিকে মেলায় পাঞ্জাবি খেলোয়াড়ের ছকের সামনে বসেছেন ক্টোচার খুঁটে টাকা নিয়ে, বাপরে বাপরে! সে কী রাত্ৰি! মনে আছে।

জীবন ডাক্তার একটা লম্বা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। একটু নড়ে বসলেন।

না। সেদিনের কথা ঠিক মনে নাই, স্পষ্ট মনে পড়ে না। মনে পড়িয়ে দিলে মনে পড়ে। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনি একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন। কেন এমন হয়েছিল? কেন?

চঞ্চল হয়ে উঠলেন বৃদ্ধ। মনে পড়ে গেল সেই গোপন সংকল্পের কথা ঘোড়া কিনে ঘোড়ায় চড়ে আতর-বউকে পালকিতে ছড়িয়ে একদিন কাঁদী যাবেন। ঘোড়া তিনি কিনেছিলেন। বড় সাদা ঘোড়া। আতর-বউকে অলঙ্কার দিয়েছিলেন অনেক। কিন্তু কাঁদী যাওয়া হয় নি। কেন যে যান নি তা আজও বুঝতে পারলেন না। সংকোচ না ভয়, কে জানে? হয়ত বা দুই-ই। যে কারণেই হোক, পারেন নি। শুধু প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের মাদকতায় অঞ্চলটাতেই প্রমত্তের মত ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রতিষ্ঠার সেই বোধ করি শ্রেষ্ঠ সময়! চিকিৎসার খ্যাতি তাকে সর্বজনমান্য। করে তুলেছিল। সরকার পর্যন্ত তাকে খাতির করে—এখানকার প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত করেছিল। কিন্তু কিছুতেই মন ভরে নি। যা পেয়েছেন তা দু হাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মনই তৃপ্তি পায় নি তো সঞ্চয় করবেন কোন্ আনন্দে? যদি বল প্রতিষ্ঠার আনন্দে, বলতে পার, কিন্তু সেও ফাঁকিতে পরিণত হয়েছে। তাই তো হয়। বাবা বলতেন রঙলাল ডাক্তারও বলতেন প্রতিষ্ঠা যদি সত্যকারের আনন্দ না হয়, মনকে যদি ভরপুর করে না দেয়, তবে সে জেনো মিথ্যেতার আয়ু সামান্য কয়েকটা দিনের, সে দিন কটা গেলেই সে প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় ভুয়ো মিথ্যে। রঙলাল ডাক্তার হেসে ব্রান্ডির গ্লাস হাতে নিয়ে বলতেন—এই এর নেশার মত। একদিন বলেছিলেন নবদম্পতির আকর্ষণের মত। সেটা যদি নিতান্তই রূপ যৌবন ভোগের আনন্দের মত আনন্দ হয়—তবে রূপ যৌবন যাবার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ বিস্বাদ হয়ে তেতো হয়, মিথ্যে হয়। কিন্তু সে যদি ভালবাসা হয়, তবে সে কখনও যায় না জীবন! যদিও আমি ও দুটোর স্বাদ জানি না। বলে হা-হা করে হেসেছিলেন।

বাবা বলতেন পরমানন্দ মাধবের কথা। তাঁকে না পেলে কিছুই পাওয়া হয় না। তাকে পাওয়া যায় কি না জীবনমশায় ঠিক জানেন না। তবে তিনি পান নি। সম্পদের মধ্যে পান নি, প্রতিষ্ঠার মধ্যে পান নি, সংসারে আতর-বউ ছেলে-মেয়ে সুষমা সুরমা নিরুপমা বনবিহারী কারুর মধ্যে না।

নেশা তিনি করতেন না। নেশা ছিল রোগ সারানোর, রোগীকে বাঁচানোর। আর ছিল দাবা এবং মেলায় জুয়ো খেলা। মনে আছে, হাতের কঠিন রোগী বাঁচবে কি মরবে অন্তরে অন্তরে তাই বাজি রেখে জুয়োর ছকে দান ধরতেন। জিতলে বাঁচবে, হারলে মরবে। মেলে না। তবুও ধরতেন।

সে আমলে জুয়া খেলাটা দোষের ছিল না, অন্তত বড়লোকের ছেলের দোষের ছিল না। ছেলেবয়স থেকেই অভ্যাস ছিল কিছু কিছু। তারপর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। সেটাকে বাড়িয়ে দিলে আবার আতর-বউ।

শশী বলছে সেই এক রাত্রির কথা। মনে পড়ছে বৈকি! সব মনে পড়ছে। রাত্রি শুধু নয়–রাত্রি দিন, সেকাল, সেকালের মানুষজন সকলকে মনে পড়েছে। সেকালের জলটলমল দিঘি, ধানভরা ক্ষেত-খামার, শান্ত পরিচ্ছন্ন ছায়াঘন গ্রামগুলি, লম্বা-চওড়া দশাসই মানুষ, মুখে মিষ্ট কথা, গোয়ালে গাই, পুকুরে মাছ, উঠানে মরাইয়ে ধান, ভাঁড়ারে জালায় জালায় চাল, কলাই মুগ মসুর ডোলা অড়হর মাষকলাই, মন মন গুড়—সে কাল—সে দেশ দেখতে দেখতে যেন পাটে গেল।

ম্যালেরিয়া ছিল না তা নয়। ছিল। পুরনো জ্বর দু-চার জনের হত। শিউলিপাতার রস আর তাদের বাড়ির পাঁচনে তারা সেরে উঠত। হঠাৎ ম্যালেরিয়া এল সংক্রামক ব্যাধির মত।

শশী হি-হি করে হাসছে। বলছে—হো-হো করে কেঁকে করে জ্বর। শশীর প্রকৃতি অনুযায়ী ঠিকই বলেছে শশী। জীবন ডাক্তারের সে স্মৃতি মনে পড়লে সমস্ত অন্তরটা কাতর আর্তনাদ করে ওঠে। উঃ, কত যে শিশুর মৃত্যু হয়েছিল সেবার, তার সংখ্যা নাই। শিশুমড়ক বলা চলে। মায়ের কান্নায় আকাশ ভরে উঠেছিল।

এ অঞ্চলে তখন তার বিপুল পসার। তিনি ছাড়া ছিলেন হরিশ ডাক্তার। কিশোরের বাবা কৃষ্ণদাসবাবু যাকে প্রথম স্থান দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। সে তখন ব্রজলালবাবুর দাতব্য চিকিৎসালয়ে কম্পাউন্ডার হয়েছে। দেখতে দেখতে আর দুজন ডাক্তার এসে বসল। পাসকরা ডাক্তার নয়, কম্পাউন্ডারি করত—রোগের মরসুমে ডাক্তার হয়ে এসে বসল। এই নবগ্রামের নরপতি রায়চৌধুরী একখানা হোমিওপ্যাথিক বই কিনে আর ওষুধ কিনে এক পাড়াগাঁয়ে গেল চিকিৎসা করতে। বরদা রায়চৌধুরীর ছোট ছেলে স্কুলের পড়া ছেড়ে চলে গেল কলকাতা—আর. জি. কর মেডিক্যাল স্কুলে পড়তে। পাগলা নেপালের ছোট ভাই-সেও খানিকটা পাগল ছিলপাগলা সীতারাম, সে খুলে বসল ওষুধের দোকান। নবগ্রাম মেডিক্যাল হল। খুচরা ও পাইকারি ওষুধের দোকান।

এই মড়ক মহামারীর মধ্যে মানুষ চিকিৎসা ব্যবসায়ে উপার্জনের প্রশস্ত পথ দেখতে পেলে।

ঘরে ঘরে মানুষ নিলে শয্যা। তাকে ঘুরতে হত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বাবুপাড়া, বণিকপাড়া, শেখপাড়া, মিয়াপাড়া, জেলেপাড়া, ডোমপাড়া, কাহারপাড়া, বাউরিপাড়া। হরিশ ডাক্তারের দু পকেট বোঝাই হত টাকায়। তার হত তিন পকেটচার পকেটও হতে পারত। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তার বংশের ধারা তিনি ক্ষুণ্ণ করেন নি। অর্থ কাম্য ছিল না তা নয়–কিন্তু তার সঙ্গে পরমার্থও ছিল কামনা। ওরই ওপর তো মহাশয়দের মহাশয়ত্ব। হায় আতরবউ, আজ সেই তিনি কি রতনবাবুরা চার টাকা দিতে এসেছিল বলেই চার টাকা নিতে পারেন? ছি–ছি!

তিনি ডাকে বের হতেন-পথে যে তাকে ডেকেছে তার বাড়িই গিয়েছেন, যে যা দিয়েছে। তাই না দেখেই পকেটে ফেলেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে সাহায্য করে এসেছেন। হরিশ এখানে আগন্তুক, সে রোজগার করতেই এসেছিল। জীবন দত্ত, এখানকার তিনপুরুষের চিকিৎসক, মশায়ের বংশ, শুধু তাই নয়—নিজের গ্রামের তিনি শরিক জমিদার, তাঁর কাছে কি উপাৰ্জন বড় হতে পারে? কখনও কোনোদিন মনেও হয় নি। বরং পকেট থেকে মেকি এবং খারাপ আওয়াজ টাকা আধুলি সিকি বের করে আতর-বউ বকাকি করলে তিনি কৌতুক অনুভব করতেন।

আতর-বউ বলতেন—হেসো না! আমার গা জ্বালা করে।

জীবনমশায় তাতেও হাসতেন। কারণ আতর-বউয়ের গাত্রজ্বালা স্থায়ী ব্যাধি। ওই জ্বালা চিতাকাষ্ঠে সঞ্চারিত হয়ে দাউদাউ করে জ্বলে তবে নিৰ্বাপিত হবে।

সে সময়ে পর পর দুটো ঘোড়া কিনেছিলেন তিনি। একটা বড় একটা মাঝারি। পায়ে হেঁটে ঘুরে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। বছর তিনেকের মধ্যেই দুটো ঘোড়াই অকৰ্মণ্য হয়ে গেল। কুমরি রোগ অর্থাৎ কোমরে বাত হল। জীবন ডাক্তারের বিপুল ভার বয়ে দুটো জীব প্রায় অক্ষম হয়ে গেল। জানোয়ার দুটোর শেষ জীবন হাঁটের মাক-ব্যবসায়ীর তামাক বয়ে অতিবাহিত হয়েছে। এরপর আর ঘোড়া কেনেন নি জীবন ডাক্তার। তাঁর শক্তির তো অভাব হয় নি, অভাব হত সময়ের, তা হোক, চারটেয় পাঁচটায় খাওয়া-তাই খেয়েছেন। মাঠের পথ ভেঙে ডাক্তার। হাটতেন। লোকে বলত—হাতি চলছে। হাতিই বটে। একদিন সকালে জুতোর কাদা ঘোচাতে গিয়ে ইন্দির লাফিয়ে উঠেছিল—বাপরে! সাপ! একটা মাঝারি কেউটে সাপের মাথা উঁর জুতোর তলায় চেপটে লেগেছিল। ঠিক জুতোর তলায় কে নিপুণ হাতে কেউটের মাথা একে দিয়েছে। ভাগ্যক্রমে অন্ধকারে ক্ৰক্ষেপহীন মাতঙ্গপদপাতটি ঠিক সাপটির মাথার উপরেই হয়েছিল! ইন্দির জুতোটা এনে তাকে দেখাতে তিনি হেসেছিলেন। আতর-বউ শিউরে উঠে মনসার কাছে মানত করেছিলেন তাঁকে তিরস্কার করেছিলেন। এমনই কি মানুষের উপার্জনের নেশা! দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে টাকার জন্যে। তাতেও তিনি হেসেছিলেন এই কদিন আগেই আতর-বউ যে যা দেয়, ফি নেওয়ার জন্য বলেছিলেন, দাতাকৰ্ণদের ছেলের গলায় ছুরি দিতে হয় তা জান? তুমি তাই দেবে। সে আমি জানি।

বন্ধুরা তাঁদের রহস্য করে বলত দেশের লোকের সর্বনাশ আর ডাক্তারদের পৌষ মাস।

তাতেও তিনি হাসতেন। বুঝতেন বন্ধুদের ফিস্ট খাবার অভিপ্রায় হয়েছে। বলতেন—তা হলে পৌষ মাসে তো কিছু খেতে হয়। ফিষ্টি-টিষ্টি কিছু কর তা হলে।

—দে টাকা দেয়!

সেতাব সুরেন্দ্ৰ নেপাল ফিস্টের আয়োজনে লেগে যেত। গন্ধে গন্ধে শশীও জুটত। হরিশ ডাক্তারকেও নিমন্ত্রণ পাঠাতেন।

এসব হত রাত্রে। দিনে অবকাশ কোথায়? ভোরে উঠে আরোগ্য-নিকেতনে রোগী দেখে ডাক থেকে ফিরতেই হয়ে যেত অপরাহু, বেলা চারটে। চারটের পর খাওয়াদাওয়া সেরে দূরান্তের ডাক। সেখান থেকে ফিরতে নটা, দশটা, বারটা। তিনটেও হত। বারটা পর্যন্ত সেতাব সুরেন নেপাল তার অপেক্ষায় থাকত। আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ায় আলো জ্বলত, ইন্দির যোগাত চা আর তামাক, তারা খেলত দাবা। আর বসে থাকত চৌকিদারেরা। জীবনমশায় তখন প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত। জীবনমশায় ফিরে এসে অন্তত একহাত দাবা খেলে চৌকিদারের হাজিরার খাতায় সই করে তবে বিশ্রাম করতেন। কতদিন রাত্রি প্রভাতও হয়ে যেত। খাওয়াদাওয়ার দিনে ইন্দির আর শশী যেত নবগ্রামের বাজারে। ডাক্তার চিট দিতেন। তেল ঘি নুন মসলা এমনকি সাহাদের দোকান থেকে আসত মদ। সুরেন নেপাল হরিশ ডাক্তার শশী এদের মদ নইলে তৃপ্তি হত না। নেপাল সুরেন যেত পাঠার খোঁজে। চৌকিদার যেত, জেলে ডেকে আনত, সে পুকুর থেকে মাছ। ধরে দিত। ডাক্তার আত্মবিস্মৃতই হয়েছিলেন। সে যেন একটা নেশার ঘোর।

মনে পড়ছে সে রাত্রির কথা। হ্যাঁ, জীবনের একটা স্মরণীয় রাত্রি বটে। বাড়ি, সেদিন বিকেলে বাড়ি থেকে বের হবেন প্রথমে যাবেন হরিশ ডাক্তারের বাড়ি, হরিশের ছেলের অসুখ শুনেছেন। তারপর যাবেন মেলায়। মেলা চলছে সে সময়। ভাদ্র মাসে, নাগ পঞ্চমীতে মনসা পুজোর মেলা। মেলার কর্তারা এসে নিমন্ত্রণও করে গেছে। জীবনমশায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে একটা রক্ষা করে জুয়ো খেলার বন্দোবস্ত করে দেবেন। এবং সেখানে জুয়া খেলে জীবনমশায়। দশ-বিশ টাকা জুয়াড়ীকে দিয়েও আসবেন। ঘরের মধ্যে জামা পরবার জন্যে ঢুকেই দেখলেন আতর-বউ জামার পকেট থেকে টাকা বের করে নিচ্ছেন। স্বামীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আতর-বউয়ের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। কোনো কথা বলবার আগেই আতর-বউ বলেছিলেন জুয়ো খেলে তুমি টাকা দিয়ে আসবে, সে হবে না। তোমার লজ্জা হয় না জুয়ো খেলতে? জীবন মশায় বলছিলেন–জুয়ো খেলব না; টাকা বের করে নিয়ো না। ছেলেদের দেব, চাকরদের দেব-ওরা সব মেলা দেখতে যাবে; মেলার মধ্যে দু-চার জন হাত পাতে; দিতে হয়। টাকা রাখ।

–রইল পাঁচ টাকা।

–পাঁচ টাকায় কী হবে?

–না। আর দেব না। কিছুতেই দেব না।

–ভাল।

জামাটা টেনে নিয়ে পাঁচটা টাকার নোটটাও ফেলে দিলেন। তারপর জামাটা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলে বনবিহারী, নতুন বাইসিক্ল হাতে নিয়ে বাপের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে, মেলা দেখতে যাবে, টাকা চাই। গায়ে ডবলব্ৰেস্ট কোট, পায়ে পাম্পসু। বনবিহারী বাবুদের ছেলেদের সমান বিলাসী। চাকর ইন্দির দাঁড়িয়ে, নন্দ তখন ছেলেমানুষ, সেও দাঁড়িয়ে, তারা জানে—মশায় মেলার সময় বকশিশ দেবেন। সকলের দিকে তাকিয়ে যেন আগুন জ্বলে গেল। আতর-বউ পাঁচ টাকার নোটখানা কুড়িয়ে নিয়ে ছেলের হাতে দিলেন। জীবনমশায় বললেন–ইন্দির, আমার সঙ্গে আয়।

তিনি ভুলে গেলেন–হরিশের ছেলের অসুখের কথা। শুনেছিলেন, ছেলেটির অসুখ করেছে। গত রাত্রে হরিশকে নিমন্ত্ৰণ পাঠিয়েছিলেন খাওয়ার জন্য; হরিশ আসতে পারে নি, লিখেছিল–ছেলেটার হঠাৎ কম্প দিয়া জ্বর আসিয়াছে। মেয়েরা ভয় পাইতেছে, যাইতে পারিলাম না। জীবনমশায় ভেবেছিলেন একবার খোঁজ নেবেন। কিন্তু উদ্ভ্রান্ত হয়ে ভুলে গেলেন। নবগ্রামে সাহাদের মদের দোকানে এসে সাহাকে ডেকে বললেন–পঞ্চাশটা টাকা চাই সাহা।

সাহা শুধু মদের দোকানই করত না, টাকা দাদনেরও কারবার করত, সাধারণকে টাকা দিত গহনার উপর, সম্মানী ব্যক্তিকে হ্যান্ডনোট।

অবাক হয়ে গেল সাহা—মশায়ের টাকা চাই।

চাই। কাল-পরশু চেয়ে নিস। আন টাকা। বিনা বাক্যব্যয়ে সাহা টাকা এনে তার হাতে তুলে দিলে। কোনো স্মরণচিহ্ন চাইলে না।

টাকা নিয়ে ইন্দিরকে দুটো টাকা দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন—মেলা। মেলা ঘুরে গিয়ে বসেছিলেন জুয়োর আসরে। রাত্রি তখন আটটা। বসে গেলেন জুয়োর আসরে। মনে। মনে সেদিন কী বাজি রেখেছিলেন মনে নেই। বোধহয় এক বছরের মধ্যে তিনি যদি মরেন, তবে তিনি জিতবেন।

 

দশটার সময় ছুটে এসেছিল—এই শশী। শশী তখন হরিশের অধীনে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার। তার মেলাতে থাকারই কথা, কিন্তু হরিশের ছেলের অসুখের জন্য। আসতে পারে নি। ছেলের অবস্থা সংশয়াপন্ন; ওদিকে হরিশের হাতের রোগী নোটন গড়াঞীর। পুত্রবধূ মালিশ খেয়ে বসে আছে। ভুল হরিশের। ছেলের অসুখ; বিভ্রান্তমস্তিষ্ক হরিশ মালিশের শিশি দিয়ে বলেছে—এইটে খাবার।

–এখুনি চলুন আপনি।

উঠেছিলেন তাই, তখন কেঁচার খুঁটে গোটা বিশেক টাকা অবশিষ্ট, ডাক্তার উঠেই টাকা। কটা গোছ করে জাহাজের ঘরে বসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন সই! জাহাজ ডোবে তো গেল, ওঠে। তোে রেখে দিয়ো-কাল নেব।

জাহাজ ড়ুববে, অর্থাৎ তিনি হারবেন সে তিনি জানতেন। অর্থাৎ তিনি মরবেন না এক বছরের মধ্যে। অনেক দেখতে হবে তাঁকে। এখন হরিশের ছেলেকে দেখতে হবে, চল।

যেতে যেতে হরিশের ছেলে শেষ হয়ে গিয়েছিল। জীবন মশায়কে দেখে বুক চাপড়ে কেঁদে উঠেছিল হরিশ।জীবন! এ কী হল আমার! জীবন! তুমি যদি সকালে একবার আসতে ভাই, তবে হয়ত বাচত আমার ছেলে।

জীবনমশায় মৃদু তিরস্কার করেছিলেন হরিশকে—তুমি না ডাক্তার হরিশ! ছি! তোমার তো এমন অধীর হওয়া সাজে না। অন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দির এ কথা জানেন যিনি নিয়ন্তা তিনি, আর জানেন তত্ত্বজ্ঞানী—আর এ সমস্ত না বুঝেও এ কথা তো ডাক্তারের অজানা নয়। চুপ কর। মেয়েদের সান্ত্বনা দাও। আমি যাই গড়ীর বাড়ি।

মুহূর্তে হরিশের শোকের উচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

গড়াঞীর বাড়ির সামনে তখন নানা গবেষণা চলছে। হরিশের ভাগ্য ভাল; সময়টা মেলার। লোকজন সবই গিয়েছে মেলায়। নইলে এতক্ষণ হরিশের বিরুদ্ধে থানায় ডায়রি হয়ে যেত। জীবনমশায় এসে বসলেন। প্রথমেই শিশিটা হস্তগত করে পকেটে পুরলেন। তারপর নাড়ি। ধরলেন। বিষের ক্রিয়ার লক্ষণ রয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন করলেন-ওষুধটা সবটা খেয়েছে? পেটে গিয়েছে? যায় নি। ঋজালো ওষুধ রোগী বমি করে ফেলে দিয়েছে। ভয় নাই। শশীকে। বললেন––ডিসপেনসারিতে স্টমাক-পাম্প আছে—নিয়ে আয়।

সেই রাতেই রাত বারটায় খোকা চাটুজ্জে এসে পড়ল—মশায় রক্ষা করুন। আমার বোন নলিনী গলায় দড়ি দিয়েছে।

চিকিৎসার জন্য খোকা চাটুজ্জে তাকে ডাকে নি। অন্য কারণে ডেকেছিল।

জীবনমশায় প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত। তিনিই পারেন পুলিশ-লাঞ্ছনার হাত হতে বাঁচাতে। তা তিনি বাঁচিয়েছিলেন। গড়াঞীর পুত্রবধূর পেটের মালিশ বমি করিয়ে বের করে মরণের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নতুন ওষুধ দিয়ে রাত্রি আড়াইটার সময় থোকা চাটুজ্জের বাড়ি এসে বাইরের দাওয়ার উপর বসলেন। রিপোর্ট লিখে বললেন, শ্মশানে নেবার ব্যবস্থা কর। আমি রয়েছি।

সেতাবকে বললেন–দাবার ছক খুঁটি আন সেতাব। শুধু তো বসে থাকা যায় না। পাত, ছক পাত।

সব মনে পড়ছে। মনে আছে সবই; মনে পড়ালেই মনে পড়ে। সেদিন রাত্রি চারটে পর্যন্ত দাবা খেলেছিলেন-বাজির পর বাজি জিতেছিলেন। সেতাব বলেছিল—তোর এখন চরম ভাল সময় রে জীবন! ডাঙায় নৌকো চলছে।

তাঁরই তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু–!

হঠাৎ আটকে গেল নৌকো।

 

এই মেলার পরই কিন্তু বনবিহারী প্রমেহ রোগে আক্রান্ত হল। শুনলেন মেলায় সে নাকি মদও খেয়েছিল।

ডাঙায় চলমান নৌকাটা আটকেই শেষ হয় নি, অকস্মাৎ মাটির বুকের মধ্যেই ড়ুবে গেল।

জীবনমশায় ছেলে বনবিহারীকে ডেকে বলেছিলেন, ছিছিছি। বনবিহারী মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু সে নতমুখে তার কঠিন ক্রোধ ফুটে উঠেছিল। জীবনমশায় বলেছিলেন বংশের ধারাকে যে কলুষিত করে সে কুলাঙ্গার। বাপ লজ্জা পায়, মা লজ্জা পায়, ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ শিউরে ওঠেন পরলোকের সমাজে তাদের মাথা হেট হয়! জানতে পারেন নি, দরজার ওপাশে কখন আতর-বউ এসে কান পেতে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সেই মুহূর্তেই ঘরে ঢুকে বলেছিলেন—একটা ভুলের জন্য এত বড় কথা বললে তুমি ওকে? আমার গর্ভের দোষ দিলে! চৌদ্দ পুরুষের মাথা হেঁট করেছে বললে? তুমি লজ্জা পেয়েছ বললে! তুমি নিজের কথা ভেবে দেখে কথাটা বলেছ? নিজে তুমি কর নি? ও হয়ত সঙ্গদোষে কোনো ভ্ৰষ্টার পাল্লায় পড়ে একটা ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু তুমি? মঞ্জরীর জন্যে তুমি কী কাণ্ডটা করেছিলে—মনে পড়ে না?

স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন জীবনমশায়।

আতর-বউ ছেলের সামনে মঞ্জরীর কথা বৰ্ণনা শেষ করে ছেলের হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।–উঠে আয়!

জীবনমশায় বসে রইলেন অপরাধীর মত। এবং যে মঞ্জরীকে তিনি অপরাধিনীর মত জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন-আতর-বউ সেই মঞ্জরীকেই তার সামনে মাথা তুলিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল; পাওনাদারের মত।

প্রতিষ্ঠার এই উৎসবমুখরিত কালে দীর্ঘদিন মঞ্জরীকে তার বারেকের জন্যও মনে পড়ে নি। সেদিন মনে পড়িয়ে দিয়েছিল আতর-বউ। মদ্যপানের ফলে, ব্যভিচারের পাপে ভূপী বোসের ব্যাধি মঞ্জরীর ভাগ্যকে করেছিল মন্দ; তাতে কি তিনি মনে মনে আনন্দ পেয়েছিলেন? তারই জন্যই কি তিনি পেলেন এই আঘাত? সেইদিনই তিনি বুঝেছিলেন বনবিহারীর জীবনে মৃত্যুবীজ বপন হয়ে গেল। মানুষের জীবনে মৃত্যু ধ্রুব, জন্মের মুহূর্ত থেকে ক্ষণে ক্ষণেই সে তার দিকে চলে; মৃত্যু থাকে স্থির, হঠাৎ একদিন মানুষ রিপুর হাত দিয়ে তাকে নিমন্ত্ৰণ পাঠায়; তখন মৃত্যুও তার দিকে এগিয়ে আসে। এক-একজন অহরহ ডাকে। ওই দাঁতুর মত। দতু মরবে। বনবিহারীর মতই মরবে। প্রদ্যোত ডাক্তার ওকে বাঁচাতে পারবে না।

হঠাৎ জীবনমশায় সচেতন হয়ে উঠলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন।

শশী এতক্ষণ পিছনে বসে বৃদ্ধ হস্তীকে আপন মনেই গালাগাল দিয়ে চলেছিল। এর মধ্যেই পকেট থেকে ক্যানাবিসিন্ডিকা-মেশানো পানীয়ের শিশি বের করে সে এক ঢোক খেয়ে নিয়েছে। গাড়িতে তামাক সেজে খাওয়ায় বিপদ আছে। খড়ের বিছানায় আগুন লাগতে পারে। সেই ভয়েই। ও ইচ্ছা সংবরণ করে দুটো বিড়ি, চার পয়সায় দশটা গোল্ডফ্লেক সিগারেটের একটা সিগারেট শেষ করেছে। এবং মধ্যে মধ্যে দাঁতে দাঁত ঘষে ভেবেছে—বুড়োর পিঠে গোটাদুয়েক কিল বসিয়ে দিলে কী হয়? না-হয় তো—জ্বলন্ত সিগারেটের ডগাটা পিঠে টিপে ধরলে কী হয়? চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে?

মশায়কে নড়েচড়ে বসতে দেখে, ছাইয়ের বাইরে মুখ বের করে তাকাতে দেখে শশী বললে—নেমে একবার দেখব নাকি?

–কী?

–ব্যাটা দাঁতু সত্যিই ভর্তি হল কি না হাসপাতালে?

ঠিক হাসপাতালের সামনে এসে পড়েছে গাড়িখানা।

–না। কে বল তো? গলাখানি বড় মিঠে। গাইছেও ভাল। গানখানিও চমৎকার! ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে–ডাক্তার ছোকরা নয়?

উৎসাহিত হয়ে শশী ছইয়ের পিছন দিক থেকে ঝপ করে লাফিয়ে নেমে পড়ল। বললে–হা ডাক্তারই বটে। ডাক্তারের পরিবার গান করছে। যেমন স্বামী তেমনি স্ত্রী। সে একেবারে ঋটি মেমসাহেব। বাইসিকিলে চড়ে গো। আর চলে যেন নেচে নেচে। গান তা যখন তখন। অই। অঃই, দেখুন না।

সামনের বারান্দাতেই স্বামী-স্ত্রী প্রায় ছোট ছেলেমেয়েদের মত খেলায় মেতেছে। তরুণী স্ত্রী ডাক্তারের হাত চেপে ধরেছে, হাত থেকে জলের মগটা কেড়ে নেবে। সে নিজে জল দেবে। ডাক্তার বোধ করি হাত-পা ধুচ্ছিল।

ডাক্তার দেবে না। সে তাকে নিরস্ত করতে বালতি থেকে জল নিয়ে তার মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি ছুটে চলে গেল ঘরের মধ্যে। আবার ছুটে বেরিয়ে এসে কিছু যেন ছুঁড়ে মারল ডাক্তারের মুখে। ডাক্তারের মুখ সাদা হয়ে গেল। পাউডার। পাউডার ছুঁড়ে মেরেছে।

শশী খুখুক করে হাসতে লাগল।

মশায়ের মুখেও একটি মৃদু হাস্যরেখা ফুটে উঠল। গাড়ি মন্থর গমনে চলতে লাগল। গণেশ ভটচাজের মেয়ে তা হলে ভাল আছে। আশা হয়েছে। পরমানন্দ মাধব! না হলে ডাক্তার এমন আনন্দের খেলায় মাততে পারত না। ছোকরার সাহস আছে, ধৈর্য আছে। জেদ আছে। বড় হবার অনেক লক্ষণ আছে। শুধু একটা জিনিস নাই। অন্য মতকে মানতে পারে না। অবিশ্বাস করতে হলে আগে বিশ্বাস করে দেখা ভাল। বিশ্বাস করে না-ঠকে অবিশ্বাস করলে যে ঠকা মানুষ তাঁকে সেইটেই হল সবচেয়ে বড় ঠকা। তাতেই মানুষ নিজেকে নিজে ঠকায়। আর বড় কটুভাষী! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মশায়। আবার নড়ে বসলেন। কিন্তু দাঁতু বাঁচবে না। দাঁতু নিজেকে। নিজে মারছে, তাকে কোন্ চিকিৎসক বাঁচাবে? অবশ্য পরিবর্তন মানুষের হয়।

এই তো নবগ্রামের কানাইবাবু। তিনি আজ নাই, অনেকদিন মারা গেছেন। জীবন দত্ত তাকে দেখেছেন। মাতাল, চরিত্ৰহীন, দুর্দান্ত রাগী, কটুভাষী লোক ছিলেন তিনি। প্রথম পক্ষ বিয়োগের পর আবার বিবাহ করলেন দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর স্পর্শে লোহা থেকে সোনা হয়ে যাওয়ার মত আর এক মানুষ হয়ে গেলেন। মদ ছাড়লেন, ব্যভিচার ছাড়লেন, কথাবার্তার ধারা পাল্টালেন, সে রাগ যেন জল হয়ে গেল; শুধু তাই নয়, মানুষটি শুধু সদাচারেই শুদ্ধ হলেন না, পড়াশুনা শাস্ত্রচর্চা করে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন জীবনে। তাও হয়। কিন্তু বনবিহারীর হয় নি। দাঁতুরও হবে না। আবার মনে হল রামহরির কথা। বার বার প্রশ্নটা ঘুরে ঘুরে জাগছে মনের মধ্যে। কী আর হল? তবে কি এই নতুন স্ত্রীটি তার জীবনে এমন মধুর আস্বাদ দিয়েছে যার মধ্যে সে মাধবের মাধুর্যের আভাস পেয়েছে?

হঠাৎ তার একটা কথা মনে হল। তিনি মুখ বাড়িয়ে শশীকে ডাকলেন লিউকিস!

শশী ইতিমধ্যে রাস্তায় নেমে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে—তামাক সেজে হুঁকো টানছে। হুঁকোটা নামিয়ে সে সবিস্ময়েই জীবন মশায়ের মুখের দিকে তাকালে। হঠাৎ বুড়োর হল কী? লিউকিস বলে ডাকে যে!

এ নাম তার সে আমলের নাম। ম্যালেরিয়ার আবির্ভাবের সময় পাগলা নেপালের ভাই সীতারাম, যে নগ্রাম মেডিক্যাল হল খুলেছিল—সেই সীতারামের দেওয়া নাম। সেও ছিল আধপাগলা। সত্তর বছরের বৃদ্ধ থেকে ষোল বছরের ছেলে পর্যন্ত সবাই ছিল তার ইয়ার। সকলের সঙ্গেই সে তামাক খেত। অথচ তার চরিত্রের মধ্যে কোথায় ছিল একটি মাধুর্য যে এতটুকু বিরক্ত হত না কেউ।

সে কলকাতার বড় বড় সাহেব-ডাক্তারের নাম নিয়ে এ অঞ্চলের ডাক্তারদের নামকরণ করেছিল।

জীবন দত্তের নাম দিয়েছিল—ডাক্তার বার্ড।

হরিশ ডাক্তারকে বলত ডাক্তার ম্যানার্ড।

শশীকে বলত–লিউকিস।

নতুন ডাক্তার এসেছিল হাসপাতালে কলকাতার মিত্তিরবাড়ির ছেলে, তাকে বলত-ডাঃ ব্রাউন!

সীতারামের এই রসিকতা সেকালে ভারি পছন্দ হয়েছিল লোকের। ডাক্তারেরা নিজেরাও হাসতেন এবং মেজাজ খুশি থাকলে পরস্পরকে এই নামে ডেকে রসিকতা করতেন।

এতকাল পরে সেই নাম? বিস্মিত হল শশী। কিন্তু এই নামে সেকালে ডাকলে যে উত্তর সে দিত সেই উত্তরটি দিতে ভুল হল না তার। ঘাড়টা একটু ঘেঁট করে সায়েবি ভঙ্গিতে সে বললে–ইয়েস স্যার!

জীবনমশায় বললেন–সে আমলটা বড় সুখেই গিয়েছে, কী বলিস শশী?

—ওঃ, তার আর কথা আছে গো! সে একেবারে সত্যযুগ।

হেসে ফেললেন ডাক্তার। শশীর সবই একেবারে চরম এবং চূড়ান্ত। ভাল তো তার থেকে। ভাল হয় না, মন্দ তো–একেবারে মন্দ। হয় বৈকুণ্ঠ নয় নরক।

তারপরই শশী বললে–সীতারাম বেটা শাপভ্রষ্ট দেবতা ছিল, বুঝলেন? তাহঠাৎ সীতারামকে মনে পড়ল ডাক্তারবাবু?

–নাঃ। তার নামটা মনে পড়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করছিলাম রামহরির কথা।

–বললাম তো বেটার অবস্থা আজকে খারাপ, বোধহয় অনিয়ম-টনিয়ম করেছে। তা শুধাবার তো উপায় নাই। মারতে আসবে বেটা। বলে মারার চেয়ে তো গাল নাই, মরতে তো বসেইছি, না খেয়ে মরব কেন, খেয়েই মরব।

—সে তো গিয়েই দেখব রে। আমি শুধাচ্ছি ব্যাপারটা কী বল দেখি, মানে নতুন বিয়ে করে

মশায়ের কথার মাঝখানে তাচ্ছিল্যভরে শশী বলে উঠল—বেটার মতিগতি কী রকম পালটেছে আর কি!

—হুঁ। রামহরির এই স্ত্রীটি বোধহয় খুব ধার্মিক মেয়ে, দেখতেও বোধহয় খুব সুন্দরী?

শশী একটু ভেবেচিন্তে বললে—তাই বোধহয় হবে।

–হুঁ! ডাক্তার স্মিতহাস্য প্রসন্ন মুখে আবার আকাশের দিকে চোখ তুললেন।

নবগ্রামের বাজার সম্মুখে।

ডাক্তার বললেন–বাইরে বাইরে চল বাবা মাঠের পথে। ভিড় ভাল লাগে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *