১৭৬. অম্বা-অকৃতব্ৰণের কথোপকথন

১৭৬তম অধ্যায়

অম্বা-অকৃতব্ৰণের কথোপকথন

“অকৃতব্ৰণ কহিলেন, “হে ভদ্ৰে! তোমার এই দুইটি দুঃখ উপস্থিত হইয়াছে; এক্ষণে বল, ইহার মধ্যে কোনটির প্রতীকার করিতে অভিলাষ করিয়াছ? যদি শাল্বরাজকে পাণিগ্রহণ করিতে নিয়োগ করা তোমার অভিলাষ হয়, তাহা হইলে ভগবান জামদগ্ন্য তোমার হিতানুষ্ঠানের নিমিত্ত তাহাও সম্পাদন করিবেন। অথবা যদি ভীষ্মকে পরাজিত দেখিতে ইচ্ছা কর, ধীমান্ পরশুরাম তাহাও সম্পাদন করিবেন। এক্ষণে রাজা হোত্রবাহনের ও তোমার বাক্য শ্রবণ করিয়া যাহা কর্ত্তব্য, আজই তাহা অবধারণ করা উচিত হইতেছে।”

‘অম্বা কহিলেন, “ভগবন! আমি শাল্বরাজের প্রতি অনুরক্তা হইয়াছি, ভীষ্ম ইহা সবিশেষে অবগত না হইয়া আমাকে হরণ করিয়াছিলেন। আপনি মনে মনে ইহা বিচার করিয়া কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম অথবা শাল্বরাজের প্রতি যাহা কর্ত্তব্য, তাহার অনুষ্ঠান করুন। আমি আপনার নিকট আনুপূর্ব্বিক দুঃখ-কারণ নিবেদন করিলাম; এক্ষণে আপনি যুক্তি অনুসারে তদ্বিষয়ে যাহা শ্রেয়ষ্কর, তাহা সংসাধন করুন।”

“অকৃতব্ৰণ কহিলেন, “হে বরবর্ণিনি! তুমি যে ধর্ম্মসঙ্গত বাক্য কহিলে, তাহা সম্যক উপপন্ন [যুক্তিযুক্ত বলিয়া বোধগম্য] হইতেছে, এক্ষণে আমি যাহা বলি, অবহিতমনে [স্থিরচিত্তে] শ্রবণ কর। যদি ভীষ্ম হস্তিনাপুরে তোমাকে লইয়া না যান, তাহা হইলে শাল্বরাজ ভগবান পরশুরামের নির্দ্দেশানুসারে তোমাকে গ্রহণ করিবেন। ভীষ্ম তোমাকে বলপূর্ব্বক হরণ করিয়াছিলেন, সেই নিমিত্তই তোমার উপর শাল্বরাজের সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল। ভীষ্ম অতিশয় পুরুষাভিমানী ও বিজয়ী, অতএব তাঁহাকেই ইহার প্রতিফলন প্ৰদান করা কর্ত্তব্য।’

“অম্বা কহিলেন, “ভগবন! আমি ভীষ্মকেই সমরে সংহার করিব, সর্ব্বদা এইরূপ অভিলাষ করিতেছি। এক্ষণে ভীষ্মই হউন বা শাল্বরাজই হউন, আমি যাহার নিমিত্ত এইরূপ দুঃখভোগ করিতেছি ও আপনি যাঁহাকে দোষী বলিয়া বিবেচনা করিবেন, তাঁহাকেই সমুচিত শাসন করুন।”

পরশুরামের হোত্ৰবাহনসমীপে আগমন

“তাঁহাদিগের এইরূপ কথোপকথনে দিবা ও বিভাবরী [রাত্রি] অতিবাহিত হইল। অনন্তর জটাভারমণ্ডিত [জটাজালশোভিত], চীরধারী [বিলাসভাবের অনুদ্দীপক সাধারণ বসনপরিহিত], রজোগুণবিরহিত, খড়গ, পরশু ও শরাসনসম্পন্ন ভগবান জামদগ্ন্য শিষ্যগণে পরিবৃত হইয়া সৃঞ্জয়রাজ হোত্রবাহনের সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। তখন তাপসগণ, হোত্ৰবাহন ও রাজকুমারী অম্বা তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্ৰ মধুপৰ্কদ্বারা অর্চ্চনা করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে অবস্থান করিতে লাগিলেন। পরশুরাম সৎকৃত হইয়া তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে উপবেশনপূর্ব্বক রাজর্ষি হোত্রবাহনের সহিত অতীত বিষয়ের কথোপকথন করিতে লাগিলেন। পরে সৃঞ্জয়রাজ মধুরবচনে সমুচিত অবসরে তাঁহাকে কহিলেন, “ভগবন! এই অম্বা কাশিরাজকন্যা ও আমার দৌহিত্রী; এক্ষণে আপনি ইহারই মুখে ইহার কাৰ্য্য শ্রবণ করুন।”

“তখন প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় তেজঃপুঞ্জকলেবর পরশুরাম অম্বাকে স্বকার্য্যের উল্লেখ করিতে কহিলে অম্বা তাঁহার সন্নিধানে উপনীত এবং মস্তকদ্বারা পাদবন্দন ও কমলদলকোমল [পদ্মপত্ৰতুল্য স্নিগ্ধ] পাণিতলদ্বারা পাদস্পর্শপূর্ব্বক সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া অবিরল বাম্পজল [দুঃখে নির্গত নেত্রজল] বিসর্জ্জন করিয়া তাহার আশ্রয় গ্রহণ করিল। রাম কহিলেন, “হে রাজনন্দিনি! তুমি সৃঞ্জয়রাজের যেরূপ স্নেহভাজন, আমারও তদ্রূপ; এক্ষণে আমার সমক্ষে আপনার মনোদুঃখ বৰ্ণনা কর; আমি তোমার অভিলষিত কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিব।” অম্বা কহিল, ‘ভগবন! আমি আপনার শরণাপন্ন হইলাম, এক্ষণে 
আপন
ি আমাকে ঘোর শোকপঙ্কার্ণব [দুঃখরূপ কর্দমময় সমুদ্র] হইতে উদ্ধার করুন।”

অম্বার পরশুরামসমীপে দুঃখনিবেদন

“তখন জমদগ্ন্য তাহার অসামান্য রূপ, অভিনব যৌবন ও পরম সুকুমারতা [মৃদুতা] সন্দর্শন করিয়া একান্ত চিন্তিত হইলেন এবং অম্বা কি বলিবে, দয়ার্দ্রচিত্তে বহুক্ষণ ইহা বিবেচনা করিয়া পুনরায় কহিলেন, “বৎসে! তুমি এক্ষণে আপনার মনোভিলাষ প্রকাশ কর।” তখন অম্বা তাঁহার সমক্ষে আনুপূর্ব্বিক আত্মবৃত্তান্ত নিবেদন করিল। পরশুরাম তাহা শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “বৎস্যে! আমি ভীষ্মের সন্নিধানে দূত প্রেরণ করিব, তিনি আমার বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহা সংসাধন করিবেন। যদি তিনি তদ্বিষয়ে পরাঙ্মুখ হয়েন, তাহা হইলে আমি অস্ত্ৰতেজোদ্বারা অমাত্যগণের সহিত তাঁহাকে সমরাঙ্গনে [যুদ্ধক্ষেত্রে] দগ্ধ করিব। অথবা যদি ভীষ্মের প্রতি তোমার অভিরুচি না হয়, তা হইঁলে আমি শাল্বরাজকে তোমার পাণিগ্রহণ করিতে নিয়োগ করিব।

ভীষ্মবিনাশার্থ অম্বার প্রার্থনা

“তখন অম্বা কহিল, ‘ভগবন! শাল্বরাজের প্রতি পূর্ব্বাবধিই আমার অনুরাগসঞ্চার হইয়াছে শ্রবণ করিয়া মহাবীর ভীষ্ম তৎক্ষণাৎ আমাকে পরিত্যাগ করিলেন। পরে আমি সৌভরাজসন্নিধানে গমন করিয়া তাঁহাকে স্ত্রীলোকের বক্তব্য কথা [নারীজনের যতটুকু বলা সম্ভব-স্ত্রীরূপে গ্রহণের উপযুক্ত বাক্য] কহিলাম, কিন্তু তিনি আমার চরিত্রের প্রতি আশঙ্কা করিয়া আমাকে গ্ৰহণ করিলেন না। আপনি স্বীয় বুদ্ধিবলে এই সকল অনুধাবন করিয়া যাহা কর্ত্তব্য তাহা অবধারণ করুন। মহাব্ৰত ভীষ্ম তৎকালে আমাকে বলপূর্ব্বক হরণ করিয়া আপনার [তাঁহার নিজের] বশবর্ত্তী করিয়াছেন, সুতরাং তিনি আমার এই দুৰ্দশার মূল কারণ; আপনি তাঁহাকে সংহার করুন। আমি তাঁহার নিমিত্তই ঈদৃশ দুঃখ প্রাপ্ত হইয়া অপ্রিয়ানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছি। ভীষ্ম অতিশয় লুব্ধ, নীচপ্রকৃতি ও সমরবিজয়ী; অতএব তাঁহাকেই ইহার প্রতীকার প্রদর্শন করা কর্ত্তব্য হইতেছে। তিনি যৎকালে আমার এই অপকার করেন, তখনই আমি তাঁহাকে সংহার করিব, এইরূপ সঙ্কল্প করিয়াছিলাম। এক্ষণে আপনি আমার এই মনোরথ সফল করুন। যেমন পুরন্দর [ইন্দ্ৰ] বৃত্ৰাসুরকে বিনাশ করিয়াছেন, তদ্রূপ আপনিও তাহাকে বিনষ্ট করুন।’ ”