১৭৩. অম্বা-প্ৰত্যাখ্যান

১৭৩তম অধ্যায়

অম্বা-প্ৰত্যাখ্যান

“ভীষ্ম কহিলেন, “মহারাজ। অনন্তর আমি জননী সত্যবতী, মন্ত্রী ও পুরোহিতের অনুমতিক্ৰমে কাশিরাজদুহিতা অম্বাকে গমন করিতে আদেশ করিলাম।” তখন অম্বা বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণপরিরক্ষিত ধাত্রীকর্ত্তৃক অনুসৃত হইয়া শাল্বপতির রাজধানীতে গমন করিলেন। পরে রাজধানী পথ অতিক্রম করিয়া ভূপালসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ। আমি আপনার উদ্দেশে আগমন করিয়াছি।” শাল্বপতি ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, “হে বরবর্ণিনি! তুমি অন্যপূর্ব্বা [একের উদ্দেশ্যে নিরূপিতা পাত্রী বিবাহের উদ্দেশ্যে অন্যকর্ত্তৃক গৃহীতা] হইয়াছ; আমি আর তোমার পাণিগ্রহণ করিব না; তুমি পুনরায় সেই ভীষ্মের সন্নিধানে গমন কর। তিনি অন্যান্য ভূপালগণকে পরাজিত করিয়া বলপূর্ব্বক তোমার করগ্রহণ করিয়াছেন; এই নিমিত্ত আমি আর তোমাকে প্রার্থনা করি না।

তুমি তৎকালে ভীষ্মের প্রতি অনুরক্ত হইয়াছিলে, সুতরাং আমার ন্যায় শাস্ত্ৰজ্ঞ ভূপতি অন্যের ধর্মোপদেষ্টা হইয়া কিরূপে অন্যপূর্ব্বা নারীকে অভিলাষ করিবেন? অতএব, গমনকাল অতিক্রান্ত হইতেছে; এক্ষণে তুমি স্বেচ্ছানুসারে গমন কর।”

“তখন একান্ত অনঙ্গশরপীড়িতা [কামবাণব্যথিতা] অম্বা শাল্বপতিকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি এরূপ কহিবেন না; ইহা কখনই সঙ্গত হইতে পারে না। আমি ভীষ্মের প্রতি প্রীতিমতী নহি; এ নিমিত্ত আমি অবিরল বাষ্পাকুললোচনে রোদন করিতেছিলাম; তথাপি তিনি অন্যান্য মহীপালগণকে পরাজিত করিয়া বলপূর্ব্বক আমাকে গ্ৰহণ করিলেন; আমি আপনার একান্ত ভক্ত, আমার কিছুমাত্র অপরাধ নাই; অতএব আপনি আমাকে গ্রহণ করুন; ধর্ম্মানুসারে নিরপরাধ ভক্তকে পরিত্যাগ করা প্রশস্ত নহে। এক্ষণে আমি ভীষ্মকে আমন্ত্রণ ও তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণ করিয়া আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। শ্রবণ করিয়াছি, মহাবাহু ভীষ্ম আপনার ভ্রাতার নিমিত্ত এই কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছেন, তিনি স্বয়ং আমাকে প্রার্থনা করেন না। বিবাহকাল উপস্থিত হইলে তিনি স্বীয় কনিষ্ঠভ্রাতা বিচিত্ৰবীৰ্য্যকে আমার কানীয়সী [কনিষ্ঠা] ভগিনী অম্বিকা ও অম্বালিকাকে প্রদান করিয়াছেন। হে রাজন। আমি মস্তক স্পর্শ করিয়া শপথ করিতেছি, আপনা ব্যতিরেকে অন্য বরকে ধ্যান করি না। আমি আত্মাকে স্পর্শ করিয়া [নিজ দেহে হাত দিয়া] সত্য কহিতেছি, আমি অন্যপূর্ব্বা নহি। এক্ষণে আমি স্বয়ং সমুপস্থিত হইয়া আপনার প্ৰসন্নতালাভের অভিলাষ করিতেছি, আপনি আমাকে গ্ৰহণ করুন ।”

শাল্বপ্রত্যাখ্যাতা অম্বার ভীষ্মনিধন-সঙ্কল্প

“অনন্তর কাশিরাজ দুহিতা অম্বা বারংবার এইরূপ প্রার্থনা করিলেও শাল্বরাজ সৰ্পের নির্মোক [পুরাতন ত্বক-খোলস] পরিত্যাগের ন্যায় তাঁহাকে ত্যাগ করিলেন; তাঁহার প্রতি কিছুতেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিলেন না। : তখন অম্বা রোষাবিষ্ট হইয়া বাষ্পাকুললোচনে গদগদ বচনে কহিলেন, “মহারাজ। আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন, এক্ষণে আমি যথা ইচ্ছা তথা প্রস্থান করি; সাধু ব্যক্তিরাই সত্যের ন্যায় আমার রক্ষক হইবেন।” শাল্বরাজ অম্বার এইরূপ বিলাপ ও পরিতাপবাক্য শ্রবণ করিয়াও তাঁহাকে পরিত্যাগ করিলেন এবং বারংবার কহিতে লাগিলেন, “হে নিতম্বিনী! তুমি এ স্থান হইতে প্রস্থান কর। মহাবীর ভীষ্ম তোমাকে গ্রহণ করিয়াছেন, আমি তাহার বলবীৰ্য্যে নিতান্ত ভীত ও শঙ্কিত হইতেছি।”

“অম্বা অদূরদর্শী শাল্বরাজকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া অতি দীনমনে কুররীর [উৎক্রোশ পক্ষী] ন্যায় রোদন করিতে করিতে রাজধানী হইতে নিৰ্গত হইলেন; মনে করিলেন, এই ভূমণ্ডলে আমার তুল্য দুঃখিনী রমণী আর নাই। আমি বান্ধবহীন হইয়াছি; শাল্বরাজও আমাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। ভীষ্ম আমাকে শাল্বরাজসন্নিধানে গমন করিতে অনুমতি করিয়াছিলেন, সুতরাং আমি পুনরায় হস্তিনানগরে গমন করিতে সমর্থ হইতেছি না। এক্ষণে আমি আপনার ভাগ্য কিংবা ভীষ্মকে নিন্দা করিব না। আর আমার স্বয়ংবরের অনুষ্ঠাতা সেই মূঢ় [কন্যাবিবাহ ব্যস্ততায় মোহাপন্ন] পিতাকেই বা কি নিমিত্ত নিন্দা করি? ইহা আমারই দোষ। প্রথমে তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইলে আমি যে ভীষ্মের রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া শাল্বরাজসন্নিধানে গমন করি নাই, তাহারই ফলভোগ করিতেছি। এক্ষণে সেই মূঢ়চেতাঃ পিতাকে ধিক! কারণ, তিনি আমাকে বীৰ্য্যশুল্কা করিয়াছেন বলিয়া আমি সকলের ত্যাজ্য হইয়াছি। আমাকে ধিক! ভীষ্মকে ধিক, শাল্বরাজকে ধিক এবং বিধাতাকেও ধিক! আমি তাঁহাদেরই দুষ্ট অভিপ্ৰায়ে এইরূপ কষ্টভোগ করিতেছি। এক্ষণে বোধ হইতেছে, মনুষ্যেরা স্ব স্ব ভাগ্যের ফলভোগ করিয়া থাকে। শান্তনুনন্দন ভীষ্মই আমার এই বিপদের নিদান। অতএব যুদ্ধদ্বারা হউক বা তপঃপ্রভাবেই হউক, ভীষ্মকে ইহার প্রতিফল প্রদান করিতে হইবে, কোন্ রাজা তাঁহাকে যুদ্ধে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবেন, এক্ষণে তাঁহারই অনুসন্ধান করা কর্ত্তব্য।’

অম্বার তপস্যা-ব্যবস্থা

“কাশিরাজদুহিতা অম্বা নগর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া এইরূপ নিশ্চয় করিয়া পুণ্যাত্মা তপস্বিগণের আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। পরে তাঁহাদিগকে ভীষ্মকর্ত্তৃক হরণ, গৃহগমনে অনুমোদন ও শাল্বের প্রত্যাখ্যানপ্রভৃতি বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করাইলেন এবং তথায় তাপসগণকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়া সেই যামিনী যাপন করিলেন।

“ঐ আশ্রমে শ্রৌত [বেদ]-স্মার্ত্ত [স্মৃতিবিহিত]-ক্রিয়াকুশল, ব্রহ্মবিৎ, শাস্ত্ৰজ্ঞ ও তপোবৃদ্ধ এক তপস্বী বাস করেন। তিনি শোকদুঃখপরায়ণা অম্বাকে ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া কহিলেন, “বৎসে! তোমার ত’ এইরূপ দুৰ্দশা ঘটিয়াছে, এক্ষণে আশ্রমবাসী তপস্বিগণ তোমার নিমিত্ত কিরূপ অনুষ্ঠান করিবেন?”

‘অম্বা কহিলেন, “হে তপোধনগণ! আপনারা আমার প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করুন। আমি সন্ন্যাসাশ্রম অবলম্বন করিয়া তপানুষ্ঠান করিব। আমার বোধ হইতেছে, আমি পূর্ব্বজন্মে মোহবশতঃ যেসকল পাপানুষ্ঠান করিয়াছি, ইহা তাহারই ফল। আমি শাল্বরাজকর্ত্তৃক নিরাকৃত [প্রত্যাখ্যান-দূরীকৃত] হইয়া নিরানন্দমনে স্বজনসন্নিধানে গমন করিতে আর অভিলাষ করি না। আপনারা দেবতুল্য, এক্ষণে অনুগ্রহ প্রদর্শনপূর্ব্বক আমাকে তপানুষ্ঠানবিষয়ে [তপস্যাচরণবিষয়ে] উপদেশ প্রদান করুন।” তখন সেই ব্ৰাহ্মণ দৃষ্টান্ত, শাস্ত্র ও যুক্তি প্রদানপূর্ব্বক তাঁহাকে আশ্বাসিত করিয়া অন্যান্য ব্রাহ্মণগণের সহিত তাঁহার কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিতে অঙ্গীকার করিলেন।”