১৫৩. দুৰ্য্যোধনের আদেশে কৌরবযুদ্ধসজ্জা

১৫৩তম অধ্যায়

দুৰ্য্যোধনের আদেশে কৌরবযুদ্ধসজ্জা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! ‘রাজা দুৰ্য্যোধন রজনী প্রভাত হইবামাত্র একাদশ অক্ষৌহিণী-সন্নিধানে গমন করিয়া মনুষ্য, হন্তী, রথ ও অশ্বসকলকে তাহাদিগের পুরোভাগ[সম্মুখভাগ], মধ্যভাগ ও পশ্চাদ্ভাগে সন্নিবিষ্ট হইতে আদেশ করিলেন। তখন বিচিত্র সৈন্যগণ অনুকর্ষ [যুদ্ধ করিতে করিতে রথের কোন কাঠ ভাঙ্গিয়া গেলে তাহা বদলাইবার কাঠ], মনোহর তূণীর [বাণাধার তূণ], বরূথ [রথ নির্ম্মাণে ব্যবহৃত ব্যাঘ্রাদির চর্ম্ম], তোমর [হস্তদ্বারা ক্ষেপণীয় লোহার ফলকমুখ দণ্ড], খড়্গ, ধ্বজ, পতাকা, শর, শরাসন [ধনুক], শক্তি [লৌহদণ্ড], নিষঙ্গ [পদাতিগণের ব্যবহাৰ্য্য লৌহদণ্ড], বিচিত্র রজ্জু, আস্তরণ [যুদ্ধপরিচ্ছদ], কবচগ্রহবিক্ষেপ [দণ্ডের মাথায় বঁড়শীর মত বক্রাকার লৌহ লাগান—যাহা দূর হইতে বিপক্ষের বর্মে লাগাইয়া টানিয়া আনা যায়], তৈল [* বিপক্ষ পক্ষে নিক্ষেপার্থ তপ্ত তৈল, গরম গুড়, জল, বালি ও সরিষা। হাঁড়ীর মধ্যে বিষধর সর্প-উহা বিপক্ষগণের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়।], শুড় [*], সলিল [*], ঘৃত, বালুকা [*], সর্ষপ [*], কুম্ভ [*], ধূনকৰ্পচূৰ্ণ [ধুনা], ঘণ্টিকাফলক-লৌহাস্ত্র [ঘুঙুর দেওয়া বর্শা], উপল [পাথরের নুড়ি], শূল, ভিন্দিপাল [লৌহফলক দণ্ড], মধুচ্ছিষ্ট [মোম], মুদগর, কাণ্ডদণ্ড [লৌহকণ্টক ফলক দণ্ড], লাঙ্গল [বিষমাখা লাঙ্গলবৎ ফলকযুক্ত দণ্ড], বিষ, শূর্প [তপ্ত বালুকা নিক্ষেপার্থ কুলা], পিটক [মঞ্জুষা-কুলা প্রভৃতির রক্ষার্থ পেটরা], দাত্র [দা], অঙ্কুশ [হাতী চালাইবার বক্রমুখ লৌহদণ্ড—ডাঙস], কণ্টকযুক্ত কবচ [বিপক্ষ মুষ্টি মারিতে না পারে, এই জন্য উপরে লৌহকণ্টকাবৃত বর্ম্ম], বাসী [কাষ্ঠছেদনাৰ্থ কুঠারের মত অস্ত্ৰ—বাইস বা বাস্যা], লৌহ-কণ্টক [লোহার কাঁটা], শৃঙ্গ [গদাঘাতে স্ফীত স্থানের দূষিত রক্ত বাহির করিবার জন্য ছুঁচাল শিং], ঋষ্টি [লৌহ-ফলকযুক্ত কাষ্ঠদণ্ড], ভল [বক্রাগ্র খড়গ], কুঠার [কুড়োল], কুর্দ্দাল [কোদাল], তৈলাক্ত ক্ষৌমবস্ত্ৰ [তৈলমাখা রেশমের বস্ত্ৰ— উহার ভস্ম বেদনাস্থলে লাগাইলে উপশম হয়], অন্যান্য বিবিধ আয়ুধ [অন্ত্র] গ্রহণ ও নানাপ্রকার মণি এবং সুবৰ্ণাভরণ ধারণ করিয়া ব্যাঘ্রচর্ম্মাচ্ছাদিত দ্বীপি [চিতাবাঘ] চর্ম্মপরিবেষ্টিত রথে আরোহণপূর্ব্বক প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। সৎকুলসম্ভূত শস্ত্রবিশারদ অশ্বতত্ত্বজ্ঞ কবচধারী মহাবল বীর সকল সারথিকাৰ্য্যে নিযুক্ত হইলেন। শর, শরাসন প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রসহকৃত পতাকা পরিশোভিত৷ অসিচর্ম্মপট্টিশ [খড়গ, ঢাল ও তারোয়াল] সম্পন্ন, ঘণ্টাচামরাদিযুক্ত উৎকৃষ্ট তুরগ [অশ্ব] চতুষ্টয়যোজিত রথসকল পরিদৃশ্যমান [দৃষ্ট] হইতে লাগিল। যোদ্ধগণ ঐ সকল রথে অশুভহর যন্ত্র [অমঙ্গলনাশক ঔষধযুক্ত কবচ] ও ঔষধসকল বন্ধন করিলে পর ঐ সকল রথ সুরক্ষিত নিতান্ত দুরাক্রম্য নগরের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। একজন হয়তত্ত্ববেত্তা [অশ্ববিজ্ঞানবিৎ] ধূরসন্নিহিত [অশ্বপার্শ্বস্থ বন্ধনকাষ্ঠ] ও অশ্বদ্বয়ের রক্ষক ও দুইজন রথিশ্রেষ্ঠ পার্ষ্ণি-সারথি [অশ্বের পার্শ্বরক্ষক] হইল।

বদ্ধকক্ষায় [হস্তিপৃষ্ঠস্থ কাঠের ক্ষুদ্র গৃহাকার উপবেশন স্থানে– হাওদায়] পরিশোভিত অলঙ্কৃত হস্তিসকল রত্নসম্পন্ন পর্ব্বতের ন্যায় প্রতীয়মান হইয়া উঠিল। তাহাদিগের রক্ষা করিবার নিমিত্ত দুইজন অঙ্কুশধারী, দুইজন ধনুৰ্দ্ধারী, দুইজন খড়গধারী এবং একজন শক্তি ও ত্রিশূলধারী নিযুক্ত হইল। তখন দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণ সর্ব্বপ্রকার আয়ুধ-কোষসম্পন্ন [কোষাবদ্ধ খড়গাদি শস্ত্রসমন্বিত] মত্তমাতঙ্গদ্বারা পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। কবচধারী, পতাকাসম্পন্ন অলঙ্কৃত অশ্বারোহীসকল অশ্বে আরোহণ করিল। পুতগতিরহিত [এদিক-ওদিক না বেঁকিয়া সম্মুখভাগে সবলে দ্রুতগতিসম্পন্ন], সম্যক শিক্ষিত, সুবৰ্ণালঙ্কারে অলঙ্কৃত শতসহস্ৰ অশ্ব আরোহীদের বশবর্ত্তী হইয়া রহিল। বহুবিধ রূপধারী, কবচশস্ত্রসম্পন্ন, সুবর্ণমাল্যপরিশোভিত পদাতিগণ যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইতে লাগিল। এক এক রথের দশ দশ হস্তী, প্রত্যেক হস্তীর দশ দশ অশ্ব ও প্রত্যেক অশ্বের দশ দশ পদাতি পাদরক্ষক হইল অথবা এক এক রথের পঞ্চাশৎ পঞ্চাশৎ হস্তী, প্রত্যেক হস্তীর শত শত অশ্ব ও প্রত্যেক অশ্বের সাত সাত পদাতি পাদরক্ষা করিতে লাগিল। পাঁচশত হস্তী, পাঁচশত রথ, পাঁচশত অশ্ব ও পঞ্চবিংশতি শত পদাতিতে এক সেনা হয়, দশ সেনাতে এক পৃতনা ও দশ পৃতনাতে এক বাহিনী হইয়া থাকে। ইহাদিগের সাধারণ নাম সেনা, বাহিনী, পৃতনা, ধ্বজিনী, চমু ও বরূথিনী।

এইরূপে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সঙ্কলিত হইল; তাহার মধ্যে মহারাজ দুৰ্য্যোধন একাদশ অক্ষৌহিণী সংগ্ৰহ করিলেন এবং পাণ্ডবগণের সাত অক্ষৌহিণী সংগৃহীত হইল। পঞ্চপঞ্চাশৎ পদাতিতে এক পত্তি ও তিন পত্তিতে এক সেনামুখ হয়; ইহা গুল্ম শব্দেও অভিহিত হইয়া থাকে। তিন গুল্মে এক গণ হয়; কুরুসৈন্যমধ্যে অযুত অযুত গণ নিযুক্ত ছিল। রাজা দুৰ্য্যোধন মহাবলপরাক্রান্ত বুদ্ধিমান্ মনুষ্যদিগকে পরীক্ষা করিয়া সেনাপতিপদে নিযুক্ত করিলেন এবং পৃথক পৃথক সেনানায়ক পার্থিবগণকে আনয়ন করিয়া পূর্ব্বেই সেনানায়কপদে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন। এক্ষণে তিনি মহাবীর কৃপ, দ্রোণ, শল্য, জয়দ্ৰথ, কাম্বোজাধিপতি সুদক্ষিণ, কৃতবর্ম্মা, অশ্বত্থামা, কৰ্ণ ভূরিশ্রবা, শকুনি, সৌবল ও মহাবল বাহ্লীক, ইঁহাদিগকে প্রতিদিন দুইবেলা সর্ব্বসমক্ষে বিধিবৎ অর্চ্চনা করিতে লাগিলেন এবং যাহারা ঐ সমস্ত মহাবীরগণের বশবর্ত্তী, তাহারাও দুৰ্য্যোধনের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত সৈন্যগণের অন্তনিবিষ্ট হইল।