১৪৯. সৈন্যনিৰ্য্যাণপর্ব্বাধ্যায়—পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধোদ্যোগ

১৪৯তম অধ্যায়

সৈন্যনিৰ্য্যাণপর্ব্বাধ্যায়—পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধোদ্যোগ

বৈশম্পয়ন কহিলেন, মহারাজ!! ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া তাঁহারই সমক্ষে ভ্রাতৃগণকে কহিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ! কৌরবসভায় যেরূপ কথোপকথন হইল এবং বাসুদেবের যে প্রকার অভিপ্রায়, তোমরা তাহা সম্যক অবধারণ করিলে; অতএব এক্ষণে আমার সেনাসমুদয় বিভাগ কর। এই সাত-আক্ষৌহিণী সেনা বিজয়ার্থ সমবেত হইয়াছে। মহাবীর দ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন, চেকিতান, সাত্যকি ও ভীমসেন এই সাতজন সেই সাত-আক্ষৌহিণী সেনার নায়ক হইবেন; ইঁহারা সকলেই বেদপারগ, যুদ্ধবিশারদ, অস্ত্রবেত্তা, সচ্চরিত্র, লজ্জাশীল ও নীতিকুশল এবং রণস্থলে শরীরপাত করিতেও উদ্যত আছেন। হে সহদেব! যিনি এই সাতজন সেনাপতির নায়ক হইতে পারেন এবং সংগ্রামে মহাবলপরাক্রান্ত জ্বলন্ত অনলসঙ্কাশা [অগ্নিতুল্য উজ্জ্বল] ভীষ্মের শরজালের তেজ সহ্য করিতে সমর্থ হয়েন, এমন এক সেনাবিভাগনিপুণ ব্যক্তিকে নির্দ্দেশ করিয়া বল। হে পুরুষপ্রবর! কে আমাদিগের সেনাপতিপদে প্রতিষ্ঠিত হইবার উপযুক্ত, তদ্বিষয়ে তুমি আত্মমত প্রকাশ কর।”

সেনাপতিনির্ব্বাচন-ব্যবস্থা

সহদেব কহিলেন, “মহারাজ! আমরা যাঁহার আশ্রয়লাভ করিয়া পৈতৃক রাজ্যাংশপ্রাপ্তির নিমিত্ত উদ্যুক্ত হইতেছি, যিনি আমাদের সমদুঃখসুখ [সুখ-দুঃখে তুল্যজ্ঞানী] মিত্র, সেই যুদ্ধদুর্ম্মদ [সমরোন্মুক্ত] মহাবীর বিরাটই রণস্থলে ভীষ্ম ও অন্যান্য মহারথগণের বলবীৰ্য্য সহ্য করিতে সমর্থ হইবেন।”

অনন্তর বাক্যবিশারদ নকুল কহিলেন, “মহারাজ! যিনি বয়স শাস্ত্ৰজ্ঞান, ধৈৰ্য্য, কুল ও আভিজাত্যসম্পন্ন [কুলমৰ্যাদাযুক্ত], যিনি মহর্ষি ভরদ্বাজ দুৰ্দ্ধৰ্ষ [দুৰ্দমনীয়—দুর্নিবার] ও সত্যপ্রতিজ্ঞ, যিনি মহাবীর ভীষ্ম ও দ্রোণের প্রতি প্রতিনিয়ত স্পর্দ্ধা প্রকাশ করিয়া থাকেন, যিনি শতশাখাসম্পন্ন বৃক্ষের ন্যায় পুত্রপৌত্ৰগণপরিণত ও পার্থিবগণের শ্লাঘনীয়, যিনি দ্রোণবিনাশের নিমিত্ত রোষাপরবশ হইয়া স্বীয় সহধর্মিণীসমভিব্যাহারে অতি কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়াছিলেন, যিনি পিতার ন্যায় সতত আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকেন, সেই দিব্যাস্ত্ৰবিৎ [প্রধান প্রধান অস্ত্রে অভিজ্ঞ] দ্রুপদরাজিই আমাদিগের সেনাপতি হইবেন, তিনি ভীষ্ম ও দ্রোণের বিক্রম অনায়াসে সহ্য করিতে পরিবেন।”

ধৃষ্টদ্যুম্নের সেনাপতিত্বে অর্জ্জুনের অনুমোদন

অনন্তর অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ! যে অনলসঙ্কাশ দিব্যপুরুষ তপোবলে ও মহর্ষিগণের সন্তোষ প্রভাবে শরাসন, কবচ ও খড়্গ ধারণ এবং দিব্য-অশ্বসংযোজিত রথে আরোহণ করিয়া মহামেঘের ন্যায় রথঘর্ঘরশব্দে [রথচক্রের ধ্বনি] দিঙ্মণ্ডল প্ৰতিধ্বনিত করিয়া অগ্নিকুণ্ড হইতে উত্থিত হইয়াছিলেন; যাঁহার স্কন্ধ, ভুজযুগল ও বক্ষঃস্থল সিংহের ন্যায়; যাঁহার ভ্রূ, দন্তপংক্তি, হনূ [চোয়াল], মুখমণ্ডল ও লোচনযুগল অতি রমণীয়; যাঁহার জক্রু [কণ্ঠের উভয় পার্শ্বের হাড়] গৃঢ়া [অস্থূল—সরু] এবং চরণদ্বয় সুগঠিত; যিনি সর্ব্বশস্ত্রের অভেদ্য এবং যিনি দ্রোণবিনাশের নিমিত্ত প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন; সেই সিংহের ন্যায় গর্জ্জনশীল, বলবিক্রমশালী, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয় ধৃষ্টম্যুম্ন ভীষ্মদেবের অশনিসংস্পৰ্শ [বজ্রাগ্নির ন্যায় দাহ্যগুণযুক্ত], প্ৰদীপ্তমুখ ভুজঙ্গতুল্য, বেগে যমদূতসম, নিপাতবিষয়ে পাবক[আশুধ্বংস বিষয়ে অগ্নি]-সদৃশ ও বজ্রের ন্যায় কঠিন শরজাল অনায়াসে সহ্য করিতে সমর্থ হইবেন। পূর্ব্বে ভগবান রাম [পরশুরাম] রণস্থলে ঐ সমস্ত শর সহ্য করিয়াছিলেন। হে মহারাজ! এক্ষণে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন-ব্যতিরেকে মহাব্ৰত ভীষ্মের পরাক্রম সহ্য করিতে কে সমর্থ হইবে! তিনি দুর্ভেদ্য কবচধারী ও ক্ষিপ্ৰহস্ত এবং যুথপতি মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ, আমার মতে তিনিই সেনাপতি হইবার উপযুক্ত পাত্র।”

ভীমের সমর্থন

ভীমসেন কহিলেন, “মহারাজ! সিদ্ধপুরুষ ও মহর্ষিগণ কহিয়া থাকেন, দ্রুপদাত্মজ শিখণ্ডী ভীষ্মের বন্ধসাধনাৰ্থ সমুৎপন্ন হইয়াছেন; তিনি যখন সমরমধ্যে দিব্যাস্ত্ৰজাল বিস্তার করেন, তৎকালে লোকে মহাত্মা রামের ন্যায় তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া থাকে। স্যান্দন[রথ]স্থিত বর্ম্মধারী শিখণ্ডীকে সমরে সংহার করিতে কে সমর্থ হইবে? তিনি ভিন্ন দ্বৈরথযুদ্ধে ভীষ্মকে বিনাশ করিতে কেহই সক্ষম হইবেন না। অতএব আমার মতে তিনিই সেনাপতি হইবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত পাত্র।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ভ্ৰাতৃগণ! বাসুদেব সমস্ত জগতের সারাৎসার [সারবান], বলাবল ও ইহাদের অভিপ্রায়ও সম্যক অবগত আছেন; এক্ষণে ইনি যাঁহাকে নির্দ্দেশ করিবেন, আমি তাঁহাকেই সেনাপতিপদে নিয়োগ করিব। কৃষ্ণ কৃতাস্ত্র বা অকৃতাস্ত্রই হউন, বৃদ্ধ বা যুবাই হউন, ইনিই আমাদিগের জয়পরাজয়ের মূল কারণ। একমাত্র ভগবান বাসুদেব সমস্ত প্ৰাণ, রাজা, ভাব, অভাব, সুখ, অসুখ সকলই প্রতিষ্ঠিত আছে, ইনি ধাতা ও বিধাতা, ইঁহাতেই সমস্ত সিদ্ধি বিদ্যমান রহিয়াছে। অতএব কোন ব্যক্তি আমাদিগের সেনাপতি হইবেন, ইনি তাহা অবধারণ করুন। রজনী সমুপস্থিত হইল, এক্ষণে আমরা সেনাপতির বিষয় অবধারণা করিয়া প্রাতঃকালে অস্ত্রশস্ত্রাদির অধিবাসন [জয়াবহ সংস্কার] ও স্বস্তিবাচনপূর্ব্বক কৃষ্ণের আদেশানুসারে সমরাঙ্গনে গমন করিব।”

কৃষ্ণানুমোদন ধৃষ্টদ্যুম্নের সৈনাপত্যগ্রহণ

অনন্তর কৃষ্ণ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া অর্জ্জুনের মুখ নিরীক্ষণপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! ইহারা যেসকল ব্যক্তির নামোল্লেখ করিলেন, তাঁহারাই সেনাপতির উপযুক্ত, শত্রুজয়ে সুসমর্থ। তাঁহারা রণস্থলে অবতীর্ণ হইলে লুব্ধপ্রকৃতি পাপাত্মা ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের কথা দূরে থাকুক, দেবরাজ ইন্দ্রের অন্তঃকরণেও ভয়সঞ্চার হয়। আমি আপনার হিতানুষ্ঠানের নিমিত্ত সন্ধিসংস্থাপনবিষয়ে একান্ত যত্ন করিয়াছি, অতএব এক্ষণে আমরা ধর্মের ঋণ হইতে বিনির্ম্মুক্ত হইলাম এবং লোকের নিকটেও নিন্দনীয় নহে। অবিচক্ষণ বালক দুৰ্য্যোধন আপনাকে [নিজেকে] অস্ত্রশস্ত্ৰে সুনিপুণ ও বলসম্পন্ন জ্ঞান করিয়া থাকে। অতএব আপনি সেনাসকল সুসজ্জিত করুন। ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ মহাবীর ধনঞ্জয়, ক্ৰোধনস্বভাব ভীমসেন, যমোপম নকুলসহদেৱ, যুযুধান, অভিমন্যু, বিরাট, দ্রুপদ, দ্ৰৌপদীতনয় ও অন্যান্য মহাবলপরাক্রান্ত অক্ষৌহিণীনায়কদিগকে নিরীক্ষণ করিলে রণস্থলে অবস্থান করিতে কদাচি সমর্থ হইবে না। আমাদিগের দুরাসদ [ভয়ঙ্কর] দুষ্প্রধর্ষ [দুৰ্দমনীয়] মহাবল সৈন্যসমুদয় সংগ্রামে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের সেনাদিগকে সংহার করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে মহারাজ! আমার মতে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুন্ন সেনাপতি হউন।”

পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধসজ্জার সাড়া

বাসুদেব এইরূপ কহিলে তত্রস্থ ভূপালসকল একান্ত হৃষ্ট ও নিতান্ত সন্তুষ্ট হইলেন; তাঁহাদিগের অতি গভীর আনন্দকোলাহল সমুত্থিত হইল। ইতস্ততঃ ধাবমান সৈন্যগণের ‘সাজ সাজ’ শব্দ, অশ্বের হ্রেষারব, মাতঙ্গগণের বৃংহিত, রথচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি এবং শঙ্খ ও দুন্দুভিনিনাদে চতুর্দ্দিক ব্যাপ্ত হইয়া উঠিল। দূতসকল ইতস্ততঃ ধাবমান হইল; পাণ্ডবগণ সসৈন্য যুদ্ধযাত্ৰা করিবার নিমিত্ত বর্ম্মধারণ করিতে লাগিলেন; তখন রথমাতঙ্গ জনপদসমাকুল সেনাসমাগম ঊৰ্ম্মি[তরঙ্গ—ঢেউ]মালাসঙ্কুল মহাসাগরের ন্যায় একান্ত ক্ষুব্ধ ও পরিপূর্ণ গঙ্গার ন্যায় নিতান্ত দুৰ্দ্ধর্ষ [দুর্নিরীক্ষ্য] হইয়া উঠিল। পাণ্ডবেরা প্রাচীর নির্ম্মাণ ও বীরপুরুষ নিয়োজন দ্বারা স্ত্রী ও সমস্ত ধনের রক্ষাবিধান এবং অর্থীদিগকে সুবর্ণ ও ধেনুদান করিয়া, রথারোহণপূর্ব্বক সেনাসমভিব্যাহারে গমন করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণেরা তাঁহাদিগের স্তুতিবাদে[জয়াশীর্ব্বাদসূচক প্রশংসা বাক্যোচ্চারণে] প্রবৃত্ত হইলেন। ভীমসেন, মাদ্রীতনয় নকুলসহদেব, অভিমনু, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন, প্রভদ্রক ও পাঞ্চালগণ সেনামুখে গমন করিতে লাগিলেন। তখন সেনাগণের মধ্য হইতে সমুদ্রের ন্যায় ঘোরতর শব্দ সমুথিত হইয়া নভোমণ্ডল স্পর্শ করিল। ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই সেনাবিদারণপটু[বিপক্ষ সৈন্যের ভঙ্গীকারী] স্বীয় সৈন্যগণের মধ্যবর্ত্তী হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। শকট, আপণ[বাজার দোকান], বেশ্যাগণ[বিপক্ষ সৈন্যের মোহনাৰ্থ বেশ্য সংগ্ৰহ], যান, বাহন, কোষ, যন্ত্র, আয়ুধ, অস্ত্ৰচিকিৎসক ও চিকিৎসকসকল তাঁহার সমভিব্যাহারে যাত্ৰা করিল। রাজা যুধিষ্ঠির সমস্ত পরিচারক এবং অকৰ্মণ্য ও দুর্ব্বল সৈনিক পুরুষদিগকে সংগ্ৰহ করিয়া লইলেন [যুদ্ধের অন্যত্র রাখিয়া দিলেন]। সত্যবাদিনী দ্রুপদনন্দিনী দাসী ও দাসগণকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়া উপপ্লব্যানগরে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

কৈকেয়গণ, ধৃষ্টকেতু, কাশীরাজপুত্র বিভু, শ্রোণিমান, বসুদান ও শিখণ্ডী— ইঁহারা বিবিধ অলঙ্কার, অস্ত্রশস্ত্র ও বর্ম্মধারণ করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরকে বেষ্টনপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। বিরাট, যজ্ঞসেন, সৌমিক, সুশর্ম্মা, কুন্তীভোজ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের আত্মজগণ সৈন্যের পশ্চিমাৰ্দ্ধে গমন করিলেন। অনাবৃষ্টি, চেকিতান, ধৃষ্টকেতু এবং সাত্যকি— ইহারা চারি-অযুত রথ, দুইলক্ষ অশ্ব, চারিলক্ষ পদাতি ও ছয়-অযুত হস্তী লইয়া বাসুদেব ও ধনঞ্জয়কে বেষ্টনপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর পাণ্ডবগণ কুরুক্ষেত্রে উপনীত হইয়া বৃষভের ন্যায় ঘোরতর নিনাদ ও শঙ্খধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন। বিশেষতঃ, বাসুদেব ও অর্জ্জুন অধিকতর শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। সৈন্যগণ বজনির্ঘোষিসদৃশ সেই পাঞ্চজন্যনিনাদ [পাঞ্চজন্যনামক প্ৰসিদ্ধ শঙ্খের ধ্বনি] শ্রবণগোচর করিয়া নিতান্ত সন্তুষ্ট হইল। শঙ্খদুন্দুভিধ্বনিতসহকৃত বীরগণের সিংহনাদে পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও মহাসাগর প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।