১৪৮. কৃষ্ণের কৌশলবাক্য-দুৰ্য্যোধনের যুদ্ধোদ্যোগ

১৪৮তম অধ্যায়

কৃষ্ণের কৌশলবাক্য-দুৰ্য্যোধনের যুদ্ধোদ্যোগ

কৃষ্ণ কহিলেন, “হে ধর্ম্মানন্দন! মহাত্মা ভীষ্ম, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী এইপ্ৰকার উপদেশ প্রদান করিলেও দুর্ম্মতি দুৰ্য্যোধন প্রতিবোধিত [জাগরিত—বিগতমোহ] হইল না। ঐ দুরাত্মা তত্রস্থ সমুদয় সভ্যগণের প্রতি অনাস্থ [১১] প্রদর্শনপূর্ব্বক ক্ৰোধবক্তনয়নে গাত্ৰোত্থানাপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিল; ক্ষীণায়ু [অবিশ্বাস] ভূপতিগণ তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইল। দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রতনয় সেই ভূপতিগণকে পুনঃ পুনঃ কহিতে লাগিল, “হে ভূপালগণ! আদ্য পুষ্যানক্ষত্র! অতএব সকলে কুরুক্ষেত্রে গমন কর।” কালপ্রেরিত [যুদ্ধে সম্ভাবিতমৃত্যু]। ভূপালগণ দুর্য্যেধনের অনুজ্ঞাক্রমে ভীষ্মকে সেনাপতি করিয়া হৃষ্টচিত্তে সৈন্যগণসমভিব্যাহারে ত্বরায় গমন করিতে লাগিল। তালকেতু [যাহার রথধ্বজে তালতরু অঙ্কিত] ভীষ্ম কৌরবগণের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনার সম্মুখে অবস্থিতি করিয়া অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিলেন।

“হে নরনাথ! কুরুসভামধ্যে মহাত্মা ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র ও মনস্বিনী গান্ধারী আমার সমক্ষে যাহা যাহা কহিয়াছিলেন এবং অন্যান্য যেসমুদয় ঘটনা হইয়াছিল, তাহা আপনাকে কহিলাম; এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য হয়, করুন। হে রাজন! আমি আপনাদের উভয় পক্ষের পরস্পর সৌভ্রাত্রসংস্থাপন, বংশের অভেদ ও প্ৰজাগণের বৃদ্ধির নিমিত্ত সর্ব্বাগ্রে সমবাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলাম; কিন্তু যখন দেখিলাম দুৰ্য্যোধন সন্ধিস্থাপনে সম্মত নহে, তখন সমুদয় ভূপতিগণকে একত্ৰ করিয়া দেবমানুষসম্পর্কীয় কার্য্যের কীর্ত্তন, অদ্ভুত অমানুষ, দারুণ কর্ম্মপ্রদর্শন, সেই সমুদয় ভূপতিগণকে ভৎসন, দুৰ্য্যোধনকে তৃণজ্ঞান, ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণকে কপট দূতনিবন্ধন নিন্দা এবং কর্ণ ও শকুনিকে বারংবার ভয় প্রদর্শনপূর্ব্বক ভেদোৎপাদন করিতে লাগিলাম।

“এইরূপে সেই সমুদয় ভূপতিদিগকে বাক্য ও মন্ত্রণাদ্বারা ভেদিত [মতদ্বৈধসমন্বিত] করিয়া পরিশেষে কুরুবংশীয়গণের অভেদ [* সাম, দান, ভেদ, দণ্ড—শত্ৰু বশ করিতে এই চারিটি প্রধান উপায়। দুৰ্য্যোধনের পক্ষ হইয়া যাহারা যুদ্ধ করিবে, কৃষ্ণ তাঁহাদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি উৎপাদন করিলেন; কিন্তু কুরু-পাণ্ডবের ভেদোৎপাদন অবাঞ্ছনীয়বোধে অভিমানপ্রিয় দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি কর্ত্তৃপক্ষের প্রতি ভেদনীতি প্রয়োগ না করিয়া দমননীতি প্রয়োগ করিলেন।] ও স্বকাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত দানপক্ষ [*] অবলম্বনপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনকে কহিলাম, “হে ধৃতরাষ্ট্রতনয়! মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডবগণ স্ব স্ব মান পরিত্যাগপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর ও ভীষ্মের আজ্ঞানুবর্ত্তী ও অধীন হইয়া কালাতিপাত করিবেন ও উহাদের বাক্যানুসারে তোমাকে সমুদয় রাজ্য প্ৰদানপূর্ব্বক আপনারা অনীশ্বর [পরাধীন] হইয়া থাকিবেন। সমুদয় রাজ্য তোমারই হইবে, পিতামহ ভীষ্ম, বিদুর ও তোমার বাক্যানুসারে তোমাকে কেবল র্ত্তাহাদের পঞ্চভ্রাতাকে পঞ্চগ্রাম প্ৰদান করিতে হইবে; পাণ্ডবগণ তোমার পিতার অবশ্য পোষ্য [প্রতিপাল্য]।

“হে ধৰ্মরাজ! দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন আমার এই বাক্যেও সম্মত হইল না; সুতরাং কৌরবগণের প্রতি চতুর্থ উপায় দণ্ডপ্রয়োগব্যতীত উপায়ান্তর দেখিতেছি না; দুৰ্য্যোধনের সংগৃহীত ভূপতিগণ কালপ্রেরিত হইয়া বিনাশের নিমিত্ত কুরুক্ষেত্রে গমন করিয়াছে। হে মহারাজ! কৌরবসভায় যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তৎসমুদয় আপনার নিকট কীর্ত্তন করিলাম। লোকবিনাশের হেতুভূত, আসন্ন্যমৃত্যু কৌরবগণ বিনাযুদ্ধে আপনাকে কদাপি রাজ্যপ্ৰদান করিবে না।”

ভগবদ্যানপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত