১৪২. বিদুরকর্ত্তৃক কুন্তীকে সন্ধিভঙ্গ-সংবাদদান

১৪২তম অধ্যায়

বিদুরকর্ত্তৃক কুন্তীকে সন্ধিভঙ্গ-সংবাদদান

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! যদুবংশাবতংস মহাত্মা বাসুদেব এইরূপে অকৃতকাৰ্য্য হইয়া কুরুকুল হইতে পাণ্ডবগণের সমীপে গমন করিলে পর, মহামতি বিদুর কুন্তীর নিকট আগমনপূর্ব্বক শোকাকুলিতচিত্তে [শোকে ব্যাকুলিতচিত্তে] শনৈঃ শনৈঃ কহিতে লাগিলেন, “হে কুন্তি! বিগ্ৰহ [যুদ্ধ] বিষয়ে আমার বিলক্ষণ অসম্মতি আছে, তাহা আপনার অবিদিত নাই। আমি অনুক্ষণ দুৰ্য্যোধনকে সন্ধি করিতে অনুরোধ করিতেছি, তথাপি ঐ দুরাত্মা কোনমতেই আমার বাক্যে কৰ্ণপাত করে না। মহারাজ যুধিষ্ঠির উপপ্লব্যানগরে বাস করিতেছেন; চেদি, পাঞ্চাল ও কৈকেয়বংশীয়গণ এবং ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব ও কৃষ্ণ প্রভৃতি মহাপ্রভাব বীরগণ তাঁহার সহায়; তথাপি তিনি জ্ঞাতি, সৌহার্দ্য ও ধর্ম্মরক্ষার নিমিত্ত বলবান হইয়াও দুর্ব্বলের ন্যায় সন্ধিসংস্থাপনে যত্ন করিতেছেন। বয়োবৃদ্ধ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের শান্তিপথাবলম্বনে কিছুমাত্র বাসনা নাই, তিনি পুত্ৰমদে মত্ত হইয়া অধৰ্ম-পথের পথিক হইয়াছেন। স্পষ্টই বোধ হইতেছে, জয়দ্ৰথ, কৰ্ণ, দুঃশাসন ও শকুনির দুবুদ্ধিপ্রভাবে অচিরাৎ পরস্পর ভেদ সমুপস্থিত হইবে। যাহারা ধাৰ্মিকের প্রতি এইরূপ অধৰ্মব্যবহার করিয়া বৈরানিল প্ৰজ্বলিত করিয়া থাকে, তাহারা অবশ্যই অচিরাৎ কর্মের ফলপ্ৰাপ্ত হয়। কৌরবগণ বলপূর্ব্বক ধর্ম্ম বিনষ্ট করিলে কাহার মন বিক্ষোভিত না হইবে? দেখুন, কেশব যখন সন্ধিস্থাপনে অকৃতকাৰ্য্য হইয়া প্রতিনিবৃত্ত হইয়াছেন, তখন পাণ্ডবগণ অবশ্যই সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবেন, তাহা হইলেই কৌরবগণের অনয়নিবন্ধন [অন্যায়ের জন্য] অসংখ্য বীরপুরুষ অকালে কালকবলে [মৃত্যুমুখে] প্রবেশ করিবে। হে ভদ্রে! আমি এই চিন্তায় আকুল হইয়া দিবারাত্ৰ নিদ্রাসুখে বঞ্চিত হইয়াছি।”

ভাবী জ্ঞাতি-বধে কুন্তীর চিন্তা

মনস্বিনী কুন্তী বিদুরের বাক্যশ্রবণে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, অর্থে ধিক! ঐ অর্থের নিমিত্ত এই যুদ্ধে জ্ঞাতিবধ ও সুহৃদ্বর্গের পরাভব হইবে। পাণ্ডব, চেদিবংশীয় ও যাদবগণ একত্ৰ হইয়া কৌরবগণের সহিত সংগ্ৰাম করিবে। ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি আছে? ধনহীনের সংগ্রাম দোষাবহ বলিয়া স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে, আর যুদ্ধ না করিলে পরাভব হইয়া থাকে; অতএব ধনহীনের মৃত্যুই শ্ৰেয়ঃ; জ্ঞাতিক্ষয় করিয়া জয়লাভ করা কখনই কর্ত্তব্য নহে। হায়! এই সমুদয় চিন্তায় আমার হৃদয় দুঃখানলে দগ্ধ হইতেছে। শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, যোধাগ্রগণ্য [যোদ্ধশ্রেষ্ঠ] দ্রোণাচাৰ্য্য ও কর্ণ দুৰ্য্যোধনের পক্ষ হইয়া আমার ভয়াবৰ্দ্ধন করিতেছেন। অথবা আচাৰ্য্য দ্রোণ স্বেচ্ছাক্রমে কখনই শিষ্যগণের সহিত সংগ্ৰাম করিবেন না, ভীষ্মই বা কি বলিয়া পাণ্ডবগণের প্রতি চিরপোষিত সুহৃদ্ভাব পরিত্যাগ করিবেন? কেবল বৃথাদৃষ্টি [মিথ্যাদশী] মোহানুবর্ত্তী অনর্থনরত বলবান দুরাত্মা কৰ্ণ পাপমতি দুৰ্য্যোধনের বশবর্ত্তী হইয়া পাণ্ডবগণকে দ্বেষ করে বলিয়া আমার মন সতত দগ্ধ হইতেছে।

কুন্তীর কর্ণসন্নিধানে গমন

“অতএব আজি কর্ণের নিকট তাহার জন্মবৃত্তান্ত বৰ্ণন করিয়া পাণ্ডবগণের প্রতি তাহার মন প্ৰসন্ন করিবার চেষ্টা করিব। আমি বাল্যকালে বিশ্বস্ত সখীগণে পরিবৃত হইয়া পিতা কুন্তীভোজের অন্তঃপুরে বাস করিতাম। ঐ সময় ভগবান দুর্ব্বাসা আমার ভক্তিভাবে পরিতুষ্ট হইয়া আমাকে দেবাহানমন্ত্র প্রদান করেন। আমি ব্যাকুলচিত্তে স্ত্রীভাব ও বালস্বভাবপ্রযুক্ত বারংবার মন্ত্রের বলাবল ও ব্রাহ্মাণের বাক্যবল চিন্তা করিতে লাগিলাম এবং কিরূপে পিতার চরিত্রে দোষস্পর্শ না হয়, আর কিরূপেই বা আমি আপনি সুকৃতিশালিনী ও অনপরাধিনী হইব, এই বিবেচনা করিয়া নিতান্ত কৌতুহল ও অজ্ঞানপ্ৰযুক্ত ব্ৰাহ্মণকে নমস্কার করিয়া সেই মন্ত্রপাঠ্যপূর্ব্বক সূৰ্য্যদেবকে আহ্বান করিলাম। সূৰ্য্যদেব মন্ত্রপ্রভাবে আমার নিকট আগমন করিয়া কন্যাবস্থাতেই আমার গর্ভে কৰ্ণকে উৎপাদন করিলেন। কর্ণ আমার কানীনপুত্র, কি নিমিত্ত আমার হিতকর বাক্য শ্রবণ না করিবো?”

মহানুভবা কুন্তী এইরূপে কাৰ্য্য বিনিশ্চয় [কর্ত্তব্যনিৰ্ণয়] করিয়া ভাগীরথীতীরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। ক্রমে গঙ্গাতীরে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, স্বীয় আত্মজ সত্যপরায়ণ মহাতেজাঃ কৰ্ণ পূর্ব্বমুখে উৰ্দ্ধবাহু হইয়া বেদপাঠ করিতেছেন। পাণ্ডুপত্নী পৃথা আতপতাপে [রৌদ্রকিরণে] নিতান্ত তাপিত হইয়াছিলেন, কর্ণের পশ্চাদ্ভাগে উত্তরীয়চ্ছায়ায় [উত্তরীয় বস্ত্রের ছায়ায়] দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহার জপাবসান প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। মহানুভব কর্ণ অপরাহ্ন পৰ্য্যন্ত পূর্ব্বাভিমুখে জপ করিয়া পরিশেষে পশ্চিমাভিমুখ হইবামাত্র কুন্তীকে অবলোকন করিলেন। তখন তিনি বিস্মিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন।