১৪১. দুৰ্য্যোধনপক্ষের দুর্নিমিত্ত সূচনা

১৪১তম অধ্যায়

দুৰ্য্যোধনপক্ষের দুর্নিমিত্ত সূচনা

সঞ্জয় কহিলেন, “মহাবীর কর্ণ কেশবের হিতবাক্য শ্রবণ করিয়া পূজাপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মধুসূদন! তুমি আমাকে অবগত হইয়াও কি মুগ্ধ করিতে অভিলাষ করিতেছ? এই যে পৃথিবীর প্ৰলয়াদশা [নাশের অবস্থা] সমুপস্থিত হইয়াছে, আমি, শকুনি, দুঃশাসন ও রাজা দুৰ্য্যোধন, এই চারিজন ইহার কারণ, পাণ্ডব ও কৌরবগণের এই ঘোরতর সংগ্রামে পৃথিবী রুধিরদ্বারা কর্দমিত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। দুৰ্য্যোধনের বশীভূত রাজা ও রাজপুত্ৰগণ এই সমরে শস্ত্ৰাগ্নিদ্বারা দগ্ধ হইয়া শমনসদনে গমন করিবেন। ভুরি ভুরি দুঃস্বপ্ন, ঘোরতর দুর্নিমিত্ত ও নিদারুণ লোমহর্ষণ উৎপাতসকল যুধিষ্ঠিরের জয় ও দুৰ্য্যোধনের পরাজয় সূচনা করিতেছে। অতি তীক্ষ্ন মহাদ্যুতি শনি[*প্রজাপতিদৈবত রোহিণীনক্ষত্র শনিদ্বারা বিদ্ধ হওয়ায় প্রজাপতি (প্রজাধিপতি রাজা) দুৰ্য্যোধনের বিধাশঙ্কা। মঙ্গলবিদ্ধ জ্যেষ্ঠানক্ষত্রে জ্যেষ্ঠ রাজা দুৰ্য্যোধনের নাশশঙ্কা। মৈত্ৰদৈবত অনুরাধাবেধে রাজার মিত্রসমূদয়ের মৃত্যুসূচনা। রাকারাদি মহাগ্ৰহ রাহুবিদ্ধ চিত্রনক্ষত্রে রাজজাতির জীবনাশঙ্কা।] গ্ৰহ প্রাণীগণকে অধিকতর পীড়া প্ৰদান করিবার নিমিত্ত রোহিণীনক্ষত্র[*]কে নিপীড়িত করিতেছে, মঙ্গল[*]গ্ৰহ জ্যেষ্ঠা[*]নক্ষত্রের নিকট বক্র হইয়া মিত্ৰগণকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত অনুরাধাকে [*] প্রার্থনা করিতেছে, বিশেষতঃ, যখন মহাপাতনামে গ্ৰহ চিত্ৰা[*]নক্ষত্ৰকে পীড়া প্ৰদান করিতেছে, তখন কুরুগণের ঘোরতর বিপদ উপস্থিত, তাহাতে সন্দেহ নাই। চন্দ্ৰমার কলঙ্ক ক্ষীণ হইয়াছে, রাহু সূৰ্য্যকে গ্রহণ করিতেছে, এই উল্কাসকল কম্পান্বিত হইয়া আকাশ হইতে নির্ঘাত[বজ্ৰতুল্য শব্দে]সহকারে নিপতিত হইতেছে, মাতঙ্গগণ ভীষণ গর্জ্জন করিতেছে এবং অশ্বগণ পানীয় ও তৃণে অনাদর করিয়া অশ্রুমোচন করিতেছে। পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, এই সকল দুর্নিমিত্ত প্রাদুর্ভূত হইলে প্রাণীবিনাশকর মহাভয় উপস্থিত হয়। অশ্ব, হস্তী ও মনুষ্যগণ অত্যল্প আহার করিয়া প্রচুর পুরীষ [বিষ্ঠা—মল] পরিত্যাগ করিতেছে, পণ্ডিতগণ ইহাকে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র ও সৈন্যগণের পরাভবচিহ্ন বলিয়া নির্দ্দেশ করিতেছেন।

সমরসূচনায় অনিষ্ট্ৰদৰ্শন

“ ‘পাণ্ডবগণের বাহনসকল হৃষ্ট ও মৃগগণ তাঁহাদিগের দক্ষিণদিকস্থ হইয়া তাঁহাদিগের বিজয়লক্ষণ সূচিত করিতেছে, আর দুৰ্য্যোধনের বামদিকস্থ মৃগগণ ও দৈববাণী ইহার পরাভবলক্ষণ প্রকাশ করিতেছে। পবিত্ৰ পক্ষী ময়ুর, হংস, সারস, চাতক ও চকোরগণ পাণ্ডবগণের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছে, আর গৃধ্র [শকুনি], কঙ্ক [হাড়গিলা], বক, শ্যেন [বাজ], রাক্ষস, বৃক [নেকড়েবাঘ] ও মক্ষিকাগণ কৌরবগণের অনুগামী হইতেছে। দুৰ্য্যোধনের সৈন্যমধ্যে ভেরীর শব্দ নাই; পাণ্ডবগণের পটহ [ঢাক] সকল আহত না হইয়াও শব্দ করিতেছে। কুরুসৈন্যমধ্যে কৃপপ্রভৃতি জলাশয়সকল বৃষভগণের ন্যায় শব্দ করিতেছে, দেবতা মাংস ও শোণিত বর্ষণ করিতেছেন। প্রাকার [প্রাচীর], পরিখা [গড়খাই], ব্যপ্র [মুক্তিকাস্তুপ-মাটির ঢিপি] ও চারু তোরণে সুশোভিত গন্ধর্ব্বনগর [আকাশে উদীয়মান কল্পিত নগর] সূৰ্য্যসংযুক্ত হইয়া উদিত হইতেছে, তথায় কৃষ্ণবর্ণ পরিবেশ [সূৰ্য্যমণ্ডল] দিবাকরকে আচ্ছাদিত করিয়া রহিয়াছে; পূর্ব্ব [প্রাতঃ] ও পশ্চিম [সায়ং] উভয় সন্ধ্যাই কৌরবগণের বিপত্তি সূচনা করিতেছে। একপক্ষ, একনায়ন, একচরণ, ঘোরদর্শন পক্ষিগণ ও শিবা [শৃগাল] সকল ঘোর রব করিতেছে; কৃষ্ণগ্ৰীব, রক্তপদ ভয়ানক শকুনিগণ পশ্চিমাভিমুখে গমন করিতেছে। পূর্ব্বদিক লোহিতবর্ণ, দক্ষিণদিক শস্ত্রবর্ণ ও পশ্চিমদিক। কাঁচামাটীর পাত্রের ন্যায় হইয়াছে। এই সকল কৌরবগণের পরাভাবের চিহ্ন লক্ষিত হইতে লাগিল। কৌরবগণ যে গুরু, ব্রাহ্মণ ও ভক্তিমান ভৃত্যগণকে দ্বেষ করিতেছে, ইহাও তাহাদের পরাভবলক্ষণ। এইরূপ উৎপাত দর্শন ও দিকসকল প্রদীপ্ত হইয়া দুৰ্য্যোধনের মহাদাভয় উদ্ভাবন করিতেছে।

“ ‘আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি যে, রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণের সহিত সহস্রস্তম্ভোপরি সন্নিবেশিত প্রাসাদে আরোহণ করিতেছেন, তৎকালে তোমাদের সকলেরই শ্বেত উষ্ণীষ [পাগড়ী], শ্বেত বস্ত্র ও শ্বেত আসন লক্ষিত হইতেছে। পৃথিবী রুধিরে আবিল [কর্দমাক্ত] ও অন্ত্রে পরিবেষ্টিত হইয়াছে। যুধিষ্ঠির অস্থিরাশির উপরিভাগে আরোহণ করিয়া প্রফুল্পচিত্তে সুবৰ্ণপাত্রে ঘূতপয়স ভোজন ও মেদিনীমণ্ডল গ্ৰাস করিতেছেন। অতএব যুধিষ্ঠিরই তোমার প্রদত্ত এই বসুন্ধরা ভোগ করিবেন।

“ ‘পুনরায় স্বপ্নে দেখিলাম যে, ভীমকর্ম্মা বৃকোদর গদাহস্তে উচ্চপর্ব্বতে আরোহণ করিয়া যেন এই পৃথিবী গ্ৰাস করিতেছেন। অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে, তিনিই মহারণে সমুদয়কে নিঃশেষিত করিবেন। হে হৃষীকেশ! আমি জানি, যেখানে ধর্ম্ম, সেইখানেই জয়। পুনরায় দেখিলাম, গাণ্ডীবী [গাণ্ডীবাবধনুৰ্দ্ধারী] ধনঞ্জয় তোমার সহিত পাণ্ডুবৰ্ণ গজে আরোহণ করিয়া যারপরনাই শোভা ধারণ করিয়াছেন। নকুল, সহদেব ও সাত্যকি—এই তিন মহারথ শুভ্র কেয়ুর, শুভ্র কণ্ঠত্ৰাণ [গলবন্ধ], শুভ্ৰ মাল্য, শুভ্ৰ অম্বর [বস্ত্ৰ], শুভ্ৰ ছত্র ও শুভ্র উষ্ণীষ। ধারণ করিয়া নরবাহনে আরোহণ করিয়া আছেন। অতএব তোমরাই দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি পার্থিবগণকে সংহার করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। পুনরায় দেখিলাম, ধৃতরাষ্ট্রের সৈন্যগণমধ্যে অশ্বত্থামা, কৃপ, কৃতবর্ম্মা, সাত্বত ও অন্যান্য পার্থিবগণ রক্তবর্ণ উষ্ণীষ। ধারণ করিয়া রহিয়াছেন; আমি, মহারথ ভীষ্ম ও দ্রোণাচাৰ্য্য—আমরা সকলেই উদ্ভযুক্ত রথে আরোহণ করিয়া দক্ষিণদিকে গমন করিতেছি, অতএব আমি, অন্যান্য রাজমণ্ডল ও সমুদয় ক্ষত্রিয়, আমরা সকলেই গাণ্ডীবাগ্নিতে প্রবেশ ও যমসদনে গমন করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

“কৃষ্ণ কহিলেন, “হে কর্ণ! যখন আমার বাক্য তোমার হৃদয়ঙ্গম হইল না, তখন নিশ্চয়ই এই বসুন্ধরার সংহারাদশা সমুপস্থিত হইয়াছে। প্রাণীগণের বিনাশকাল নিকটবতী হইলে ন্যায়বৎ [ন্যায্যের মত] প্রতীয়মান অন্যায়সকল তাহাদের হৃদয় হইতে অপসারিত হয় না।”

“কৰ্ণ কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! হয় আমরা এই ক্ষত্রান্তকারী [ক্ষত্ৰিয়গণের নিঃশেষে নাশকারী] মহারণ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব, না হয় স্বৰ্গে গমন করিয়া তোমার সহিত সম্মিলিত হইব। সম্প্রতি আমরা সমরক্ষেত্রে পুনরায় তোমার সহিত মিলিত হইব।”

“হে মহারাজ! কর্ণ এই কথা কহিয়া কেশবকে গাঢ় আলিঙ্গন ও তাহার নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া, রথ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। পরে বিষণ্নচিত্তে সুবৰ্ণবিভূষিত স্বীয় রথে আরোহণপূর্ব্বক আমাদিগের সহিত আগমন করিলেন। বাসুদেবও সারথিকে ‘রথ চালাও, রথ চালাও’ বলিয়া সাত্যকিসমভিব্যাহারে অতি শীঘ্র প্ৰস্থান করিলেন।