১৩৯. কর্ণের স্বীয় অধিকারত্যাগমাহাত্ম্য

১৩৯তম অধ্যায়

কর্ণের স্বীয় অধিকারত্যাগমাহাত্ম্য

“কৰ্ণ কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! তুমি সৌহৃদ্য, প্রণয়, সখ্য বা তাহা নিশ্চয় অবগত হইলাম এবং আমি যে ধর্ম্মানুসারে রাজা পাণ্ডুর পুত্র, তাহারও সন্দেহ নাই। আমার জননী কন্যাকাবস্থায় দিবাকরের ঔরসে আমাকে গর্ভে ধারণ এবং তাঁহারই বাক্যানুসারে জাতমাত্র আমাকে বিসর্জ্জন করিয়াছিলেন। আমি যখন এইরূপে জন্মলাভ করিয়াছি, তখন ধৰ্মশাস্ত্রানুসারে পাণ্ডুই আমার পিতা, তাহার সন্দেহ নাই; কিন্তু কুন্তী আমাকে আমার অমঙ্গল উদ্দেশেই পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। অনন্তর সারথি অধিরথ আমাকে দর্শন করিবামাত্র গৃহে আনয়ন করিয়া সৌহার্দ্যসহকারে রাধার হস্তে সমর্পণ করিলেন। আমার প্রতি স্নেহবশতঃ তৎক্ষণাৎ রাধার স্তনে ক্ষীরসঞ্চার হইল। তিনি আমার মূত্র ও পুরীষ পরিষ্কার করিতে লাগিলেন। অতএব মাদৃশ ধৰ্মজ্ঞ ও ধর্ম্মশাস্ত্ৰ-শ্রবণাপরায়ণ ব্যক্তি কিপ্রকারে তাহার পিণ্ড লোপ করিবে? আর অধিরথও আমাকে পুত্ৰ বলিয়া অবগত আছেন। এবং আমিও সৌহার্দ্যবশতঃ তাহাকেই পিতা বলিয়া জানি। তিনি অপত্যস্নেহানুসারে শাস্ত্রানুগত বিধিদ্বারা আমার জাতকর্ম্মাদি সম্পন্ন করিয়া আমার নাম বসুসেন রাখিয়াছেন। অনন্তর আমি যৌবনসীমায় পদার্পণ করিয়া দারপরিগ্রহ করিয়াছি; তাহাদের হইতে আমার পুত্রপৌত্ৰসকল জন্মপরিগ্রহ করিয়াছে এবং আমার হৃদয় সেইসকল ভাৰ্য্যাতে দৃঢ়বদ্ধ হইয়াছে। অখণ্ড ভূমণ্ডল বা রাশীকৃত সুবর্ণের বিনিময়ে, হর্ষ বা ভয়ে এই সকল অন্যথা করিতে আমার সামর্থ্য নাই।

“ ‘এইপ্রকারে আমি ধৃতরাষ্ট্রকুলে দুৰ্য্যোধনকে আশ্রয় করিয়া ত্ৰয়োদশ বৎসর অকণ্টকে রাজ্যভোগ ও সূতগণের সহিত বারংবার বহুবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছি। সূতজাতির সহিত আমার বিবাহাদি ক্রিয়াকলাপ নির্ব্বাহিত হইয়াছে। রাজা দুৰ্য্যোধন আমাকে প্রাপ্ত হইয়াই উৎসাহসহকারে পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ উপস্থিত করিয়াছেন। দ্বৈরথযুদ্ধে [দুইজন রথীর পরস্পর সম্মুখসমর] আমিই সব্যসাচীর [অর্জ্জুনের] প্রতিযোদ্ধা বলিয়া পরিকল্পিত হইয়াছি। বধ, বন্ধন, ভয় বা লোভাবশতঃ ধীমান দুৰ্য্যোধনের সহিত মিথ্যা ব্যবহার করিতে পারিব না। যদি আমি সব্যসাচীর সহিত দ্বৈরথযুদ্ধ না করি, আমার ও পার্থের অপকীর্ত্তি হইবে। তুমি যে হিতের নিমিত্তই কহিতেছ, তাহাতে কোন সংশয় নাই এবং পাণ্ডবগণ যখন তোমার বশীভূত হইয়া আছে, তখন তাহারা অবশ্যই সমুদয় কার্য্য সম্পন্ন করিবে। তুমি যে আমার জন্মবৃত্তান্ত যুধিষ্ঠিরের নিকট গোপন করিয়া রাখিয়াছ, ইহা আমি হিতকর বলিয়া অঙ্গীকার করিতেছি। জিতেন্দ্রিয় ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির আমাকে কুন্তীর প্রথমজাত পুত্ৰ বলিয়া জানিতে পারিলে রাজ্যগ্ৰহণ করিবেন না। আর আমিই যদি সেই সুবিস্তীর্ণ রাজ্যপ্রাপ্ত হই, তাহা হইলে দুৰ্য্যোধনকেই প্ৰদান করিব; অতএব ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরই রাজ্যেশ্বর হইয়া থাকুন। হৃষীকেশ যাহার নেতা এবং ধনঞ্জয়, মহারথ ভীমসেন, নকুল, সহদেব, দ্ৰৌপদেয়গণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, উত্তমৌজা, যুধামন্যু, সত্যধর্ম্ম, সৌমকি, চেদিরাজ, চেকিতান, অপরাজিত শিখণ্ডী, ইন্দ্ৰগোপবৰ্ণ পঞ্চ কেকয়, ভীমসেনের মাতুল ইন্দ্রায়ুধবর্ণ মহানুভব কুন্তিভোজ, মহারথ শ্যেনজিৎ ও বিরাটপুত্র শঙ্খ যাঁহার যোদ্ধা, তাহারই পৃথিবী ও তাঁহারই রাজ্য। তিনি যখন ভূরি ভূরি ক্ষত্ৰিয় সংগ্ৰহ করিয়াছেন, তখনই তিনি এই সকল রাজসমাজপ্ৰসিদ্ধ প্ৰদীপ্ত রাজ্য প্ৰাপ্ত হইয়াছেন।

‘হে বৃষ্ণিনন্দন! দুৰ্য্যোধনের যে শস্ত্ৰযজ্ঞ হইবে, তুমি তাহার উপদেষ্ট ও অধ্বর্য্য হইবে; বৰ্ম্মিত [বৰ্মদ্বারা আচ্ছাদিত] কলেবর কপিধ্ব এই যজ্ঞে হোতৃপদ গ্রহণ করিবেন; গাণ্ডব, স্রুক ও পুরুষকার আজ্যস্থানীয় হইবে; সব্যসাচিপ্রযুক্ত ঐন্দ্র, পাশুপত, ব্রাহ্ম ও স্থূণাকৰ্ণ [দৃঢ় এবং স্থূল বাস] প্রভৃতি অস্ত্ৰসকল যজ্ঞের মন্ত্র হইবে; অর্জ্জুনসদৃশ বা অর্জ্জুন অপেক্ষাও অধিকতর পরাক্রান্ত অভিমন্যু গীত ও স্তোত্ৰ পাঠ করিবেন; শব্দায়মান ভীমসেন উদগাতা [প্রথম বেদ-গায়ক] ও স্তোতা [স্তবকারী] হইবেন; জপহোমপরায়ণ ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির ব্ৰহ্মা হইবেন; শঙ্খশব্দ, মুরজশব্দ, ভেরীশব্দ ও সিংহনাদ উৎকৃষ্ট মঙ্গলধ্বনি হইবে, যশস্বী নকুল ও সহদেব পশুবন্ধন করিবেন; ধ্বজদণ্ড ও রথশ্রেণী যূপস্থানীয় হইবে; কর্ণী [কোরাণীর মত কুটিলমুখ শর], নালীক [শল্যাস্ত্র এবং বাণ], নারাচ [শর] ও বৎসদস্ত[গোবৎসের দাঁতের মত ফলকযুক্ত]সকল চমসাধ্ববর্য্য[সোমরসাহুতি নিক্ষেপকালের সহকারী], তোমরসমূহ সোমরসের কলস, শরাসনসকল পবিত্র [দুইটি কুশাগ্রদ্বারা নির্মিত যজ্ঞ-তৃণ], অসিসকল কপাল ও মস্তকসকল পুরোডাশের [যজ্ঞীয় পিষ্টকের] পাকপাত্র এবং রুধির হবিঃস্থানীয় হইবে; নির্ম্মল গদাসকল পরিধি [যে জ্বলন্ত কষ্ঠের উপর আহুতি প্রদত্ত হয়], ও শক্তিসকল এই যজ্ঞের সমিধ হইবে; দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্যের শিষ্যগণ সদস্য হইবেন; অর্জ্জুন, দ্রোণ ও অশ্বত্থামাপ্রভৃতি মহারথগণের হস্তবিনির্মুক্ত শরনিকর পরিস্তোম[সোম নিক্ষেপের পাত্ৰ] হইবে; সত্যকি প্রাপ্তিপ্ৰস্থানিক [দ্বিতীয় বেদগায়ীর গোয় বেদগীত] কর্ম্ম সম্পাদন করিবেন; দুৰ্য্যোধন এই যজ্ঞে দীক্ষিত [*যজ্ঞে সপত্নীক হইয়া দীক্ষিত হইতে হয়] হইবেন; এই মহতী সেনা তাঁহার পত্নী [*] হইবে; মহাবল ঘটোৎকচ এই বিস্তূত অতিরাত্ৰ [দীর্ঘরাত্রেও যুদ্ধ হইবে, যুদ্ধকে যজ্ঞরূপক করা হইয়াছে। ঘটোৎকচ নিশাচর, নিশীথ রাত্ৰে শত্রু বন্দী করা ঘটোৎকচের সুখসাধ্য] যজ্ঞকর্মে পশুবন্ধন করিবে এবং যিনি শৌত [বেদবিহিত] যজ্ঞে হুতাশন হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছেন, সেই প্রতাপবান ধৃষ্টদ্যুম্ন এই যজ্ঞের দক্ষিণা হইবেন।

“ ‘হে কৃষ্ণ! আমি দুৰ্য্যোধনের প্রীতির নিমিত্ত পাণ্ডবগণকে অনেক কটুবাক্য কহিয়াছি; এক্ষণে সেই অপকর্ম্মনিবন্ধন অনুতাপ হইতেছে। যখন তুমি আমাকে ধনঞ্জয়ের হস্তে নিহত হইতে দেখিবে, তখন পুনরায় এই যজ্ঞের অগ্নিচয়ন [অগ্নির উদ্দীপনা] হইবে। যখন ভীমসেন সিংহনাদসহকারে দুঃশাসনের রুধির পান করিবেন, তখন সোমরসপ্যানসমাপন হইবে। যখন ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডী দ্রোণ এবং ভীষ্মকে নিপাতিত করিবেন, সেই সেই সময়ে এই যজ্ঞের বিশ্রাম হইবে। যখন মহাবল ভীমসেন দুৰ্য্যোধনকে সংহার করিবেন, তখন তাঁহার যজ্ঞ পরিসমাপ্ত হইবে। যখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূ ও পৌত্ৰপত্নীসকল একত্ৰ মিলিত এবং স্বামীহীন, পুত্রবিহীন ও নাথাবিহীন হইয়া গান্ধারাসমভিব্যাহারে কুক্কুর, গৃধ্ৰু ও কুকুর [উৎক্রোশপক্ষী-কুড়ল যা ঈগলপাখী] সঙ্কুল রণক্ষেত্রে রোদন করিবেন, তখন এই যজ্ঞের অবভৃথস্নান [যজ্ঞান্ত স্নান— যজ্ঞসমাপ্তির পর মন্ত্রপুত জলে অভিষেক—বর্ত্তমান কালে যজ্ঞান্ত শান্তি] সমাধান হইবে। হে কেশব! বিদ্যাবৃদ্ধ ও বয়োবৃদ্ধ ক্ষত্ৰিয়গণ যেন তোমার নিমিত্ত বৃথা প্রাণত্যাগ না করেন। ত্ৰৈলোক্যের মধ্যে এই কুরুক্ষেত্র অতি পুণ্যতম স্থান; যাহাতে ক্ষত্ৰিয়গণ এই ক্ষেত্ৰে শস্ত্রদ্বারা নিধনপ্রাপ্ত হইয়া স্বৰ্গলাভ করেন, তাহা সম্পাদন কর; তাহা হইলে পর্ব্বত ও নদীসকল যাবৎ বর্ত্তমান থাকিবে, তাবৎ তোমার কীর্ত্তি অবিনশ্বর [অক্ষয়] হইয়া রহিবে। ব্রাহ্মণগণ ক্ষত্ৰিয়গণসমাজে এই যশস্কর মহাভারতযুদ্ধ কীর্ত্তন করিবেন। অতএব মন্ত্রণা সংবরণ [গোপন] পূর্ব্বক যুদ্ধের নিমিত্ত আমার নিকট কৌন্তেয়কে আনয়ন কর।’ ”